আর পপি, বৃষ্টিরা জানবে, তাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা * আনন্দবাজার
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আল মাহমুদ ০৮ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১০:১৬:২৪ রাত
দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন শেখ হাসিনা! চতুর্থ শ্রেণির বিউটি বা পপি খাতুনেরা বরং মনমোহন সিংহের নামই জানে না।
অথচ বছর নয়-দশের এই বালিকারা কিন্তু এই রাজ্যেরই বাসিন্দা, ভারতের নাগরিক। তবে আর পাঁচটা প্রাথমিকের পড়ুয়াদের সঙ্গে ফারাকটা হল, পপি-বিউটিরা পড়ে বাংলাদেশের স্কুলে। ওরা এবং ওদের মতো আরও জনা তিরিশ।
দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলি ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম নিচা গোবিন্দপুর। সংখ্যালঘু-প্রধান এই গ্রামের অবস্থান ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের মাঝ বরাবর জিরো পয়েন্টে। ভারতের ভূখণ্ড থেকে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে বাংলাদেশের দিনাজপুর ঘেঁষা এই গ্রামে ঢুকতে হয়। ভারতের দিকে কাঁটাতার থাকলেও বাংলাদেশের দিকে উন্মুক্ত। সে দিক দিয়ে হাঁটা পথে মিনিট ১৫ গিয়ে দক্ষিণ দাউদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে যায় পপি, বিউটি, বৃষ্টি খাতুনেরা। অথচ তাদের গ্রামে শিশু শিক্ষাকেন্দ্রের পাকা ঘর আছে। যা এখন তালাবন্ধ। ঘরের ভেতরে কেউ রেখেছেন ধান। বারান্দায় কঞ্চি ও পাটকাঠির স্তূপ বোঝাই।
কেন?
শিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের এডুকেশন গ্যারান্টি স্কিমের আওতায় ওই গ্রামে ২০০৬ সালে একটি শিশু শিক্ষাকেন্দ্র চালু হয়। তখন ক্লাস চলত গ্রামেরই এক বাসিন্দার বারান্দায়। কেন্দ্রটির জন্য ৬ শতক জমি দান করেন গ্রামের কৃষিজীবী এফাজ মোল্লা। এর পর সংশ্লিষ্ট ধলপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েত ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে ওই জমিতে পাকা ঘর গড়ে দেয়। কিন্তু ২০১২-র ৩১ মার্চ কেন্দ্রীয় প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। ওই প্রকল্পে রাজ্যে যে শিক্ষা কেন্দ্রগুলি চলত, সেখানকার পড়ুয়াদের ধারে-কাছের প্রাথমিক স্কুল ও শিক্ষাকেন্দ্রে ভর্তি করে নেওয়া গেলেও বাদ পড়ে যায় নিচা গোবিন্দপুর। স্কুলশিক্ষা দফতরের এক আধিকারিক জানান, ওই শিক্ষাকেন্দ্রটিকে রাজ্যের স্কুলশিক্ষা দফতরের আওতায় আনতে গেলে যা করা দরকার ছিল, তা হয়ে ওঠেনি।
ছবি: অরূপ মোহান্ত।
গ্রামবাসীরা জানাচ্ছেন, শিশু শিক্ষাকেন্দ্রের পরিচালক দুই শিক্ষক মজিদ আলি মণ্ডল এবং পরিমল মণ্ডল দীর্ঘদিন বিনা বেতনে পড়ানোর কাজ চালিয়ে যান। মজিদ আলি মণ্ডল বলেন, “প্রশাসনিক জটিলতায় বেতন না পেলেও দীর্ঘদিন কাজ চালিয়েছি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের পরে আর টানা সম্ভব হয়নি।” যদিও গ্রামবাসীর দাবি, প্রায় মাস ছ’য়েক ওই শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে পড়াশুনো হচ্ছিল না। মিড-ডে মিলও চালু হয়নি। শিক্ষাকেন্দ্রটির জন্য জমিদান করা এফাজ মোল্লার হতাশা, “গ্রামের বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে জমি দিয়েছিলাম। বাড়িও হল। কিন্তু পড়াশুনো বন্ধ হয়ে গেল। এখন আমারই পরিবারের বাচ্চারা বাংলাদেশে পড়তে যাচ্ছে।”
স্থানীয় সূত্রের খবর, বাংলাদেশের দিনাজপুরে থাকা আত্মীয়দের সাহায্য নিয়ে সেখানকার স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে গ্রামের ৩০ জন বাচ্চাকে। দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টে অবধি স্কুল চলে। সীমান্তে মোতায়েন বিজিবি-র জওয়ানেরাও বিষয়টি জানেন। তাই তাঁরাও এ পারের বাচ্চাদের ওপারে যেতে বাধা দেন না। গ্রামের ইয়াকুব আলি মোল্লা, জিয়ার মণ্ডলেরা বলেন, “গ্রাম থেকে দু’কিলোমিটার দূরে বলপাড়া বা জামালপুরে বাচ্চাদের পড়তে পাঠানো যায়। কিন্তু সেখানে যেতে হবে বড় রাস্তা ধরে। বিপদের ঝুঁকি থাকে। সেটা এড়াতেই গ্রামের অনেকে আলপথে দাউদপুরে পাঠান বাচ্চাদের। গ্রামের জনা পাঁচেক বাচ্চা যায় বলপাড়ায়।”
দাউদপুরের স্কুলে কী পড়ো?
বিউটি-পপিরা জানায়, বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি ভাষা এবং বিজ্ঞানের পাশাপাশি তারা পড়ে বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় আর ইসলামের ইতিহাস। এই পরিস্থিতির জন্য কে দায়ী, তা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা তথা ধলপাড়া পঞ্চায়েতের আরএসপি সদস্য অনিল রায় এবং পঞ্চায়েতের বর্তমান তৃণমূল প্রধান উজ্জ্বল মণ্ডল জড়িয়ে পড়েছেন রাজনৈতিক চাপান-উতোরে। তবে একটা বিষয়ে দু’জনেই একমত, এ দেশের বাচ্চাদের বাংলাদেশের স্কুলে গিয়ে পড়াটা দুর্ভাগ্যজনক।
হিলির বিডিও ম্যাথিয়াস লেপচা আবার এই পরিস্থিতির জন্য সীমান্তের এই গ্রামের ভৌগোলিক অবস্থানকেই দায়ী করেছেন। বৃহস্পতিবার তিনি গ্রামটি ঘুরে এসে বলেন, “ওখানে ফের পঠনপাঠন শুরু করতে ওই দুই শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেছি। সরকারি ভাবে যাতে দ্রুত শিক্ষকেন্দ্রটি খোলা যায়, সেই চেষ্টা করছি।”
তবে যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন বন্ধ শিক্ষাকেন্দ্রের ঘরে এক কোণায় পড়ে থাকা ব্ল্যাকবোর্ডে ঝুল আর ধুলো জমবে। ঘরে ধানের স্তূপ থাকবে। বারান্দায় থাকবে কঞ্চি পাটকাঠির বোঝা। আর পপি, বৃষ্টিরা জানবে, তাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় সঙ্গীত হল, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি....।’
বিষয়: বিবিধ
১২৬৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন