নীলপদ্মে লুকায়িত নীলাম্বরী নীলাঞ্জনা – শেষ পর্ব
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ২৩ এপ্রিল, ২০১৫, ০৯:২৫:৫৯ রাত
বাসাভিমুখে যেতে যেতে দৃষ্টিপথের সীমানায় যতদূর চোখ যায় সব কিছুতেই নতুনত্বের ছোঁয়া অনুভব করলাম। নতুন নতুন রুচিসম্মত আধুনিকতার পরশে নির্মিত বিল্ডিং, ঝকঝকে রাস্তা ঘাট, মানুষের আশা জাগানিয়া উৎফুল্ল চিত্ত দর্শনে আনমনা হয়ে কেমন যেন অদ্ভুত এক মিশ্রিত ভালোলাগার স্পর্শ অনুভব করলাম হৃদয়ে। খুউব করে মনে পড়ছিল সেদিনটির কথা যেদিন আমি একটি ভারী লাগেজ নিয়ে এডিনবরার পথে হাটছিলাম হঠাৎ এক বয়োবৃদ্ধা কাছে এসে বন্ধুসুলভ পরিচিতজনের মত জিজ্ঞেস করেছিল, “মে আই হেল্প ইউ”। তার সদয় আচরণে সেদিন শুধু মুগ্ধই হয়নি সাথে অবাকও হয়েছি। প্রতিত্তুরে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এই মহতী হৃদয়ের প্রবীণার দিকে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম আর প্রাণভরে তার জন্য দোয়া করতেছিলাম বিধাতার কাছে।
সেইসাথে মনে পড়ে গেল এক রমজান ঈদের কথা। তখন আমি বাংলাদেশে। রমজান ঈদের তিন দিন আগে কর্মস্থল থেকে রিক্সাযোগে বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎ তিনজন হুণ্ডারোহী মগবাজার থানার কাছে আমার রিক্সার গতিপথ আটকিয়ে দিয়ে একজন হুণ্ডায় বসে থাকলো আর বাকী দু’জন আমার দু’পাশে দাঁড়িয়ে একটি চকচকে ধারালো ছুরি সামনে ধরে আমার গলার স্বর্ণের চেইনটি কেটে নিয়ে মুহূর্তেই হুণ্ডাযোগে সটকে পড়ে খুব দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমাদের দেশের এহেন অনিশ্চয়তা, অনিরাপত্তা, পশ্চাৎমুখী জাহেলী বর্বর মানসিকতাসম্পন্ন মানুষদের আচরণে কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থেকেছিলাম সেদিন। বেদনাহত মন আজো বিড়বিড় করে বলে উঠে এই না হলে আমরা বাংলাদেশী। এরাই তো আমাদের দেশের আগামী দিনের প্রজন্মের উত্তরসূরী। যারা ভয়ঙ্কর মাদক সেবনসহ নীতি আদর্শ বিবর্জিত নানা অপকর্মে অভ্যস্থ আর এটিই হল আমাদের দেশের আধিকাংশ তরুণ সমাজের বাস্তব অপকর্মের খণ্ডিত চিত্র!
এভাবেই গভীর চিন্তা ও ভাবনাপ্লুত মন নিয়ে সশরীরে বাসার সামনে এসে উপস্থিত হয়েই প্রথম দর্শনেই কিছুটা পরিবর্তনে হতচকিত ও বিব্রত হলাম। বাসার সামনের ছোট গেইট এবং গাড়ী বের করার গেইট দুটোই উন্মুক্ত। হঠাৎ নজরে এলো কয়েক বছর আগে আমার ছেলে কর্তৃক আমাকে দেয়া উপহারের গাড়ীটি যথাস্থানে নেই। সেখানে শোভাবর্ধন করছে আরেকটি নতুন মডেলের গাড়ী। কৌতূহলী মন নিয়ে আরো কয়েক কদম বাড়িয়ে আমার প্রিয় বাগানটির জীর্ণশীর্ণ অবস্থা দেখে আর্তনাদ করে উঠলো ভিতরটা। যে বাগানটি আমার সান্নিধ্যে ছিল সদা হাস্যজ্জ্বোল সাজানো গোছানো ঝকঝকে তকতকে। সেটি আজ রোগে শোকে জরাজীর্ণ, মৃত প্রায়। যথাস্থানে নেই আমার ভালোবাসার সেই গোলাপ গাছটি। অনেক অচেনা দৃশ্য মনে হল আমার কাছে। এক বুক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মূল ফটকের কলিং বেলে চাপ দিতেই একজন ত্বরিত এসে দরজা খুলে দিল।
বাসার ভিতরে প্রবেশ করে লাগেজ রেখে চারিদিকের চেনা অতিপরিচিত অঙ্গনকে অচেনা ভঙ্গিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম। পরিশেষে আমার ছোট্ট কিচেনে প্রবেশ করলাম। কিচেনে যথারীতি সবকিছুই আছে, নেই শুধু আমার শখের রেকর্ড প্লেয়ার আর তাজা ফুলের আসনটি। যেখানে প্রায় প্রতিদিন সকালে বাগানের ফুল দিয়ে ড্রয়িং রুম, বেড রুম আর একটি রান্না ঘরের ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখতাম। আর রান্নার সময়টুকু রেকর্ড প্লেয়ারে আমার নির্বাচিত সঙ্গীত শুনতাম। আহ! কতই না মধুময় ছিল সেই ফেলে আসা সময়গুলি।
উপস্থিত দু’জনের সাথে কুশল বিনিময়ের পর এবার ক্লান্তি নিবারণের পালা। পরের দিন যথারীতি সকালে আমার অতি প্রিয় জায়গাগুলোর মধ্যে ডুবে থাকার বাসনা রেখে সারা দিনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে নিয়ে বের হলাম। প্রথমেই ইচ্ছে হল ঝর্ণার কাছে যাওয়ার। যেখানে রয়েছে প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যের সমাহারে এক হৃদয়কাড়া নয়নাভিরাম ঝর্ণাধারা। বিরামহীন জলরাশি কোথা থেকে আসছে কোথায় এর সূচনা কেউ জানেনা। দর্শনার্থীরা প্রাণভরে কেউ দাঁড়িয়ে কিংবা বসে মনের মাধুরী মিশিয়ে উপভোগ করছে পরম করুণাময়ের অবিশ্বাস্য সৃষ্টিকে তাদের প্রিয়জনদেরকে সাথে নিয়ে। শ্বেত শুভ্র সুখী হাঁসগুলো মনের আনন্দে ভেসে বেড়াচ্ছে এদিক থেকে সেদিকে যা বিমুগ্ধ করছে সবাইকে। ক্যামেরায় কিংবা মোবাইলে ধারণ করছে নিজেদের ইচ্ছেমত। আর আমি ক্যামেরাবন্দী করছি আমাদের সুপ্ত হৃদয়ের নিভৃতে।
ঘোরের মাঝে হঠাৎ মনে হল বাংলাদেশে ফোন দিয়ে স্কাইপে এই জীবন্ত দৃশ্য দেখালে কেমন হয়?! পর পর দু’টি নাম্বারে ফোন দিয়ে প্রিয়জনদের কাউকেই না পেয়ে বিফল মনোরথ হয়ে কিছুক্ষণ সেই মনোমুগ্ধকর জায়গাটিতে কাটানোর পর ধীরে ধীরে অন্য একটি আকর্ষণীয় স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। সেখানে পাথর কেটে নির্মিত রাণীর সুউচ্চ ভবনের নীচের পার্কটিতে লক্ষ্য করলাম সবুজ ঘাসের উপরে কৃত্রিম ঝর্ণার পাশে কেউবা শুয়ে, কেউবা বসে, কেউবা স্টলে চা পানে ব্যস্ত। আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মেতে আছে আইসক্রিম ও খেলাধুলায়। আমিও ওযু শেষে যোহরের নামায আদায় করার পর এক কোণায় বসে সাথে করে নিয়ে আসা খাবার খেয়ে তৃপ্ত হলাম। প্রতিটি মুহূর্তকে একান্তভাবে আলিঙ্গন করে সৃষ্টির অপার রূপে মোহিত হলাম আর হৃদয়ভরে কৃতজ্ঞতা পেশ করলাম সেই মনিবের দরবারে যিনি এই সৌভাগ্যের ভাগীদার করেছেন আমাকে।
তারপর ছুটে চললাম অতি ভালোলাগার কাছে সাগরের পাশে। যেখানে প্রায়ই আগে বাসা থেকে পায়ে হেটে যেতাম। রক্তিম সূর্যের হৃদয়স্পর্শী লুকোচুরি আজো প্রাণে দোলা দেয়। কেন যে এমন হয়!! সাগরের সেই সুবিশাল বুকে কেন জানি আমার মনটা সবসময় পড়ে থাকে অজানা এক বিশেষ ভালোলাগায়। যেখানে গেলে মনটা ভরে উঠে এক সমূদ্র আনন্দের ভাবনায়। কল্পনার ডানাগুলো বিস্তৃত হয়ে পেখম মেলে উড়তে থাকে সীমাহীন অজানায়। যা শুধু অনুভব করা যায়, রূপ দেয়া যায় না ভাষায়। বিস্ময়াতীত!!
অসীম মুগ্ধতা নিয়ে অনাবিল প্রাণের টানে ও হৃদয় জুড়ানো মৃদু হাওয়ার শীতল আবেশে কোথায় যে ডুবে ছিলাম জানিনা। যেখানে ভেসে ভেসে যাচ্ছিল মন পবনের নাও। সেই সুদূরে হারিয়ে গেলাম বহমান পালকীর স্মৃতির ভেলায়। রূপালী আলোয়, ঝলমলে পূর্ণিমায়। সেথায় সন্ধ্যাতারা ছায়া ফেলে নীল নীলিমায়। নিবু নিবু আলো দেয় দিগন্ত রেখায়। ডুবন্ত ফেরারী স্রষ্টার ভাবনায়। নীলাম্বরী নীলাঞ্জনা সেথা নীলপদ্মে লুকিয়ে রয়। সম্বিত ফিরে এলে অভিভূত করা অনুভবে সমস্ত সৌন্দর্যকে হৃদয়ের গহীনে তুলে রাখলাম অপার মমতায়। যা কখনই কোন ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করা আদৌ সম্ভব নয়...!!!
বিষয়: বিবিধ
১৯৯০ বার পঠিত, ৪০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যাহোক বড় বোনের জন্য উৎসাহ, প্রেরণাসহ সুন্দর অনুভূতি রেখে জন্য যাওয়ার জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
জাজাকাল্লাহ।
তবে এখন প্রচুর পড়াশোনা করা প্রয়োজন বিশেষত সাহিত্য নিয়ে।
আত্মজীবনীমূলক বইগুলো অধ্যয়ন করলে খাম্মুনি এক অনন্য লেখিকা হবেন।
ইনশাআল্লাহ.....
খাম্মুনির লিখা অনন্য সুন্দর লাগে আমার কাছে।
খাম্মুনির জন্য দোয়া করি আর কলম জাদুকর[এন্টিইসলামিক] দের পতন এর দোয়া করি।
আমিন
হৃদয়ে আঘাতের মত ঘটনা।
তারপর কি হলো? বিস্তারীত জানতে আগ্রহী....
আপনার নিখুঁত পঠন দৃষ্টি ও আগ্রহী প্রশ্ন সত্যিই মুগ্ধ করলো আমাকে। আপনার জন্য অন্নেক অন্নেক দোয়া। জাজাকাল্লাহু খাইর।
কেমন আছেন আপনি?
ঢাকায় এখন ঝড় হচ্ছে ।
সেরকম ঝড়......... কালবৈশাখী . . . . .
আমি ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ্। পরে কথা হবে ইনশাল্লাহ। তোমার জন্য অন্নেক অন্নেক দোয়া।
ছিনতাই কিন্তু বৃটেনেও হয় যতটুক জানি। শফিক রেহমান এর "লাল গোলাপ" অনুষ্ঠানে এক ভদ্রলোক একবার বলেছিলেন তিনি লন্ডন,ওয়াশিংটন, মস্কো এবং ঢাকায় ছিনতাই এর স্বিকার হয়েছিলেন। ঢাকার ঘটনাটি ছিল তার অনুষ্ঠান রেকর্ডিং এর জন্য আসার পথে!!
আপু এত সুন্দর করে বর্ণনা লিখেছেন ছবি দেন নি কেন ?
ছবি দিলে তো আর মনের কথা গুলো বলা হতো না। লিখার পরিধি অনেক বিস্তৃত হতো এবং পাঠক ধৈর্যহারা হয়ে যেতো তাই ছবি দেয়া হয়নি।
আপনার জন্য অনিঃশেষ দোয়া , শুভেচ্ছা এবং শুভকামনা।
অসাধারণ সুন্দর শব্দের গাথুনিতে আপনার লেখাটি পড়ে মুগ্ধ হলাম।
ধন্যবাদ।
সেথায় সন্ধ্যাতারা ছায়া ফেলে নীল নীলিমায়। নিবু নিবু আলো দেয় দিগন্ত রেখায়। ডুবন্ত ফেরারী স্রষ্টার ভাবনায়। নীলাম্বরী নীলাঞ্জনা সেথা নীলপদ্মে লুকিয়ে রয়। সম্বিত ফিরে এলে অভিভূত করা অনুভবে সমস্ত সৌন্দর্যকে হৃদয়ের গহীনে তুলে রাখলাম অপার মমতায়। যা কখনই কোন ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করা আদৌ সম্ভব নয় বারবার পড়তেই ভালো লাগছে.......।
জাযাকিল্লাহু খাইর!
তোমার অপরিসীম মমতায় লিখা মন্তব্যগুলো পাঠের জন্য আমি বরাবরই লোভাতুর থাকি নিজের অপরিসীম অযোগ্যতা জেনেও ।
ব্যস্ততা সত্ত্বেও আমার লিখাটি পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা। প্রানভরা অন্নেক অন্নেক দোয়া ও শুভকামনা রইলো তোমাদের সকলের জন্য। জাজাকাল্লাহু খাইর আপু।
আপনার সদয় স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি ও প্রেরণাপূর্ণ মূল্যবান অনুভূতি রেখে যাওয়ার জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
লিখেন না কেন ভাইয়া? একটু চেষ্টা করেন...
এতোসব বিশেষণের সমাহারে আপনার উপলব্ধি ব্যক্ত করেছেন যে পড়ে সত্যিই লজ্জিত বোধ হচ্ছে যার যোগ্য আমি নই। বোনটির দোয়া করবেন যেন পরম করুণাময়ের কৃপায় আমার এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারি।
আপনার জন্য প্রানভরা অন্নেক অন্নেক দোয়া ও শুভকামনা রইলো।
মন্তব্য করতে লগইন করুন