মাতার সাথে কাবার পথে
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ১৮ নভেম্বর, ২০১৫, ০৩:২৯:৫৪ দুপুর
মনের মেঘলা আকাশে থেকে থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। অভূতপূর্ব এক অনুভূতির। আর মাঝে মাঝে ঝির ঝির বাতাসের হালকা এক দমকা হাওয়া মনকে করছিলো উতলা। দোদুল্যমানতার দোলাচলে। জিন্দেগীর জালে আটকে থাকা মনের কোণে দীর্ঘদিনের পোষিত স্বপ্নের এযে সত্যিই বাস্তবরূপ! অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল! আঁধার ঘুচিয়ে ধীরে ধীরে নেমে এলো প্রত্যাশিত সুবহে সাদেক। আহ! এ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম প্রভাত! ইস! কী দারুণ সকাল! গাছ, ফুল, পাখী, মিষ্টি বাতাস মিলে চমৎকার সকালের আবহে মনে হল সবকিছুই অন্যরকম। অন্তর জুড়ে বিরাজ করছিলো আশ্চর্য ধরণের এক অব্যক্ত ভাবনার। সারারাত দু’চোখে এক ফোঁটাও ঘুম এলো না। অজানা এক আনন্দে। মধুময় ভাবনার জগতে এক সময় বিছানা ছাড়লাম মায়ের ডাকে। প্রতি রাতের ন্যায় তাহাজ্জুদ নামাযের জন্য।
মধ্যরাত থেকেই পরিবারের মধ্যে সফরের জন্য চলছিলো আঞ্জাম। ফজরের নামাযের পর পরই চোখে পড়লো বাড়ীর আঙিনা জুড়ে আত্মীয় স্বজনসহ সর্বশ্রেণীর মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি। মায়ের মেহনতি হাতের ছোঁয়ায় দীর্ঘ সতের বছর যাবত আলোকিত ভূবণে কোরআন পাঠের জন্য যারা নিবেদিত, সেই জান্নাতি ফুলের সুবাসে ভরে উঠলো উঠান। বিদায়বেলার। সবকিছুকে ছাপিয়ে অবতারণা হলো এক হৃদয়স্পর্শী দৃশ্যের।
সফরের শুরুতেই প্রেমানুরাগী মন পরম ব্যাকুলতায় মহান প্রভূর স্মরণে নফল নামায আদায় শেষে পদযুগল প্রসারিত করলো। সকলের সান্নিধ্যের আশায়। অন্তরে আনন্দের ঢেউ, অশ্রুপূর্ণ আঁখি আর ভেজা কণ্ঠে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলাম আমরা। আনন্দ আর বেদনার সংমিশ্রণে। আমার মমতাময়ী মা, ছোট ভাই এবং আমি। সাথে ছিল আমার পতিজ্বি এবং আরেক ছোট ভাই। শুরু হলো বহু কাঙ্ক্ষিত সৌভাগ্যময় স্বপ্নের সফরের। পুন্যময় পথে মহান মালিক রাব্বুল আলামীনের সন্মানিত মেহমান হিসাবে। হৃদয়ে তখন বইছিলো প্রেম ও পুণ্যের প্রস্রবণে মিশানো মহব্বতের নহর।
কেননা এ সফর কোন সাধারণ সফর ছিল না। ১৩ই রমযান হঠাৎ করেই মা আমার গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সাথে সাথেই এক ক্লিনিকে রংপুরে ভর্তি করা হোল। ভর্তি হয়েই জরুরী অপারেশেন। এভাবেই পর পর দু’বার অপারেশন। যিনি অপারেশন করলেন তিনিও একজন মহিলা হাজ্বী। মা হজ্ব করবেন জেনে অনেক যত্ন নিলেন। কিন্তু শরীরের একটি ফোঁড়া মানুষের জীবন জিন্দেগীকে কীভাবে নিমিষেই ওলট পালট করে দেয় তা ভাবতে আজো আমার অন্তর কেঁপে উঠে। অপারেশনের পর শ্বাসকষ্ট শুরু হলে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হোল। মা আমার অচেতন! দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে! অপারেশনের জায়গায় জন্ম নিলো বিশাল এক গভীর ক্ষত! নিয়মিত অপারেশন থিয়েটারে চলছে ড্রেসিং। অনেক দামী দামী ঔষধপত্র। তা সত্ত্বেও ক্রমেই অবস্থার অবনতি। পরিবারের সকলেই দিশেহারা। একমাত্র ভরসা শুধু মেহেরবান মনিব, সর্বশক্তিমান প্রভূ।
মহান মালিকের দরবারে একান্ত প্রাণের আকুতি মিনতি। আপনিই শুধু পারেন অসম্ভবকে সম্ভব করতে। আমার মায়ের আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণ করে দিতে। তাঁর একমাত্র স্বপ্নসাধ মৃত্যুর পূর্বে আপনার মেহমান হয়ে আপনার পবিত্রতম ঘরে কদম চিহ্ন রাখা। আপনি তা কবুল করুণ। তাঁর বাসনাকে বাস্তবরূপ দিন। চারিদিকে আকাশ বিদীর্ণ করা আহাজারি। নিরবিচ্ছিন্ন প্রার্থনা। মোনাজাত হোল তালীমের আসরে, ঘরে ঘরে এবং মসজিদে মসজিদে। তারপর করুণাময়ের করুণা হোল। জ্ঞান ফিরে এলো।
পূর্ণোদ্দমে চিকিৎসা চলছে। এমতাবস্থায় আমাকে ক্লিনিক থেকে বাড়ীতে ফিরতে হবে। কেননা আমি মায়ের অসুস্থতার পূর্বেই রমযানের শেষ দশদিন ইতিকাফের নিয়্যত করেছি। মা’কে অনেক কষ্টে আমার ইতিকাফের নিয়্যত সম্পর্কে অবহিত করলাম। এ এক জটিল সিদ্ধান্ত! কঠিন পরীক্ষা! অবশেষে হৃদয়বিদারক এক ব্যথাতুর পরিবেশে মা’কে আল্লাহ্র উপর সমর্পিত রেখে এবং আমার অন্যান্য ভাইবোনকে দায়িত্ব দিয়ে অভিমুখী হলাম। করুণাময়ের কাছে। প্রভূর পানে। এটাই মনে হল শ্রেয়তর। আকাঙ্ক্ষা তিনি ক্ষমা পরবশ হবেন। কারণ তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল এবং পরম দয়ালু। তিনিই তো ওয়াদা করেছেন, সৎকর্মশীলদের প্রতি আমি আমার দানের হস্ত প্রসারিত করবো। সুবহানআল্লাহ্।
এরপর দয়াময়ের দয়ায় ঈদের একদিন আগে রংপুর থেকে মাকে গ্রামের বাড়ীতে আনা হল। অনেক ঝুঁকি কাঁধে নিয়ে। কারণ একদিকে ঈদ আর অন্যদিকে রমযান ঈদের পরপরই এই প্রথম তাঁর আদরের নাতনীর বিয়ে। যা অনেক পূর্বেই নির্ধারিত ছিল। বিতরণ করা হয়েছে বিয়ের আমন্ত্রিত কার্ড।
বাড়ীতে প্রতিদিন মায়ের ড্রেসিং চলছে। সেবা শশ্রুসার ত্রুটি নেই। এমনি এক সময়ে হজ্বের ঠিক ১০ দিন পূর্বে চূড়ান্ত চেকআপের জন্য ডাক্তারের কাছে পুনরায় নিয়ে যাওয়া হোল। মহিলা সার্জন পরীক্ষা শেষে জরুরী অপারেশনের উপদেশ দিলেন! জানালেন ক্ষত অনেক গভীর। আবারো পরিবারে কান্নার রোল! শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা! অবশেষে আমাদের অবস্থা অনুধাবন করে আরেকজন বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে বললেন উনি। তিনিও ২০১৫ এর হজ্বযাত্রী। যিনি আমার মাকে পরীক্ষা করে জানালেন, অপারেশনের প্রয়োজন নেই। নিয়মিত ড্রেসিং আর অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই ক্ষত শুকিয়ে যাবে এবং ক্রমেই স্বাভাবিক সুস্থতা ফিরে আসবে। স্বজনদের মধ্যে ফিরে এলো কিছুটা শান্তি, স্বস্তি ও পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস।
পরিশেষে মহামহিমের দয়ার উপর ভরসা রেখে সকল ড্রেসিংয়ের সরঞ্জামাদি ও ঔষধপত্র সাথে নিয়ে হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে গন্তব্য সুনিশ্চিতভাবে নির্ধারিত হোল। আমরা ইং ১৬/০৮/২০১৫ তারিখ হাজির হলাম হাজী ক্যাম্পে। সেখানে অনেকের সাথে আলাপচারিতা ও ভাব বিনিময় হল। আমাদের সৌদি ভিসাযুক্ত পাসপোর্ট তখনো বাংলাদেশী কর্মকর্তার নিকট পৌঁছায়নি। বলা হল যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে। আমরা সকলেই খুব উদ্বিগ্ন। শুধুই প্রভূকে ডাকছি।
আমার পতিজ্বি ও ছোট ভাইয়ের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা অব্যাহত। কারণ পরেরদিন সোমবার ইং ১৭/০৮/১৫ তারিখ সকাল ৯টা ৫মিনিটে আমাদের ফ্লাইট। এটি দ্বিতীয় হজ্ব ফ্লাইট। বাংলাদেশ থেকে। বেশ কয়েক ঘণ্টা পর হঠাৎ করেই সংবাদ এলো আমাদের সৌদি ভিসাযুক্ত পাসপোর্ট এসেছে। মনের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো আলহামদুলিল্লাহ্।
বিনিদ্র রজনী আমার। পাশে আমার জননী ক্লান্তিপূর্ণ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অতি সন্তর্পণে হজ্ব প্রশিক্ষণে প্রদেয় বইগুলো পড়ছি। অন্তর দিয়ে। মনের মঞ্জিলে ভাসছে। আল্লাহ্র ঘর! তাওয়াফ! সাঈ! যমযম! হাজরে আসওয়াদ! রুকনে ইয়ামিনী! মাকামে ইব্রাহীম! ছাফা মারওয়া, পবিত্র মদীনা মনোয়ারা! ইত্যাদি! সেইসাথে নিয়মকানুন ও দোয়া দরূদগুলো আওরাচ্ছি মনোযোগ ভরে। খুব সতর্কভাবে। আর ভাবছি আল্লাহ্ জাল্লাহ শানহুর বিশাল করুণা ও অনুগ্রহের কথা! আল্লাহ্ই সর্বোত্তম মনোস্কামনা পূর্ণকারী।
এহরামের জন্য সংগৃহীত ছিল ধবধবে সফেদ তিন জোড়া কাপড়। যদিও মহিলাদের ক্ষেত্রে কাপড় ব্যবহারে কোন বিধি নিষেধ নেই। তারপর পা টিপে টিপে বাথরুমে গোসল ও ওযু সেরে এহরামের কাপড় পরিধান করতঃ ২ রাকাত সুন্নাতুল এহরামের নামায আদায় করলাম। বসা অবস্থায় ওমরাহ্-র নিয়্যত করে ৩ বার তালবিয়াহ পাঠ করে দাঁড়িয়ে গেলাম। এরই মধ্যে অনুভব করলাম মায়ের ক্লান্তি কেটে গেছে। আমার দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে নিজের প্রস্তুতির জন্য তৎপর হলেন।
হজ্ব ক্যাম্পে মালপত্র কাস্টমস পরীক্ষা শেষে বিমানের গাড়ীতে ঢাকা বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আপনজনদেরকে আল্লাহ্র হাতে সোপর্দ করে। অবশেষে বাংলাদেশ বিমানে পদার্পণ। প্রথম শ্রেণীর আসনে বসে উড়ছি উন্মুক্ত আকাশে। মাতার সাথে কাবার পথে! আল্লাহু আকবর! লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক......!!
বিষয়: বিবিধ
১৭৪০ বার পঠিত, ৩৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভাবছি কত বিপদই না উডে গেল আপনাদের উপর। আপনার আম্মার বাকী হায়াত সুস্থতায় কাটুক এটাই দোয়া করছি।
হজ্বের বাকী সফরনামা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
মা-শা আল্লাহ, অল্প কথায় চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কিছু অনতিদূর জীবন বৃত্তান্ত। সুন্দর পোষ্টটির জন্য শুকরিয়া।
জ্বী আংকেল অন্নেক আশঙ্কার ভিতর দিয়ে বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, সব কাজই সফল এবং সুন্দরভাবে হয়েছে। মাশাআল্লাহ।
এটাই মহামহিমের অশেষ করুণা, দয়া এবং অনুগ্রহ।
মায়ের জন্য অসাধারণ হৃদয়স্পর্শী দোয়ায় আমীন।
জান্নাত্মনিসহ আপনাদের জন্য অনিঃশেষ দোয়া ও শুভ কামনা।
তোমার অসাধারণ হৃদয়স্পর্শী দোয়ায় আমীন।
তোমাদের সবার জন্য প্রাণ উজাড় করা অনিঃশেষ দোয়া ও শুভ কামনা।
প্রতিটি হজ্ব যাত্রীরই একটি আকাঙ্ক্ষা মাবরুর হজ্ব (ত্রুটিবিহীন হজ্ব) যার প্রতিদান জান্নাত ছাড়া অন্য কিছু নয়। সোবহানয়াল্লাহ্!
আপনার জন্য অনিঃশেষ দোয়া ও শুভ কামনা।
=
মহান দয়ালু ওনাকে সন্মানিত মেহমান হিসাবে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুণ। আমীন।
অনুচিত জেনেও একটি বিষয় জানতে ইচ্ছে হচ্ছে! যদি কিছু মনে না করেন। আপনি কী হজ্ব করেছেন সবুজ ভাই?
অসাধারণ একটি তথ্য দেয়ার জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
ভালো থেকো। সবসময়।
অসাধারণ একটি মন্তব্যের জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপপপপপি
দোয়া ও সুন্দর মন্তব্যের জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
মহান প্রভূর দয়ার ছায়াতলে থাকো এটাই প্রার্থনা।
'সৌভাগ্যবানদের নসীবেই জোটে এমন কাংখিত সফর!'
ইনশা আল্লাহ অবশ্যই 'হজ্জ্বে মাবরুব' হাসিল হয়েছে!
করুণময়ের অপার রহমত যেন আমাদের উপরও হয়-এই দুয়ার দরখাস্ত শ্রদ্ধেয়া আপুজ্বী!
জাযাকুমুল্লাহু খাইরান!
আপনার জন্য দোয়া এমনিতেই আসে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে। নিশ্চয়ই মহান দাতা আপনার সহী ইচ্ছাকে পূর্ণ করবেন ইনশাল্লাহ।
আপনার হৃদয়স্পর্শী দোয়া ও সুন্দর মন্তব্যের জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
মহান আল্লাহর দরবারে আপনাদের সবার জন্য দুয়া। এই অধমের জন্যও দুয়ার আর্জি রইলো, বৃদ্ধা মাকে নিয়ে হজ্জ্বে যাবার একটা অনুচ্চারিত ইচ্ছা আমারও আছে, জানিনা মায়ের বর্তমান অবস্থায় তা সম্ভব হবে কিনা। তবে আপনার আম্মাজানের কাহিনী শুনে মনে হয় আল্লাহর দরবারে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারলে সব অসম্ভবই সম্ভব.....
আপনার নেক বাসনা দয়াময় কবুল করুন এই প্রার্থনা।
উপস্থিতির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
তোমার জন্য অনেক দোয়া করি যেন মহান রব তোমাকেও তাঁর মেহমান বানিয়ে নেন। আমার পরিবারের জন্য সুন্দর অনুভূতি ও অসাধারণ দোয়া রেখে যাওয়ার জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
আলহামদুলিল্লাহ! অনেক বড় সৌভাগ্য আপনার আপু! আল্লাহ আপনাদের কবুল করে নিন। আমিন।
দেরীতে মন্তব্যের জন্য দুঃখিত।
মন্তব্য করতে লগইন করুন