লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে:-। ৯০ বছরের এক বৃদ্ধের ট্রাজেডি
লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আল মাহমুদ ২৯ জুলাই, ২০১৩, ০৭:৫৮:২৬ সন্ধ্যা
হামিদ মীর
আজ মনটি খুবই ভারাক্রান্ত। ভাবছি রমজানে আমরা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য রোজা রাখছি কিন্তু এই মোবারক মাসে কিছু দুনিয়াদার শক্তিকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমরা কেন পরস্পরের রক্ত ঝরাচ্ছি? খুনখারাবির এই দৃম্য মিশর থেকে শুরু করে ইরাক, বাংলাদেশ, পাকিস্তান সবখানে দেখা যাচ্ছে। পাকিস্তানে বোমা হামলায় দুই ডজন নিষ্পাপ মানুষের প্রাণহানির ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই মিশরের সেনাবাহিনী রাজপথে শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছে। রমজানের মতো পবিত্র মাসে কিভাবে একটি মুসলিম দেশের সেনাবাহিনী জনগণের ওপর গুলি চালায়! ভারাক্রান্ত মনে অন্তর্চক্ষু দিয়ে আমি দেখছি, সে দিন বেশি দূরে নয়, রমজানে মুসলমানদের রক্ত প্রবাহকারী মিশরের সেনাপ্রধান ও তার সহযোগীদের সে দেশের কোথাও আশ্রয় মিলবে না। আরব মিডিয়া জেনারেল আলসিসিকে এ যুগের ফেরআউন বলে অভিহিত করেছে। তবে এই ব্যক্তিটি তার কর্মকা- ও আচরণের দ্বারা আমাকে জেনারেল ইয়াহইয়া খানের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন।
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সহযোগীরাও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারীদের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং ব্যালটের সিদ্ধান্তকে বুলেটে পাল্টে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এই অপচেষ্টা ফলে পাকিস্তান ভেঙে দুই টুকরো হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার রাজপথে যে রক্তের প্রবাহ বইয়ে দিয়েছিল চার দশক পরও সেই ছাপ মুছে যায়নি। জেনারেল আল সিসি মিশরের রাজপথে যে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছে এর প্রতি জন্ম নেয়া ঘৃণা কয়েক প্রজন্মের অন্তরে তাজা থাকবে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও জেনারেল আল সিসির মতো সেনাপ্রধানরা আজ পর্যন্ত নিজ জাতির বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারেননি। এসব লোক সব সময় নিজের জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন এবং যুদ্ধে যুদ্ধেই তাদের জীবন কেটে যায়।
আজ অর্ধেক মিশর আল সিসির সঙ্গে আর অর্ধেক তার বিরুদ্ধে। ১৯৭১ সালেও অর্ধেক পাকিস্তান জেনারেল ইয়াহিয়া ও তার সহযোগীদের সঙ্গে ছিল আর অর্ধেক ছিল বিরুদ্ধে। ওই সেনা অভিযানের ঘৃণা থেকেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম। কয়েক দশক পার হয়ে গেছে কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি আজও একাত্তরে ঝুলে আছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর ৯০ বছর বয়স্ক সাবেক আমির প্রফেসর গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয়ার বিষয় সারা বিশ্বে আলোচিত হয়েছে। প্রফেসর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মিলে বাঙালিদের গণহত্যায় অংশ নিয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকার ৯০ বছর বয়স্ক এক বৃদ্ধকে দেয়া ‘অন্যায়’ এই সাজাকে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় বলে চুপ থেকেছে। এ ব্যাপারে গত সপ্তাহে সরকারের এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বাকবিতণ্ডা হয়েছে, যা মিডিয়ায় আসেনি। এ ব্যাপারে পরে বিস্তারিত বলব, প্রথমে গোলাম আযমের সাজার কিছু প্রেক্ষাপট আলোচনা করছি।
পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী প্রফেসর গোলাম আযমের একটি লেখা ‘বাংলাদেশে নির্যাতনের রহস্য’ গত বছর পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করেছে। পাকিস্তান জামায়াতের প্রধান শাহেদ হাশমি ওই পুস্তিকাটি ছাড়াও প্রফেসর খুরশিদ আহমদের একটি চিঠি এবং আরো কিছু কাগজপত্র আমাকে দিয়েছেন। এতে গোলাম আযমকে দেয়া সাজার সমালোচনা করা হয়েছে। গোলাম আযম তার লেখায় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৪৮ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান ঢাকায় যান গোলাম আযম নিজে তার কাছে একটি মেমোরেন্ডাম পেশ করেন যাতে বাংলা ভাষাকে উর্দুর পাশাপাশি মাতৃভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবি জানানো হয়। ওই দাবিতে সংগ্রাম করার কারণে ১৯৫২ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তাকে কারাভোগ করতে হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলে গোলাম আযম দলটির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান।
গোলাম আযম বলেন, তিনি ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত সেনা অভিযানের কঠোর প্রতিবাদ জানান। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করা হয়, গোলাম আযম পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে মিলে আল বদর প্রতিষ্ঠা করেন এবং আওয়ামী লীগের সমর্থকদের হত্যা করেন।
পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার পর গোলাম আযম বৃটেন চলে যান। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে গোলাম আযম পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে যান। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট তাকে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়। ২০০০ সালে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন। কিন্তু শেখ হাসিনা ওয়াজেদ তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করে সাজা দেন।
চলতি বছরের মার্চ মাসে আমার ঢাকা সফরকালে ট্রাইব্যুনালে সাজা দেয়ার প্রতিবাদে আন্দোলন চলছিল। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে আমার সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়। আমি বলেছি, খোদ শেখ মুজিবুর রহমান তার শাসনামলে পাকিস্তান বাহিনীর ১৯৫ অফিসারকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট পাস করেছিলেন। শেখ মুজিব ওই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে দাবি জানান, পাকিস্তানের পক্ষে অংশ নেয়া ৯০ হাজার সেনার মধ্যে শুধু ওই অফিসারদের বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হোক, যারা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে ১৯৫ সেনা কর্মকর্তাকে ক্ষমা করে দেন। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তার হত্যাকারীদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর ঐক্য আওয়ামী লীগকে পুরানো কষ্টের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ফলে আজ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় ন্যায়বিচারকে ‘তামাশার বস্তু’ বানিয়েছে।
১৯৭১ সালের ঘটনার তদন্তের জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ ডিসেম্বর বিচারপতি মাহমুদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়। তবে পাকিস্তান সরকার এই কমিশনের প্রতিবেদন আমলে নেয়নি। মাহমুদুর রহমানের কমিশন সুপারিশ করেছিল, জেনারেল ইয়াহইয়া খান, আব্দুল হামিদ খান, এইচএম পীরজাদা, মেজর জেনারেল ওমর (আসাদ ওমরের বাবা), জেনারেল গুল হাসান ও জেনারেল আবু বকর উসমানের বিচার উন্মুক্ত আদালতে চালিয়ে যেতে। পাকিস্তানে যদি বিচারপতি মাহমুদুর রহমানের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হতো তাহলে বাংলাদেশেও যুদ্ধাপরাধ ইস্যুটি শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু পাকিস্তানে আজও ১৯৭১ সালের সেনা অভিযানের সমালোচকদের ‘গাদ্দার’ বলে চুপ করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। সত্য কথা হলো, মেজর জেনারেল আবু বকর উসমান ও মেজর জেনারেল খাদ হোসাইন রাজা তাদের বইয়ে বাংলাদেশে চালিত নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগ স্বীকার করেছেন। আর এর জন্য কোনো না কোনোভাবে তো আমাদের ক্ষমা চাইতেই হবে।
গত সপ্তাহে পাকিস্তান সরকারের উচ্চতর এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বললেন, গোলাম আযম পাকিস্তানের পক্ষে লড়াই করেছেন। সুতরাং পাকিস্তান সরকারের উচিত তার সঙ্গে করা অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ জানানো। কিন্তু একজন সিনিয়র মন্ত্রী এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, গোলাম আযম সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। কারণ ওই যুদ্ধ ছিল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী একটি দলের বিরুদ্ধে। আর ওই সংখ্যাগরিষ্ঠতাই ছিল পাকিস্তান। ওই সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আরেক মন্ত্রী গোলাম আযমকে সাহায্য করার পক্ষে মত দেন। তবে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এ বিষয়ে আলোচনা দীর্ঘ হতে দেননি।
আমার মতে, এ ব্যাপারে বিতর্কে না জড়িয়ে আমাদের চুপ থাকাই উত্তম। ৯০ বছরের বৃদ্ধ গোলাম আযমকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। আমাদের শুধু একজন গোলাম আযম নয়, ওই লাখো বীরদের কথাও ভুলে যাওয়া উচিত নয় যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতা করেছেন এবং আজও ঢাকায় শরণার্থী ক্যাম্পে পড়ে আছেন। জেনারেল জিয়াউল হক ১১ বছর এবং পারভেজ মুশাররফ নয় বছর পাকিস্তানের ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু তারা পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতাকারী ওই বীরদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। এটা কি পাকিস্তানের সঙ্গে গাদ্দারি নয়? যে জাতির মধ্যে দেশপ্রেম ও গাদ্দারির বিষয়টি আইন-কানুনের পরিবর্তে রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসাবে নির্ধারিত হয় সেখানে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও জেনারেল আল সিসির মতো সুবিধাবাদী শাসক চেপে বসে। পরে এমন শাসকদের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত শুধু ৯০ বছরের প্রফেসর গোলাম আযমই নয়, কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত ভুগতে হয়। আমরা কিছুটা ভুগেছি, আরো ভোগান্তি বাকি আছে। আল্লাহ আমাদেরকে সুবিধাবাদী শাসকদের থেকে রক্ষা করুন।
দৈনিক জং-এর সৌজন্যে। উর্দু থেকে অনুবাদ:
বিষয়: বিবিধ
৯৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন