হযরত ইমাম বোখারী (রহঃ) এর অজানা কথা
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ১২ মার্চ, ২০১৪, ০৮:৩৮:১৭ রাত
হাদীস শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠতম মানব হযরত ইমাম বোখারী (রহঃ) এর পুরা নাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহীম ইবনে মুগীরা আল বোখারী। তাঁর ডাক নাম আবু আবদুল্লাহ। মুসলিম জাহানের এক অদ্বিতীয় সাধক পুরুষ, বিশ্ববরেণ্য মহা মনীষী হযরত ইমাম বোখারী (রহঃ) মুসলিম অধ্যুষিত এবং ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির লীলাভূমি উজবেকিস্থানের বোখারা নগরীতে ১৯৪ হিজরীর ১৩ই শাওয়াল জুমআর দিন নামাযের পর জন্মগ্রহণ করেন। তখন আব্বাসী খেলাফতের আমল ছিল। সে যুগে বোখারা নগরী আব্বাসী খলিফাদের শাসনাধীন ছিল। তাঁর পূর্বপুরুষ ইরানের অধিবাসী। পিতার নাম ছিল ইসমাঈল।
তিনি বোখারা নগরে জন্ম গ্রহণ করার কারণেই এই পবিত্র জায়গাটি মুসলিম জাহানের প্রায় সকল মানুষের নিকট অতি পরিচিত। হযরত ইমাম বোখারী (রহঃ) শিশুকাল থেকে এই নগরীতেই লালিত পালিত হয়েছেন। হাদীস জগতে তিনি মোমেনীন উপাধিতে ভূষিত হন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন বিশিষ্ট মুহাদ্দিস, খোদাভীরু ও ন্যায় পরায়ণ ব্যক্তি। পৈতৃক সূত্রে প্রচুর ধন-সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভোগ বিলাস এবং লোভ লালসাকে ঘৃণা করতেন। তাই তিনি তাঁর পৈতৃক ধন-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দান করে দেন। সম্পদের প্রতি তিনি নির্মোহ ছিলেন তাই বিলাসিতা কখনো তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি।
দৈহিক গঠন ও আকৃতি
ইমাম বোখারী (রহঃ) এর দৈহিক গঠন ছিল হালকা পাতলা। তিনি খুব লম্বা বা বেঁটে ছিলেন না, বরং মাঝামাঝি ধরনের ছিলেন। তিনি খুব কম খেতেন। তিনি ছিলেন দরবেশ প্রকৃতির লোক, আবেদ জাহেদ। শাগরেদদের প্রতি ছিলেন খুবই মহানুভব, দয়ালু এবং সাধারণ লোকদের প্রতি ছিলেন দানশীল।
শৈশব এবং শিক্ষা জীবন
হযরত ইমাম বোখারী (রহঃ) এর শৈশবেই পিতৃবিয়োগ ঘটে। তাই বাল্যকালেই পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হলে তাঁর মমতাময়ী মা তাঁর লালনপালন ও প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। স্নেহময়ী মাতার আদর্শিক তত্ত্বাবধানে ইমাম বোখারী (রহঃ) লালিত পালিত হতে থাকেন। তিনি মায়ের অনুপ্রেরণায় স্থানীয় শিক্ষাঙ্গনে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ এবং কুরআন শরীফ মুখস্থ করেন। হাদিস শিক্ষায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত আগ্রহী। যেন তাঁর সৃষ্টিই হয়েছিল হাদিসের জন্য। মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মোবারকের সব কিতাব মুখস্থ করেন। তখন থেকে তাঁর মনে হাদীসচর্চার এক অদম্য স্পৃহা জাগ্রত হয়। তিনি নিজেই বলেন, আমার বয়স যখন দশ বছর তখন আমি হাদিস চর্চার প্রতি অনুপ্রাণিত হই।
বিস্ময়কর স্মৃতি শক্তি
শৈশবেই তাঁর অদ্ভুত তীক্ষ্ণ মেধা এবং স্মরণ শক্তি সবাইকে আনন্দে উদ্বেলিত ও বিস্মিত করে। মাত্র দশ বছর বয়সেই তিনি সনদসহ কয়েক হাজার হাদীস মুখস্থ করে ফেলেন। অথচ হাদীস মুখস্থ করা কোরআন মুখস্থ করার মত ব্যাপার নয়। কেননা হাদীসের মধ্যে শুধু মতন বা বিষয়বস্তুই নয়, বরং সনদ বা বর্ণনা সূত্রেরও সুবিশাল ধারাবাহিকতা রয়েছে। আর হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ নাম একটার সাথে আরেকটার পার্থক্য সহ মুখস্থ করে ধরে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু ইমাম বুখারীর পক্ষে এটাও একেবারে সহজসাধ্য ছিল। মুহাম্মদ ইবনে হামদুওয়ায়হ (রহঃ) তাঁর বর্ণনায় বলেন, আমি ইমাম বোখারী (রহঃ) কে বলতে শুনেছি; আমি এক লক্ষ সহীহ হাদীস এবং দু’লক্ষ গায়রে হাদীস মুখস্থ করেছি। অন্য বর্ণনা মতে, তিনি ছয় লক্ষ হাদীসের হাফেজ ছিলেন।
তাঁর ছোটবেলার একটি ঘটনা অত্যন্ত চমকপ্রদ। তখন তিনি দশ বছরের কিশোর। তখন তৎকালীন বোখারা নগরে সে যুগের এক খ্যাতিমান মুহাদ্দিস দাখেলীর শিক্ষাঙ্গনে হাদীসের পাঠ নেয়ার জন্য তিনি নিয়মিত অংশ গ্রহণ করছিলেন। একদিন ইমাম দাখেলী একটি হাদীস সনদ সহকারে শুনালেন (আরবি আয়াত ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২) ‘সুফিয়ান আবু যোবাইর থেকে এবং তিনি ইবরাহীম থেকে বর্ণনা করেছেন’। তখন ইমাম বোখারী (রহঃ) প্রতিবাদ করলেন। তিনি বললেন আবু যোবাইর তো ইবরাহীম থেকে বর্ণনা করেননি। ইমাম দাখেলী তাঁকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন। তবুও তিনি না থেমে ওস্তাদকে বললেন, মেহেরবানী করে আপনার বক্তব্যটি একবার মূল পাণ্ডুলিপির সাথে মিলিয়ে দেখুন। তিনি অতিরিক্ত জোর দেয়ার কারণে উস্তাদের মনে সংশয় দেখা দিল। তিনি ভিতরে গিয়ে মূল পাণ্ডুলিপির সাথে মিলিয়ে দেখলেন, তাঁর ভুল হয়েছে। তাই তিনি ফিরে এসে ইমাম বোখারী (রহঃ) কে বললেন, তাহলে তুমিই বল সনদটি কেমন হবে? ইমাম বোখারী (রহঃ) উত্তরে বললেনঃ ইবরাহীম থেকে আবু যোবাইর নয়, আদীর পুত্র যোবাইর বর্ণনা করেছেন। তখন উস্তাদ দাখেলী সংগে সংগেই কলম নিয়ে তাঁর সামনের মূল কপিটি সংশোধন করে নিলেন এবং বললেন, তোমার কথাই ঠিক।
শিক্ষায়তনের উপস্থিত অন্যান্য সকলেই হাদীস লেখার প্রতি চরম গুরুত্বারোপ করলেও ইমাম বোখারী (রহঃ) লেখার দিকে মোটেও লক্ষ্য করতেন না। এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর কেউ কেউ তাঁকে ঠাট্টা তিরস্কারের স্বরে বললেন, তুমি যখন হাদীস লিখছ না তাহলে অনর্থক সময় নষ্ট করে লাভ কি? উত্তরে তিনি বললেন, আচ্ছা, তাহলে তোমরা যে সমস্ত হাদীস লেখেছ প্রত্যেকেই তার এককপি করে হাতে নাও এবং সমস্ত হাদীস শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার কাছ থেকে শুনে নিজ নিজ কপি সংশোধন করে নাও। উল্লিখিত ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়, অতুলনীয় স্মৃতি শক্তির অধিকারী ইমাম বোখারী (রহঃ) কে আল্লাহ তা’আলা ইলমের হাদীসের জন্যই সৃষ্টি করেছিলেন। ইমাম মুসলিম (রহঃ) তাঁর সম্পর্কে বলেন, হে ইমাম! হিংসুক ছাড়া কেউ আপনার সাথে দুশমনী করতে পারে না। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, দুনিয়াতে হাদীস শাস্ত্রে আপনার সমতুল্য আর কেহ নেই।
ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক ইবনে কুজাইমা (রহঃ) বলেন, আসমানের নীচে আমি মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বোখারী (রহঃ) হতে রাসুল (সাঃ) এর হাদীস সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী ব্যক্তি আর কাউকে দেখতে পাইনি।
হাদীস শাস্ত্রে অমূল্য অবদান
ইমাম বোখারী (রহঃ) বোখারী শরীফ ছাড়াও অনেক গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। উল্লেখযোগ্য কিতাবগুলো হচ্ছেঃ আদাবুল মুফরাদ, রফউল ইয়াদাইন, কেরাআত খালফাল ইমাম, বিবরুল ওয়ালিদাইন, তারীখে কবীর, তারীখে সগীর, তারীখে আওসাত, খালকে আফআলুল ইবাদ, কিতাবু দদোআ’, জামেউল কবীর, মুসনাদুল কবীর, কিতাবুল আশরেরাহ, কিতাবুল হেবা, আসমাউস সাহাবা, কিতাবুল ইলাল, কিতাবুল বিজদান, কিতাবুল মাবসুত। মূলত ইমাম বোখারী (রহঃ) এলমে হাদীসের খেদমতেই নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
ইমাম বোখারী (রহঃ) ছিলেন অনুপম চরিত্রের অধিকারী, অত্যন্ত খোদাভীরু। তাঁর সততা ও বিশ্বস্ততা জনশ্রুতিতে পরিণত হয়েছিল। এ সম্পর্কে তাঁর ছাত্র জীবনের একটি বিস্ময়কর ঘটনা উল্লেখযোগ্য। একবার তিনি এক হাজার স্বর্ণ মুদ্রা সংগে নিয়ে সমুদ্র পথে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে সাধুবেশী এক প্রতারক ইমাম বোখারী (রহঃ) এর সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং এক পর্যায়ে তাঁর রক্ষিত স্বর্ণ মুদ্রার কথা জেনে ফেলে। লোকটি ইমাম সাহেব থেকে স্বর্ণ মুদ্রা নেয়ার জন্য হঠাৎ ঘুম থেকে সজোরে চিৎকার দিয়ে বলতে থাকে, আমার এক হাজার স্বর্ণ মুদ্রা চুরি হয়ে গেছে। ফলে জাহাজে এক চাঞ্চল্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। ইমাম বোখারী (রহঃ) লোকটির ধূর্ততা ও দুরভিসন্ধি বুঝতে পারলেন। তিনি ভাবলেন, এই পরিস্থিতিতে তাঁর সত্য কথায় কেউ কান দেবে না। তাঁর কাছে স্বর্ণ মুদ্রা পাওয়া গেলে তা হবে তাঁর বিশ্বস্ততার উপর এক বিরাট কলংকজনক অধ্যায়। তাই তিনি হাদীস শাস্ত্রের ইজ্জত রক্ষার্থে স্বর্ণ মুদ্রার থলেটি এভাবে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলেন, যেন কেউ টের না পায়। তিনি ভাবলেন, এক হাজার স্বর্ণ মুদ্রা গেলে অসুবিধা নেই। কারণ যদি আমার নিকট স্বর্ণ মুদ্রা এ অবস্থায় পাওয়া যায়, তাহলে মানুষ আমার হাদীস বর্ণনার প্রতি সততা ও বিশ্বশ্ততা হারিয়ে ফেলবে। হাদীসের প্রতি তাঁর সুগভীর প্রেম ভালবাসা ছিল, তাই তিনি নিজের সততা বহাল রেখেছিলেন।
ইমাম বোখারী (রহঃ) এর ইন্তেকাল
গোটা মুসলিম জাহানকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ইমাম বোখারী (রহঃ) ২৫৫ হিজরীর পহেলা শাওয়াল ঈদুল ফিতরের (শনিবার দিবাগত) রাতে এশার নামাযের পর ইসলাম জগতের এই মহান পুরুষ প্রায় ৬৩ বছর বয়সে সমরকন্দ যাওয়ার পথে খরতঙ্গ নামক স্থানে আপন প্রতিপালকের সান্নিধ্যে চলে যান। সমরখন্দ থেকে দু’ফারলং দূরবর্তী ‘খরতঙ্গ’ নামক স্থানে এক পল্লী গ্রামে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তাঁর কোন পুত্র সন্তান ছিলেন না। বিভিন্ন বর্ণনায় জানা যায়, জানাযার পর যখন তাঁকে কবরে শোয়ান হয়, তখন তাঁর কবর শরীফের মাটি থেকে মেশক আম্বরের সুগন্ধ বাতাস প্রবাহিত হয়ে চারিদিক মোহিত করে তোলে। অনেক দিন পর্যন্ত সেখানকার লোকেরা কবরের মাটি সংগ্রহ করে তা দিয়ে মেশক আম্বরের সুগন্ধ গ্রহণ করতেন এবং আশ্চর্যবোধ করতেন।
আল্লাহর এক বিশেষ অলী বর্ণনা করেন, “আমি একদিন স্বপ্নযোগে দেখতে পেলাম, কতিপয় সাহাবী রাসুলুল্লাহ (দঃ) এর সাথে এক জায়গায় অপেক্ষা করছেন। আমি রাসুলুল্লাহ (দঃ) কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা এখানে কেন অপেক্ষা করছেন? তিনি উত্তরে বললেন, আমরা মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল বোখারীর জন্য অপেক্ষা করছি। কয়েকদিন পর যখন আমি তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেলাম, তখন স্বপ্নের দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম, আমি যে সময় এ স্বপ্ন দেখেছি, ঐ রাত্রেই হযরত ইমাম বোখারী (রহঃ) ইন্তেকাল করেন।
হযরত ইমাম বোখারী (রহঃ) এর একজন বিশিষ্ট শাগরেদ ইমাম ফারাবী (রহঃ) বলেন, আমি একদা স্বপ্নযোগে হযরত ইমাম বোখারী (রহঃ) কে রাসুলুল্লাহ (দঃ) এর পেছনে পেছনে যেতে দেখলাম। আমি দেখলাম, রাসুলুল্লাহ (দঃ) যখনই তাঁর কদম মোবারক উঠাচ্ছেন, ইমাম বোখারী (রহঃ) সে স্থানেই পা মোবারক রেখে হাঁটছেন।
সূর্য যতদিন হবে উদিত, বিচ্ছুরিত হবে সূর্য কিরণ, রাতের নীল আকাশে ঝুলতে থাকবে যতদিন সেতারের মালা, ততদিন বিশ্ব মানব তাঁকে স্মরণ রাখবে। হে ইমামুল মুহাদ্দিসীন! আপনার উপর বর্ষিত হোক আল্লাহর অফুরন্ত শান্তি আর রহমতের অঝোর ধারা।
বিষয়: বিবিধ
২৩১১ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন