“প্রিয় বাবা” আমার প্রেরণার পৃথিবী (শেষ-পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ২৪ এপ্রিল, ২০১৪, ০২:১৬:৪০ দুপুর
আমার বাবা বাড়ীতে ঢুকলে সবার মুখেই ঈদের মত আনন্দের আভা ফুটে উঠতো। মুহূর্তেই উৎসবমুখর সেই প্রাণের স্পন্দন ছড়িয়ে পড়তো চারিদিকে। ভরিয়ে উঠতো বাড়ীটা আদর আর সোহাগে। ওনার নিয়মিত অভ্যাস ছিল খাওয়ার টেবিলে বসে আমাদেরকে মুখে তুলে খাওয়ানো। সংসারে আমি প্রথম সন্তান হওয়ায় সবক্ষেত্রে আদরের ভাগটাও বেশী বরাদ্দ ছিল আমার জন্য। আমাদের গ্রামে তখন বৈদ্যুতিক সংযোগ ছিল না।
প্রায়ই ঘুমাতে গিয়ে গরমে ছটফট করে এপাশ ওপাশ করতাম। তারপর দেখতাম বাবা নিজের হাতে নকশী কারুকাজে সেলাই করা পাখা দিয়ে বাতাস করছে। নিষেধ করলে মৃদু শাসনের সুরে বলতেন ‘কথা না বলে ঘুমাও’ তারপর ঠাণ্ডা বাতাসের আরামে কখন ঘুমিয়ে যেতাম টেরই পেতাম না।
আমাদের বাড়ীর প্রচলন হোল কাজের লোকজনসহ একত্রে বসে খাওয়া। তাদের প্রতি সবসময় বাবার তীক্ষ্ণ নজর ছিল। তাদেরকে খুশী করতে মাঝে মধ্যে গল্পের আসর বসাতেন। নিজের পাশে বসিয়ে তাদেরকে তৃপ্তি সহকারে খাওয়াতেন। তারা বাবাকে অনেক পছন্দ করতো। বাবার উপদেশ পেয়ে ছোটবেলা থেকেই পরকালে জবাবদিহিতার ভয় আমাদেরকেও মানুষের প্রতি অনেক উদার আর মহৎ হতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। আমাদের বাড়ীতে যে রান্নাই হোক না কেন এক বাটি পাশের বাড়ীতে পাঠানোর রেওয়াজ ছিল। সে অভ্যাস আজও বিদ্যমান। আর বাড়ীতে যেদিন বিশেষ পিঠা পোলাও মাংসের আয়োজন হতো সেদিন বাবা পাশের বাড়ী থেকে মুরুব্বীদের ডেকে এনে একসাথে খেতেন। যদিও নিজে খুব পরিমিত আহারে অভ্যস্ত ছিলেন।
বিশেষ করে রমযান মাসটি ছিল আরও বর্ণিল অভিনব ব্যতিক্রম। এ মহান মাসটি আসার আগেই বাড়ীতে বিশাল প্রস্তুতি চলতো। সব কিছুছেই সাজ সাজ রব। ঘর দুয়ার কাপড় চোপড় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা করা। ঈদের নতুন কাপড়। ত্রিশ দিনে কি কি করা হবে? কীভাবে ইফতার বণ্টন হবে? সেহরির খাবার কে মসজিদে নিয়ে যাবে ইত্যাদি। কারণ মসজিদের ঈমামকে খাওয়ানোর দায়িত্ব ছিলো আমাদের। প্রতিটি নামাযের আযান এবং সেহরির সময় মাইকে প্রচারিত হতো। এসময় ইসলামিক গান-গজলও প্রচারিত হতো যে কালচার এখনো আছে। বাজারের পাশে আমাদের বাড়ী। বাড়ী থেকে প্রতিদিন ইফতারী পাঠানো হতো বাজারে। সেখানে অনেক মানুষ সমবেত হতো ইফতারির জন্য। হরেক রকম ইফতারিতে ভরে যেত সেই আসরটি।
বই পড়ে আর গল্প শুনে সেই অল্প বয়সেই বেশী বেশী করে ইবাদত করতাম যাতে প্রিয় নবী (সঃ) কে স্বপ্নে দেখতে পারি। কোরআন খতমের প্রতিযোগিতা চলতো বাড়ীতে। তাহাজ্জুদের নামায শেষে সাহরী খাওয়ার পর আমরা অনেকেই ঘুমাতাম না। নফল ইবাদত, আলোচনা আর কোরআন তেলওয়াত করতে করতে ফজরের মধুর আযান মাইকে ভেসে আসতো। আর সাথে সাথে সবাই নামাযে দাঁড়িয়ে যেতাম। এভাবেই চলছিল আমাদের পরিবারের স্বপ্নেভরা মধুময় সোনালী দিনগুলো।
এরপর একদিন জীবনের আকাশে নেমে এলো কালবৈশাখীর প্রচণ্ড ঝড় তুফান। সেই নির্মম নিষ্ঠুর অবিশ্বাস্য তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল আমাদের স্বপ্নের ভূবন। নিমিষেই সর্বগ্রাসী বিষাদের নোনা জলে বিষময় হয়ে উঠলো আমাদের স্বপ্ন সাধের স্বর্গীয় বাগান। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী স্বাধানীতা যুদ্ধ শুরু হলে এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই আমরা ভারতের এক নিকটাত্মীয়ের বাড়ীতে আশ্রয় নেই। আমাদের বাড়ী সীমান্তে হওয়ার কারণে যদিও এর দুরত্ব বেশী ছিল না। তাই যুদ্ধ শেষের পরপরই আমার বাবার সাথে গ্রামের অবস্থা সরেজমিনে স্বচক্ষে দেখার জন্য ছুটে যাই। গ্রামে প্রবেশ করে প্রথমে আমরা দু’জনেই বাকরুদ্ধ ও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি।
অসংখ্য মানুষের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন বিকট কংকালসার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। পুরো গ্রামটাই ছিল একটা ধ্বংসস্তূপ, শ্মশান, দুর্গন্ধযুক্ত ভূতুড়ে এলাকা। মুহূর্তেই মনে হোল সমস্ত পৃথিবীটা যেন আমার সামনে ঘুরছে। আমি মানসিকভাবে হতচকিত ও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লাম। বাবা আমার মানসিক অবস্থা টের পেয়ে শক্ত করে বললেন, সাহস হারালে চলবে না, আমাদের বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। আরও কতদূর যেতে হবে তাও ঠাওর করতে পারতে ছিলাম না। আর পারবোই বা কী করে?!! ঘটনার আকস্মিকতায় সবকিছুই তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। কারণ আমার বয়স তখন মাত্র এগার বছর।
বনজঙ্গল আর পোকা মাকড়ে ভরা পথে ভীতিপ্রদ মনে দুরু দুরু করে কিছুদূর এগোনোর পর আমাদের প্রাসাদসম বাড়ীর ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়লো। বুকের ভিতর অকস্মাৎ মোচড় দিয়ে ধরাক করে উঠলো। বাবার মুখের দিকে লক্ষ্য করলাম তিনি তখনও ধীর স্থির শান্ত। শুধু এটুকু বললেন এখন থেকে প্রতিদিন এখানে এসে ময়লা আবর্জনাগুলো পরিষ্কার করতে হবে। পরের দিন বাবা একাই বের হলেন, কারন তিনি সারা দিন এই দুর্ভেদ্য অরণ্য সামর্থ্য অনুযায়ী ধীরে ধীরে বসবাস যোগ্য করে তুলবেন এই আশায়। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস ফেরার পথে একটু রাস্তাচ্যুত হতেই পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরিত হলে সাথে সাথেই বাবার বাম পায়ের হাঁটু পর্যন্ত উড়ে যায়। বিকট আওয়াজের শব্দ শুনে গ্রামেরই আরেক লোক অলৌকিকভাবে সেখানে গিয়ে দেখে বেহুশ অবস্থায় বাবা পড়ে আছে। উনি তাড়াতাড়ি বাবার রক্তমাখা পা জামা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে কাঁধে তুলে নিয়ে আসেন।
সন্ধ্যার পরও বাবা না ফেরায় সবাই আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করে। এক পর্যায়ে বাবার রক্ত প্লাবিত দেহ উদ্ধার করে সাথে সাথেই আত্মীয় স্বজনদের সহযোগিতায় কুচবিহারের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর শুরু হয় জীবনের আরেক অধ্যায়। যা সিনেমা নাটককেও হার মানায়। আনন্দের বাতিঘর রূপ নেয় নিকষ আঁধারে। এক নিমিষেই সর্বস্ব হারিয়ে আমরা হয়ে যাই পথের ভিখারী। শুরু হয় গন্তব্য বিহীন অনিশ্চিত দুর্গম যাত্রা। কিন্তু এরপরও জীবনের বাঁকে বাঁকে রেল লাইনের মত আঁকা বাঁকা বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে কখনই দমে যাননি আমার বাবা মা। আমাদেরকে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে সত্যপ্রীতি, ন্যায়নীতি, সংযম ও ধৈর্য ধারণে উদ্বুদ্ধ করতেন।
বাবা অস্ত্রোপচার শেষে এক পা হারিয়ে সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরলেন বটে কিন্তু আমাদের হৃদয়ের গভীরে রক্তক্ষরণ হোত অবিরত, ক্ষত ক্রমাগত হতে লাগলো দগ দগে। লাঠিতে ভর করে চলাফেরা করতে বাবা খুউব কষ্ট পেতেন। বিশেষ করে টয়লেট ব্যবহার করার সময় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতেন। তিনি অন্তরমুখী চরিত্রের মানুষ ছিলেন তাই মা সাহায্যে এগিয়ে গেলে হাসিমুখে বলতেন, “ভেবো না আমি ঠিক আছি কয়েকদিন পর সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে ইনশা’আল্লাহ”। যে বাবা ছিলেন সুদর্শন, সুঠাম দেহী, কর্মঠ, নীরোগ তার এহেন কষ্টে কলিজাটা ছিঁড়ে খান খান হয়ে যেত। মনে হত নিজের পা’টা কেটে বাবার পায়ে জোড়া লাগিয়ে দিই। এ শূন্যতা কখনই পূরণ হবার নয়। মা প্রায় বলতেন টাকা থাকলে একটা প্লাস্টিকের পা লাগালে তোর বাবা আবার হাটতে পারতেন। বুকের ভিতর তুষের অনল দাউ দাউ করে জ্বলে। আজ সামর্থ্য আছে আলহামদুলিল্লাহ কিন্তু বাবা বেঁচে নেই। তাই বলি “দুঃখ যদি দাও হে প্রভু শক্তি দাও মোদের সহিবার”।
পরিবারে তখন রুজি রোজগারের জন্য কর্মক্ষম ব্যক্তি কেউ ছিল না। একমাত্র বাবা সে পঙ্গুত্ব বরণ করে অসহায় শিশুর মত ছটফট করতেন। সন্তানদের মুখে আহার না তুলে দেয়ার অসহনীয় যন্ত্রণার কষ্টে কুঁকড়ে মরছিলেন তিনি। কখনো দিনে একবার খাবার জুটেছে তো অন্য বেলায় আহারের কোন বন্দোবস্ত করা সম্ভব হয়নি। এভাবেই অর্ধাহারে অনাহারে কেটেছে কতোগুলো বছর। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে কাজেরও কোন সংস্থান ছিল না। আমার ছোট ভাই উদ্ভ্রান্ত পাগলের মত ঘুরে বেড়াতো কাজের খোঁজে। এরপরও মহান রাব্বুল আলামীনের অশেষ রহমতে পরিবারের মায়া মমতার অপূর্ব বন্ধনে বাবা মায়ের অভূতপূর্ব ধৈর্য, অপরিসীম ত্যাগ, সংযম এবং আত্ম বিশ্বাসের ছায়াতলে অনুভব করতাম মুক্তির অপেক্ষা।
ক্রমেই পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে লাগলো। এরপর বেঁচে থাকার সংগ্রামে নতুন উদ্যমে শুরু হল জীবন। আমার দাদার রাইস মিলের ধ্বংসাবশেষ গুলো তখনও ছিল অনেক মূল্যবান। সাথে ছিল আমার মায়ের অনেক মূল্যবান শখের স্বর্ণালঙ্কার। মায়ের কাছে গল্প শুনেছি আমার দাদী পরমা সুন্দরী ছিলেন। মুখাবয়ব, গাঁয়ে আলতা মিশানো রং, লম্বা ছিপ ছিপে এবং ঘন দীঘল কেশী ছিলেন। তাঁর চুল শুকানোর জন্য বাড়ীর ভিতর একটা পুরু তার টানানো ছিল। যখন উনি বধূ হয়ে প্রথম বাড়ীতে পদার্পণ করেন তখন পা থেকে মাথা পর্যন্ত উনাকে এত ভারী ভারী গহনা পড়ানো হয়েছিল যে উনি সেগুলোর ভারে হাটতে পারেননি। বয়সে অনেক ছোট ছিলেন বলে পালকি থেকে কোলে করে বাড়ীর ভিতরে নেয়া হয়েছিল। অলংকার গুলো যুদ্ধের আগে লোহার সিন্দুকে থরে থরে সাজানো ছিল। যাহোক পরবর্তীতে একে একে সেগুলো নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি করে আমাদের লালনপালন, পড়াশুনাসহ সমস্ত ব্যয়ভার সামলাতে হয়েছে।
পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে বাবার রেখে যাওয়া প্রেরণাস্পর্শে আমি ইংল্যান্ডে উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরি। তারপর ছেলের কারণে ২০০৫ সালে আবারও ইংল্যান্ডে এসে দীর্ঘ সময় ধরে এখানেই ব্যস্ততম জীবন কাটাচ্ছি। আমার অন্যান্য ভাইবোনও আল্লাহ্র রাব্বুল আলামীনের অপার মেহেরবাণীতে সবাই স্ব স্ব ভুবন নিয়ে সন্তুষ্ট আলহামদুলিল্লাহ্। অথচ যে মানুষটি প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার মাধ্যমে অমানুষিক পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদেরকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন, অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন আজ এই সুখের দিনে তিনি আমাদের পাশে নেই। জীবিতাবস্থায় কিছুই করতে পারিনি সবচেয়ে এই প্রিয় মানুষটির জন্য। যার কষ্ট প্রতিনিয়ত আমাকে ব্যথিত করে নীরবে নিভৃতে কাঁদায়। আমার প্রাণপ্রিয় বাবাসহ যে সকল বাবা চিরতরে চলে গেছেন আপনারা তাঁদের জন্য প্রাণভরে দোয়া করবেন মহামহিম প্রভু যেন তাঁদের সকলকেই জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করেন। আর পৃথিবীর সকল জীবিত বাবাদের প্রতি আমার বিনীত সশ্রদ্ধ ছালাম জানিয়ে তাঁদের সুস্থতা ও শান্তিময় জীবনের প্রত্যাশাটুকু পৌঁছে দেয়ার নিয়তেই মূলত আজকের এ লেখার অবতারণা। কোন সন্তানই যেন তার বাবাকে অসম্মান বা কষ্ট না দেয়, তাঁরা যেন বঞ্চিত না হয় তাঁদের প্রত্যাশিত প্রাপ্তিটুকু থেকে এই হোক আমাদের সকলের কামনা।
সুপ্রিয় সন্মানিত পাঠকের প্রতি আরেকটু ধৈর্য ধারণের অনুরোধসহ
আমাদের পরিবারের মূল প্রাণশক্তি ছিল আমার বাবা-মায়ের অপরিসীম প্রেম ভালোবাসাপূর্ণ গভীর ত্যাগ আর পারস্পারিক বিশ্বাসের মহত্বম খাঁটি আত্মিক সম্পর্কের মহামিলন। কঠিন বিপদের সময়ও তাদের মধ্যে দেখেছি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস, আল্লাহ্র প্রতি অগাধ আস্থা অবিচলতা আর ইস্পাত কঠিন ধৈর্য। কোনকিছুতেই তাঁদের মনোবল ভেঙ্গে পড়তে দেখিনি। নিকটাত্মীয়সহ পরিবারের সবাই সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে বিপদ মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়তো অদম্য স্পৃহায়। তাই কেন জানি কষ্টের দিনগুলিও ত্যাগের মহিমায় সগৌরবে দীপ্তি ছড়াতো। সবার মহানুভবতা আর হৃদয়ের নিবিড় আলিঙ্গনে সব কষ্ট নিমিষেই দূর হয়ে মন প্রাণ অবর্ণনীয় শান্তির আবেশে জুড়িয়ে যেত। এসব গুণের কারণে আজও আমাদের পরিবারকে বলা হয় উত্তম আদর্শ পরিবার। আমার বাবার মানবীয় গুনের অনুপ্রেরণামূলক অমূল্য রত্ন ভাণ্ডার আজও আমাদেরকে উদ্যমী হতে শক্তি যোগায়। আমার পূন্যময়ী মা তাই বাবার অবর্তমানে মহব্বতের ডানা বিছিয়ে সবাইকে সযতনে আজও আগলিয়ে রেখেছেন।
এই তো মনে হয় সেদিনের কথা, আমি তখন সরকারী চাকুরীরত অবস্থায় সাবেক পি জি হাসপাতালে কর্মরত থাকার সুবাদে ক্যাম্পাসেই পরিবারসহ ছিলাম। বাড়ী থেকে সংবাদ আসলো যে বাবা হঠাৎ অসুস্থ বোধ করায় তাকে রংপুর হাসপাতালে নেয়া হয়েছে এবং সেখানেই বর্তমানে চিকিৎসাধীন। আমার ছোট বোন তখন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যাম্পাসেই থাকতো। আর আমার ইমিডিয়েট ছোট ভাই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ণরত। আমি কাল বিলম্ব না করে আমার পরিবার ও ছোট ভাইসহ রংপুরে ছুটে গেলাম। তখন আমাদের সংসারে ছিল একমাত্র পুত্র সন্তান। আমার বাবা নাতীকে দেখে মুহূর্তেই সমস্ত রোগ যন্ত্রণা ভুলে বিছানায় শুয়েই তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন।
এরপর একে একে সবার কুশলাদি জেনে নিলেন। আমি তখন আমার বাবার মাথায় ও শরীরে হাত বুলিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ তিনি আমার হাত দু’খানি বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে কিছু উপদেশ দিলেন। আমার দু’চোখ বেয়ে তখন দর দর করে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। হঠাৎ দেখি বাবা অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। পরে দ্রুত অচেতন অবস্থায় তাঁকে রংপুর থেকে পি জি হাসপাতালে নিয়ে এসে সবার সার্বিক সহযোগিতায় কেবিনে ভর্তি করানো হোল। চিকিৎসার এক পর্যায়ে বাবা চোখ মেলে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন “আমি এখন কোথায়”? বললাম আপনি এখন পি, জি হাসপাতালে। আমার মায়ের সাথে কথা বললেন। এরপর তরল জাতীয় খাবার খেলেন। আমরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। অথচ একদিন পর আবার অচেতন হয়ে গেলেন। তারপর একে একে পাঁচদিন অজ্ঞান অবস্থায় থেকে আমাদের সকলের মায়া মমতার বন্ধন ত্যাগ করে চলে গেলেন তাঁর আপন ভূবনে!
সোনার চামচ মুখে দিয়ে যে মহৎপ্রাণ মানুষটির আগমন ঘটেছিল এ ধরায় কোন এক শুভক্ষণে মনুষ্যত্ববোধ সঞ্চারিত করার জন্য, অশ্রু প্লাবিত বিদায়ের শেষ ক্ষণে সেই নিঃস্ব নবাব সিরাজদ্দৌলার প্রাণহীন নিথর দেহ নিয়ে আমরা চলেছি তখন গ্রামের পথে। গভীর রাত্রিতে টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল। সারা রাতের যাত্রা পথে কেবলি মনে হচ্ছিল সমস্ত প্রকৃতি যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমার মমতাময়ী মা সহ অন্যান্য সদস্যরা তখন নিবিষ্ট চিত্তে তাসবীহ জপছি। প্রত্যূষে বাড়ীতে পৌঁছে দেখি ব্যাকুল ব্যথিত হৃদয়ে প্রতীক্ষারত অগণিত মানুষ। মৃত্যু সংবাদ পৌঁছার সাথে সাথে রাতেই মাইকে জানানো হয়েছিলো গ্রামবাসীকে। চারিদিক লোকে লোকারণ্য তিল ধারণের ঠাই নেই। উপস্থিত সকলকেই শোক সাগরে ভাসিয়ে আমার বাবা শেষ বিদায় নিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। শায়িত হলেন অন্তিম চিরনিদ্রায় আমাদেরকে নিদ্রাহীন ব্যথাতুর রেখে।
বিষয়ঃ contest_father
বিষয়: বিবিধ
২০৫৮ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন