“প্রিয় বাবা” আমার প্রেরণার পৃথিবী পর্ব-২
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ২৩ এপ্রিল, ২০১৪, ১১:৫০:২১ রাত
মানবপ্রেমের জন্য আমার বাবা জীবদ্দশায় তাই সর্বস্তরের মানুষের হৃদয় প্লাবিত অকুণ্ঠ সমর্থন, সম্মান আর উজাড় করা প্রাণঢালা ভালবাসায় অভিসিক্ত হয়েছেন প্রতিটি মুহূর্তে। অন্যায়ের প্রশ্নে তিনি ছিলেন সর্বদা আপোষহীন, অবিচল, দৃঢ় প্রত্যয়ী এক অতন্দ্র প্রহরী। পরিবারের প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসাকে উপেক্ষা করতে না পেরে এক পর্যায়ে নিজেকে জড়িয়েছিলেন গ্রামীণ রাজনীতিতে। যদিও বিশুদ্ধ রাজনৈতিক চর্চা সেকালেও ছিল অনুপস্থিত। এজন্য আমাদের পরিবারকে চরম মূল্য দিতে হলেও বাবার প্রতি সাধারণ মানুষের ভালবাসা বা সম্মানের কমতি কখনই ছিল না, আজও নেই আলহামদুলিল্লাহ। সমস্ত কূটকৌশল, ঘৃণ্য অপবাদ আর ষড়যন্ত্রকে অসীম ধৈর্য, সাহস আর অপ্রতিরোধ্য চিত্তে মোকাবিলা করে বিশাল ব্যবধানে পর পর তিনবার স্থানীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন।
আমরা ভাই-বোনেরা মহৎপ্রাণ দানশীল সংগ্রামী একজন বাবা পেয়ে সত্যিই ধন্য এবং গর্বিত। বাবার আদর্শ, সত্যবাদিতা, ন্যায়নীতিবোধ, পরমতসহিষ্ণুতার মূর্ত চেতনাগুলো আজও আমাদেরকে সুনিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করে, ভাবায়, নিভৃতে কাঁদায়, অনুপ্রাণিত করে। তিনি ছিলেন ক্ষমাশীল ত্যাগী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিচক্ষণ ব্যক্তি। অবলীলাক্রমে শত্রুকে অশেষ ক্ষমায় আপণ করে নিতেন। বলতেন এরাতো আমারই চাচা কিংবা মামা আমারই আপনজন। আমরা তো একই গ্রামে বসবাস করি। রাত পোহালেই একে অন্যের মুখ দেখতে হবে। যারা এসব করছে আমার বিশ্বাস তারা না বুঝেই করছে কিংবা কারও প্ররোচণায় করছে। একদিন তারা নিজেদের ভুল নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে। এমনিভাবে শত্রুরা একসময় তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতেন এবং বাড়িয়ে দিতেন অবারিত বন্ধুত্বের হাত।
আমার বাবা আমার কাছে সবসময়ই একটু অন্যরকম, একেবারেই আলাদা ব্যতিক্রমধর্মী এক মানুষ। যার জন্য কোন বিশেষণই আমার কাছে মানানসই বা মনোঃপুত হয় না। কোন মনোহরী শব্দ সম্ভার বা বাক্য চয়ন তাঁর আসল কর্মগাঁথা কারুকার্যময় জীবনকে অবিকলভাবে চিত্রিত করে না। আর স্বল্প পরিসরে তা সম্ভবও নয়। মনে হয় তার বিশাল জীবনের এক বালুকণার সমানও বলা হোল না। মনটা বরাবরই অতৃপ্ত থেকে যায়। তাই বলি “প্রিয় বাবা তোমার তুলনা শুধুই তুমি”।
বোধ হওয়ার পর থেকেই বাবার অসীম ধৈর্যশক্তি দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি। আমার বড় ফুফু ছিলেন অনেক আদুরে, আবেগী ও অভিমানী। প্রায়ই দেখতাম অতি ক্ষুদ্র কারণে ছেলেমানুষি করে নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিতেন। বাড়ীতে ফিরে বাবা নিয়মিত ওনার পরম পূজনীয়া দাদী, মাসহ একে একে সবার খবর নিতেন। যখন শুনতেন তাঁর অতি আদরের বোনটি না খেয়ে শুয়ে আছেন, তখনই তিনি তাঁর কাছে ছুটে যেতেন। অভিমান ভাঙাতে অনেক লম্বা সময় ব্যয় করতে হতো তাঁকে। দীর্ঘ সময়ে অন্যদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটলেও আমার বাবা বলতেন আমার বোনকে না খাইয়ে আমি কি খেতে পারি? আমরা অনেক সময় ফুফুকে এই বলে ক্ষ্যাপাতাম যে উনি ভাইয়ের আদর পাওয়ার জন্যই মূলত এরূপ করেন! পরবর্তীতে আমার বাবার অবর্তমানে স্মৃতি রোমন্থন করে এই ফুফু প্রায়ই কান্নায় ভেঙে পড়তেন।
আমার বাবা-মায়ের মধ্যে বিরাজিত ছিল স্বর্গীয় ভালবাসাপূর্ণ এক অদ্ভুদ প্রেমময় দাম্পত্য জীবন। বাড়ীতে কাজের লোক থাকা সত্বেও মায়ের কাজে সহযোগিতা করার জন্য আমার বাবা সবসময়ই অতি আগ্রহে মুখিয়ে থাকতেন। বিশেষ করে সকালের নাস্তার সময় মা যখন রুটি বানাতেন বাবা তখন চুলার পাশে বসে সেঁকে দিতেন। সংসারের বড় বউ হিসাবে বিশাল দায়িত্বভার ও সন্তান-সন্ততির লালন পালনকালে আমার মা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। আমার বাবার অস্থিরতা উদ্বিগ্নতা আর দরদ মাখা সেবার অভাবনীয় অতুলনীয় দৃশ্য আমরা আজও ভুলতে পারি না। আমার স্নেহময়ী মা পরম গৌরবে নিকটাত্মীয়দের কাছে বাবার এসব গুণাবলীর প্রশংসা করতেন হরহামেশাই।
গরীব আত্মীয় স্বজনদের কেউ কেউ আমাদের বাড়ীতে থেকে লেখাপড়া সম্পন্ন করেছেন। সমাজে তাদের মধ্যে আজ অনেকেই উচ্চপদস্থ সুপ্রতিষ্ঠিত। কালের পথ পরিক্রমায় পরবর্তীতে অনেকেই আমাদের দুর্দিনে নিরাপদ আশ্রয় ও শান্তির সুশীতল ছায়া হয়ে পাশে থাকতে সচেষ্ট ছিলেন। বাবা তাদেরকে প্রচণ্ড ভালবাসতেন তবে স্বভাবসিদ্ধভাবেই অন্যের আর্থিক সাহায্য গ্রহণকে ভীষণ অপছন্দ করতেন। উনি আমাদের দানের হাতকে প্রসারিত ও উৎসাহী করতে প্রায়ই বলতেন, যারা দান করে তাদের হাত থাকে উপরে, আর যারা গ্রহন করে তাদের হাত থাকে নীচে। এটা অবশ্যই আমাদের স্মরণে রাখা উচিৎ।
তিনি পড়তে ভীষণ ভালবাসতেন। অনেক বিষয়েই ওনার জ্ঞানের গভীরতা ছিল বিস্ময়কর। বিভিন্ন রকমের বই দিয়ে গচ্ছিতাকারে সযত্নে সাজানো ছিল ঘরের দেয়াল। সে সময় গ্রামে টি ভি না থাকায় নিয়মিত রেডিও শুনতেন ও খবরের কাগজ পড়তেন। কিন্তু আমাদের গ্রামে সেসময় একদিন পর খবরের কাগজ পৌঁছাত। আমার বাবা চাতক পাখীর ন্যায় বসে থাকতেন সেই কাগজটি পাবার আশায়! হাতে পাওয়ার সাথে সাথেই অধীর আগ্রহে পড়ায় মনযোগী হতেন। তারপর গুরুত্বপূর্ণ সংবাদগুলো বাড়ীর সদস্যদের সাথে শেয়ার করতেন। বাবা প্রায়ই আমাদেরকে শিক্ষামূলক আদর্শিক গল্প শোনাতেন।
একদিন বললেন এক লোকের সুন্দর জুতার অনেক শখ ছিল সেটা পূর্ণ করতে না পারায় তার মনে ছিল অনেক দুঃখ। সে লোকটি একদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ চোখে পড়লো একটি লোকের দু’টি পা না থাকায় পরম আনন্দে হাতে ভর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে। আর তা দেখে নিমিষেই তার মধ্যে অনুশোচনা বোধ হলো যে আমার জুতা নেই তাই এতো কষ্ট আর এই লোকটির তো দু’পায়েই নেই। এই ভেবে তার সব মনের কষ্ট মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল। বাবার সাথে আমাদের সব ভাইবোনদের সম্পর্ক ছিল হৃদ্যতাপূর্ণ বন্ধুসুলভ। যদিও মনের কোণে অজান্তে একটুখানি ভয় লুকিয়ে থাকতো। বাবার ব্যক্তিত্ব, গাম্ভীর্যপূর্ণ অভিব্যক্তি কথা বলার মাধুর্য ও উপস্থাপনায় আমি বিস্ময়ে অভিভূত হতাম। তাঁর সুমিষ্ট দরদী শান্তনার বাণীতে বিপদগ্রস্ত মানুষ গভীর সঙ্কটাপন্ন মুহূর্তেও নিঃশঙ্কচিত্তে হালকা প্রাণে অনেক আস্থা শক্তি আর শান্তি খুঁজে পেতেন।
আমার বাবার লেখার হাত ছিল চমৎকার। উনি সময় পেলেই যেমন জ্ঞানগর্ভ এবং বিনোদন মূলক আলোচনা জমিয়ে তুলতেন, ঠিক তেমনি একটু অবসর এলেই লিখতে বসতেন। তাঁর অনেক প্রাণস্পর্শী অসাধারণ লেখার সাথে আমাদের পরিচয় ছিল অনেক ছোটবেলাই। তবে কিছু লেখা অনেক দুর্বোধ্য ঠেকতো, সেগুলোর মর্মার্থ উদ্ধার করা ছিল অনেক কঠিন কাজ। বাবার লেখার প্রতি আমাদের এক অপ্রতিরোধ্য মোহ আর আকর্ষণ থাকায় ওনার নিজের হাতের লেখাগুলো ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার এক অভিনব প্রতিযোগিতা ছিল আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে। যার একটি লেখা ৪৫ বছর পর আজও আমার সংগ্রহে আছে।
চলবে......।
বিষয়ঃ contest_father
বিষয়: বিবিধ
১৩৮৭ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে লগইন করুন