একটি বর্ষণমূখর সন্ধ্যা এবং আমার মধুময় স্মৃতির পাখীরা
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ০৯ আগস্ট, ২০১৪, ০৫:১২:০০ বিকাল
একদিন প্রবল বর্ষণমূখর সন্ধ্যায় আমি যখন আমার ভাইবোনদের নিয়ে ঈদের পরিকল্পনায় ব্যস্ত ঠিক তখনই কানে ভেসে আসলো এক দরাজ গলার মিষ্টি মধুর অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর। মনের অজান্তেই অবিশ্বাস্যকরভাবে সেই সুরের ভাবাবেগ আমার হৃদয়তন্ত্রীকে নাড়িয়ে দিল। কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে দেখি এযে সত্যিই বাস্তব কল্পনা নয়। আমার প্রথম স্কুল জীবনের অতি শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক “হানিফ স্যার” তখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে। যিনি জ্ঞানে-গুণে, চিন্তা-চেতনায়, মন-মননে, সৎসাহসে, ন্যায়বোধে এবং পাহাড়সম নীতি-আদর্শের এক দ্বীপ্তিময় আলোকিত শিক্ষকের প্রতীক। আমি আনন্দে বিস্ময়ে তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই মানুষটি মুষলধার বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ছাতা মাথায় দিয়ে আজ আমাকে দেখতে এসেছে বহু বছর পর। লজ্জায় অপমানে কষ্টে নিজেকে ধিকৃত করলাম।
আমি তখন ঢাকায় থাকতাম। প্রায়ই মা’কে জিজ্ঞাসা করতাম আমার শিক্ষকদের ব্যাপারে। যাদের চরম আত্মত্যাগ, অপরিসীম দায়িত্ববোধ আর অনুপম স্নেহশীল সুদৃষ্টিভঙ্গির কারণে আজকের এই আমি। আমার জীবনের যেটুকু প্রাপ্তি বা অর্জন সম্ভব হয়েছে সেটা মূলতঃ পরিবারের পাশাপাশি এই গুরুজনদের অতুলনীয় অনুগ্রহ, সন্তুষ্টি, আনুকল্য, ও দূরদৃষ্টির কারণে। তাই মাঝে মাঝেই কিছু একটা করার অনেক চিন্তা মাথায় আসতো আমার প্রিয়ভাজন শিক্ষদেরকে নিয়ে। কিন্তু অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতা তা হতে দেয়নি কখনও। তাই সে ঈদে দায়সারাভাবে আমার বেশ কয়েকজন আদর্শ শিক্ষকদের জন্য ক্ষুদ্র কিছু উপহার সামগ্রী কিনেছিলাম। ঈদের ছুটি ছিল কম তাই বাধ্য হয়েই ভাইদের দ্বারা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম তাঁদের কাছে। পরে ওনার সহধর্মিণীর কাছে জানতে পেরেছি উনি সেটি পেয়ে আনন্দে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। পরের দিন নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদন করে তাই বেলাশেষে তিনি তাঁর হৃদয়ের অনুভূতিটুকু জানাতে এসেছিলেন আমার কাছে।
স্যারকে দেখে মনের অজান্তেই একে একে মনের রংধনুতে ভেসে উঠলো সেইসব মধুময় স্মৃতির পাখীরা। খুব ভোরে কেউ জেগে উঠার আগেই বকুল তলা থেকে তাজা ফুল কুড়িয়ে এনে মালা গেঁথে সাথে রাখা, পাকা আম-জাম কুড়ানো। মক্তবে গিয়ে আরবী শেখা। তারপর নাস্তা সেরে স্কুলের দিকে রওয়ানা দেয়া। সেখানেও কেটেছে ব্যস্ত মায়াময় মুহূর্ত। ক্লাস শুরুর প্রারম্ভে সারিবদ্ধভাবে সকলেই দু’কাতারে দাঁড়িয়ে যেত আর আমরা তিনজন দাঁড়াতাম মাঝখানে “জাতীয় সঙ্গীত” পরিবেশন করার জন্য। কী মনোরম সেই দৃশ্য। তারপর প্যারেড করতে করতে ক্লাস রুমে ঢুকে পড়া। সুন্দর সাম্য-ভ্রাতৃত্ব আর শৃঙ্খলার হৃদয় জুড়ানো দৃশ্য। তারপর ব্রেকে খেলাধুলা এবং বিনোদনমূলক আয়োজন। সাথে থাকতো মাসিক, ত্রয়মাসিক বাৎসরিক প্রতিযোগিতা।
খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ছিল আমার একচ্ছত্র দাপট। খেলাধুলা, গজল, কবিতা আবৃতিতে জুটতো একসাথে অনেক অনেক পুরুস্কার। একবার দেশের বাহিরেও অংশগ্রহণ করে ছয়টি প্রথম পুরুস্কার পেয়েছিলাম। এর পাশাপাশি পড়াশুনায় নিয়মিত ভাল ফলাফলের কারণে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা হতো আমার খালা সম্পর্কীয় সমবয়সী এক ক্লাসমেট ও আরেকজনের সাথে। সে এক বিশাল মধুর স্মৃতি। সেটা না হয় সময় হলে আরেকদিন শুনিয়ে দিব।
এসব ভাবতে ভাবতে মুহূর্তেই স্যারের কথায় সম্বিৎ ফিরে এলো সাথে হতাশা, আশঙ্কা, অনিশ্চয়তা আর অন্ধকারের গ্লানি। মনটা বেদনাহত হল ভীষণভাবে। এ কি শুনছি আমার প্রিয় স্কুলটির ব্যাপারে। স্যার এখন অবসরপ্রাপ্ত। তাই কষ্ট বয়ে বেড়ানো ছাড়া তাঁর আর কোন গত্যান্তর নেই। বড় অসহায় সে আজ বয়সের কাছে। তবুও ভিতরে প্রতিবাদের আগ্নেয়গিরির দাবানল। যার সংগ্রামী চেতনা, আত্মসন্মান ও ব্যক্তিত্ববোধ দৃঢ় হিমাচলসম। তাই চারিদিকে অধিকাংশ শিক্ষকদের চারিত্রিক ও নৈতিক অধঃপতনের বীভৎস অরুচিকর দৃশ্য তাঁকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। পাশে বসে ওনার হৃদয়ের আর্তনাদ কিছুটা হলেও আঁচ করতে পাচ্ছিলাম। সত্যিই জাতি আজ ধ্বংসের কিনারায়। পরিকল্পিতভাবে শিক্ষার নামে চলছে ধর্ষণবাজী, চাঁদাবাজি, জুলুমবাজি আর অপশিক্ষার মহড়া।
যারা মানুষকে জিম্মি করে মিথ্যার ঘোরে জীবিকা আহরণের পেশা বানিয়ে নিয়েছে। এসব স্বঘোষিত মাস্তানদের অনেক ক্ষমতা! তাদের সামনে প্রতিবাদ জানালেই জোটে লাশের মিছিল!! জাতি হিসাবে আজ আমরা কোথায়? করনীয় কি কিছুই নেই?!!! আমরা কি এভাবেই চেয়ে চেয়ে দেখবো?!!! নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলাম আমি। তাঁর নিজ হাতে গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে যারা ঐক্যের বদলে দলাদলি ভাঙ্গন, সহমর্মিতার পরিবর্তে অপমান, শান্তির বিপরীতে প্রতিহিংসার প্রতিযোগিতায় মত্ত তাদের কথা স্মরণে রেখে শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোর মন আজ ছিন্ন ভিন্ন অজানা এক অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কে। আমার প্রিয় স্যার সেদিন অনেক কষ্ট পেয়ে কাঁদলেন এবং কাঁদালেন অতীতের কিছু সুখ দুঃখময় স্মৃতি রোমন্থন করে।
স্কুল প্রাঙ্গন জুড়ে ছিল অনেক চিত্তাকর্ষক শিক্ষণীয় লিখা। যেমন ‘Knowledge is Power’ ‘ Man is Mortal’ ইত্যাদি। মনে হল সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে আমাদের মূল্যায়ন কেমন হওয়া উচিৎ? আমাদেরকে মরতে হবে এই সত্যটি আজ আমরা বেমালুম ভুলে গেছি। তাইতো নিশ্চিন্তে ডুবে আছি মহাপাপের অতল সমুদ্রে। “মানুষ মরণশীল” আমরা এই চির সত্য কথাটি কীভাবে ভুলে যাই?! মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে বলেছেন, “যখন মানুষের প্রাণ কণ্ঠনালীতে এসে পৌঁছায় তখন তারা অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে”। (সূরা বাকারাঃ ৮৪)
কিছুদিন পর মায়ের কাছে জানতে পেলাম সমস্ত কষ্ট যন্ত্রণা নিয়ে প্রতিবাদের আগুন ঝরানো মানুষটি অতি নীরবে নিভৃতে এক বুক অভিমান নিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। রেখে গেছেন সন্তানের মমতা দিয়ে নিজের হাতে তৈরি করা অগণিত সুযোগ্য স্নেহধন্য সুযোগ্য শিক্ষার্থী। যারা আজ নিজ নিজ ভূবণে আলো ছড়াচ্ছেন। সুপ্রিয় পাঠক আপনাদের কাছে বিনীত প্রার্থনা আপনারা সকলেই আমার শ্রদ্ধেয় এই প্রধান শিক্ষকের জন্য প্রাণভরে দোয়া করবেন। আল্লাহ্ যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করেন। আমীন।
বিষয়: বিবিধ
১৬৪৬ বার পঠিত, ৫৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বারবার একই ভুল...
তাইনেরা জেনো ব্লগার গো নামের পাশে একখান সাইনবোর্ড লাগাইয়া দেন যে- ইহা হইতাসেন গিয়া পুরুষ, আর ইহা হইলেন ললনা।। <:-P <:-P
দোয়া রইলো ভালো সব গত শিক্ষকদের জন্য ...
দোয়া রইলো আপনার জন্যও।
ছাত্র জীবনে তাঁর এক ছেলে ছিল আমার ক্লাস মেট। তার সাথে স্যারের বাসায় গিয়ে তাদের গরিবী হালত দেখে অবাক হয়েছিলাম। তারপরও তিনি ছাত্রদেরকে অতিরিক্ত সময় পড়িয়ে কোন টাকা দাবী করতেন না। আজকাল বেশীরভাগ শিক্ষক শিক্ষক নামের কলংক। তারা টাকা ছাড়া কিছুই বুঝেন না। নিজেদের নিকট প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করার জন্য ক্লাসে সঠিকভাবে পাঠদান করেন
আপনার শিক্ষকের জন্য দোয়া রইলো।
শিক্ষকের জন্য দোয়া রইলো
যখনই এই ধরনের লেখা ব্লগে পড়ি ভালো লাগলো ধন্যবাদ।
তাঁদের বেশিরভাগই আজ পৃথিবীতে নেই। আমি তাঁদের সকলের মাগফিরাতের জন্য আল্লাহ তায়ালার দরবারে ফরিয়াদ জানাই। আর যাঁরা জীবিত আছেন তাঁদের সার্বিক সুস্থতা এবং ঈমানী মৃত্যুর জন্য দোয়া করছি।
আমার এক বন্ধুর নাম হলো হানিফ।
খুব ভালো লাগলো খাম্মুনি অন্নেক শুকরিয়া।
মন্তব্য করতে লগইন করুন