আসুন কোরআনের দর্পণে নিজের অবস্থান তালাশ করি, একটি সত্য ঘটনার মধ্য দিয়েঃ
লিখেছেন লিখেছেন সন্ধাতারা ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ১০:১৬:৫০ রাত
আহনাফ বিন কায়েস শুধু একজন বীর যোদ্ধাই নন বরং তিনি ছিলেন আরবী সাহিত্যের একজন অনন্য বিখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তি। একদিন এক ব্যক্তির একটি কোরআনের আয়াত শুনে তার মনের গভীরে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হল, কারণ সে আয়াতে আল্লাহ্ পাক বলেছেন, “আমি তোমাদের কাছে এমন একটি কেতাব নাযিল করেছি, যাতে ‘তোমাদের কথা’ আছে, অথচ তোমরা চিন্তা-ভাবনা করো না” (সূরা আম্বিয়া, ১০)।
জ্ঞানসাধক আহনাফ জিজ্ঞাসু ও বিস্মিত মনে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলেন, কোরআনে ‘আমাদের কথা’ লিখা আছে! তিনি জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন তাহলে কোরআনে তাহলে ‘আমার কথা’ কী লিখা আছে?
এরপর তিনি কোরআন মজীদে এক গোত্রকে পেলেন তাদের ব্যাপারে বলা হল, “রাতগুলো তারা নিজেদের মালিকের সেজদা ও দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যে দিয়ে কাটিয়ে দেয় (সূরা আল ফোরকানঃ ৬৪)।”
আবার অন্য এক দল সম্পর্কে বলা হল, “তাদের পিঠ রাতের বেলায় বিছানা থেকে আলাদা থাকে, তারা নিজেদের প্রতিপালককে ডাকে ভয় ও প্রতাশা নিয়ে, তারা অকাতরে আমার দেয়া রেযেক থেকে খরচ করে (সূরা হা-মীম সাজদাঃ ১৬)”।
আর একটু পরে অন্য এক গোত্রের সম্পর্কে পরিচয় দেয়া হল, “এরা রাতের বেলায় খুব কম ঘুমায়, শেষ রাতে তারা আল্লাহ্র কাছে নিজের গুনাহখাতার জন্য মাগফেরাত কামনা করে (সূরা আয যারিয়াত ১৭-১৯)”।
এবার তিনি আর এক দলের পরিচয় পেলেন, যাতে বলা হয়েছে, “এরা দারিদ্র ও স্বাচ্ছন্দ্য উভয় অবস্থায় আল্লাহ্র নামে অর্থ ব্যয় করে, এরা রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে, এরা মানুষকে ক্ষমা করে, বস্তুত আল্লাহ্তায়ালা এসব নেককার লোকদের ভালোবাসেন (সূরা আল ইমরানঃ ১৩৪)”।
তারপর আরেক গোত্রের পরিচয় এল, এদের ব্যাপারে বলা হল, “এরা বৈষয়িক প্রয়োজনের সময় অন্যদেরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তাদের নিজেদের রয়েছে প্রচুর অভাব ও ক্ষুধার তাড়না। যারা নিজেদেরকে কার্পণ্য থেকে দূরে রাখতে পারে তারা বড়ই সফলকাম (সূরা আল হাশরঃ ৯)”।
এভাবে অন্য আর এক দলের সম্পর্কে বলা হল, “এরা বড়ো বড়ো গুনাহ বেঁচে থাকে, যখন এরা রাগান্বিত হয় তখন প্রতিপক্ষকে মাফ করে দেয়, এরা আল্লাহ্র হুকুম আহকাম মেনে চলে, এরা নামায প্রতিষ্ঠা করে, এরা নিজেদের মধ্যকার কাজকর্মগুলোকে পরামর্শের ভিত্তিতে আঞ্জাম দেয়। আমি তাদের যা দান করেছি তা থেকে তারা অকাতরে ব্যয় করে (সূরা আশ-শুরাঃ ৩৭-৩৮)”।
তারপর ভিন্ন এক দল সম্পর্কে বিধৃত করে পরিচয় দেয়া হয়েছে এভাবে, “যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ্ তায়ালা ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই, তখন তারা গর্ব ও অহংকার করে এবং বলে, আমরা কি একটি পাগল ও কবিয়ালের জন্যে আমাদের মাবুদদের পরিত্যাগ করবো? (সূরা আছ ছাফফাতঃ ৩৫-৩৬)”।
একটু পরে তিনি আরও একটি দল পেলেন, এ দলের ব্যাপারে বলা হল, “যখন এদের সামনে আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করা হয় তখন এদের অন্তর খুবই নাখোশ হয়ে পড়ে, অথচ যখন এদের সামনে আল্লাহ্ তায়ালা ছাড়া অন্যদের কথা বলা হয় তখন এদের মন আনন্দে নেচে উঠে (সূরা আঝ ঝুমারঃ৪৫)”।
পরবর্তীতে সবার কথা জানার পর হযরত আহনাফের মনের পর্দায় একে একে সবার ছবি ভেসে উঠল। কিন্তু নিজের ছবির সাথে কোন গোত্রেরই মিল পেলেন না। এ পর্যায়ে তিনি বিষণ্ণ চিত্তে সকরুণভাবে বলে উঠলেন, হে আল্লাহ্ তায়ালা, আমি তো ‘আমার কথা’ এই কোরআনের কোথাও খুঁজে পেলাম না। কোরআন মজীদে আমার সাদৃশ্যস্বরূপ আমিতো কাউকে কোথাও দেখতে পেলাম না, অথচ তুমি নাকি এ কেতাবে সবার কথাই বলেছো!
এবার তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে আবারও গভীরভাবে মনোনিবেশ করলেন কোরআনে নিজেকে খুঁজে পাবার জন্য। এরপর আর এক গোত্রের কথা পেশ করা হল, যেখানে কতিপয় হতভাগ্য মানুষকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, তোমাদের কিসে জাহান্নামের এই আগুনে নিক্ষেপ করলো? তারা বলবে, আমরা নামায প্রতিষ্ঠা করতাম না, আমরা গরীব মিসকিনদের খাবার দিতাম না, কথা বানানো যাদের কাজ- আমরা তাদের সাথে মিশে সে কাজে লেগে যেতাম। আমরা শেষ বিচারের দিনটিকে অস্বীকার করতাম, এভাবেই একদিন মৃত্যু আমাদের সামনে এসে হাজির হয়ে গেল (সূরা আল মোদ্দাসসেরঃ ৪২-৪৬)”।
আহনাফ কোরআনে বর্ণিত বিভিন্ন মানুষের অবস্থার সাথে নিজেকে আবারও মিলিয়ে নিলেন, বিশেষ করে শেষাক্ত মানুষটির অবস্থা দেখে বলে উঠলেন, হে আল্লাহ্, এধরনের মানুষের উপর আমার কোনই সম্পর্ক নেই, আমি এদের উপর ভীষণভাবে অসন্তুষ্ট। এ গোত্রের ব্যাপারে আমি তোমারই আশ্রয় ও সাহায্য চাই।
নিজেকে তিনি প্রথম শ্রেণীর মানুষদের কাতারভুক্ত ভাবতে পারছেন না সত্যি কিন্তু এও অনুধাবন করলেন যে, আল্লাহ্ তায়ালা তাকে ঈমানী রত্ন দান করেছেন। তাই তার জায়গা প্রথম ভাগ্যবানদের সারিতে না হলেও শেষের অভাগাদের সারিতেও যে নয় সেটা তিনি মনে মনে অনুভব করলেন। এমতাবস্থায় আল্লাহ্ভীতি এবং মন্দকাজের স্বীকৃতি দুটোই তার মনে উদিত হলো। তাই আশা ও শঙ্কায় আল্লাহ্ তায়ালার ক্ষমা, দয়া ও রহমতের আকাঙ্ক্ষাও পোষণ করলেন। তাই ভাল-মন্দ মেশানো একজন মানুষের ছবি কোরআনের বুকে কোথাও না কোথাও তিনি পেয়ে যাবেন এই মানসিকতায় আত্মবিশ্বাসের সাথে আবারও খুঁজতে লাগলেন।
বুকভরা প্রশ্ন আর অভিমান নিয়ে নিজেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করলেন এভাবে, কেন, তারা কি আল্লাহ্র বান্দা নয় যারা ঈমানের দৌলত পাওয়া সত্ত্বেও নিজেদের গুনাহর ব্যাপারে থাকে একান্ত অনুতপ্ত। কেন, আল্লাহ্ তায়ালা কি এদের সত্যিই নিজের অপরিসীম রহমত থেকে মাহরুম রাখবেন? এই কেতাবে যদি সবার কথা থাকতে পারে তাহলে এ ধরণের লোকের কথা থাকবে না কেন? এই কেতাব যেহেতু সবার তাই এখানে সবার কথাই থাকবে এটাই অবধারিত সত্যিই। তাই তিনি ধীর চিত্তে আবারও কোরআনের বুকে আলিঙ্গন করলেন, আর মুহূর্তেই নিজের স্বরুপ উন্মোচিত করতে পেরে আনন্দে বলে উঠলেন; এটাই তো আমি।
এমনি এক বিশেষ মুহূর্তে হযরত আহনাফের দু’চোখ আনন্দে জ্বল জ্বল করে ঠিকরে পড়ল, “হ্যাঁ এমন ধরনের লোক আছে যারা নিজেদের গুনাহ স্বীকার করে। এরা ভালো মন্দ মিশিয়ে কাজকর্ম করে-কিছু ভালো কিছু মন্দ। আশা করা যায় আল্লাহ্ তায়ালা এদের ক্ষমা করবেন। অবশ্যই আল্লাহ্ তায়ালা বড় দয়ালু বড় ক্ষমাশীল (সূরা আত তাওবাঃ ১০২)”।
হযরত আহনাফ আল্লাহ্র কেতাবে নিজের জায়গা খুঁজে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে খুশী মনে বলে উঠলেন আমি নিজেকে পেয়ে গেছি। আমি যেমন আমার গুনাহর কথা স্বীকার করি ঠিক তেমনি ভাল কাজের কথাও অস্বীকার করি না। আল্লাহ্র দয়া যে আমার সাথে আছে তাও আমি অনুভব করি। আমি কখনই আল্লাহ্র রহমত এবং দয়া থেকে নিরাশ হই না। কেননা পাক কালামেই বলা হয়েছে, “আল্লাহ্র দয়া থেকে তারাই নিরাশ হয় যারা গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট (সূরা আল হেজরঃ ৫৬)”।
এমনি এক মুহূর্তে হযরত আহনাফ কোরআন পাঠকের কথার সত্যতা অনুধাবন করে নীরবে বলে উঠলেন হে মালিকে এলাহি তুমি মহান, তোমার কেতাব মহান, সত্যিই তোমার এই কেতাবে দুনিয়ার গূণী-জ্ঞানী, পাপী-তাপী, ছোট-বড়, ধনী-নির্ধন, বাদশা-ফকির সবার কথাই আছে। তোমার কেতাব সত্যিই অতুলনীয়, অনুপম। পবিত্র কোরআন মজিদে যে অপরিসীম জ্ঞান জিজ্ঞাসা এবং নিজের অবস্থানের যে অমূল্য বার্তা লুকিয়ে আছে আসুন এই হৃদয়স্পর্শী সত্য ঘটনা জানার পর সেটা আরও নিখুঁতভাবে পড়খ করে নিজেকে নিখাদ ও পরিশুদ্ধ করে নিই। আমীন।
বিষয়: বিবিধ
১৪৪৮ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন