নিঃসঙ্গতায় মুগ্ধতা
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ১১ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৪:৩০:১৬ বিকাল
শ্রাবন্তী নও মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে যায় আবীরের। বুদ্ধিমতী, অপরূপ সুন্দরী আর সুঠামদেহী শ্রাবন্তীর কথা বলার ঢং অত্যন্ত চমৎকার যা তাকে ভীষণভাবে আকর্ষণ করে। আবীর আজকাল শ্রাবন্তীর সাথে সময় কাটানোর জন্য উতলা হয়ে উঠেছে। তার চক্ষু ও হৃদয় যেন সারাক্ষণ সেই মেয়েটির কাছে পরে থাকে। ক্লাস শেষে তাই আজ আর কোন ভনিতা না করে সরাসরি তার মনের ব্যাকুলতার কথা জানায় শ্রাবন্তীকে। উত্তরে মেয়েটি তার ধর্ম, সমাজ সংসার, পরিবেশ ও পড়ালেখার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রবল আপত্তি তোলে। তার সংসারে একমাত্র মা তাকে অনেক সংগ্রাম করে আজ তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাদপীঠে পৌঁছে দিয়েছে অনেক স্বপ্ন বুকে লালন করে। প্রথম মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়ার পরেই বাবা তার মাকে ফেলে অন্যত্র চলে যায়। মুখ ফিরে তাকায়নি কোনদিন তাদের সংসারের দিকে। অনাহারে অর্ধাহারে কেটেছে জীবন। তার মা কাপড় সেলাই করে চালিয়েছে সংসার। সে কোনভাবেই এই অভাগিনী মায়ের স্বপ্নকে ভূলুণ্ঠিত করবে না প্রতিজ্ঞা করে। হৃদয়ের আঁখি মেলে তার শৈশব, কৈশোরের বেদনাময় দিনগুলোকে সে স্মৃতিচারণ করে আরেকবার।
সবকিছু শুনে ক্ষণিকের জন্য আবীর স্তব্ধ হলেও আশাহত হয় না। বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে সর্বাবস্থায় পাশে থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। পড়াশুনার পাশাপাশি দিনে দিনে বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হতে থাকে। সময় দ্রুত গড়িয়ে যায়। তারপর একসময় দু’জনেই পড়াশুনা শেষ করে জীবনের তাগিদে ছোটে চাকুরীর খোঁজে। ছেলেটির একটি চাকুরী হলেও মেয়েটি তখনও বেকার। এমতাবস্থায় আবীরের ভালোবাসার প্রচণ্ডতায় মুগ্ধ হয়ে অবশেষে মাকে না জানিয়ে ধর্ম পরিবর্তন করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় শ্রাবন্তী। নিঃসন্দেহে এটি ছিল অনেক জটিল ও দুরূহ কাজ তার জন্য। তবুও ভালবাসার মানুষটির কাছে নিজেকে সপে দিতে আজ সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ছোটবেলা থেকেই নিয়তির উপর ভরসা ও নির্ভর করেই তো তার জীবনের পথচলা। তাই সমাজ, সামাজিকতা এবং মায়ের ভালোবাসা ও অনিচ্ছাকে গুরুত্ব না দিয়ে আবীরের ভালবাসাকে প্রাধান্য দিতে মনস্থির করে সে। কারণ পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই সে অন্তত একটি বিষয় লক্ষ্য করেছে তা হলো আবীরের প্রাঞ্জল ভালোবাসায় ভরা অনুগত অন্তর। এমন ভাবাদর্শের একটি ছেলেই ছিল তার কাঙ্ক্ষিত জীবনের একমাত্র সাধনা। যে তার সব ভাবনা, চিন্তা ও ইচ্ছাগুলোকে অনুভব করবে সন্মান করবে তার প্রতি সদয় বিশ্বাসী ভালোবাসার অনুরাগ থেকে।
চাকুরীর প্রয়োজনে বান্ধবীর বাড়ীতে বেশ কয়েকদিন থাকতে হবে এই কথা বলে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেয় শ্রাবন্তী। সেদিনেই বিয়ের ক্ষণে আয়েশা খাতুন নাম নির্বাচন করে বিবাহপর্ব সমাধা করেন কাজী সাহেব। নববধূরূপে ছেলের বাড়ীতে সে পদার্পণ করে অন্য এক জগতের মানুষ হয়ে। আজ সে মুসলমান নতুন এক অনুভূতি স্পন্দিত হচ্ছে তার হৃদয়ের গভীরে। আবীর ছোটবেলায় বাবা মা কে হারিয়ে বড় হয়েছে আপন ভাই ভাবীর কাছে। তাই বাবা মার অনুপস্থিতির কষ্ট আজ যেন বেশ স্পষ্ট বলে প্রতিভাত হচ্ছে। আয়েশা আগেই জানতো এসব তাই কিছুটা স্বস্তি-শান্তি আবার কিছুটা অজানা শঙ্কা ভীতি ও অপরাধবোধ যেন তাকে আছন্ন করে রাখছিল। সেইসাথে দুঃখী মায়ের মুখখানি বার বার ভেসে উঠছিল হৃদয়ে। ভীষণ খারাপ লাগছিল মায়ের কথা মনে করে। এভাবে মিশ্র অনুভূতিতে কয়েকদিন কেটে গেল। তারপর একদিন মায়ের কাছে ফিরে সব ঘটনা খুলে বলে ক্ষমা চেয়ে নেয় দুজনে। মা আহত হলেও স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে আবীরের সাথে।
কিছুদিন পর এক গভীর রাতে আয়েশার ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে পাশে আবীরকে না দেখে অপেক্ষা করতে থাকে তার জন্য। অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও আবীরের অনুপস্থিতি তাকে চিন্তিত করে তোলে। কী করবে কিছুই ভেবে পায় না সে। আয়েশা জানতো ভাসুর সাহেব বাড়ীতে থাকেন না। চাকুরীর কারণে তাকে থাকতে হয় অন্য একটি এলাকায়। তবে মাঝে মধ্যেই তিনি বাড়ীতে আসেন। একপর্যায়ে তাই ধীরে ধীরে ঘরের বাহিরে এসে দাঁড়ায় আয়েশা রাতের অন্ধকারে। হঠাৎ কানে ভেসে আসে ফিস ফিস আওয়াজে কথার বলার শব্দ। বিশ্বাস হয় না তার। হঠাৎ করে যেন বদলে যাচ্ছিল তার মনের মাধুরী মেশানো পৃথিবী। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছিল সে। বিস্তৃত পৃথিবী ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছিল। মূর্তির মত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে সে দরজার সামনে। কতক্ষণ এভাবে কেটে গেছে জানে না সে। হঠাৎ দরজা খোলার আলতো শব্দে সম্বিৎ ফিরে পায় সে। দুজনের মধ্যে চোখাচোখি হতেই ফ্যাকাসে বিবর্ণ হয়ে যায় আবীরের মুখ।
তারপর আবীরের মুখে সব ঘটনা শুনে পাথর হয়ে যায় আয়েশা। তার স্বপ্নের পৃথিবী দমকা হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যায় এক ঝাপটায়। অতল সমুদ্রে কোথাও যেন কোন কূল কিনারা নেই। মূহূর্তেই যেন পৃথিবীর সব আলো নিভে গেল তার সামনে থেকে। কোনভাবেই হিসেব মেলে না তার। বড়ভাবীর সাথে দীর্ঘদিন যাবত প্রণয়ের সম্পর্ক রেখে কেন আবীর তার সাথে এমন সুনিপুণ প্রেমের ভান করেছিল?! কেন বিয়ে করেছিল তাকে? প্রশ্নগুলোর উত্তর আবীর এড়িয়ে গেছে। উপরন্তু মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে আয়েশাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। অবশেষে আবীরকে ফেলে অজানা গন্তব্যে পা বাড়ায় আয়েশা। কোন বাধা দেয়নি আবীর।
দৃঢ়প্রত্যয়ী আয়েশা বেঁচে থাকার জন্য নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরু করে। বহুদিন যাবত নিঃসঙ্গ জীবনে নানা ধরনের দুঃখকষ্ট নিয়ে কেটে যাচ্ছে তার দিনগুলি। অতীত জীবনের সিদ্ধান্তকে বহুবার ঘৃণাভরে পুরাপুরি ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত করতে চেয়েছে সে কিন্তু আজো পারেনি। এটাই জীবনের পরীক্ষা ভেবে প্রাপ্য দণ্ড মাথা পেতে নিয়েছে আয়েশা। আপাতদৃষ্টিতে এগুলো শাস্তি মনে হলেও একান্তে সে প্রশান্তি অনুভব করে। আল্লাহ্ভীতি আজ তাকে অন্য এক ভূবনের মেহমান বানিয়ে দিয়েছে আলহামদুলিল্লাহ্। যেখানে পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্ব নেই, উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নেই, সুখ দুঃখের হিসেব নেই, কোন খ্যাতি বা ঐশ্বর্যের আকাঙ্ক্ষা মোহ নেই। মহান আল্লাহ্ পাকের অপার অফুরন্ত করুণাধারায় সে আজ সিক্ত পরিপূর্ণভাবে। রবের অপার ভালোবাসায় আজ তার নিঃসঙ্গ জীবন অনিঃশেষ মধুর মুগ্ধতায় সঙ্গময় হয়ে উঠেছে যেন...।
বিঃ দ্রঃ – সত্য ঘটনার আলোকে।
বিষয়: বিবিধ
১৪২৭ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
১ম দুই লাইন পড়ে মনেহল, ভালবাসার কাহিনী। তাই , অবরোধ এর পরে পড়ব ।
আপনার অভিভূত করা দোয়ায় আমীন।
আস সালামু আলাইকুম ওয়ারহমাতুল্লাহ....শ্রদ্ধেয়া আপুজ্বী!
মহান আল্লাহ যার ভাগ্যে প্রকৃত কল্যান লিখে রেখেছেন শত মুসিবত-পরিক্ষার পরে হলেও আসে তা!
আবীরদের মত মানুষদের জন্যে শুধুই ঘৃণা আর অপদস্থতা রয়েছে!!
ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহ....। শ্রদ্ধেয়া আপুজ্বী!
আপনাদের আন্তরিক মনোভাবের কারণেই ব্লগে এখনো আমার উপস্হিতি! কিছু শেখার আশায় রয়েছি!
আল্লাহ আপনাদের উপর প্রকৃত কল্যাণ সদা বর্ষণ করুন-এই দোয়া জানাই!!
যাহক, সবকিছুর পরেও যে মেয়েটা সত্যের সন্ধান পেয়েছে, আলাহামদুলিল্লাহ...
অনেক সুন্দর লিখাটিতে ভালোলাগা রেখে গেলাম।
আপপপু খুবই সুইট হোয়েছে লিখাটি
১০০% সহমত ।
আপনার মূল্যবান উপস্থিতির জন্য বারাকাল্লাহু ফিক। মনে হচ্ছে আমার অন্য একটি লিখার বিষয়বস্তুকে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে ভাইয়া!
মহান রাব্বুল আলামীন আপনাকে সর্বাবস্থায় ভালো রাখুন, সুস্থ রাখুন এবং দুনো জাহানের কামিয়াবী হাসিলের তৌফিক দিন এই প্রার্থনা রইলো।
জীবনের পরম প্রশান্তি লাভ বেশীরভাগ সময় চরম নেগেটিভ বিষয় থেকেই শুরু হয়। অনেক উন্নত উপমা। জীবন চলার পথে পরম অভিজ্ঞতা হিসেবে সবার কাজে লাগবে।
আপনার স্বতঃস্ফুর্ত উপস্থিতি ও গুরুত্বপূর্ণ মতামত মুগ্ধ করলো ভাইয়া।
দোয়া করবেন বোনের জন্য।
মূল্যবান অনুভূতি রেখে যাওয়ার জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর ভাইয়া।
মন্তব্য করতে লগইন করুন