মহিমান্বিত অমর কীর্তি
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ০৫ জুন, ২০১৪, ০৬:১৪:২৬ সন্ধ্যা
একজন নব্য ভূমিষ্টজাত শিশু নির্মল বিশুদ্ধ চিত্তে এই ধরাতলে আপনজনদের সান্নিধ্যে দয়া-মায়া, আদর-সোহাগ, স্নেহ-ভালবাসা, সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়নিষ্ঠতার জ্ঞানে পরিপূর্ণ আলোকিত এক মানুষ হয়ে বেড়ে উঠে, আর অপরদিকে কেউবা ছোট থেকেই বৈরী পরিবেশ-পরিপার্শ্বিকতায়, অন্যায়, অবহেলায় অশ্লীল রাজত্বে ডুবে থাকা পিতা-মাতার পাপাচার এবং অনৈতিক কার্যকলাপের আবহাওয়ায় অভ্যস্থ হয়ে এটাকেই স্বাভাবিক জীবন হিসাবে বেঁচে নেয়। ইতিহাসে তার অগণিত নজীর আছে। এক্ষেত্রে সম্রাট আলমগীর অবশ্যই সৌভাগ্যবান যে, তিনি উদার, ন্যায়বান, নম্র-ভদ্র, পরোপাকারী, দয়ালু ও আল্লাহ্ভীরু ন্যায়বিচারক একজন শাসক হিসাবে তাঁর প্রজাদের কাছে অতি আপনজন হিসাবে বিবেচিত হতে পেরেছেন। তারই একটি নমুনা এখানে পেশ করা হলঃ
বাদশাহ আলমগীর কর্তৃক প্রেরিত একজন মুসলমান সেনাপতির নেতৃত্বে একটি সৈন্যবাহিনীর দল একদিন পাঞ্জাবের এক পল্লবীর ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে হঠাৎ সেই গ্রামের এক ব্রাহ্মণের অপরূপা সুন্দরী মেয়ের প্রস্ফুটিত গোলাপের মত মুখশ্রী দেখে পাগল প্রায় লোভাতুর সেনাপতি তৎক্ষণাৎ তার পিতার কাছে কন্যাটিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। সেইসাথে তিনি এই সিদ্ধান্ত জারী করেন যে, আজ থেকে এক মাস পরেই তিনি তাঁর বাড়ীতে কন্যাটিকে বিবাহের উদ্দ্যশ্যে বর বেশে হাজির হবেন।
মেয়েটির বাবা ঘটনার আকস্মিকতায় হতচকিত হয়ে পড়েন। আসন্ন বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতির আশঙ্কায় দিশেহারা হয়ে শেষ পর্যন্ত সম্রাট আলমগীরের শরণাপন্ন হন। সম্রাটকে সম্ভাব্য বিপদের কথা জানিয়ে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করলেন। তিনি মনোযোগ দিয়ে সব শুনার পর মেয়েটির পিতাকে এ মর্মে আশ্বস্থ করে বললেন, “যাও, নিশ্চিন্তে বাড়ী ফিরে যাও। নির্দিষ্ট দিনে আমি তোমার বাড়ীতে উপস্থিত থাকব”। এ কথা শোনার পর ব্রাহ্মণ নানা আশা-নিরাশার দোলাচলে দুশ্চিন্তার ঝুঁকি নিয়ে বাড়ীর পথে পা বাড়ালেন। মাথায় তখন তাঁর বহুমুখী প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। সেইদিন সত্যিই কি সম্রাট স্বশরীরে আসবেন? না কি তাঁর পক্ষ থেকে অন্য কোন প্রতিনিধি পাঠাবেন? আর যদি সত্যি সত্যিই সম্রাট আসেন তাহলে নিশ্চয়ই তাঁর সাথে অনেক লোক-লস্কর, হাতি-ঘোড়াও থাকবে। তাহলে তাদের তিনি থাকতে দিবেন কোথায়? খাবারের ব্যবস্থাই বা করবেন কীভাবে? ইত্যাদি অনেক বিষয় তখন মনের মধ্যে উঁকি ঝুঁকি মারছিল। আর বিষয়গুলো নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত বোধ করলেন।
অবশেষে সকল জল্পনা-কল্পনা ও চিন্তার অবসান ঘটিয়ে বিবাহের পূর্বের দিন সম্রাট আলমগীর একাই ব্রাহ্মণের বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। ব্রাহ্মণ তো সম্রাটকে দেখে বাকরুদ্ধ, হতবাক! রাত্রির গভীরে আরও আশ্চর্য ও বিস্মিত হলেন! দরিদ্র ব্রাহ্মণের সেই জীর্ণ কুটীরের একটি কামরায় আল্লাহ্ভীরু মহৎপ্রাণ সম্রাট সারা রাত ইবাদত-বন্দেগী ও মোনাজাতে অশ্রু বিসর্জন করে কাটিয়ে দিলেন। তাঁর ক্রন্দন দেখে ব্রাহ্মণের পরিবার অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে ভাবতে লাগলেন, কেন তিনি কাঁদছেন? তাঁর কীসের অভাব? কিন্তু প্রশ্নের উত্তরগুলো তাঁদের অজানাই থেকে গেল। কেননা সম্রাটকে জিজ্ঞেস করার সাহস ও শক্তি কোনটিই তাঁদের হল না।
যাহোক, পরদিন যথাসময়ে মোঘল সেনাপতি বরের সাজে সুসজ্জিত হয়ে ব্রাহ্মণের ঘরে হাজির হয়ে বললেন, “বিবাহের পূর্বে আপনার কন্যাকে একবার দেখা উত্তম। আপনার কন্যা কোথায়”? পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী সম্রাটের শেখানো ভাষায় তাঁরা সম্রাটের কামরা দেখিয়ে দিলেন। আর বরবেশী সেনাপতি ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই দেখলেন খোলা তরবারি হাতে তার সামনে দণ্ডায়মান স্বয়ং সম্রাট আলমগীর। উত্তাল-উদ্ভ্রান্ত যৌবনের বুক ভরা আবেগ, স্বপ্নে বিভোর পুলকিত হৃদয়, মধুময় মাহেন্দ্র ক্ষণের জন্য চঞ্চল উদ্বেলিত চিত্ত আর মুখ ভরা হাসি এক মুহূর্তেই বিবর্ণ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। একদিন এই সেনাপতির প্রচণ্ড দাপটে শত্রুসৈন্যর আত্মা ভয়ে প্রকম্পিত হয়ে উঠতো এবং যার হৃদয়কে ভয়ভীতি বা দুর্বলতা কখনও স্পর্শ করেনি, আজ সে হৃদয় কাল বৈশাখী ঝড়ের ন্যায় অবিশ্বাস্য তাণ্ডবে ভীষণ শব্দ করে কেঁপে উঠল। প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় নিজেকে কোনরকম সামাল দিয়ে স্বাভাবিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করলেন বটে কিন্তু দুঃখ, লজ্জা, শাস্তি আর অপমানের আশঙ্কায় জ্ঞানহারা হয়ে বলিষ্ঠ দেহধারী সেনাপতি মাটিয়ে লুটিয়ে পড়লেন। এ অবিশ্বাস্যকর ও শ্বাসরুদ্ধ দৃশ্য দেখে কন্যার পিতা সম্রাট আলমগীরের সুবিচার, দায়িত্ববোধ আর অসাম্প্রদায়িক ভূমিকা দেখে আনন্দে অভিভূত রুদ্ধ প্রায় কণ্ঠে বললেন, “ আপনি আমার, বিশেষ করে আমার কন্যার ইজ্জত রক্ষা করেছেন। আপনার ঋণ অপরিশোধ্য”। সম্রাট ব্রাহ্মণকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আলিঙ্গন করে বললেন, “ভাই এ মহান দায়িত্ব আমার। আমি যে আমার দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে পেরেছি এতেই আমি ধন্য”।
আমাদের মাঝে সম্রাট আলমগীর আজ স্ব শরীরে নেই সত্যিই, কিন্তু তাঁর মহিমান্বিত অমর কীর্তি মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে আজও অনুরণিত হচ্ছে জনমানুষের প্রাণের স্পন্দনে, শিরা-উপশিরায় এবং ধমনীতে। তিনি মহত্বের মাধুর্যসহ বেঁচে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন লক্ষ কোটি মানুষের হৃদয়ে শ্রদ্ধায় এবং সম্মানে অভিষিক্ত হয়ে যুগ থেকে যুগান্তরে।
বিষয়: বিবিধ
১৬৯৪ বার পঠিত, ২৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কীবোর্ড
বিজয় ইউনিজয় ফোনেটিক ইংরেজি
নাম: সুর্যের পাশে হারিকেন
শাসন বেশি হয়নি - শ্রদ্ধেয়া আপু... আমি সবসময়ই এই শাসন আশা করি আমার শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় জনদের কাছথেকে।
সুন্দর দোয়ার জন্য অন্নেক অন্নেক খুশি হলাম। আপনার জন্যও প্রভুর কাছে দোয়া করছি, আল্লাহ্ যেন আপনার সকল যায়েজ ও মোবাহ্ ইচ্ছাগুলো পুরণ করে দেন। আমীন।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ আপু।
আমি কিন্তু আপু না!!
এটাই ছিলো আমাদের গর্বের ইতিহাস, সত্যিকার মুত্তাক্বী মুসলমান ন্যায়পরায়ন শাসকদের শাসন নীতি। এখনও আমারা অন্তর থেকে ভালোবাসি উনাদের। দোয়া করি প্রাণভরে।
অন্যদিকে.... বর্তমান যুগের (নামধারী-)মুসলমান শাসকদের দেখলে বুঝা যায়, কত নিচে নামতে পারে এ মুসলিম জাতী! হায় আল্লাহ্ বাচাও মুসলমানদের ঈমান, দান করো হেদায়ত, সাহস দাও তোমাকে ভালোবেসে তোমার কথামতো জীবনে পরিচালানার করতে পারার।
হায় আল্লাহ্ বাচাও মুসলমানদের ঈমান, দান করো হেদায়ত, সাহস দাও তোমাকে ভালোবেসে তোমার কথামতো জীবনে পরিচালানার করতে পারার। আমিন
মন্তব্য করতে লগইন করুন