ফেলে আসা আলো আঁধারির দিনগুলি – পর্ব ৩
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ১০:৪১:১২ রাত
পর্ব ২
http://www.bd-today.net/blog/blogdetail/detail/6327/mbanu/62160#.VPHvWuH26ac
আমার প্রাণপ্রিয় সভানেত্রীর মুখে জানতে পেলাম উনি স্বামীসহ খুব শীঘ্রই স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আমেরিকা চলে যাচ্ছেন। ওনার বাবা মা ভাইবোন সকলেই তাদের দু’জনের জন্য গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন সেখানে। অফিসিয়াল কাগজপত্র সব প্রস্তুত। এমতাবস্থায় উনি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত সাংগঠনিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে আমাকে সভানেত্রী পদে মনোনীত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন বলে আমাকে জানালেন। আমি যদি ওনার অনুরোধ উপেক্ষা করে পদ নিতে অনীহা প্রকাশ করি সেক্ষেত্রে হয়তো অনেক মনোঃকষ্ট নিয়ে তাকে দেশ ছাড়তে হবে। তাঁর করুণ আকুতি দেখে আমি নিরুপায় হয়ে সময়ের আবেদন করলাম চিন্তা ভাবনার জন্য।
এরই মধ্যে আমার বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে বেতন ভাতাদি বন্ধসহ অনেক প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। নোংরা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে আমি যে সরকারী বাসায় থাকতাম সেটা অবিলম্বে ছেড়ে দেয়ার নোটিশ জারী করা হয়েছে। চারিদিকে তখন কাল বৈশাখীর ঝড়। মনে হচ্ছিল যেন মুহূর্তেই লণ্ডভণ্ড হয়ে নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছি আমি। উপায়ন্তর না দেখে মনস্থির করলাম নুরুল ইসলাম স্যারের সাথে একবার দেখা করা আবশ্যক। উনার ন্যায় নীতিবোধে এতটাই আকৃষ্ট ছিলাম যে, মনে হল হয়তো আমার এই দুর্দিনে উনি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ থেকে আমাকে নিরাশ করবেন না। কিন্তু কীভাবে দেখা করবো তার কোন কিনারা করতে পাচ্ছিলাম না। অবশেষে হঠাৎ করেই উনার চেম্বারে গিয়ে উপস্থিত হলাম। স্যার তখন রোগী দেখায় ভীষণ ব্যস্ত। পুরো চেম্বার জুড়ে রোগীরা ভীড় করে সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। আমি স্যারের অফিসের সামনে বসা চিকিৎসকের স্মরনাপন্ন হয়ে জোর অনুরোধ রাখলাম যেভাবেই হোক স্যারের সাথে আমার দেখা করা খুব জরুরী। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আপনার কী শারীরিক সমস্যা? আমি উত্তরে বললাম শারীরিক সমস্যা নয় আমি মূলতঃ প্রশাসনিক বিষয়ে কথা বলতে এসেছি। তারপর উনি জিজ্জেস করলেন আমি স্যারকে চিনি কী না? উত্তরে বললাম জ্বি।
এরপর আমার হাতে এক টুকরা কাগজ দিয়ে বললেন এতে আপনার নাম ঠিকানা ও সাক্ষাতের উদ্দেশ্য লিখে দিন আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। স্যারের রুম থেকে বের হয়ে সেই চিকিৎসক আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। এও বললেন আপনাকে দেরী করতে হবে কেননা দূর দূরান্ত থেকে অনেক অসুস্থ রোগীরা সাক্ষাতের অপেক্ষায় বসে আছেন। আমি উত্তরে বললাম অপেক্ষা করতে আমার কোনই অসুবিধা নেই। যাহোক কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার সাহেব এসে জানালেন স্যার আমাকে যেতে বলেছেন। রুমের ভিতরে প্রবেশ করে সালাম জানালাম। সালামের উত্তর দিয়ে সামনের চেয়ারে বসতে বললেন। তারপর ব্যক্তিগত অফিসারকে ডেকে কী যেন নিয়ে আসতে বললেন। একটু পরে অন্য একজন বাসার ভিতর থেকে হোম মেইড স্যুপসহ নাস্তা নিয়ে আসলেন। স্যার টেবিলের সামনে রেখে আমাকে বললেন আগে খেয়ে নেন তারপর আপনার কথা শুনবো। তাঁর উদারতা, প্রীতিময় আন্তরিকতা, সৌজন্যতা ও বিস্ময়কর আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম আমি। হৃদয়ে অনুভব করলাম “মানুষ মানুষের জন্য” এর নতুন মানবিক রূপের অপরূপ সৌন্দর্যময় শিক্ষা।
এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় আমি কিছুটা বিব্রতবোধ করে স্যারকে বললাম আপনি খেয়ে নেন স্যার আমি বরং বাহিরে একটু অপেক্ষা করি। স্যার কিছুটা শাসনের সুরে বললেন এখন আমার খাওয়ার সময় নয় এটা আপনার জন্য আপনি খেয়ে নেন। পাল্টা জবাব দেবার আর সাহস পেলাম না। সুবোধ বালিকার মত স্যারের আদেশ পালন করে বললাম আমি আসলে অনেক বিপদগ্রস্থ তাই আপনার স্মরণাপন্ন হয়েছি। যদিও এখানে আসাটা আমার ঠিক হয়নি কিন্তু এছাড়া আমার আর কোন বিকল্প পথ খোলা ছিল না। এরপর সবকিছু ধৈর্যের সাথে শুনে অত্যন্ত আন্তরিকতার সহিত আমাকে কিছুটা শান্তনার অভয় বাণী শুনিয়ে বললেন আপনাকে আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। একজন সচিব তার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে আগামীকাল আমার কাছে আসবেন। উনার সাথে সরকারী আইনগত দিক জেনে তারপর আপনাকে আমি জানাবো।
পরের দিন গেটে কেউ একজন কড়া নাড়ছেন খুলে দিয়ে আগন্তকের কাছে জানতে পারি স্যার উনাকে পাঠিয়েছেন আমার ব্যাপারে সংবাদ দেয়ার জন্য। আমার কী করণীয় এ ব্যাপারে আমি যেন বিস্তারিত পি এস সাহেবের কাছে জেনে নেই। স্যারের উপদেশ মত সেই সচিব মহোদয়ের সাথে মন্ত্রণালয়ে সাক্ষাৎ করি। তারপর অবিশ্বাস্যভাবে সচিব মহোদয়ের হস্তক্ষেপে তিন দিনের মধ্যে আমার বাসা না ছাড়ার ক্ষেত্রে সরকারী বরাদ্দ আইন উল্লেখ করে একটি জি, ও (গভমেণ্ট অর্ডার) আমার নামে ইস্যু করা হয়। যার কপি মন্ত্রণালয় থেকে আমার কর্মস্থলেও পাঠানো হলো। স্যারের হস্তক্ষেপে সে যাত্রায় অবিস্বাস্যভাবে একশত ভাগ পরিত্রাণ জুটলো আমার ভাগ্যে। কিছুটা স্বস্তি শান্তি আর ভরসা পেলাম মনে মনে। সাথে সাহসী চিত্তে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার দৃঢ় পণ করলাম এই ভেবে যে সর্বশক্তিমান কোন মহৎ বান্দার উছিলায় আমাকে রক্ষা করবেন।
এদিকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আমার নামে ইস্যুকৃত মন্ত্রণালয়ের চিঠি দেখে হতবাক হয়ে গেল। অনেকেই প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলো যে, এটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে? যেখানে মন্ত্রণালয়ের একটি জি, ও এর জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়! আমি তাদের এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া থেকে বিরত থাকি এবং তাদেরকে জানিয়ে দিই, যে নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ আমার বিরুদ্ধে নেয়া হয়েছিল এটা সম্পূর্ণ বেআইনি ছিল। মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারীকৃত চিঠি তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। এদিকে আমার নিশ্চিত বিপদ থেকে রক্ষার সংবাদে আমার সহপাঠীদের ভগ্ন হৃদয় সবল হলো, তারা আতঙ্কিত পরিবেশের শ্বাসরুদ্ধকর মানসিক চাপ থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে অনুভব করলো হৃদয় শীতল করা সান্ত্বনা আর ফিরে পেল হারানো শক্তি আর মনোবল।
আমার চলমান তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে উত্তরণের নতুন স্বাদ সবার মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার করলো। আত্মবোধবিমুখ সহপাঠীদের মধ্যে জাগ্রত হল মুক্তির স্পন্দন। জেগে উঠলো দীর্ঘদিনের জমানো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অন্যরকম এক আত্মবিশ্বাসী চেতনার বোধ। এযেন মানবিক চৈতন্যের নতুন সূর্য উদিত হলো সকলের মাঝে। সবাই সংগঠিতভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমূখর বিবেকের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধের ভাবনার অস্তিত্ব নিয়ে একই কাফেলায় শরীক হলো নতুন এক দিগন্তের মোহনায়। বিবেকের অনুভূতিতে এবং মননে স্পর্শ করলো অন্যায়কে অন্যায় বলার দুর্জয় সাহস। আর এভাবেই আমার সংগ্রামী জীবনে যিনি মাথা না নোয়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, তিনি আমার অনেক শ্রদ্ধেয় স্যার জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। যিনি আমার চলার পথের অদম্য স্পৃহা ও পথিকৃৎ। এভাবেই যেকোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও প্রতিকূল পরিবেশে প্রতিবাদের ঝাণ্ডা উড়াতে বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত হলাম। যিনি আমাদের পেশাগত মূল্যবোধ ও অন্যায় নির্মূলে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিলেন একজন অপরিসীম মানবদরদী হিসাবে। যা ছিল আল্লাহ্ পাকের বিশাল এক মহার্ঘ আমাদের জন্য। চলবে
বিষয়: বিবিধ
১৬৯৮ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সালাম রইল, অনেক ধন্যবাদ।
বরাবরের মত ভালোলাগা ও আগ্রহ নিয়ে সাথে থাকার জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার মূল্যবান সুন্দর উপস্থিতি ও গুরুত্বপূর্ণ প্রেরণাময় অনুভূতি ন্যায়ের পথে দৃঢ় রাখতে সাহস ও শক্তি যোগাবে ইনশাআল্লাহ।
সুন্দর অনুভূতি রেখে যাওয়ার জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
হৃদয়স্পর্শী দোয়ায় আমীন।
সীমিত ক্ষমতার অধিকারী বান্দাদের কে আল্লাহ বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করেন! 'ওসিলা' অনেক বড় নেয়ামত,যা আল্লাহ আপনাকে দিয়ে ছিলেন!
প্রকৃত বিশ্বাস আর আস্হা নিয়ে খোদার কাছে আবেদন করলে তিঁনি সব সময়ই সাহায্যের হাত সুপ্রসারিত করেন!
সাবলীল উপস্হাপনা আজকেই মুগ্ধ করল অনেক! জাযাকিল্লাহু খাইরাল জাযা-ই আবাদান!!
সুন্দর অনুভূতি রেখে যাওয়ার জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
থাকাকালীন ডাক্তারী প্রফেশনে জড়িত ছিলেন।
আপনার প্রাণপ্রিয় সভানেত্রী আমেরিকার কোথায়
থাকেন। এখানের জীবন খুব কঠিন। যদিও ব্যাক্তিগত প্রশ্ন। আশা করি কিছু মনে করবেন না। জীবনটাই পরীক্ষা, আল্লাহের তরফ থেকে।
বিপদে আল্লাহ ই বান্দাকে রক্ষা করেন।
ধন্যবাদ। সামনে আসব আবার আপনার ব্লগ বাড়ীতে। এখানে সুপ খাবার সুযোগ না থাকল্ওে সুপের মত মজা পা্ওয়া যায় আপনার লেখনি থেকে । ধন্যবাদ।
আমার ব্লগ বাড়ীতে আগাম আমন্ত্রণ। কিছু না হোক কমপক্ষে লিখনি থেকে সুপের স্বাদ পেলেই বা মন্দ কি?
রসালো মন্তব্যের সাথে প্রেরণা মেশানো মন্তব্যটি দারুণ লাগলো। সুন্দর অনুভূতি জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
সুন্দর প্রেরণাময় অনুভূতি রেখে যাওয়ার জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
আপনার জন্য অনেক অনেক দোয়া ও শুভেচ্ছা রইলো।
এমন পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখতে, অথবা অযাচিত ঝামেলায় না জড়াতে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ন্যায়ের পক্ষে না দাঁড়িয়ে বায়াজড হয়ে যান, কিন্তু আপনার ভাষ্যমতে স্যার আপনার সাথে থেকে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। এমন সব মানুষ অন্যদের জন্যো অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
অবশ্য আপনার মত প্রতিবাদী মানুষরা আছে বলেই কিছু সুখ্যাত ব্যক্তির বায়াজড হওয়ার সুযোগ থাকে না। উনার কৃতিত্বের পাশাপাশি আপনার কৃতিত্বও অনেক।
তবে আমি কায়মনোবাক্যে বিশ্বাস করি মহান রাব্বুল আলামীন আমাকে অনেক ভালোবাসেন এবং প্রতিমুহূর্তেই তিনি তাঁর অবারিত দয়ার সাগরে আমাকে ডুবিয়ে রাখেন। সেজন্যই আমি দৃঢ় চিত্তে লড়তে পেরেছি। স্যার যদি সেদিন আমাকে সাহস না যোগাতেন, সাহায্য সহযোগিতার হাত আন্তরিকভাবে প্রসারিত না করতেন তাহলে হয়তো অঙ্গুরেই আমি সমাধিস্থ হয়ে যেতাম। একজন উচ্চ পদস্থ মানুষের এই অমূল্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত আমাকে আজও অভিভূত করে।
এখানে আসলেই আমার কোন কৃতিত্ব নেই সবই সংঘটিত হয়েছে রবের ইশারায় এবং ইচ্ছায়। আল্লাহ্ পাক আমাদের সকলকেই ন্যায়ের পথে অবিচলিত রাখুন।
সাথে থাকার জন্য অনিঃশেষ দোয়া ও শুভকামনা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
অনেক দিন পর পড়লাম! তাই মন্তব্য ও দেরিতে দিলাম। লিখে যান আপনার মগজ গলানো লিখা হতে পারে কারো কারো জন্য এই লেখা জীবন চলার পথে পাথেয় হবে! আল্লাহ যাযা দিন আপনাকে সহ সবাইকে!
আপনার জন্য অনিঃশেষ দোয়া , শুভেচ্ছা এবং শুভকামনা রইলো।
বোনের জন্য বেশী বেশী করে দোয়া করার জন্য বিশেষ অনুরোধ থাকলো ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন