মহব্বতের মহতী ছোঁয়া
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ০৯ মার্চ, ২০১৫, ০১:১৪:১৮ রাত
শিহাব কিশোর বয়স থেকেই মুখে দাঁড়ি রাখার কারণে আশেপাশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তার নাম দিয়েছিলো রবিনহুড ভাইয়া। কারণ তাদের কচি মনের দর্পণে তাকে রবিনহুডের মতো দেখাতো। শিহাব লেখাপড়া ও টিউশনিসহ শত ব্যস্ততার ফাঁকে একটু ফুরসুৎ পেলেই অন্তরঙ্গভাবে তাদেরকে নিয়ে মজার আসর জমাতো। প্রচণ্ড ভালোবাসতো এসব ফেরেস্তাতুল্য শিশু কিশোরদের। কোমলমতি শিশু কিশোররাও শিহাবের সান্নিধ্য ভীষণ পছন্দ করতো।
সরকারী কোয়ার্টারে বসবাস করার কারণে সেখানে এক ঝাঁক উদ্যম উচ্ছ্বল ও উচ্ছৃখল কিশোরের হই হুল্লোড়ের সাথে সবাই কমবেশি পরিচিত ছিল। প্রায়ই ঘটতো সেখানে নানারকম অমানবিক ও অনভিপ্রেত অপ্রীতিকর ঘটনা। এসব কারণে এক পরিবারের সাথে অন্যদের রেষারেষি, মনমালিন্যতা হরহামেশা লেগেই থাকতো। তাদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম চরিত্রের ছিল শিহাব। ছোটবেলা থেকেই সে ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তার চরিত্র মাধুর্য সকলকেই মুগ্ধ করতো। সবার সাথেই ছিল তার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। শিহাবের বুদ্ধিমত্তা, ত্যাগ, ধৈর্য, সহনশীলতা, মায়ামমতা ও ধর্মীয় আচরণে সকলেই ছিল সন্তুষ্ট ও অভিভূত।
শিহাবের সাহচর্যে ধীরে ধীরে উচ্ছৃখল কিশোরদের মধ্যে এক ধরণের পরিবর্তন অনুভূত হয়। শিহাবের কাছ থেকে তারা পেয়েছিলো জীবন গড়ার বাস্তব স্বপ্নময় সুন্দর উপমা। তাদের প্রত্যেকের জীবনে শিহাব হয়ে উঠেছিলো অনুকরণীয় একটি প্রস্ফুটিত গোলাপ। সময়ে অসময়ে শিশু কিশোরদের মনের চাওয়া পাওয়া, আনন্দ বেদনাগুলোর সাথে শিহাব মিশে গিয়ে সেগুলো সমাধানে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হতো। তাদেরকে শুধু মিষ্টি কথা ও শ্বান্তনার বাণী শুনিয়েই ক্ষান্ত হতো না, বাড়িয়ে দিতো সে অকৃত্রিম বন্ধুত্বের অবারিত হাত। টিউশনি থেকে যে আয় হতো তা থেকে সাধ্যমত তাদের ছোট ছোট আবদার গুলোকে পূরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতো সে।
মাঝে মাঝে শিহাব তাদেরকে মানবতার জন্য নবীজির ত্যাগ ও দরদীময় জীবন কাহিনী শোনাতো। দুষ্টুমি ভরা জীবনে এসব রোমাঞ্চকর সত্য কাহিনী তারা শিহাবের মুখ থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে সেগুলোকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে অনুপ্রাণিত হতো। সেইসাথে বই পড়ার প্রবল আগ্রহ জন্মে তাদের অন্তরে। শিহাবের সংগ্রহে থাকা নবীজিসহ বিশ্বখ্যাত মনিষীদের আত্মজীবনীমূলক বইগুলি পড়ার ভীষণ নেশায় এখন পেয়ে বসেছে তাদের। নিজেরাও এখন বই কেনা শুরু করেছে। অভিভাবকগণও আনন্দ চিত্তে তাদের সুন্দর এই দাবীগুলি আপ্রাণ মিটিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই তারা একে অন্যের বইগুলো শেয়ার করে পড়ে। ক্ষেত্র বিশেষে কারো কোন কাজে অসন্তুষ্টি, ভুল বুঝাবুঝি ও অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হলে বিষয়টি সরাসরি সেই ব্যক্তিকে আক্রমণ না করে ত্রুটিগুলো পরোক্ষভাবে বিনয় ও ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে নিরসন করা হতো। এভাবেই পারস্পারিক ঝগড়া বিবাদ, মতবিরোধ, মতভেদ ও সমস্যাগুলোর সুন্দর সমাধান সকলের সম্মতিক্রমে সন্তুষ্টি সহকারে মিটে ফেলে তৈরি হতো পারস্পারিক গাঢ় বন্ধুত্ব।
এক সময় বিভিন্ন বয়সী হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে পারস্পারিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতার ফলে মানবিক বন্ধুত্ব ক্রমেই গাঢ়তর হয়ে উঠে। সহজেই তারা নিয়মিতভাবে একে অপরের সাথে নিখাদ মহব্বত আর মমতাপূর্ণ সঙ্গ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে। শিহাবকে দেখার আশায় তারা উন্মুখ হয়ে প্রহর গুনতো। শিহাবের স্কুল থেকে আসতে দেরী হলে তারা অস্থির হয়ে উঠতো। আবার কখনো বা এক বুক অভিমান নিয়ে মুখ গোমরা করে বসে থাকতো অনুযোগের ভঙ্গীতে।
শিহাব এই অভিভূত করা দৃশ্যগুলোকে সযতনে হৃদয়ের গভীরে গেঁথে রাখতো এক সাগর ভালোবাসা দিয়ে। তারা আজকাল নিয়মিত প্রকাণ্ড এক বট গাছের ছায়ায় বসে তাদের নিত্যদিনের কর্মের পরিকল্পনা করে। এখন আর পাড়ার লোকদের কোন অনাহুত ঘটনার মুখামুখি হতে হয়না। নেই কোন চিৎকার চেঁচামেচি। চারিদিক শুনশান নীরবতা ও নিস্তব্ধতা। কচি শিশু কিশোর মেলায় জেগে উঠে নির্মল উচ্ছ্বাসভরা আনন্দময় জীবনের রূপরেখা। যেখানে এখন আনন্দ ও খুশীর কোন সীমা পরিসীমা নেই। ওদের সবার হৃদয়ে উথলে উঠে মানবপ্রেমের বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের আনন্দময় অনুভূতি।
তাদের উচ্ছ্বল আনন্দ ভরা ঝলমলে মুখগুলো পরিবারের সব অশান্তি, নিত্যদিনের কোলাহল, দুঃচিন্তা আর বিষাদের রেখা মুছে দিয়ে ছড়িয়ে দেয় স্বস্তি আর শান্তি। সেখানে কোন হিংসা বিদ্বেষ নেই, হানাহানি খুনাখুনি নেই, নেই কোন অপমৃত্যুর আর্তনাদ। সেখানে এখন বিরাজ করছে শুধু নিখাদ সৌন্দর্যের ভাব বিনিময় আর মায়া মমতায় ভরা অকৃত্রিম ভালোবাসার ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। মুক্ত পাখীর কলকাকলীতে মুখরিত জীবনগুলো খুঁজে পায় প্রশান্তির স্বাদ। অনুভবে শুষে নেয় আত্মতৃপ্তিময় পরিশুদ্ধ নির্মল সত্যের হাসনা হেনার সুবাস। একের প্রতি অন্যের অনুভূতিবোধ, আতিথেয়তা, মমত্ববোধ, যত্নশীল মানসিকতা, অনুগ্রহশীলতার এক অনবদ্য অনুপম উপমায় রূপ নেয়।
এখন তারা সবাই নিয়মিত ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে দলবদ্ধভাবে আযানের সাথে সাথে মসজিদে ছুটে যায় নামায আদায় করার জন্য। শিহাবের মত ইসলামিক পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করে, নম্র ভদ্রভাবে নরম সুরে কথা বলে, নিয়মানুবর্তিতার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখে, বড়দেরকে শ্রদ্ধা করে এবং তাদের আদেশ উপদেশ আদবের সাথে পালন করে। এক কথায় সবকিছুতেই শিহাবের ধর্মীয় অনুভূতিসম্পন্ন আচরণগুলো তাদের মধ্যেও পরিলক্ষিত ও পরিস্ফুটিত হতে থাকে। লেখাপড়ায় সকলেই স্ব স্ব স্কুলে আগের তুলনায় অপ্রত্যাশিত ভালো রেজাল্ট করতে থাকে। যা সকল অভিভাবকের নজর কাড়লো, অফুরন্ত আনন্দে মন প্রাণ আন্দোলিত হলো এবং শিহাবের প্রতি তাদের দিল সন্তুষ্টিতে ভরে উঠলো। এভাবে দিনে দিনে অত্যন্ত মজবুতভাবে দ্বীনের আলোয় গড়ে উঠলো প্রতিটি পরিবার। সেইসাথে আশেপাশের সকলেরই প্রশংসাভাজন ও অভাবনীয় শান্তি সুখের সুন্দর একটি নয়ন জুড়ানো আদর্শিক মডেলের অনুকরণীয় হয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো এই শিশু কিশোরীয় কমিউনিটি। যেখানে বিরাজিত কলঙ্কময় ঘুটঘুটে অন্ধকার মুছে গেল চিরতরে। ফুটে উঠলো ন্যায়, সত্য ও সুন্দরের আলোকবর্তিকা শুধুমাত্র শিহাবের মহব্বতের মহতী ছোঁয়ায়।
বিষয়: বিবিধ
১২৩৭ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুন্দর চরিত্র মানুষকে আকর্ষন করে, এর ক্ষমতা অনেক শক্তিশালী!নোংরা এবং বিপথগামী সমাজকে সুন্দর পথে ফিরিয় আনার জন্য এরকম অসংখ্য শিহাবকে আজ প্রয়োজন!
সুন্দর চমৎকার লিখাটির জন্য আন্তরিক শুকরিয়া!
আপনার বলিষ্ঠ প্রেরণাসমৃদ্ধ মন্তব্যটির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর আপুনি। আপনার জন্য অনেক অনেক দোয়া ও নিরন্তর শুভেচ্ছা রইলো।
আপনার জন্য অনেক অনেক দোয়া ও নিরন্তর শুভেচ্ছা রইলো।
আপু গল্পের নায়ক শিহাব কি আপনার ছেলে ?
মাশাআল্লাহ্ তুমি অনেক অনেক বুদ্ধিমতী আপু! তোমার প্রশ্নের উত্তরে না বললে মিথ্যে বলা হবে তাই ...।
তোমার জন্য অনেক অনেক দোয়া ও নিরন্তর শুভেচ্ছা রইলো।
অনেক দূরে অচেনা থেকেও যেন অনেক আপন হয়ে গেছেন আপনি আমাদের পরিবারের মাঝে। আপনার ছেলে মেয়ে তথা পরিবার সম্পর্কে বলবেন কী? যদি আপত্তি না থাকে।
আমার ছেলের জন্য দোয়া করেছেন জেনে খুব খুশী হলাম। মহান দয়ালু আল্লাহ্ পাক যেন আপনার দোয়া কবুল করে আমার ছেলের জ্ঞাত অজ্ঞাত সবরকম পাপরাশি ক্ষমা করে তাঁর প্রিয়জনের তালিকাভুক্ত করে নেন।
আপনার জন্য প্রাণভরা দোয়া রইলো।
আপনার পরিবারের সকলের প্রতি রইলো আমার সস্রদ্ধ ছালাম ও শুভেচ্ছা।
মঙ্গলময় সবাইকে ভালো রাখুন, সুস্থ রাখুন আর সর্বাবস্থায় আল্লাহ্র পথে পা অবিচলিত রাখুন। জাযাকাল্লাহ।
খুব ভালো লাগল এই লিখাটি। অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানবেন।
ভালো থাকবেন খুব ভালো সবসময়। প্রাণভরা দোয়া রইলো আপনিসহ পরিবারের সকলের জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন