রূপকথার ফেরীঘাটে ফেরারী রাজকুমার

লিখেছেন লিখেছেন পিন্টু রহমান ২৮ জুন, ২০১৩, ০৮:২৫:২৬ রাত

এপারে মধু আর জানালার ওপারে দোলা; আহা, এ যেন রাঁধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি!

হুবহু একই রকম; কোন অমিল নেই।

প্রায় প্রতিদিনই মধু তার দু’চোখ ঝালিয়ে নিত। মুগ্ধতার আবেশে চোখের পাতা তখন বুঁজে আসতো। মিল-অমিল লক্ষ করতো। বিশেষ মূহুর্তে আবার আক্ষেপ করে বলতো, ইস, নিখিলদার হাতে যদি একখানা বাঁশি থাকতো!

এই আক্ষেপ নতুন নয়; বৌদি প্রথম যেদিন রায়দের বউ হয়ে এ বাড়িতে এসেছিল ঠিক সেদিন থেকেই। কতদিন ভেবেছে বিষয়টি বৌদিকে স্মরণ করিয়ে দেবে, কিন্তু চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত করা হয়নি। বৌদির মুখোমুখী দাঁড়ালেই মধু খেয় হারিয়ে ফেলতো। মুখ দিয়ে কথা সরতো না।

মধু তখন সবে অষ্টম শ্রেণীর চৌকাঠে। পড়াশুনায় প্রচণ্ড অমনোযোগী, ঘরে মন বসতো না, বাইরে অশান্তি। স্কুল পালিয়ে ফসলের মাঠে হারিয়ে যেত। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই ঘুমে চোখের পাতা বুঁজে আসতো। এই নিয়েও কম ঝামেলা পোহাতে হয়নি। বাবা-মা বকাবকি করতো। শাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখতো।

- লক্ষি বাপ আমার; এই সাত সকালে ঘুমালে কি হবে, পড়াশুনা না করলে পরিক্ষায় নির্ঘাত ফেল করবি।

পাশ-ফেল নিয়ে মধুর কোনো উদ্বেগ ছিলনা। পড়াশুনা তার কাছে উঠকো ঝামেলা, অকারণ সময় নষ্ট করা। জেরার মুখে প্রায়ই সে মিথ্যচার করতো। আজ জ্বর, কাল পেটে ব্যথা নয়তো অন্য কোনো অনুষঙ্গ।

বাবা অফিস থেকে ফিরে চেঁচামেচি করতো, মধুর মা, তোমার ছেলেকে দিয়ে আর হবেনা, অন্য কোনো কাজে লাগিয়ে দাও। তাতে সংসারে দুটো পয়সা আসবে।

ক্ষোভ সামলাতে না পেরে বাবার সামনে মা তাকে কিল-ঘুষি মারতো। মুখে আঁচল চেপে কান্নাকাটি করতো।

- আর কত মধু; আর কত জ্বালাবি আমায়! আমি যে আর সহ্য করতে পারিনা। তোর জন্য কি মরেও শান্তি পাব না!

মার খেয়েও মধুর কোনো আক্ষেপ ছিলনা। বরং কয়েকদিনের জন্য লেখাপড়ার জগতে অবাঞ্চিত। স্কুলে যাওয়ার তাড়া থাকতো না। কোন বকাবকি না। অফুরন্ত অবসর। জানালায় দাঁড়িয়ে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হত। তার কিশোর মনে অসংখ্য প্রশ্ন উঁকি-ঝূঁকি মারতো। হালকা মেগুলো নিয়ে সিমাহীন কৌতুহল। আচ্ছা, দিনশেষে পাখিরা কোথায় ফেরে!

মধুর জীবনভাবনা এই মূহুর্তে আমার লেখক সত্ত্বায় ছায়াপাত করছে। ঐ কিশোর ছেলেটির মাঝে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছি। তাছাড়া ওর ছন্নছাড়া জীবনের খণ্ডাংশ উন্মোচন না করলে আজকের মধু আর সেদিনের মধুর মধ্যকার পার্থক্য বুঝাতে পারতাম না; বোঝাতে পারতাম না মধুর জীবনে দোলা বৌদির কি প্রভাব ছিল!

জানালার ঠিক ওপারেই নিখিলদের বাসা। দো-তলা বাড়ির ওপরতলা ছিল নিখিলদার জন্য নির্ধারিত। আর ঐ বাসার চার দেওয়ালের মাঝেই দোলা বৌদিকে সে নতুন করে আবিষ্কার করেছিল। টিউব লাইটের উজ্জ্বল আলোয় বৌদির মায়াবী মুখটা আরো বেশি মায়াময় হয়ে উঠতো। নিখিলদা ঘরে না ফেরা পর্যন্ত বৌদি সুস্থির হয়ে বসতো না; ঘরের মধ্যে পায়চারি করতো। মানুষ সমান আয়নার সামনে নিজেই নিজেকে দেখতো। শাড়ির ভাঁজগুলো ঠিকঠাক করতো। কপালের টিপটা বার-বার শাড়ির সাথে মিলিয়ে নিত। কখনোবা জানালার শিক ধরে দুর আকাশে হারিয়ে যেত। মুখ থেকে খসে পড়তো টানা দীর্ঘশ্বাস।

ঐ দীর্ঘম্বাসের অর্থ মধুর কাছে আজো রহস্যাবৃত। তবে দোলা বৌদির সুখ দুঃখের অনুলিপি তার বুকের গহীণে প্রতিনিয়ত জমা হত; মনে হাহাকার উঠতো। অনেক রাতঅব্দি জেগে থাকতো- যতক্ষণ না বৌদির ঘর আলোশূণ্য হত।

মধুর এই পরিবর্তনে পরিবারের কেউ সেদিন অখুশি হয়নি, ছেলের ভবিষ্যত চিন্তা করে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। গভীর রাতে মা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করতো, কিরে মধু, আজকাল এত রাত জাগিস কেন!

মধুর কণ্ঠস্বরে আড়ষ্ঠতা। উত্তর দিতে গিয়ে মাথার চুলে অকারণ আঙুল চালাতো।

- ঘুম আসেনা মা। তাছাড়া সামনেই তো পরীক্ষা।

পড়াশুনার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছেলেটিকে নিয়ে নতুন করে সম্ভাবনার ডালপালা গজায়। মধুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। একদিন বড় আপা দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করেছিল, কিরে মধু, তোকে নিয়ে মা তো খাবার টেবিলে রিতীমতো বক্তৃতা দিচ্ছে! তুই নাকি রাত জেগে পড়াশুনা করিস, ঘুম না এলে ছাদে হাঁটাহটি করিস?

দিনের আলোয় জানালার ওপারে অন্ধকার; ঐ অন্ধকার মধুর বুকের মধ্যেও। বৌদিকে দেখার জন্য মনটা আঁকুপাকু করতো। ঘন-ঘন দীর্ঘম্বাস পড়তো। কায়মনে রাতের জন্য অপেক্ষা করতো।

কিন্তু বিষযটি আর গোপন থাকেনা। কিছুদিনের মধ্যেই বড় আপার কাছে জলের মত পরিস্কার। পড়ার টেবিলে এ নিয়ে প্রশ্নও উঠেছিল, মধু, রাত জেগে তুই পড়াশুনা করিস না বৌদিকে দেখিস?

দীপা নতুন করে তার কিশোর ভাইটিকে আবিষ্কার করে। খাতার ভাঁজে-ভাঁজে কবিতার ছত্র। কোন-কোনটার রচয়িতা মধু স্বয়ং নিজে। মলাটের উপর মায়াবী মুখের রেখাচিত্র।

- তুই ফাজিল হয়ে গেছিস মধু। বাবা জানলে কি হবে বলতো?

বড় আপার কথা গুরুত্বহীন। মধু পাত্তা দিত না। কেননা পৃথিবীর সব সুখ ঐ জানালায়। জানালার পথ ধরেই তো বৌদির জীবনাকাশে সূতাকাটা ঘুড়ির মত বিরামহীন চক্কর দেওয়া। বস্তুত: ঐ সময়ের জীবনভাবনা ছিল বৌদি কেন্দ্রিক।

আচ্ছা, এই জামাটি কি বৌদির পছন্দ হবে; যদি না হয়! কিংবা পরীক্ষায় ফেল করলে কি হবে? খুবই লজ্জার ব্যাপার, কিছুতেই মুখ দেখানো যাবে না।

ঐ সময় মধুর বোধের আঙিনা সংকুচিত হতে শুরু করে। কোন-কোনদিন রুমে আলো জ্বালাতে পর্যন্ত মনে থাকতো না। পা টিপে টিপে মা কাছে এসে জিজ্ঞেস করতো, কি হয়েছে বাবা, সারাদিন এতসব কি চিন্তা করিস? শরীর খারাপ হয়নি তো!

আড়মোড়া ভেঙে মধু জানালার উপর উঠে বসতো। দুহাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে বলতো, কিছুতো হয়নি মা।

- তাহলে সারাক্ষণ এমন করে থাকিস কেন?

- কেমন করে থাকি মা।

- এই যে কারো সাথে কথা বলিসনা। খেলার মাঠে খেলতে যাস না। ঘরকুনো ব্যাঙের মত চললে একদিন ঠিক পাগল হয়ে যাবি।

আজ মনে হয়, মধু যে সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাবে মা কি তখন জানতো! মা না জানলেও বৌদি হয়তো ইঙ্গিত পেয়েছিল, বুঝতে পেরেছিল জীবনের মধ্যগগনে তার রঙিন সূর্যটা গাঢ় অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। তা না হলে হাতের ইশারায় সেদিন কিশোর প্রেমিকটিকে কাছে ডাকবে কেন, কেনই বা সুখের স্রোতে পানসি ভাসাবে!

অবশ্য নিখিলদার এতে আপত্তি ছিলনা। নিখিলদা ব্যস্ত মানুষ; কোন দরকার পড়লেই মধুকে ডেকে পাঠাতো। আবেগের রঙ না মাখিয়ে জিজ্ঞেস করতো, তোমার কি কাজ আছে মধু?

মধু সমীহ করে বলতো, কেন দাদা, কিছু করতে হবে?

- হ্যাঁ, কাজ না থাকলে বৌদির সাথে একটু মার্কেটে যেও।

মার্কেট, মন্দির, খেলার মাঠ, সিনেমা হল, নিখিলদার দোকান, পূজো মণ্ডপ এমন কোন জয়গা নেই যেখানে ওরা ঘুরতো না। বেড়ানোর ফাঁকে সংসারের টুকটাক মালামালও কিনতো। আর মধু তখন আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। দোলার তখন মনে হত, মধু হয়তো গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন; কাছে থেকেও যেন অনেক দুরের বাসিন্দা! মধু নিজেও ঐ ভাবনার যুতসই কারণ খুঁজে পেত না। এক একসময় মনে হতো, সেকি বৌদির সংসারটাকে হিংসা করে?

এমন ভাবনা মনে আসতেই মধু প্রবল বেঁগে মাথা ঝাঁকাতো। বৌদি তখন পাশে সরে এসে জিজ্ঞেস করতো, কি হয়েছে ঠাকুরপো; খারাপ লাগছে?

- না না বৌদি, কিচ্ছু হয়নি। সব ঠিক আছে।

বউদি বাঁকা চোখে জানতে চাইতো, কি ঠিক আছে ঠাকুরপো?

মধু বুঝতো, বৌদির এটা চালাকি। তার মনের ভিতরটা পড়ে দেখার জন্যই এতসব অনুষঙ্গ।

আচ্ছা, দোলা কি তার কিশোর প্রেমিকটিকে পুরাপুরি আত্তস্থ করতে পেরেছিল! নাকি প্রচ্ছন্ন কিছু ভাবনা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল?

এই প্রশ্নের উত্তর মধুর কাছে আজো অজানা। তবে পার্কের নির্জন পুকুরপাড়ে বৌদি আরো বেশি নির্জনতায় ডুবে যেত।

একদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে- পশ্চিমের আকাশে তখন মাত্রই গোধূলীর রঙ চড়েছে। বিচিত্র শব্দে মাথার উপর দিয়ে ঝাঁকবেঁধে উড়ে যায় বুনো টিয়া। সম্মুখে পুকুরের নীল জল আর ঘাটের সিঁড়িতে বৌদি।

- কি ভাবছো বৌদি?

দোলার ভাবনার জগতে যেন এক টুকরো ঢিল পড়ে। তথাপি আলোড়িত না হয়ে বলেছিল, ভাবছি তোমার কথা।

মধু খানিকটা অবাক হয়েছিল, আমার কথা মানে!

- জ্বি; তোমার কাব্যচর্চা কেমন চলছে ঠাকুরপো?

লজ্জার আবরণ মধুকে আষ্টেপিষ্টে বেঁধে ফেলতে চায়। জীবনের এই চরম সত্যটি বৌদির কাঠগড়াই হাজির হলো কেমন করে! সন্দেহের তীর বড় আপার পানে। সেই মনে হয় ফাঁস করে দিয়েছে।

মধুর নিজেকে অপরাধী মনে হয়। বৌদি তার হাত টেনে পাশে বসায়। কয়েক মূহুর্ত নিরবে কেটে যায়।

- কি হলো ঠাকুরপো; কথা বলছো না যে?

মধুর নিচু ঘাড় আরো নিচু হতে চায়। কিন্তু বৌদি তাকে পিঠ চাপড়ে আস্বস্থ করে।

- আমি সব জানি ঠাকুরপো।

সাহস করে মধু চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করেছিল, আর কি কি জান বৌদি?

- শুনতে চাও?

মধু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।

দৃষ্টির সীমারেখা প্রসারিত করে বৌদি বলেছিল, কেউ একজন আমার জানালার প্রেমে পড়েছে। রাতের পর রাত সে আমার জানালা পাহারা দেয়; হা-হুঁতাশ করে।

ঐ একজন যে মধু নিজে একথা আর মুখ ফুঁটে বলতে হয়না, কথার ম্যারপ্যাচে বুঝে যায়। প্রথম-প্রথম মনে হয়েছিল, বৌদি রাগ করবে, খুব করে বকবে। অথচ হয়েছিল ঠিক তার উল্টো।

- জীবনের হিসেব বড় গড়মিল ঠাকুরপো। খালি চোখে চোখের জল আর নদীর জলের পার্থক্য বোঝা যায়না, কিংবা মানুষের উপরটা দেখে ভিতরটা আন্দাজ করা বোকামি। কবিতা-টবিতা লিখে মানুষ উচ্ছন্নে যায়। তারচেয়ে লেখাপড়ায় মন দাও। সামনে ই তো পরীক্ষা; ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে তৈরি করো।

কতদিন আগে বলা কথা; অথচ মূহুর্তের জন্য ভুল হয়না। আজ বুঝতে পারে ঐ কথাগুলোর মাঝে কি অমৃত লুকিয়ে ছিল!

একবার বৌদির সাথে তার বাবার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। যে কদিন ছিল খুব মজা করে ঘুরেছিল। ফেলে আসা কৈশর নতুন করে দোলার হাতে ধরা দিয়েছিল। মধুকে নিয়ে ছেলেমিপনায় মেতে উঠেছিল। কলতলা থেকে ভেসে আসতো উচ্ছ্বল হাসির কলতান।

- ঠাকুরপো, এই সাত-সন্ধ্যায় ঘুমালে কিন্তু চলবে না। শহর থেকে গানের দল এসেছে, সারারাত ধরে আমরা গান শুনবো।

গান না শুনলেও ঘুমাতে পারতো না। রাত জেগে-জেগে ঠাকুরমার রূপকথার আসর, কাকাতো ভাই-বোনদের নিয়ে লুডু খেলা, ঝড়ের রাতে আম বাগানে আম কুড়ানো, বিলের জলে শালুক তোলা, পুকুর ঘাটে এপার-ওপার সাঁতার কাঁটা, সব সব যেন জীবন্ত হয়ে আছে।

মধুকে দেখিকে বান্ধবীরা জিজ্ঞেস করতো, ছেলেটা কে রে দোলা, ঠাকুরপো নাকি?

বৌদি মিষ্টি হেসে উত্তর দিত, না না, ঠাকুরপো হবে কেন; ও আমার নতুন বর, নতুন দেবতা। কেমন হয়েছে বলতো, খুব সুন্দর তাইনা!

অনিমাদির ঠোঁটে তখন বাঁকা চাঁদের হাসি।

- কেমন হয়েছে সেতো তোরই ভাল জানা; আমরা তো আর খেয়ে দেখিনি! দোলা বৌদিও কম যাই না, ইস খেতে চাইলেই হলো; ওটা আমার জন্য ষ্পেসাল। বুঝেছিস?

বান্ধবীরা কি বুঝেছিল না-বুঝেছিল জানিনা তবে মধু ষ্পষ্টই বুঝতে পারছিল তার সময় ফুরিয়ে আসছে। গ্রামের কলেজে ভর্তি হলে নাকি ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হওয়া অসম্ভব। এখানে পদে-পদে বিপদ। শিক্ষকের মান ভাল না। ঠিকমতো ক্লাশ হয়না। বৌদির মুখে অসংখ্য অভিযোগ।

কিন্তু মধু প্রতিবাদ করতো। যুক্তির পর যুক্তি খাঁড়া করতো- তোমার ধারণা ঠিক নয় বৌদি। গ্রামের কলেজে কি ছাত্র ভর্তি হয়না? নাকি তারা ভাল রেজাল্ট করেনা? তুমি দেখে নিও, আমিও ভালো করবো।

এক-আধদিন নিখিলদাও আলোচনায় শামিল হত।

- ভুল করোনা মধু, শহরে চলে যাও। দেখবে, জীবনের গতিপথ বদলে যাবে। ভুলেও আর গ্রামের কথা মনে পড়বে না।

নিখিলদার কথা সত্য বিবর্জিত। ভিত্তিহীন। শহর জীবনের সাথে কিছুতেই সে মানিয়ে চলতে পারেনি। পলে-পলে নাড়ীর টান অনুভব করে। ভুবনডাঙার কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে,বৌদির চাঁদমুখ। পড়াশুনায় মন বসে না। ক্লাশ করতে ভাল লাগে না। জানালার প্রতি দূনির্বার আকর্ষণ। নির্ঘুম চোখে মেসের ছোট্ট জানালায় দীর্ঘরাত বসে থাকে। তখন মনে হয়, বৌদি যেন সামনেই দাঁড়িয়ে! সিঁদুরনদী পেরিয়ে কপালের ঠিক মাঝ বরাবর রক্তের মত লাল টিপ; চুপিসারে যেন তাকে হাতছানি দিচ্ছে!

মনে হতো এই বুঝি বড় আপা ঝাঁপটে ধরে জিজ্ঞেস করবে, বলতো আমি কে?

কিছুদিন পরের ঘটনা; মুখোমুখী জানালায় অন্য একটি মেয়ের অস্তিত্ত্ব। মধুর মতোই অসহায় ভঙ্গিতে চেয়ে থাকে। হাতের ইশারায় কিছু বোঝাতে যায়। কিন্তু মধু বুঝতে পারেনা; বোঝার চেষ্টাও করেনা। অথচ ঐ মেয়েটিকে নিয়েই ঘটে গেল ঘটনার ঘনঘটা।

মেস মালিকের মুখে নানামুখী অভিযোগ, মোর তিন পুরুছের বিবসা। কুনোদিন কেউ কিছু কইবার পারে নাইগ্যা। তয় তুমার জ্বালায় মুছকিলে পরছি। বেবাক মাইনষে খালি জিগায়।

কথার আগামাথা বুঝতে না পেরে মধু জিজ্ঞেস করে, কেন, কি হয়েছে চাচাজান?

- ও না বুজার ভ্যান করতিছো? কুনো লাভ হইবোনা, বেবাকটি জাইন্যা গিছি। ঐ জানালায় বইস্যা কুন আকামডা করোছ? বেহুদা ছাওয়ার কনেকার, এই মেছে ভি তুমায় রাখোন যাইবো না।

শুরু হয় জানালা বিভ্রাট আর মেস বদলের পালা। থেমে থাকেনা ভবিষ্যতের নৌকোও; তির-তির করে সম্মুখে এগিয়ে চলে। কলেজের চৌকাঠ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত বারান্দা।

চুড়ান্ত লক্ষের অভিমুখে যখনি দাঁড় বাইবে, ঠিক তখনি শুরু হল জীবনের ছন্দপতন। গ্রাম থেকে খবর এল, দোলা বৌদি আর নেই; জলে ডুবে আতœহত্যা করেছে!

খবরটা প্রথম-প্রথম বিশ্বাস হয়নি। মনে হয়েছিল, আর যাইহোক বৌদি মরতে পারে না। হালকা বাতাসে শিঁকড়সুদ্ধ একটা গাছ উপড়াতে পারে না। অথচ তাই হয়েছে, মধু আজ ঝড়ে বিধ্বস্ত গাছ, হালভাঙা নাবিক।

দুই:

বছর ঘুরতে না ঘুরতে নিখিলদা পুনরায় ধুমধাম করে বিয়ে করে। দোলা বৌদির সাজানো গোছানো সংসারে নতুন মহারথি; রায়দের নতুন বউ। দলবেঁধে পড়শীঁরা তাকে দেখতে আসে, কুশল বিনিময় করে। কিন্তু মধু পারেনা; দোলা বৌদি তার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। নিখিলদার প্রতি ঘৃণা জন্মিয়েছে।

ভালবাসার কি কোনো মূল্য নেই! কেমন করে সে বৌদিকে ভুলতে পারলো!

মধুর চারপাশে কেবল নিঃসঙ্গতা। বিদায় নিয়েছে সব কর্মব্যস্ততা। নিজেকে বড় ক্লান্ত মনে হয়। উত্তরের জানালাটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। পৃথিবীর সব কোলাহল থেকে নিজেকে আড়াল করে নিয়েছে। কিন্তু বৌদির মুখটি আর আড়াল করতে পারে না; হঠাৎ হঠাৎ চোখমেলে তাকায়।

মাঝে-মাঝে বড় আপা কান ভাঙায়, ভুল করিসনি মধু, লেখাপড়াটা শেষ কর, দেখিস একদিন কাজে লাগবে।

মধু অনেক দেখেছে, নতুন করে আর দেখার ইচ্ছে নেই। বৌদিও একদিন নিজেকে তৈরি হতে বলেছিল, দশজনের একজন হয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু আজ মনে হয় সব মিথ্যে, ছেলেভোলানো গল্প। বরং মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করাই জীবন।

বিষয়: সাহিত্য

১৫৫১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File