সোনামণিদের রমযান এবং ঈদ অভিজ্ঞতা
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ১৪ জুন, ২০১৬, ০৮:৪৪:২৪ সকাল
ইংল্যান্ডের মত ননমুসলিম দেশে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলা এবং ছোট ছোট জান্নাতী পাখীগুলোর জন্য মসজিদের যে হৃদয়গ্রাহী আয়োজন তা স্বচক্ষে দেখে এবং রমযানের প্রকৃত লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, মর্যাদা ও শিক্ষা তা হৃদয় দিয়ে অনুভব ও উপভোগ করে সত্যিই বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়। যা বাংলাদেশের মসজিদ প্রাঙ্গনে অনেকটা স্বপ্ন বলেই বিবেচিত হতে পারে। এখানে রমযান ছাড়াও মুসলিম পরিবারগুলো সময় পেলেই ছোট ছোট কচি মায়াবী সন্তানসহ অনেকটা সময় মসজিদে অতিবাহিত করেন। কেউবা কোরআন তেলওয়াত, কেহ বা জিকির আসগর আবার কেহ বা দ্বীনি আলোচনায় ব্যস্ত সময় কাটাতে ভালোবাসেন। এছাড়াও মেয়ে এবং শিশুদের জন্য আছে নিয়মিত স্টাডি সার্কেলসহ কোরআন শিক্ষার ব্যবস্থা। তার সাথে আছে অন্যান্য কর্মপরিকল্পনা যেমন মসজিদের উন্নতি এবং সার্বিক সহযোগিতামূলক ফান্ড সংগ্রহ ইত্যাদি।
এভাবেই মুসলিম পরিবারগুলো তথা কোমলমতি শিশুদের মধ্যে গড়ে উঠে সখ্যতা ও পারস্পারিক হৃদ্যতা। বিদেশ-বিভূয়ে অজানা-অচেনা বিভিন্ন দেশের বসবাসরত সমস্ত মুসলিম পরিবারের মাঝে বিশেষ করে রমযান মাসে এই যে মহামিলন মেলা, পারস্পারিক ধর্মীয় বোধের আদান প্রদান, একের জন্য অন্যের মহব্বত, হাদিয়া দেয়া নেয়া, প্রতিদিন বিভিন্ন রকমারি সুস্বাদু খাবার, ফলমূল, পানীয় মসজিদে সরবরাহ করাসহ নিজেদেরকে অন্যের সেবায় উৎসর্গ করার যে ব্যতিক্রমধর্মী চেতনা ও মূল্যবোধ তা ইসলাম বা কিতাবে থাকলেও নিরবিচ্ছিন্নভাবে বাস্তবে এতটা প্রয়োগ সত্যিই বিমোহিত করে। মানুষের অন্তরে প্রেরণা যোগায় ও ইসলামী কর্মকাণ্ডে সোনামণিদেরকে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। এভাবেই অনুপ্রাণিত হয়ে ছোট ছোট সোনামণিরা বড়দের পাশাপাশি সেবা করতে প্রাণান্তকর ব্যস্ত সময় কাটায়। ইফতারী পরিবেশনের সময় তাদের মধ্যে বিরাজিত থাকে শুভ্র-সত্য আর সৌন্দর্যের এক মায়াভরা নয়নজুড়ানো অভিব্যক্তি। তাদের কচি মুখের আনন্দের ঝর্ণাধারা সবাইকে যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। এই অনুভূতির অকৃত্রিম মাধুর্য সত্যিই বর্ণনাতীত। প্রতিদিন কোন না কোন অবিশ্বাস্য ঘটনা বা দৃশ্য হৃদয়কে নতুন চেতনায়, নতুন ভাললাগায়, নতুন উদ্দীপনায়, ঈমানী আদর্শে ও সুবাসিত স্পর্শে ভরিয়ে তোলে। আর কেবলিই মনে হয় এটাই ইসলামের শ্বাশত সৌন্দর্য। আমরা মুসলমানরা ইসলামকে পরিপূর্ণভাবে পালন না করার কারণে মূলতঃ এই সৌন্দর্যগুলো থেকে বঞ্চিত।
আমরা যে এলাকাটিতে বাস করি তা মূলতঃ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা বললেও অত্যুক্তি হবে না। যার ফলে পবিত্র মাহে রমযানের আগেই শুরু হয় সাজ সাজ রব। যেমন রমযান ছাড়াও নামাযের ওয়াক্ত হলে নিয়মিত গেটে কলিং বেল চেপে একসাথে মসজিদে নামায পড়তে যাওয়া। পবিত্র মাহে রমযানের শুরুতেই শুকনা ইফতারী যেমন খেজুরের বাক্স পাঠানো। পারস্পারিক সৌহার্দমূলক ধর্মীয় ভাবের আদান প্রদান এবং প্রায় প্রতিদিন ইফতারী বণ্টন। যা একের প্রতি অন্যের যে শ্রদ্ধা, সম্মান, সহমর্মিতা, মহানুভবতা, ত্যাগ, সংযম, সেবা, আতিথেয়তা আর আন্তরিকতা প্রদর্শনের যে অপূর্ব প্রতিযোগীতা তাতে যে কেউ অভিভূত না হয়ে পারে না। আর এ কারণেই রমযানের প্রতিটি দিনই মনে হয় এক একটি ঈদ।
এছাড়াও মসজিদে ছোট ছোট সোনামণিরাসহ বিভিন্ন বয়সী ব্যক্তিদের জন্য মাসব্যাপী কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন সকলকেই ব্যতিব্যস্ত ও প্রানবন্ত করে রাখে। ইসলাম বিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এবং সঠিক উত্তর সরবরাহকৃত বাক্সে ফেলতে বেশ প্রতিযোগিতা চলতে থাকে পুরা মাসব্যাপী। শিশুরা ইফতারি শেষে হাদিসের বই নিয়ে ছুটাছুটি করে, কেউবা মোবাইলে ইন্টারনেট ঘাটে সঠিক উত্তর পাবার আশায়। আবার কেউবা বাবা মাকে ঘিরে ধরে জিজ্ঞাসা করে জানতে চায়, সঠিক উত্তর কোনটি? সত্যিই বলতে কি এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শুধু শিশুরাই শিখেনি, বড়রাও লাভবান হয়েছে। তারাবী শেষে প্রতিদিনই সঠিক উত্তর দাতার নাম মাইকে ঘোষণা করা হয় এবং ঈদের দিন লটারির মাধ্যমে চূড়ান্ত প্রতিযোগী নির্বাচন করে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। একই সময়ে পুরুস্কার বিতরনের জন্যও থাকে বিশেষ আয়োজন ।
এভাবেই অপরিচিত একে অপরের পরিচিতিসহ কুশল বিনিময়, সৌহার্দমূলক কথাবার্তা, অকৃত্রিম দরদ, হৃদয় উজাড় করা আত্মত্যাগ যার স্পর্শ বা সান্নিধ্যে মুহূর্তেই প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। এভাবেই ইসলাম ধর্মের যে স্বাদ, পবিত্রতম ভালোলাগা ও ভ্রাতৃত্ববোধের নির্যাস তা বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একেবারে মিলেমিশে একাকার হয়ে একশত ভাগ পূর্ণ হয়। ইফতারির পর পর মাগরিবের নামায আদায় করে মহিলারা কেউ কেউ কোরআন তেলোওয়াত করেন, কেউবা জিকির আজগর আবার কেউবা গ্রুপে বসে হাদীস নিয়ে আলোচনায় রত থাকেন। সকল সোনামণিদের জন্য আছে পৃথক ব্যবস্থা। যেখানে তারাও চিত্তাকর্ষক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সময় অতিবাহিত করে। এরপর তারাবীর নামায শেষে অনেকেই চলে যান নিজ আলয়ে। আবার কেহ কেহ একেবারে ফজরের নামায আদায় করে তবেই ফিরেন বাসায়। এভাবে ক্রমেই সকলের মধ্যে প্রগাঢ় এক আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠে। একদিন কোন সাথী কোন কারণে অনুপস্থিত থাকলে অন্য সাথীরা তার ব্যাপারে জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে।
তারাবী শেষে মসজিদের ঈমাম সাহেব যে বয়ান করেন তার প্রতি মসজিদে আগত সকলেরই থাকে এক বিশেষ আকর্ষণ। মসজিদ প্রাঙ্গণে বয়ানের সময় কান্নার রোল পরে যায়। কারো কারো বুক ভিজে যায়। দু’চোখ বেয়ে ঝরে অঝোর ধারার বর্ষণ। শ্রেণীভেদে আনন্দে বিষাদে আত্মহারা হয়ে শিশুরাও বড়দের সাথে হাত তুলে মোনাজাত করে পরম করুণাময়ের দরবারে। মাঝে মাঝে এপাশ ওপাশ তাকিয়ে থাকে ও তন্ময় হয়ে ভাবে। তারপর মোনাজাত শেষ হলে তাদের মনের কোণে উঁকি দেয় হাজারো প্রশ্নের। এভাবেই তারা একটির পর একটি প্রশ্ন করে জানে ও শেখে দ্বীনের মহামূল্যবান আদর্শকে। কচি প্রাণে জন্ম নেয় ইসলামের প্রতি দরদ ও ভালোবাসা। এভাবেই তারা মনের কোণে রমযান এবং ঈদের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে বাস্তব পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।
ঈদের দিন চারিদিক থেকে দলে দলে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই তাকবির পড়তে পড়তে পায়ে হেটে ছুটে চলে জামাতের দিকে। এই মনোরম দৃশ্য দেখতে ভীষণ ভাল লাগে। জামাত প্রাঙ্গন জুড়ে থাকে সর্ব শ্রেণীর মানুষ এবং শিশু কিশোরের বিশাল সমারোহ। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের উপস্থিতি নজর কাড়ার মত। ঈদের নামায ও ঈমাম সাহেবের মর্মস্পর্শী খুতবা শেষে মোনাজাতের সময় তৈরি হয় এক ভিন্ন আবহ। চারিদিকে পরিলক্ষিত হয় বিষাদে ভরা এক করুন হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে পুরা চত্তর। সবার চোখের সামনে ভেসে উঠে আফগানিস্থান, মিশর, ইরাক, সিরিয়া, বাংলাদেশসহ মুসলিম দেশগুলোর ভয়াবহ লোমহর্ষক চিত্র। সকলের চোখের পানি আর আহাজারিসহ অন্তরের আকুতিমাখা দোয়া যেন আসমান আর জমিনে একাকার হয়ে যায়। দোয়া করা হয় সকল মজলুমের তরে মিনতি ভরে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে। পরিশেষে মুসলিম জাহানের শোক শক্তিতে রুপান্তরিত হয়ে প্রতিটি ঈদ মুসলমানদের জন্য শান্তি ও সুখের বার্তা বয়ে আনুক করা হয় এই কামনা।
ঈদের নামায ও মোনাজাত শেষে থাকে বিভিন্ন সুস্বাদু খাবারের লোভনীয় আয়োজন এবং স্বতঃস্ফূর্ত পরিবেশনা। এছাড়াও মসজিদ প্রাঙ্গনে আয়োজন করা হয় অস্থায়ী ছোট ছোট শপিং মলের। যেখানে অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে পোশাক পরিচ্ছেদসহ বিভিন্ন উপহার সামগ্রী বিক্রী করা হয়। শিশুদের জন্য আছে চমৎকার উপভোগ্য খেলার সরঞ্জামাদির সুন্দর ব্যবস্থা যা আকর্ষণীয় ও চিত্তাকর্ষক। সবকিছু মিলে পুরো রমযান এবং ঈদ উদযাপনের বাস্তব উপলব্ধি সোনামণিদের জন্য বেশ উপভোগ্য এবং শিক্ষণীয়ও বটে।
বিষয়: বিবিধ
১৬৩৪ বার পঠিত, ২৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মাশা আল্লাহ আপু।
আপনার সুন্দর প্রথম উপস্থিতি ও আপনার প্রেরণাপূর্ণ অনুভূতির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
পড়া ও আপনার প্রেরণাপূর্ণ অনুভূতির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
অনেক লাইনের ভীড়ে এই লাইনটি খুজে পেয়ে ভালো লাগল। তবে আপনাদের ঈদ বেশ সমারোহে চলে। দেশের থেকেও বেশী উৎসব মুখর। তবে আমার ছোটবেলার রোজা,ঈদের ধারে কাছেও নেই এসব। আমারটা ছিলো অতি এক্সসেপশনাল সুপার।(আমার কছে) ...কি না করেছি রে......সেসব স্মৃতি আর পাওয়া সম্ভব না....
পাবই বা কিভাবে.....কর্মরত দোকানদার,ঘুমন্ত মানুষদের ঘরের কোনে,দোকানের নীচে টাইম পটকা ফিট করে ভয় দেখানো তো এখন সম্ভব নয় !!!বাচ্চাদের প্যান্ট খুলে নিয়ে আলকাতরার উপরও বসানোও সামাজিকতার পর্যায়ে পড়বে না.....
ঠিকই বলেছ বোন! নিজের জন্মভূমিতে ইসলামের দুর্দশাগ্রস্ত চিত্র খুবিই বেদনাদায়ক।
তোমার সুন্দর উপস্থিতি ও প্রেরণাপূর্ণ অনুভূতির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
তোমার গুরুত্বপূর্ণ দোয়ায় আমীন! ছুম্মা আমীন।
আপনার স্বতঃস্ফূর্ত সুন্দর উপস্থিতি ও প্রেরণাপূর্ণ অনুভূতি ভীষণ ভালো লাগলো।
কিন্তু পরক্ষণেই নিজের জন্মভূমিতে ইসলামের দুর্দশাগ্রস্ত চিত্রের খবর পড়ে মনটা বেদনায় টন টন করছে।
দোয়া করা ছাড়া আর কিইবা করতে পারি!
জাজাকাল্লাহু খাইর।
চমৎকার একটি লিখা পড়লাম আলহামদুলিল্লাহ । আমাদের এখানেও কম বেশী এই ধরণের আয়োজন চলমান আছে আলহামদুলিল্লাহ। আসলেই এটা অত্যন্ত প্রয়োজন বাচ্চাদের ধর্মীয় অনুভূতির সাথে একাত্নতার জন্য ।
জাযাকিল্লাহু খাইর আপু।
তোমার সাথে সহমত আপু। এসব বাস্তব জীবনঘনিষ্ঠ কর্মকাণ্ডে ছোট ছোট শিশুরা ভাল কাজে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়।
তোমার মূল্যবান উপস্থিতি ও প্রেরণাদায়ক মন্তব্যের জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
হয়তো পৃথিবীটা অল্প সময়ে ভূ-স্বর্গে পরিণত হয়।
ঈদের দিনের কান্নাজড়িত অশ্রু সিক্ত নয়ন ৫ বছর আগে দেশে দেখেছিলাম, প্রবাসে এমন দৃশ্য নেই। সবাই যেন নিজ নিজ ব্যস্ততায় নিমগ্ন।
আপনার লিখাটি সত্যিই অন্তর নাড়া দিয়েছে। অনেক অনেক শুকরিয়া। জাযাকিল্লাহ খাইর
আপনার মূল্যবান উপস্থিতি ও প্রেরণাদায়ক হৃদয়স্পর্শী মন্তব্যে অভিভূত হওয়ার পাশাপাশি নিজের জন্মভূমির কথা ভেবে অনেক কষ্টও পেলাম।
বৈষয়িক ব্যাপারে আমরা যতটা মরিয়া হয়ে উঠি অপরদিকে ঠিক তেমনি দ্বীনের ব্যাপারে আমরা বড়ই উদাসীন। এটাই যেন বাস্তবতা। সুন্দর বলেছেন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার মূল্যবান উপস্থিতি ও হৃদয়স্পর্শী মন্তব্যের সাথে সহমত।
মহান রব আমাদের দেশসহ আমাদের আগামী প্রজন্মকে হেফাজত করুণ। আমীন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন