ফেলে আসা আলো আঁধারির দিনগুলি – পর্ব ৭
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ১৬ মার্চ, ২০১৫, ০১:৪০:৪৮ রাত
পর্ব ৬
http://www.bd-today.net/blog/blogdetail/detail/6327/mbanu/62726#.VQXsquH26ac
চোখের পলকে তিন মাস শেষ হয়ে গেল। কখন যে চূড়ান্ত পরীক্ষার মুহূর্ত দুরু দুরু মনের দরজায় এসে হাজির হলো টেরই পেলাম না। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে ভাবছি এই পরীক্ষার ফলাফলের উপর নির্ভর করছে অনাগত স্বপ্নসাধে মিশিয়ে থাকা আমার অনেক অনেক অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষাগুলো। সাথে সাথে মনের পর্দায় ভেসে উঠলো বিগত দিনের সংগ্রামের বাস্তব নাটকীয় জীবন্ত চিত্র। অবশেষে প্রতীক্ষিত তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ নির্ধারিত সময়ের পরীক্ষা শেষ হলো। আবারও ফলাফলের জন্য অধীর অপেক্ষা।
আমাদের গ্রুপে সচিবালয়ের সচিব, এন, জি, ও –এর পরিচালকসহ বিভিন্ন বিভাগের প্রার্থী ছিল। ক্লাসে বেশ প্রতিযোগিতা হতো, মজাও হতো বেশ ক্লাসের পারফর্মেন্সকে কেন্দ্র করে। অন্যান্য ফরেনার টিচারের মধ্যে একজন ছিলেন বেশ ইয়াং। তার নাম ছিল সু হাইড। ক্লাসে গ্রামার বিষয়ে তার দু একটি ক্ষেত্রে বিনয়ের সাথে আপত্তি জানালে সে সানন্দে স্বীকার করে নিতো। সেই থেকে সে আমাকে ক্লাসে ডাকতো গ্রামাটেরিয়ান বলে। ক্লাসে প্রায়ই আমাকে বলতো তুমি আমার চেয়েও অনেক ভাল গ্রামার জানো। আর উপস্থিত ছাত্রছাত্রী যারা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতো এবং পরিবারের সাথে যোগাযোগ ছিল তারা বলতো সু সে ভালো গ্রামার জানে কারণ তার ছেলে ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র সেজন্য। প্রায়ই ক্লাসে সবার আগে আমার টাস্ক শেষ হলে কেউ কেউ ফানি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। আর ক্লাস শেষে এগুলো নিয়ে বেশ মজার আসর জমতো আমাদের মধ্যে।
যাহোক প্রতীক্ষার প্রহর শেষে আশাতীত ফলাফলে মনের আকাশে স্বপ্নের পাখীরা নিজের অজান্তেই উদ্দীপ্ততায় ডানা মেলে আকাশে উড়লো। ভীষণ আনন্দবোধ হলো। সেইসাথে গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে শোকর আদায় করলাম অবিশ্বাস্য এই প্রাপ্তিতে।
পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার সাথে সাথেই আমাদেরকে খুব দ্রুত বিদেশে পাঠানোর সকল প্রস্ততি শুরু হলো। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পাঁচ জন নির্বাচিত প্রার্থীগণকে ইংল্যান্ডে পৌঁছাতে হবে এবং প্রথম ক্লাস শুরুর পূর্বে অবশ্যই সেখানে সকলকেই উপস্থিত থাকতে হবে। কোন কারণবশতঃ কোন প্রার্থী সঠিক সময়ে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হলে কোর্সে অংশগ্রহনে অযোগ্য হিসাবে বিবেচিত হবে মর্মে চিঠি দেয়া হলো। মন্ত্রণালয় কর্তৃক জি, ও (সরকারী আদেশ) সহ আনুষঙ্গিক নির্দেশনার কাগজপত্র স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে যথারীতি প্রেরিত হলো।
ফ্লাইটের টিকিটসহ বিদেশে যাওয়ার তত্ত্বাবধানে ছিল ব্রিটিশ কাউন্সিল। তাদের নির্দেশনায় ব্রিটিশ হাইকমিশনে ইন্টারভিউ ও ভিসাসহ যাবতীয় অফিসিয়াল কার্যাদি সুসম্পন্ন হলো। হাতে মাত্র তিন দিন সময় তারপরই জীবনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে! প্রথম আকাশে উড়বো!! বিদেশী ডিগ্রী অর্জন করবো!!! ইত্যাদি ইত্যাদি ইচ্ছেগুলো মনের আঙিনায় দোলা দিতে লাগলো।
আবার সেইসাথে মনের ভিতরে বিষাদের দানাগুলো মোচড় দিয়ে উঠলো। অনেক অনিশ্চয়তা, দুর্ভাবনা আর প্রিয়জনকে ছেড়ে যাওয়ার বেদনা সারাক্ষণ অন্তরে খচ খচ করে বিঁধতে লাগলো। বিশেষ করে আমার একমাত্র ছেলে সন্তানকে ছেড়ে যাবো কিছুতেই মন আর বিবেক মেনে নিচ্ছিলো না । সে তখন “ও” লেভেলের ছাত্র। এসব ভেবে ভেবে সারাক্ষণ আমার চোখের পাতা দুটো ছিল ভেজা। নানা আশংকা আর ভাবনা মনকে বিষন্নতায় ঢেকে রাখলো। যদিও আগেই জেনে নিয়েছি অধ্যয়ণকালীন সময়ে আমার ছেলে আমার সাথে থাকার অনুমতি পাবে কোর্স শুরু হওয়ার পরে।
এদিকে মন্ত্রণালয়ের চিঠি স্থানীয় প্রশাসনের হস্তগত হওয়ার সাথে সাথেই আমাকে বাসা ছাড়ার নোটিস দেয়া হলো। যদিও ইতিপূর্বে আরেকটি কোর্সের সময় বাসা ছেড়ে দেয়া সংক্রান্ত জটিলতার কারণে মন্ত্রণালয় আমার নামে চিঠি ইস্যু করে জানিয়েছিল যে প্রেষণে থাকাকালীন সরকারী বাসা ছাড়ার কোন বিধান নেই। যেহেতু আমি দু’বছর প্রেষণে থাকবো এবং এটি আমার স্কলারশিপ তাই বৃটিশ সরকারের ষ্টাইপেণ্ডের পাশাপাশি আমি আমার বেতন ভাতাদিও দু’বছর সময়কালীন সময়ে বর্তমান কর্মস্থল থেকে যথারীতি প্রাপ্ত হবো। মাসিক বাসা ভাড়া কর্তনে স্থানীয় প্রশাসনের কোনই বেগ পেতে হবে না।
কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন অনড় থেকে জানিয়ে দিলেন বাসা না ছাড়া পর্যন্ত তারা আমাকে ছাড়পত্র দিবেন না। হাতে মাত্র দুদিন সময়। এই দু’দিনে রাজধানীর মতো জায়গায় বাসা ভাড়া করে জিনিসপত্র স্থানান্তর করা আমার পক্ষে ছিল দুঃসাধ্য ও অকল্পনীয় একটি ব্যাপার। তাছাড়া এটি ছিল স্থানীয় প্রশাসনের অন্যায় পদক্ষেপ তাই তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে কিছুতেই মন সায় দিলো না। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম বিদেশ যাওয়া বাতিল করে দিবো।
এরূপ একটি জটিল মুহূর্তে আবারো জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম স্যারের কাছে পরামর্শের জন্য ছুটে গেলাম। স্যার তখন সম্পূর্ণ সুস্থ এবং বাসায় অবস্থান করছিলেন। আমার ঘটনা শোনার পর বললেন, এমন একটি সুবর্ণ সুযোগ শুধুমাত্র বাসার কারণে বাতিল করা সঠিক হবে না। আমার পরিস্থিতি এবং সময় স্বল্পতার কথা উল্লেখ করলে মন্ত্রণালয়ের কাগজ পত্র দেখার পর স্যার বললেন আপনার কোর্সে যোগদানের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের ছাড়পত্রের কোনই প্রয়োজন নেই। আপনি সচিবালয়ের চিঠি নিয়ে চলে যেতে পারেন। তারপর পরবর্তী অবস্থার আলোকে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। কখন কী হয় আমাকে জানালে আমি চেষ্টা করে বাকীটা দেখবো।
স্যারের উপদেশ শুনে সাময়িকভাবে অনেক হালকাবোধ করলেও অজানা নানা শঙ্কা এসে ভর করলো মনে। স্থানীয় প্রশাসনের ছাড়পত্র না থাকার কারণে এয়ারপোর্টে আটকিয়ে দেয়া, বিনানুমতিতে দেশ ত্যাগের জন্য বেতন ভাতাদি বন্ধ করে দেয়া ইত্যাদি নানাবিধ দুশ্চিন্তা মনকে আচ্ছন্ন করে রাখলো।
নানা ভাবনার দোলাচলে সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে মুহূর্তগুলো কাটছিলো তখন। ঠিক যেন হাঁ এবং না এর মাঝখানে। তারপর চিন্তা করলাম আল্লাহ্ চাহে তো এয়ারপোর্টে যদি সবকিছু ঠিক ঠাক থাকে তাহলে আপাততঃ কোর্সে যোগদান করি তারপর না হয় অবস্থা বুঝে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে।
অবশেষে বাসায় এসে অনেক এলোমেলো ভাবনা শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম যে, ছাড়পত্র ছাড়াই এয়ারপোর্টে যাবো বাদবাকী আল্লাহ্ ভরসা। পরেরদিন আবারো স্যারের বাসায় গেলাম বিদায় নেবার জন্য। সেইসাথে স্যারকে অনুরোধ ও জানার আগ্রহ প্রকাশ করে বললাম আসার সময় আমিতো অবশ্যই কিছু আপনার জন্য নিয়ে আসবো। আমি জানি আপনার কোন কিছুরই অভাব নেই। তারপরও যদি বলতেন আমার ভীষণ ভালো লাগতো। অনেক জোর দিয়ে বলার পর এক পর্যায়ে স্যার স্মিত হাসি দিয়ে বললেন ঠিক আছে আসার সময় আমার জন্য একটা পুল ওভার আনবেন। চলবে
বিষয়: বিবিধ
১৫০৩ বার পঠিত, ৩৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সাথেই আছি আপু! শুকরিয়া ও শুভকামনা রইলো !
আমি প্রথম অতিথি
আর হ্যাঁ আপু এই ধারাবাহিকটি লিখার মূল পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য আমার সস্রদ্ধ ও প্রাণপ্রিয় স্যারের জন্য। কিছুটা হলেও তার অপরিশোধিত ঋণের বোঝা একটু হালকা করার অপপ্রয়াস মাত্র। আমার পারিবারিক বিবরণ বিবৃত করা নয়। কিন্তু ঘটনাগুলোকে সাজাতে গিয়ে পারিবারিক বিষয়গুলো অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসে যাচ্ছে!
আপনার জন্য হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা দোয়া ও শুভেচ্ছা আপু।
সন্ধাতারা তো সন্ধাবেলা উদায় হওয়ারই কথা, এত রাতে উদয় হয় কেন? তাহলে কি নিশিতারা? যাগগে উদয়তো হল তাই শুভেচ্ছা, কমেন্ট পরে করবো্।
ফুলেল শুভেচ্ছার জন্য বারাকাল্লাহু ফিক।
নীচেরটা পেপারনী পিৎজা।
আপনার জন্য অনেক অনেক দোয়া ও শুভ কামনা রইলো। জাজাকাল্লাহু খাইর।
স্যারের জন্য পুল ওভার,আমিও কিছু চাই, নিয়ে আসতে হবে কিন্তু। তবে তা আপনার পছন্দে হলেই হবে।
পরবর্তীতে কি বিড়ম্বনায় পড়েছেন, তা জানার অপেক্ষায় রইলাম। তবে বিড়ম্বনামুক্ত হয়ে স্বদেশের মায়া ত্যাগ করে বিদেশ বিভূঁইয়ে পাড়ি জমিয়েছেন এমনটাই শোনার প্রত্যাশা করছি।
চলছে, চলুক, আমি কিন্তু পিছু ছাড়ছিনা। আজ একটু কষ্ট দিয়ে ফেললাম তাই না? এতো গুলো মন্তব্যের পিঠে প্রতিমন্তব্য করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছেন নিশ্চয়। সরি ফর দ্যাট!
ভালই তো ...!!!!!
আপনার জন্য কী তাতো বললেন না ভাইয়া! বলেই দেখুন না। আপনার আবদার শুনে ভীষণ ভালো লাগলো।
একদম হাঁপিয়ে উঠিনি!! আপনার মন্তব্য আসলেই অনেক উপভোগ্য ভাইয়া। এটি একটি বিশেষ গুণ বলতে হবে আপনার। সাথে আছেন জেনে অনেক আনন্দিত হলাম। নো মোর স্যরি ভাইয়া।
আপনার জন্য অনেক অনেক দোয়া ও শুভ কামনা রইলো। জাজাকাল্লাহু খাইর।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
শুভেচ্ছা জানবেন।
ভালো থাকবেন খুব ভালো। জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার মূল্যবান উপস্থিতি ও উপদেশের জন্য নিরন্তর দোয়া ও শুভকামনা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
এই সব আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কত প্রতিভা কে ধ্বংস করছে।
গুরুত্বপূর্ণ অনুভূতি রেখে যাওয়ার জন্য নিরন্তর দোয়া ও শুভকামনা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার সংগ্রামী জিবনে তো দেখছি নূরুল ইসলাম স্যারের ভুমিকা অনেক। স্যারের জন্য বেশি বেশি দোয়া করবেন।
ঐটুকুই তো পুঁজি আংকেল। এছাড়া এই অধম আর কীই বা করতে পারি বলুন, দোয়াটুকু ছাড়া। আপনিও আমার প্রিয় স্যারের জন্য বুকভরে দোয়া করবেন আল্লাহ্ পাক যেন উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের উত্তম মেহমান বানিয়ে নেন। বিশেষ অনুরোধ রইলো আপনার প্রতি।
আপনার মূল্যবান উপস্থিতি ও উপদেশের জন্য নিরন্তর দোয়া ও শুভকামনা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার জন্য নিরন্তর দোয়া ও শুভকামনা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
চলতে থাকুক, সামনে এইচএসসি পরিক্ষা থাকায় ব্লগ থেকে বিদায় নিলাম, আবার পরিক্ষার পরে এসে বাকি পর্বগুলো পড়ব।
আপনার জন্য অন্নেক অন্নেক দোয়া ও শুভ কামনা রইলো আসন্ন এইচএসসি পরিক্ষার জন্য।
মঙ্গলময় আপনার সাহায্যকারী হয়ে উত্তম প্রতিদান দিন এই প্রার্থনা।
ভালো থাকুন, খুব ভালো।
আপনার জন্য অনিঃশেষ দোয়া , শুভেচ্ছা এবং শুভকামনা রইলো।
মন্তব্য করতে লগইন করুন