তিনি নামি-দামী ডাক্তার, মানব সেবার ব্রত নিয়েই যাঁর বেড়ে উঠা!!
লিখেছেন লিখেছেন আমি স্বাধীন ৩০ মে, ২০১৩, ১১:৩৬:০৩ রাত
বেশ কয়েক বছর আগের কথা।
মাকে দেখাতে ডাক্তারের কাছে গেলাম। হঠাৎ করেই বহুল প্রত্যাশিত কলিং বেলের শব্দ শুনলাম। ডাক্তারের সহকারী আমাদের ঢুকতে বললেন, আমি আর মা ঢুকলাম চেম্বারে। আমি সালাম দিলাম, তিনি আমাদের কিছুটা রূঢ় কন্ঠে বসতে বললেন; বসলাম আমরা। প্রবেশের সাথে সাথে অনেকটা জীর্ণ-শীর্ণ একজনকে দেখলাম মুখ কালো করে কাঁদো কাঁদো অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন। দেখে বুঝলাম বয়স ৪৫ কি ৪৭-এর মতো, দূর গ্রামের লোক, আর্থিক অবস্থা হয়তো তেমন একটা ভালো হবেনা।
যাই হোক, এর ফাঁকে ডাক্তার সাহেব আবার বেল চাপলেন, কয়েক সেকেন্ডেই তাঁর সহকারী এসে হাজির। সাথে সাথে ডাক্তার ধমকের সূরে তাকে বলল, "ওই, বসে বসে কি করছ, চোখে কি মালা দিছচ? কি মানুষ ঢুকাছ এই সব? টাকা নাই, পয়সা নাই। বের কর এখান থেকে"। সহকারী পুরো 'থ' হয়ে গেল, সে হয়তো এরকম কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলনা। "চলেন, চলেন" বলে সে গ্রাম্য লোকটাকে বাইরে নিয়ে গেল। বের হবার মুহুর্তে লোকটার ডান চোখে জল গড়িয়ে পরতে দেখলাম।
সম্পুর্ণ পরিস্থিতিতে আমি কিছুটা স্থবির হয়ে গেলাম। বুঝে উঠতে পারলাম না কি থেকে কি হল!
পরক্ষনে হাতে মুছড়ানো একটা কাগজ নিচের কোন একটা ঝুড়িতে ফেলে তিনি আমাদের দিকে মনোযোগ দিলেন। মা-কে কিছুটা সময় চেক করে কিছু টেস্ট দিলেন করার জন্য এবং পরের দিন দেখা করতে বললেন। আমরা টাকা দিয়ে বেরিয়ে পরলাম। বের হবার সাথে সাথেই মা আমাকে প্রশ্ন করলেন, "ডাক্তার ওই লোকটার সাথে এমন করলেন কেন?" আমি বললাম, "টাকা দেয়া নিয়ে কোন সমস্যা থাকতে পারে। লোকটা হয়তো টাকা দিতে পারেনি।" মা বললেন, “তাই বলে এমন!!?”
এবার সিএনজি নিব। এদিক ওদিক তাকাতেই দেখলাম সেই লোকটাকে, গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। আমি কিছুটা কৌতুহলী হয়ে তার পাশে গেলাম, পুরো ব্যাপারটা জানতে চাইলাম। লোকটি যা বলল তার মর্মাথ হল, 'তার বাড়ি ফটিকছড়ি, সে ওখানে তার হার্টের অনেক চিকিৎসা করিয়ে আর না পেরে এক আত্মীয়ের কাছে শুনে এই ডাক্তারের কাছে এসেছেন। একদিন আগে এসে সিরিয়্যাল নিয়ে রাতটা কাটিয়েছেন কোন ভাবে হাসপাতালের আশেপাশেই। আজ একজনের কাছে টাকা পাবার কথা ছিল (ডাক্তারের বিলের চেয়ে বেশি) যা দিয়ে সে ভেবেছিল ডাক্তারের টাকা দিবে, কিন্তু বিধি বাম; সে শেষ পর্যন্ত আর আসেনি। অন্য উপায় না দেখে অনেকটা সাহস করেই গেছেন ডাক্তারের কাছে।'
লোকটি আর বলতে চাইলেন না, কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। আমি উনার কথার সাথে যোগ করলাম, "ডাক্তার নিশ্চয় খারাপ ব্যবহার করেছেন আপনার সাথে?"
সহজ-সরল লোকটি আবার বলা শুরু করলেন, "হ্যাঁ। উনি আমাকে ভালভাবে চেক করে প্রেসক্রিপশন লিখছিলেন। লেখার শেষ মূহুর্তের দিকে বললেন টাকা দিতে। আমি ২০০ টাকা এগিয়ে দিয়ে বললাম, 'স্যার, আমি পুরুটা জোগাড় করতে পারিনি।‘ উনাকে সব কিছু খুলে বলতে যাবার আগেই তিনি প্যাড থেকে প্রেসক্রিপশনটা ছিঁড়ে ফেললেন। ছিঁড়ে ফেলে বললেন, ‘ফাও কথা বলার জায়গা পাননা, টাকা না থাকলে এখানে আসেন কেন?’। বলেই তিনি বেল চাপলেন। পরেরটা তুমি দেখছ। বলেই তিনি কাদঁতে শুরু করলেন।
আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। খারাপ লাগছিল খুব। নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বললাম, ‘এখন কি করবেন?’ লোকটি বলল, “ ভাবতাম, ডাক্তাররা খুব মহৎ হয়। কিন্তু আজ যা হল তাতে বুঝলাম সব উপরের ল্যাবেজ(রূপ), আসলে উনারা টাকা ছাড়া কিছু বুঝেন না, উনাদের মন বলতে কিছু নাই। এখন কি করার, বাড়িতে চলে যাব, আল্লাহ্ যা করার করবেন।”
আমি আর কিছু বলতে পারিনি। উনাকে সালাম দিয়ে মাথা নিচু করে চলে এলাম।
ঘটনাটি ভুলেই গিয়েছিলাম, আজ মনে পড়ল যৌক্তিক কারণেই। গত পরশু আমার বড় আপার গলায় টিউমার অপারেশন হল। অপারেশনের ডাক্তারই গতকাল আর আজ ড্রেসিং করল। আজ দেখলাম ডাক্তার অনেকটা নির্দয়ভাবে খুলছে ব্যান্ডেজগুলো হাতের ঘড়ি দেখতে দেখতে! আপার ব্যথা পাবার ব্যাপারটা, ব্যথা পেয়ে চোখ মুখ ঝোরে বন্ধ করে রাখার ব্যাপারটা তিনি খেয়ালই করছিলেন না। করবেনই বা কেন? উনারা ডাক্তার, উনাদের কাছে “Time is money.”
মাঝে মাঝে পেপার-এ পাওয়া যায়, অপারেশনের কয়েক মাস পর রোগীর অপারেশনের জায়গাগুলোতে নতুন করে ব্যথা শুরু হয়। চেক-আপে অপারেশনের জায়গার ভিতরে চীজর, ব্যান্ডেজ ইত্যাদি পাওয়া যায়, যেগুলো ডাক্তারের অবহেলার কারণেই রোগীর শরীরের ভেতরে ফেলে যান!! নতুন করে অপারেশন করতে হয়।
আমি বলব না, সব ডাক্তার খারাপ। ভাল মন্দ থাকেই, কিন্তু এরকম বড় ডাক্তারগুলোর ভেতরের রূপ যদি এই হয় তবে আমরা কার কাছে যাব? বাঁচান আল্লাহ্, মারেনও আল্লাহ্; কিন্তু যাদের উছিলায় বেঁচে থাকা তাঁরা যদি এমন হয় তাহলে বোধ হয় আর মানবতার বীজটুকুও অবশিষ্ট থাকেনা। তাঁদের শির্ষ্যরাই বা কি শিখবেন? সেবা করার ব্রত নিয়ে এসে টাকা ইনকামের ব্রতে লিপ্ত হলে তাদের কি আর ডাক্তার বলা যায়, নাকি নচিকেতার জনপ্রিয় ‘ডাক্তার’ গানের সেই ‘কসাই’ বিশেষণটাই তাঁদের জন্য উপযুক্ত, তা ভেবে দেখা দরকার।।
বিষয়: বিবিধ
১২৪৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন