রমযান স্মৃতির পাতায় - প্রবাসী ঈদ শুধুই কাঁদায়!.. এবং অতঃপর......!!
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ২০ জুন, ২০১৬, ০৪:২৯:২৯ বিকাল
রমযান আজি ঘরে, স্মৃতিগুলো ভীড় করে। আসন্ন খুশীর ঈদ শুধু কড়া নাড়ে। তাইতো প্রবাসের প্রথম ঈদ মনের দুয়ারে। সে দিনের অভিজ্ঞতা আজো জ্বলজ্বলে। এখনো স্মৃতির পাতায় মিশে আছে অমলিন জলে। অনেক দিন আগের কথা। রমযানের গুরুত্বপূর্ণ দিনরাতগুলো কেটেছে পড়াশুনার ব্যস্ততায়। মডিউল লিখতে বসে কখন যে ভোর হয়েছে টেরই পাওয়া যেত না। তাই সেসব বিষয়ে স্মৃতিচারণ করার মত তেমন কোন উপাদেয় বিষয় নেই। যা ছিল একেবারেই সাদামাটা। তবে রমযান শেষে স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় প্রথম ঈদ যাপন করি ১৯৯৬ সালে। তখন অনেক বাংলাদেশী মেয়ে একই হোস্টেলে থাকার কারণে সে ঈদ ছিল অনেক উপভোগ্য ও জমজমাট। একই হোস্টেলে ছিলাম সতের জন। যদিও এই আনন্দঘন মুহূর্ত ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য। তাও আবার সবার জন্য নয়। যারা অবিবাহিতা ছিল তাদের আনন্দের মাত্রাটুকু ছিল একটু বেশী। আর যারা পরিবার ছেলেমেয়ে দেশে রেখে এই আয়োজনে শরীক হয়েছিলেন তাঁদের মুখগুলো ছিল একটু অন্যরকম! বিষাদমাখা। চোখ দু’টি ছিল অশ্রুপূর্ণ। কৃত্রিম হাসিমাখা মুখে কথার ফাঁকে ফাঁকে অশ্রুসজল নয়ন হতে টলমল করে গড়িয়ে পরছিল দু’গণ্ড বেয়ে মুক্তোর দানা। থেকে থেকে হৃদয়ের গহীন থেকে বেড়িয়ে এসেছিল তপ্ত দীর্ঘশ্বাস। ব্যস্ত সময় কেটেছে টেলিফোনে কথা বলে। প্রিয়জনদের সাথে।
ঈদের দিন যথারীতি ক্লাস শেষে সবাই একসাথে বাজার করে তারপর হোস্টেলে ফেরা। সবাই মিলে অনেক মজাদার ও সুস্বাদু রান্না করা হয়েছিলো সেদিন। সেজেছিল সবাই যে যার মত করে। ইংলিশ টিচাররাও অবগত ছিলেন সেই ঈদ পার্টির। তাঁরা মুগ্ধ হয়ে অনেক কিছু জানতে চেয়েছিলেন। ঈদ সম্পর্কে। উচ্ছ্বাস আর আনন্দঘন পরিবেশে সেদিন অনেক রাত অবধি গান পরিবেশন, যার যার মত ফটোসেশনসহ আনন্দফূর্তির কোন কমতি ছিল না। যদিও সারাদিন ক্লাসে থেকে সে উপলব্ধিটুকু আঁচ করার কোন উপায় ছিল না। উপরন্তু ছিল না কোন প্রিয়জনদের জন্য নতুন কাপড়চোপরসহ ঈদের আনুষঙ্গিক কেনাকাটার তাগিদ। ছিল না আগাম টিকিট কাটার প্রতিযোগিতা। না ছিল নাড়ীর টানে ছুটে যাওয়া আপনজনদের সান্নিধ্য খোঁজার ব্যাকুলতা। ঈদ আনন্দের প্রকৃত অনুভূতি ছিল অনুপস্থিত। তাই এতো শত আনন্দ সত্ত্বেও মূলতঃ ঈদের কোন আমেজ ছিল না সেখানে। মনে হয়নি ঈদ ঈদ ভাব। অন্তত আমার কাছে।
তারপর একদিন ইউ,কে-তে আরাধ্য পরিবারের প্রত্যাশিত আগমনে ভরে উঠে হৃদয়ের আঙিনা। সুখের প্রজাপতিরা উড়ে ডানা মেলে। হেসে খেলে পথ চলে। দু’বছর শেষে আবার দেশে ফেরা, স্মৃতির সোনায় মোড়া আপন জন্মভূমিতে। অতিবাহিত হতে থাকে সময়। তারপর আবারো এডিনবরায় চলে আসা। মাস যায়, বছর গড়ায়। অতঃপর প্রিয়মুখ প্রিয়জনের টানে সবকিছু পিছু ফেলে নিউক্যাসেলে যাত্রা। এ যেন নতুন ভুবণ, আপন গগণ। চারিপাশে বাংলাদেশী পূর্বপরিচিত শুভাকাঙ্ক্ষীদের বাস। প্রতি ঈদে মমতাময়ী মা, ভাই-বোনসহ আপনজনদের অনুপস্থিতি অনেক কষ্ট দিলেও এখানে ঈদ উষ্ণতা আছে।
স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে পূর্বের লিখায় বলেছিলাম বর্তমানে আমি যে এলাকাতে থাকি তা মূলতঃ মুসলিম কমিউনিটি। এজন্য মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে জানাই লাখো কোটি শোকরিয়া। আরও শোকর এজন্য যে আমরা অনেকেই পূর্বপরিচিত ছিলাম বাংলাদেশে। একে অপরকে আমরা চিনতাম জানতাম, নিজেদের ভাল-মন্দ শেয়ার করতাম দেশে থাকাকালীন সময়ে। রবের অপার রহমতে অলৌকিকভাবে একই এলাকাতে আবার সকলেই আমরা একত্রিত হতে পেরেছি। আলহামদুলিল্লাহ্। সকলেরই বাসা একদম পাশাপাশি। আর এটা সম্ভব হয়েছে একের প্রতি অন্যের অদৃশ্য নাড়ীর টানের কারণেই।
গতবারের ঈদের জামাত বাসার পাশে হওয়ার কারণে গাড়ীতে না গিয়ে বাসার সকলেই পায়ে হেটে ঈদের জামাতে উপস্থিত হয়েছিলাম। তাই উপলব্ধির মাত্রা ও দৃশ্যগুলো ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। গাড়ী পার্ক করার কোন পেরেশানী ছিল না। সেইসাথে লক্ষ্য করলাম চারিদিক থেকে আমাদের মতই দলে দলে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই তাকবির পড়তে পড়তে পায়ে হেটে ছুটে আসছে জামাতের দিকে। এই মুগ্ধ করা মনোরম দৃশ্য প্রাণভরে উপভোগ করলাম। আমরা সবাই। জামাত প্রাঙ্গনে ঢুকে দেখি সুবিশাল জনসমুদ্র। নারী আর শিশুদের কমনীয় ও কোমল উপস্থিতি ছিল নজর কাড়ার মত। জামাতের নয়নাভিরাম বিশাল জায়গা জুড়ে ছিল নারী এবং কচি কচি জান্নাতী শিশুরা। ঈদের নামায, খাবারের আয়োজন, পুরুস্কার বিতরণী (সারা মাসব্যাপী প্রতিযোগিতার ফলাফল শেষে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা), শিশুদের জন্য চমৎকার উপভোগ্য খেলার সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা, স্থানীয় মেয়রের উপস্থিতি ও বক্তব্য এবং পরিচিতদের সাথে আনন্দ শেয়ার করার অনুভূতি ছিল বেশ আকর্ষণীয়, উপভোগ্য একেবারে অন্যরকম।
কিন্তু ঈদের নামায ও ঈমাম সাহেবের মর্মস্পর্শী খুতবা শেষে মোনাজাতের সময় তৈরি হয়েছিল এক মর্মস্পর্শী মুহূর্তের। এ এক করুন হৃদয়বিদারক দৃশ্য। গভীর বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিলো পুরা চত্তর। সবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিলো আফগানিস্থান, মিশর, ইরাক, সিরিয়া, বাংলাদেশ সহ মুসলিম দেশগুলোর ভয়াবহ লোমহর্ষক চিত্র। প্রিয়জনদের শোকে মুহূর্তেই মিলিয়ে গিয়েছিল সব আনন্দ আয়োজন। সকলের চোখের পানি আর আহাজারিসহ অন্তরের আকুতিমাখা দোয়ায় যেন আসমান যমীনও অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছিলো।
অতঃপর মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে অনেকের বাসায় যাওয়া। হরেক রকম মজাদার খাওয়া দাওয়ার পাশাপাশি মধুর স্মৃতি রোমন্থন করা। প্রশান্তিময় খোশ মেজাজে জমজমাট আড্ডা দেয়া সবকিছু মিলিয়ে মনে হয়েছিলো একেই তো বলে ঈদ। আহা! অকৃত্রিম, অনিন্দ্য মায়াময় অনুপম আনন্দ!! এভাবেই দ্বীনের হাস্যোজ্জ্বল কিরণচ্ছটায় পুরো এলাকা উল্লসিত আমোদিত কিশোর কিশোরীদের ঈদ আনন্দে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। যার দীপ্তি বর্ষিত হয়েছিল সবার প্রাণে প্রাণে।
পরিশেষে আমাদের শোক শক্তিতে রুপান্তরিত হয়ে আগামী রমযান ও ঈদ মুসলমানদের জন্য শান্তি ও সুখের বার্তা বয়ে আনুক এটাই প্রত্যাশা। সেইসাথে শাওয়াল মাসের ছয়টি রোযার কথা পূর্বেই স্মরণ করিয়ে দিয়ে আজকের মত এখানেই শুভ পরিসমাপ্তি। আগামী ঈদের আনন্দযামিনী সকলের জন্য মধুময় হয়ে উঠুক এই কল্যাণময় শুভেচ্ছা নিরন্তর। আল্লাহু আকবর।
বিষয়: বিবিধ
১৪৫৩ বার পঠিত, ৩৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
হায়রে!! ভাইটির কষ্টের কথা শুনে ভীষণ খারাপ লাগলো। মহান রব নিশ্চয়ই এই কষ্টের প্রতিফল দিবেন। ইনশাআল্লাহ।
তোমার অভিজ্ঞতার কথা লিখে সামনের নির্ধারিত তারিখে পোষ্ট করো আপু। যদি সম্ভব হয়।
তোমার মূল্যবান উপস্থিতি ও গুরুত্বপূর্ণ সুন্দর অনুভূতির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার মূল্যবান উপস্থিতি ও গুরুত্বপূর্ণ সুন্দর অনুভূতির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
চমৎকার মন্তব্যটির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার মূল্যবান উপস্থিতি ও ভালোলাগা অনুভূতির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপা, মেয়েদের দূরে গিয়ে, বিশেষ করে, একা গিয়ে পড়াশোনা করা, ইসলামী শরীয়ত বিষয়টাকে কিভাবে দেখে? আপনি সম্ভবত দুলাভাইকে সাথেই নিয়ে গেছে.
ঈদ গাহে কি নারীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে, যেমনটি বাংলাদেশে সাইদীর ওয়াজে করা হতো। নারীদের পুরুষরা দেখতে পেতনা।
আপনার স্মৃতি চারণ খুবই ভালো লেগেছে।
এইবার অন্য প্রসংগ। আপনি নারী, সন্তুষজনক সমাধান আপনার কাছেই পেতে পারি।
আমি ভাবির দেবর হয়েছি কিছুদিন হলো। বর্তমান বাস্তবতা এবং ইসলামের আলোকে ভাবির সাথে আমার পর্দার মেইনটেইন কিভাবে হবে? এই বিষয়ে সময় সুযোগ করে একটা পোস্ট দেওয়ার অনুরোধ থাকলো।
আলহামদুলিল্লাহ্। আমি যে পর্দা মেনে চলি, ভাবির মাথায় বিষয়টি দেওয়া হয়েছে।
ইসলামী বিধি বিধান একশত ভাগ মেনে চলা আমাদের মত খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য আসলেই অনেকটা দুরূহ। সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও।
তবে অনেক দীর্ঘ সময় স্বামী ও পুরো সময় ধরে ছেলে আমার সাথেই ছিল।
জ্বী ঈদগাহে নারীদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা ব্যবস্থা আছে। যেখানে পুরুষরা যেতে পারেন না।
ছোট ভাই আমি অনেক অজ্ঞ এসব বিষয়ে। কোন বিজ্ঞ আলেম বা মুফতি হয়তো আপনার জন্য সঠিক সমাধানের পথ বাতলে দিতে পারেন।
তবে আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের কথা জানি, যারা এক বাসায় বসবাস করলেও দেবর তাঁর ভাবীকে দীর্ঘ ২৫-৩০ বছরের বিবাহিত জীবনে একবারও দেখেননি। দেবরের খানাপিনা সে তার অনুপস্থিতিতে ঘরে রেখে দিত।
জাজাকাল্লাহু খাইর ছোট ভাই।
আপনার মূল্যবান উপস্থিতি ও সুন্দর অনুভূতির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
ইচ্ছে তো হয় লিখার কিন্তু......
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য। আসলেই পরিবার পরিজন ছাড়া ঈদের দিন দুঃসহ মনে হয় নিজেকে।
আপনার মূল্যবান উপস্থিতি ও সুন্দর অনুভূতির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার মূল্যবান উপস্থিতি ও সুন্দর ভালোলাগা অনুভূতির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
ঠিকই বলেছেন ভাইয়া। বিদেশের মাটীতে ঈদ মানে আনন্দের বিপরীত অবস্থা। স্টুডেন্ট হলে তো রান্না খাওয়াসহ মানসিক অবস্থার ভয়াবহ দশা।
ব্যস্ততা সত্ত্বেও আপনার মূল্যবান উপস্থিতি ও সুন্দর ভালোলাগা অনুভূতির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
ঠিকই বলেছেন ভাইয়া। বিদেশের মাটীতে ঈদ মানে আনন্দের বিপরীত অবস্থা। চাকুরীজীবী হলে তো রান্না খাওয়াসহ মানসিক অবস্থার ভয়াবহ দশা। সহমত আপনার সাথে।
ব্যস্ততা সত্ত্বেও আপনার মূল্যবান উপস্থিতি ও সুন্দর ভালোলাগা অনুভূতির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
কেনাকাটা, সে তো স্বপ্নের ব্যপার, অবশ্য দেশে টাকা পাঠিয়ে সবার জামাকাপড় কেনা হয়েছে কিনা ঠিকই খবর নিই।
বোনের বাড়িতে সেমাই চিনি দেওয়া হয়েছে কিনা? ঘরের জন্য সব সামানপত্র নেয়া হয়েছে কিনা, কারাে কোন কমতি হয়নি তো! ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু প্রবাসীরা ঈদের আগের রাতেও রাত ১২টা পর্যন্ত ডিউটি করে রুমে গিয়ে কাপড় আয়রন করে, গোসল করে, একটু সেমাই পাক করে মোটেও না ঘুমেয়ে ফজরের জামাত ধরতে মসজিদে যাই, ফজরের জামাতের ১ঘন্টা পরই ঈদের জামাত, ঈদের নামাজ পড়ে রুমে গিয়ে একটু সেমাই খেয়ে, বাড়িতে কিছুক্ষণ ফোন করে ঈদ শেষ করি। অতঃপর ঘুমে জোহর গড়ায়।
আপনার স্মৃতিচারণ স্বপ্নের মত মনে হল। ভূ-স্বর্গের টুকরো বলা যায়। শুকরিয়া রইল। অনেক অনেক ধন্যবাদ
আপনার মর্মস্পর্শী মন্তব্যের সাথে সহমত। যা স্বচক্ষে দেখেছি এবং এক সময় নিজেও ভুক্তভুগী ছিলাম।
কিন্তু নিউক্যাসেলে আসার পর ঈদের দিন দিলে অনেক শান্তি ও আনন্দ খুঁজে পাই আলহামদুলিল্লাহ্।
যদিও দেশে রেখে আসা প্রিয়জনদের জন্য প্রাণ কাঁদে। তারপরও...
মন্তব্য করতে লগইন করুন