অমরত্নের আরশিতে আরাধ্যময় আরাফাত!
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ৩০ নভেম্বর, ২০১৬, ০৫:১১:৩১ বিকাল
চোখের পলকেই যেন একটি বছর পার হয়ে গেল! প্রচণ্ড ভাবাবেগ ও শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আজো আরাধ্যময় আরাফাতের স্পর্শিত অনুভূতিগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেনি কলমের আঁচড়ে! অমরত্নতুল্য সেই সীমাহীন কষ্টের মাঝে ভালোলাগার অনুভূতিপূর্ণ পবিত্র দিনটির কথা আজো বলা হয়ে উঠেনি। কীভাবে প্রতিটি মুহূর্ত স্পন্দিত হয়েছিল দিলে? কখনো মনে হয়েছে আমাদের জন্য যেন এক দুর্যোগপূর্ণ মহাদুঃসময়!
আবার পর মুহূর্তেই চমকিত দিলে প্রবাহিত হয়েছে কৃতজ্ঞতার আনন্দময় অনন্তপ্রসারী নহর। ভাব বিহ্বলতায় মুহূর্তেই যেন সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হতো নিজের কাছে নিজেকেই। অথচ যিনি সর্ব শক্তিমান তাঁর কাছে সবকিছুই সম্ভব এবং অতি তুচ্ছ। তিনিই শুধু পারেন অবিশ্বাস্য বিষয়কে এক নিমিষেই বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তব উপযোগী করতে। সব পথলিপি যখন রুদ্ধ হয়ে যায়, বান্দা যখন দিশেহারা হয়ে চিন্তায় হাবুডুবু খেতে থাকে তখন গায়েবের এক ইশারায় সব দুয়ার একে একে খুলে যায়। অবারিত হয়ে যায় সবকিছু...। সোবহানআল্লাহ! আমার পূর্বের একটি লিখায় আমার মায়ের অসুস্থতার কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিলাম সন্মানিত পাঠক মহলের জন্য। যাহোক অপারেশনের পর দীর্ঘদিন অচেতন অবস্থায় অক্সিজেন দিয়ে মা’কে অবধারিত মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে দেয়া হতে শুরু করে আরাফাতের মাঠে মা’কে নিয়ে উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত সব ঘটনাই ছিল অচিন্তনীয়, অবিশ্বাস্যকর ও অলৌকিক। প্রতিটি কদমে কদমে দিতে হয়েছে কঠিন এক ঈমানী পরীক্ষা। চরম অনিশ্চয়তা ও কঠিন দুর্ভাবনার সাগর পাড়ি দিয়ে অবশেষে আল্লাহ্ সুবহানুতা’আলার অসীম কৃপায় ও অফুরান দয়ার বরকতে পুন্যাশ্রিত আরাফাত ময়দানে ভীষণ অসুস্থ মমতাময়ী জননীকে নিয়ে আমরা হাজির হলাম। আলহামদুলিল্লাহ্।
কিন্তু তখনো বাংলাদেশীদের জন্য নির্ধারিত স্থানে নির্মিত তাঁবুর ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমরা। মায়ের সাথে আমার ছোট ভাই এবং আমি। হঠাৎ কে যেন দূর থেকে তার নাম ধরে ডাকছে। সাক্ষাৎ হল আরেকটি বাংলাদেশী পরিবারের সাথে। যিনি আমার ছোট ভাইয়ের সাথে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। যাহোক স্বস্তির একটু আভাস মিললেও তা কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার মিলিয়ে গেল। ইতিমধ্যেই উচ্চ তাপমাত্রার কারণে ভূমিতলে তখন পা দু’টো মনে হল পুড়ে যাচ্ছিল। মস্তক গলে যাবার জোগাড়। ডায়াবেটিক রোগী মা। তাই অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং অল্প কিছু খাবার সাথে নেয়া হয়েছিল। কেননা আমাদেরকে হুইল চেয়ার ঠেলতে হবে এবং এই বাড়তি লাগেজ বহন করতে হবে এই ভেবে। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভীড়ে কিছুদূর এগুতেই আমার মা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আমরাও পরিশ্রান্ত,ক্লান্ত। কিন্তু হৃদয়ের অতলে আলোড়িত হচ্ছিল মহান প্রভুর নাম। কৃতজ্ঞ চিত্তে জপছি আর পুণ্যময় ও বরকতপূর্ণ মুহূর্তটুকুর কোন অপচয় না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখছি। মুহূর্তেই দেখতে পেলাম বেশ কিছু খাদ্য সামগ্রী ভর্তি গাড়ী। তারা সবাইকেই নানান জাতের খাবার, ফলমূল এবং পানীয় দিচ্ছেন। আমরাও খাবার এবং ঠাণ্ডা পানীয় পেলাম।
তারপর একটি গাছের ছায়ায় বসে দেখতে পেলাম পাশেই একটি ওয়াশ রুম। আমরা সবাই যে যার মত হাত পা ধুয়ে ওযু করে নিলাম। তারপর অদূরেই লক্ষ্য করলাম ফল ফলাদির স্তূপ। মায়ের কথা ভেবে কিনতে গেলাম সেখানে। দণ্ডায়মান ব্যক্তিটিকে দাম দিতে চাইলে বিনয়ী বদনে সহাস্যে বললেন, এগুলো সব ফ্রি! তোমার যত খুশী নিয়ে যাও। এগুলো তোমাদের জন্য আমাদের সামান্য হাদিয়া। তারপর একে একে সব খাবারের জায়গাগুলো দেখিয়ে বললেন, তোমার যা দরকার সেখান থেকে নিয়ে নাও!
নানান খাবারের সাথে ফলমূলের উদ্ভাসিত তাজা দীপ্তি ও সুগন্ধিময় আকর্ষণীয় উপস্থিতি আমাকে আবেগময় করে তুললো। দেশ বিদেশ ঘুরলেও এতো বড় বড় ও সুস্বাদু ফল আগে কখনই চোখে পড়েনি আমার। মধুর বিস্ময়ের মাঝে মনে হল এ এক অমূল্য আসমানি করুণা! জান্নাতি খাবার। মহান প্রভূ! যিনি তাঁর মেহমানদের জন্য খুশী হয়ে মহব্বত করে পাঠিয়েছেন। আসমান থেকে! তা না হলে লক্ষ লক্ষ মানুষ খেয়ে তৃপ্ত হচ্ছেন, সাধ্যমত সাথে নিচ্ছেন কিন্তু ভাণ্ডার পূর্ণই থাকছে! শেষ হচ্ছে না! সত্যিই অবিশ্বাস্য! দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হল। মা অনেকটা পরিতৃপ্ত ও প্রশান্ত হলেন। তারপর আবার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাটা শুরু করলাম আমরা।
প্রচণ্ড তাপদাহে পথ যেন শেষ হচ্চিল না কিছুতেই। সাথে রাখা ফ্রিজের পানির বোতল অনবরত মাথায় ও শরীরে ঢালছি কিন্তু মুহূর্তেই শুকিয়ে যাচ্ছে। এদিকে মা প্রায় বেহুঁশ। এলোমেলো কথা বলছে। অজানা আশঙ্কায় কম্পন অনুভূত হল বুকে। কিন্তু অন্তরে হিমালয়সম ভরসা আল্লাহ্র উপর। ভাবছি মহান দয়ালু নসীবে যা লিখেছেন সেটাই আমাদের জন্য উত্তম। কেননা তিনি তো অন্তর্যামী। আমাদের নিয়্যত সম্পর্কে উনি সম্যক অবহিত। আমার ছোট ভাই কিছুদুর এগিয়ে তাঁবুর খোঁজে। মায়ের শরীরের অবস্থা দেখে কী ভেবে বলে উঠলাম তাঁবু খোঁজার প্রয়োজন নেই। এখানেই কোথাও মাকে শুইয়ে দেই। আচমকা অচেনা এক লোক বলে উঠলেন,এই তো সামনেই বাংলাদেশী তাঁবু!মূহূর্তেই অসীম শক্তিতে মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো। আর আবেগে দু’গণ্ড বেয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করলো।
অদূরেই অপেক্ষা করছে একটি মধুর বিস্ময়। তাঁবুতে পৌঁছেই দেখি সব পরিচিত জন আমাদের জন্য সেখানে অপেক্ষা করছেন। যাদেরকে আমরাও সারা পথে খুঁজতেছিলাম। আল্লাহ্ সুবহানুতা’আলার অশেষ কৃপা দৃষ্টিকে মনে হল অবিরাম রহমতের বৃষ্টি! প্রথমে বিন্দু বিন্দু এরপর একেবারে মুষলধারে! সেই প্রশান্তির রিমঝিম বৃষ্টিতে আমরা সবাই মুগ্ধ, পরিতৃপ্ত, সিক্ত ও স্নাত হলাম। আমার মা সবাইকে কাছে পেয়ে অনেক খুশী। মহান দাতার অসীম দানে আনন্দে, বিহব্ললতায় ও কৃতজ্ঞতায় অন্তর হয়ে উঠলো বিগলিত উতলা।
বহু প্রতীক্ষিত জীবনের এই মহা শুভলগ্নের গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে মা’কে তাঁবুর এক কোণে শুইয়ে দিয়ে আমি গোসল সেরে আরাফাতের ময়দানের জন্য নির্ধারিত শুভ্র সফেদ পোশাকটি পরিধান করলাম। তারপর শুরু হল জিকির আজগর, রোনাজারি, ইবাদত, প্রার্থনা ও রবের নিকট করুণ মিনতি ক্রন্দন।
আমাদের জায়গাটির চারিদিক ঘেরা থাকায় ইবাদতের জন্য ছিল বেশ সুন্দর। কিন্তু পাশেই অবস্থিত এক হাজী ভাই এতো জোরে জোরে গল্প শুরু করলেন যে, ইবাদতে কিছুটা ব্যাঘাত শুরু হল। সেই সাথে আমাদের মাঝে থাকা দু’বোন কিছু ব্যক্তিগত কথা বলা শুরু করলেন। মুহূর্তের জন্য আমি বিনয়ের সাথে আরাফাত ময়দানে উপস্থিতির এবং গুরুত্বের দু’একটি চিত্র তুলে ধরতেই সবাই কথা বলা বন্ধ করে এবাদতে মশগুল হলেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আরাফার দিন অপেক্ষা অন্য কোন দিনে শয়তানকে এত অধিক পরিমাণে অপমানিত, রাগান্বিত ও ধিকৃত হতে দেখা যায় না। কেননা শয়তান সেদিন আল্লাহ্র বিশেষ রহমত নাযিল এবং বান্দাদের বড় বড় গুনাহ মাফ হতে দেখে জ্বলতে থাকে। এই দিনে আল্লাহ্ নিকটতম আসমানে অবতীর্ণ হন এবং হাজীগণকে নিয়ে ফিরিশতাগণের সাথে গর্ব করে বলতে থাকেন, “দেখ আমার বান্দাদের দিকে, তারা এলোমেলো রুক্ষ কেশে ধূলায় ধূসরিত অবস্থায় আমার নাম সর্বান্তকরণে জপতে জপতে বহু দূর দূরান্ত থেকে এসেছে, আমি তোমাদেরকে স্বাক্ষী রেখে বলছি, আমি তাদের সকল গুনাহখাতা মাফ করে দিলাম। সুবহানআল্লাহ্! কারণ এই দিনটি অনেকের জীবনে মাত্র একবারই আসে। এ দিনটির সূর্যাস্ত পর্যন্ত দোয়া কবুলের দিন!
এরপর ধীরে ধীরে চারিদিক থেকে শুরু হল কঠিন এক নিস্তব্ধতা। ইমাম সাহেবের আবেগঘন মর্মস্পর্শী খোতবা শুরুর সাথে সাথেই বিষাদময় দৃশ্যের অবতারণা হল। অন্তর যেন নিমিষেই মমের মত গলে গেল। প্রান্তর জুড়ে কান্নার রোল। বুকফাটা আর্তনাদ মহান প্রভূর দরবারে। হৃদয়ের বুক চিরে উথলে উঠলো গভীর অনুতাপের নিঃশ্বাস! ক্রন্দনরত দিল পরম আকুতি নিয়ে লুটিয়ে পড়লো সিজদায় এবং বিগলিত হয়ে কৃতজ্ঞতায় আকুল হয়ে বলে উঠলো এই পরম মুহূর্তটির যেন কখনই পরিসমাপ্তি না ঘটে জীবনে! অমরত্নের আরশিতে আরাধ্যময় আরাফাত জীবন্তস্পর্শী হয়ে থাক আমৃত্যু......!
বিষয়: বিবিধ
১৪৪২ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার ওমরা হজ্ব পালনের সংবাদে ভীষণভাবে আনন্দিত হলাম। আমাদের সকলকেই প্রতিটি মোনাজাতে শরীক রাখার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ রইলো।
আল্লাহ্ সুবহানুতা’আলা আপনার হজ্ব কবুল করুণ এই প্রার্থনা।
আপনি কী পূর্বে ফরয হজ্ব করেছেন ভাইয়া?
সুন্দর একটি মন্তব্যের জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
সর্বাবস্থায় নিরাপদে থাকুন, ভালো থাকুন ও সুস্থ থাকুন এই প্রার্থনা রইলো আপনার জন্য।
I appreciated your' best article
কেমন আছেন, আপুনি?
((রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আরাফার দিন অপেক্ষা অন্য কোন দিনে শয়তানকে এত অধিক পরিমাণে অপমানিত, রাগান্বিত ও ধিকৃত হতে দেখা যায় না। কেননা শয়তান সেদিন আল্লাহ্র বিশেষ রহমত নাযিল এবং বান্দাদের বড় বড় গুনাহ মাফ হতে দেখে জ্বলতে থাকে। এই দিনে আল্লাহ্ নিকটতম আসমানে অবতীর্ণ হন এবং হাজীগণকে নিয়ে ফিরিশতাগণের সাথে গর্ব করে বলতে থাকেন, “দেখ আমার বান্দাদের দিকে, তারা এলোমেলো রুক্ষ কেশে ধূলায় ধূসরিত অবস্থায় আমার নাম সর্বান্তকরণে জপতে জপতে বহু দূর দূরান্ত থেকে এসেছে, আমি তোমাদেরকে স্বাক্ষী রেখে বলছি, আমি তাদের সকল গুনাহখাতা মাফ করে দিলাম। সুবহানআল্লাহ্! ))
লেখাটা পড়ে আসলেই চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেলো,,
জাযাকাল্লাহ,,,
জ্বি ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি কেমন আছেন? বহুদিন ধরে আমাদের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন কেন?
কেন জানি গতকাল আপনাকে অনেক মনে করেছিলাম। আর সেইসাথে আপনার উপস্থিতি দেখে পুলকিত হলাম।
সুন্দর একটি মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক দোয়া ও শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
একেবারে ঠিক কথা বলেছেন। হৃদয়ের উজাড় করা সবটুকু আবেগ অনুভূতি সেই পবিত্রতম জায়গাটিতে যেন উপচে পড়ে। আলহামদুলিল্লাহ্।
হজ্ব সম্পর্কিত আপনার অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ও মর্মস্পর্শী লিখাটি পড়েছিলাম।
আমি একবছর পূর্বে হজ্ব করেছিলাম ভাইয়া।
অত্যন্ত প্রেরণামূলক সুন্দর একটি মন্তব্যের জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
খুব বেশী বেশী করে দোয়া করি আপনার জন্য।
আল্লাহ্ সুবহানুতা’আলা আপনার অন্তরের নেক ইচ্ছে ও সুন্দর মনোবাসনা পূর্ণ করুণ। আমীন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন