ইসলাম ধর্মের বৈশিষ্টই হল এক হাতে কোরআন - অন্য হাতে কৃপাণ!
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ০৯ জানুয়ারি, ২০১৮, ০৫:১৭:২৬ বিকাল
মুসলমানদের এক হাতে ধর্মীয় শাস্ত্র আর অপর হাতে শাণিত অস্ত্র বিষয়টি আজ স্বার্থান্বেষী অতি চতুর ব্যক্তি বিশেষের কলমের ডগায়। আর সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। জনপ্রিয় একটি স্লোগান। কর্মক্ষেত্রে পরিচিত জন কিংবা ঘরোয়া পরিবেশে দীর্ঘ আলাপচারিতার মূলে এই বিষয়টি প্রায়ই উচ্চকিত হয়ে উঠে। পৃথিবীর কোথাও কোন প্রকার হামলা হলেই সন্দেহের তীর বিদ্ধ হতে থাকে মুসলমানদের উপর। কিছু ব্যক্তি কখনও বিদ্রূপাত্মক হাসি দিয়ে আবার কখনও বা হিংসাত্মক মনোভাব প্রদর্শন করে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে ঘটনার সাথে মুসলমানরাই জড়িত।
কিছু অমুসলিমদের অন্ধ বিশ্বাস মুসলমানরাই একমাত্র যুদ্ধবাজ এবং বর্বর জাতি। যেমনটি গোটা বিশ্বে শক্তিশালী সকল প্রচার মাধ্যম তথা ইলেকট্রোনিক্স মিডিয়াজুড়ে বিরামহীনভাবে ইসলামিক বিষয়গুলো বিকৃত করে প্রচারিত হয়ে থাকে। উদ্দেশ্য একটাই ইসলামের বিরুদ্ধে মানুষকে ক্ষেপিয়ে দিয়ে নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করা। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সাধারণ পাঠক ও দর্শকদের মস্তিস্কে, মন ও মননে গেঁথে দেয়ার প্রয়াসে নানাভাবে উচ্চারিত হতে থাকে স্বচ্ছ সরল একটি বোধ আর বিশ্বাস। আর তা হল এক হাতে ধর্মীয় শাস্ত্র আর অন্য হাতে বিষাক্ত অস্ত্র নিয়ে দুনিয়াতে আবির্ভূত হয়েছে ইসলাম ধর্ম। এভাবেই কিছু অবিশ্বাসীদের গুরুতর অভিযোগ যে, ইসলাম ধর্ম মানেই অশান্তি আর অনাচার সৃষ্টিকারী একটি সন্ত্রাসী ধর্মীয় গোষ্ঠী। যারা সকল জঘন্য ও নিন্দনীয় কর্মকাণ্ডের মদদদাতা! নাটের গুরু! বিষয়টি নিয়ে তাই স্বল্প পরিসরে কিছু বিশ্লেষণধর্মী ব্যাখা প্রয়োজন।
বাস্তবতার নিরিখে অভিযোগটির গ্রহণ যোগ্যতা বা সত্যতা আসলেই কতটুকু?
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পশ্চিম ইউরোপে ১২৩৩ খৃষ্টাব্দে প্রধান ধর্মযাজক নবম গ্রেগরির আইন মোতাবেক শুরু হয় অখৃষ্টানদের খুঁজে বের করার অভিযান। অখৃষ্টানদের খুঁজে বের করার এই অভিযান ও অনুসন্ধানী প্রথাকে বলা হয় ইনকুইজিশন। সেই আইন ছিল প্রত্যেকের জন্য অবশ্যমান্য। যা কুখ্যাত আইন হিসাবে খ্যাত। ইতিহাসবিদ্গন বলেন, সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক যিনি ছিলেন মুক্ত চিন্তাধারার পরিপোষক, তিনিও ১২২০ থেকে ১২৩৫ খ্রিস্টাব্দ অবধি জার্মানি ও ইটালির জন্য কিছু আইন প্রণয়ন করেন- যেখানে উল্লেখ ছিল খৃস্টীয় যাজক সম্প্রদায়ের প্রণীত ধারণার সাথে যারা ঐক্যমত পোষণ করে না, তারা আইন বহির্ভূত ব্যক্তি। যারা খৃষ্টধর্ম গ্রহণ না করার জন্য অনুতপ্ত হবে তাদেরকে কারারুদ্ধ করা হবে। আর যারা অখৃষ্টান হওয়ার অপরাধ অনুধাবনে অপারগ তাদেরকে পুড়িয়ে মারা হবে। কেননা প্রকৃত ধর্মমত গ্রহণে প্রজাদের বাধ্য করা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। আর প্রজাদের কর্তব্য হল রাষ্ট্রীয় আনুগত্য প্রদর্শন করা।
জন ক্যালভিন ছিলেন ধর্মীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। সেখানে ধর্ম বলতে একমাত্র বাইবেলকেই তুলে ধরা হতো। এই বাইবেল থেকে বিচ্যুতকারী ঘোর পাপে অভিযুক্ত হতো। যা ছিল মৃত্যু দণ্ডাদেশযোগ্য অপরাধ। প্রণীত এই আইন এবং ১২৫২ খৃষ্টাব্দে যাজকীয় আজ্ঞা অনুযায়ী শুরু হয় অখৃষ্টান নিধনযজ্ঞ। বিচার শেষে চিহ্নিত করা হত কারা অখৃষ্টান এবং কারা খৃষ্টান। এরপর অখৃষ্টান হওয়ার অপরাধে বিশাল কড়াইয়ে পানিভর্তি করে ধীরে ধীরে পানি ফুটিয়ে সেই ফুটন্ত পানিতে মানুষকে হত্যা করা হতো। যদিও সরাসরি আগুনে পুড়ে মারার প্রথাই ছিল ব্যাপকভাবে প্রচলিত এবং অধিক পরিচিত। এভাবেই জুলুমের স্বীকার হয়ে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে মানুষ খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণে বাধ্য হতো।
এবার আসুন অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমরা দেখি ইসলাম কি বলে---
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ্ সুবহানুতাআলা স্পষ্ট করে বলেছেনঃ
ধর্মীয় বোধ বিশ্বাস একটি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ব্যাপার। কোরআনে সরল সত্য ও শুদ্ধ পথের দিকনির্দেশনা পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে (ধর্ম গ্রহণে বা অনুশীলনে) কোন প্রকার জোর জবরদস্তি নেই। (সূরা বাকারাহঃ ২৫৬)
ইসলাম শব্দের মূল উৎপত্তিই হল সালাম শব্দ থেকে। যার অর্থ শান্তি। প্রকৃত অর্থেই ইসলাম ধর্ম শান্তির বার্তাবাহক। যে ধর্মের সার্বিক উদ্দেশ্যই হল দুনিয়াতে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। যারা সমাজে নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং সীমাহীন বর্বরতায় মেতে উঠে ইসলাম কেবলমাত্র তাদের বিরুদ্ধেই শক্তি প্রয়োগের অনুমতি দেয় ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
আল্লাহ্র প্রেরিত রাসূল (সাঃ) যখন ধরাতলে এলেন তখন সমগ্র দুনিয়া সর্বপ্রকার অপকর্মের মধ্যে ছিল নিমজ্জিত। যে যুগকে আমরা জাহেলিয়াত বা অন্ধকার যুগ হিসাবে জানি। মূর্তি পূজা, মেয়েদেরকে জীবন্ত কবরে পুঁতে ফেলা, মদ, জুয়া, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, মারামারিসহ এমন কোন অনাচার নেই যা প্রতিদিন ঘটতো না। যা ছিল তখনকার সময়ে অতি সাধারণ ও স্বাভাবিক ঘটনা। এমনি এক ভয়াবহ বিপজ্জনক পরিবেশে সম্পূর্ণ নিরক্ষর দরিদ্র এতীম একজন ব্যক্তি দুনিয়াতে আবির্ভূত হলেন এবং সকলের বিরুদ্ধে হাতে তরবারি তুলে নিলেন! কেননা তখন সারা পৃথিবীর মানুষ ছিল তাঁর মত ও পথের বিরুদ্ধে। আর একজন মানুষের তরবারির ভয়ে দলে দলে মানুষ তাঁর দিকে ছুটে আসলো! ইসলাম কবুল করলো!
এ অসম্ভব ও অবাস্তব কাহিনী আদৌ কি কখনও কারো কাছে গ্রহণযোগ্য বা সত্যি হতে পারে?
আর বাস্তবতা---
সমস্ত আরব জাহান মুসলমানদের শাসনে ছিল প্রায় এক হাজার চারশ বছর। এই শাসনামলের মাঝে মাত্র কয়েক বছর ফরাসী এবং কয়েক বছর ব্রিটিশদের দখলে ছিল। এই সুদীর্ঘ শাসনামলে মুসলমানরা যদি তরবারী চালাতো তাহলে সেখানে কি কোন খ্রিষ্টানের অস্তিত্ব থাকতো?
মুসলমানরা স্পেন শাসন করেছে প্রায় আট শত বছর। সে দেশের চরম দুশমনও মুসলমানরা তরবারি দিয়ে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছে এমন ডাহা মিথ্যা কথা বলার দুঃসাহস করে না। সত্যের বিচ্যুতি ঘটাতে কিছুটা হলেও তারা সঙ্কোচ ও দ্বিধাবোধ করে। অথচ পরবর্তীতে খ্রীষ্টান ক্রুসেডরা স্পেনে মুসলমানদেরকে ধ্বংস স্তূপে পরিণত করেছে। পথে পথে ছিল তাজা রক্তের নদী। লাশের পাহাড়। এমনভাবে নৃশংসভাবে নির্মূল করেছে যে, মসজিদে আযান দেয়ার মত একজন মুসলমানও সেখানে খুঁজে পাওয়া যেত না। একইভাবে মুসলমান কর্তৃক ভারত শাসিত হয়েছে প্রায় আট শত বছর। যেখানে আজো শত করা আশি ভাগেরও অধিক অমুসলিম বসবাস করছে। যেখানে শিক্ষার জন্য আজ মুসলমানরা হিন্দু নাম রাখতে বাধ্য হচ্ছে। গরু জবেহ এবং গোস্ত খাওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। তুচ্ছ কারণে-অকারণে মুসলমানদের বুক ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে, রক্ত ঝরানো হচ্ছে। প্রতিনিয়ত প্রকাশ্য উস্কানিতে নিগৃহীত নিষ্পেষিত হচ্ছে মুসলমানরা।
একইভাবে বর্তমানে ইসরাইল, মায়ানমার, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ দেশে দেশে অসহনীয় বর্বরতা ও হিংস্রতার অজস্র উদাহরণ বিদ্যামান। এতোদসত্ত্বেও প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। খোদ আমেরিকা ও ইউরোপে ইসলামের ঝাণ্ডা উড়ছে খুব দ্রুততম গতিতে। আমেরিকার শাসকগোষ্ঠীর যুদ্ধাংদেহী মূর্তি ও ক্রমাগত হুংকারের মুখেও রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ ইসলামকে বেছে নিচ্ছে। বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ ইসলামের প্রতি ঝুঁকছে, প্রলুব্ধ হচ্ছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে কারা কৃপাণের ভয় দেখাচ্ছে?
বিরাজিত বাস্তবতায় সুপ্রমাণিত যে, ইসলামই একমাত্র শান্তির ধর্ম। ইসলাম ধর্মে যে কৃপণ বা তরবারি আছে তা হল আল্লাহ্ প্রদত্ত গভীর জ্ঞান ও আদর্শিক প্রজ্ঞা। যা মানুষের অন্তঃকরণকে আন্দোলিত করে, আলোকিত করে, বিকশিত করে, করে বিগলিত মহান স্রষ্টার অন্তর নিহিত ভালোবাসায়। কোরআন ও সহী হাদীসের সর্বোৎকৃষ্ট অকাট্য গ্রহণযোগ্য যুক্তি, অমোঘ সত্যের নির্মল সুন্দরতম হৃদয়গ্রাহী বাণী পাষাণ হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়, ঝড় তোলে। ভিতর থেকে মানুষকে বদলিয়ে দেয়। অশান্ত অস্থির প্রাণে জাগিয়ে তোলে শীতল শান্তির প্রবাহ। আর এভাবেই দুনিয়াজুড়ে ঘৃণিত প্রোপাগান্ডা সত্ত্বেও দলে দলে শান্তিপ্রিয় মানুষ ইসলামের ছায়াতলে প্রতিনিয়ত আশ্রয় খুঁজছে।
সুতরাং ইসলাম ধর্মের বৈশিষ্ট এক হাতে কোরআন এবং অন্য হাতে কৃপাণ বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে সবৈব মিথ্যা, মনগড়া, উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং বিদ্বেষ প্রসূত। এ বিষয়টি বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গীতে দলিল সাপেক্ষ এবং প্রমাণিত। তাই কৃপাণ নয় কোরআনিক শক্তিই একমাত্র মহাশক্তি যা মানুষকে দুর্বার এক অসীম যাদুকরী শক্তিতে উজ্জ্বীবিত করে, মোহিত করে, প্রাণময় করে তোলে, করে অভিভূত। যা পৃথিবীর সকল শক্তিও যদি একসাথে হয়ে রুখতে চায় তা কখনই পারবে না। পৃথিবীব্যাপী ইসলাম ধর্মকে নিয়ে যত বড় ষড়যন্ত্রই করা হোক না কেন সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র মনোনীত ধর্ম কারো পক্ষেই স্তব্ধ করে দেয়া বা নিশ্চিহ্ন করে ফেলা সম্ভব নয়। কারণ কোরআনের মহান বাণীই চিরন্তন সত্য ও সর্বোত্তম।
বিষয়: বিবিধ
৯৫৫ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন