আমি গভীরভাবে শোকাহত।
লিখেছেন লিখেছেন আহমদ মুসা ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৯:১৭:৪১ রাত
দাদা, সত্যিই মনকে বুঝাতে পারছি না আপনার এই নিষ্পাপ চেহারাটি আর কোনদিন দেখতে পাবো না ভেবে। সেই বাল্যকাল থেকেই ৩৮ বয়সের এপর্যন্ত অনেক পুরাতন স্মৃতি এবং ইতিহাস চোখের সামনে শুধু বাসছে আর বাসছে। ছোট বেলার কত আনন্দ-বেদনার স্মৃতিগুলো এখন চোখের পানিতে ভেসে বয়ে যাচ্ছে। গেলো কোরবানীর ঈদে আপনি বাড়ীতে আসলেন না। আমি চেষ্টা করেছিলাম আপনার অভিমানের রহস্য জানার।আপনি চলে গেলেন মা’বুদের ডাকে সাড়া দিয়ে জনমের জন্য না ফেরার দেশে। কেয়ামত পর্যন্ত আর সাক্ষাৎ হবে না। কিন্তু আপনার অভিমানের রহস্য যতদিন দুনিয়ায় থাকবো ততদিন শিক্ষনীয় কষ্টদায়ক নির্দোষ স্মৃতি হিসেবে বার বার নাড়া দিবে।
বাল্যকাল থেকেই সেই ভ্রাত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় রেখে যেভাবে অভিভাকত্বের মর্যাদা অর্জন করেছিলেন আমাদের বড় ছোট সমস্ত ভাই-বোদদের মাঝে (এক কথায় সমস্ত কাজিন) তার তুলনা দ্বিতীয়টি চোখে পড়ছে না। আপনি শুধু আমরা ভাই-বোনদেরই প্রিয় ছিলেন না। আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী এমনকি গোটা গ্রামবাসীর গর্বের ধন এক উজ্জল নক্ষত্র ছিলেন। আমাদের ভাই-বোনদের মধ্যে হয়তো কেউ কেউ বুঝতে না পারলেও গ্রামের সাধারণ মানুষ ঠিকই বুঝতে পেরেছে তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানকেই হারালো। গতকাল রাত্রে যখন আপনার দ্বিতীয় নামাজে জানাজায় হাজার হাজার মানুষের গগণবিদারী কান্না আর চোখের পানিতে শোকে মুহ্যমান তখন নিজের শোকাহত কাতর হৃদয়টা যেন একেবারে পাথর হয়ে গেল। সত্যিই না কতবড় একজন মহান মানুষ ছিলেন দাদা ভাইয়া আপনি!!!
সড়ক দুর্ঘনায় নিহত হওয়ার আনুমানিক আধ ঘন্টা পর চমেক এর কেজুয়াল লাশ ঘর থেকে তোলা ছবি।
এমন শত্রুহীন মানুষও বর্তমান দুনিয়ায় থাকতে পারে? আপনি ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজনের গন্ডি পেরিয়ে নিজ গ্রাম ও পাশ্ববর্তী এলাকার মানুষের এতো আদর-স্নেহ, শ্রদ্ধ-ভক্তি ও ভালাবাসা অর্জন করেছেন যা কলমের ভাষা দিয়ে বুঝানো সম্ভব নয়।
আপনার প্রথম নামাজে জানাজায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রীয় প্রটোকল অনুযায়ী সেখানে উপস্থিত আপনার সহকর্মী, সিনিয়র-জুনিয়র অফিসার সৈনিকদের আপনার প্রসংসা, চাকরী জীবনে সততার দৃষ্টান্ত, সর্বৌচ্চ পেশাদারিত্ব ও আন্তরিকতার সাথে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে যে নজীর রেখে গেলেন তা স্মরণ করে সেনাবাহিনীর সদস্যদের স্বীকৃতি দেখে নিজেকে খুব প্রাউডফিল করছিলাম। সত্যিই দাদা আমরা আপনার মত একজন মহান ব্যক্তির স্নেহধন্য ছোট ভাই ছিলাম। চাকরীতে যোগ দেয়া থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৬ বছর ৪১ দিনের বর্নাঢ্য কর্ম জীবনে একবিন্দু মাত্র লাল কালির দাগ পড়েনি আপনার পার্থিব আমল নামায়। মহান আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছি, হে মহান আল্লাহ! আমার দাদা ভাইয়ার পারলৌকিক আমলনামায় যাবতীয় লাল কালির দাগ মুছে দিয়ে পার্থিব আমলনামার মত নিষ্কলুষ এবং নির্ভেজাল হিসেবে কবুল করে তাকে তোমার প্রিয় বান্দাদের কাতারে শামিল করে নাও।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ আমি এতোক্ষণ যার কথা বর্ণনা করছিলাম তিনি হচ্ছেন আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন প্রিয় ব্যক্তি, আমার আপন খালাতো ভাই। যিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ (এফ. আই. ইউ)এ কর্মরত ছিলেন। তার নাম মুহাম্মদ নুরুল আফসার। গতকাল সকালে সড়ক দুর্ঘনায় তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহী রাজেয়ুন। তিনি ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত ধার্মিক ও পরহেজগার মানুষ ছিলেন। কোনদিন তিনি নামাজ কাজা করতেন না। অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। তার তেমন কোন আর্থিক প্রাচুর্য নেই। বেতন যা পেতেন তা দিয়েই নিজের সাংসারিক জীবন অতিবাহিত করতেন। সেনাবাহিনীতে তার পদাধিকার অনুযায়ী রেশনসহ যে সুযোগ সুবিধা পেতেন তা থেকে নিজের পরিবারের মাসিক উদৃত অংশ অসচ্চল পরিবারে বিতরণ করতেন।
বর্তমানে আমাদের গ্রামে যে সরকারী প্রাইমারী স্কুল আছে সেই স্কুলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন এবং তিনিই সর্ব প্রথম এই স্কুল থেকে পড়ুয়া পরবর্তীতে গ্রাজুয়েশন করেছিলেন। গ্রামীন অসচ্ছল অধিক সদস্য বিশিষ্ট পরিবারে জন্ম নেয়া এই সংগ্রামী মানুষটি পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে অনেক প্রতিকুল পরিবেশ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে নিজের শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে প্রথমেই পশ্চিম পটিয়ার শান্তিরহাট সংলগ্ন কুসুমপূরা উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্ম জীবন শুরু করেন। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার আগ পর্যন্ত মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেই সল্প সময়ে ব্যাপক পরিচিতি ও সুনাম অর্জন করেছিলেন। পরবর্তীতে আর্মিতে যোগ দেয়ার পরেও তার এই সুনামের অগ্রযাত্রা ও পরিধি বাড়তে থাকে।
আমরা যারা তার বিভিন্ন আত্মীয় সূত্রে ভাই-বোন ছিলাম তাদের মধ্যে সবার বয়সে বড় ছিলেন তিনি। এজন্য প্রায় সময় গর্ব করে বলতেন আমি পচিশ ভাইয়ের বড় ভাই। অবশ্য বোনদের মধ্যে অনেকেই বয়সে তার সিনিয়রও আছেন। তবে তিনি বড় ছোট সবার কাছেই সমান জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সফল শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি। তার উৎসাহ ও প্রেরণায় আমাদের গ্রামের অনেক পরিবারে আজ উচ্চ শিক্ষিত ছেলে-মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত। তিনি যেমন ছিলেন সবার বড় তেমনি বড় ভাইয়ের মত ব্যক্তিত্ব ও অভিভাবকত্ব করার যোগ্যতাও ছিল তার মধ্যে উত্তমরূপে।
এক কণ্যা সন্তানসহ তিনি তিন সন্তানের পিতা। তার বড় ছেলে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। দ্বিতীয় মেয়ে সন্তান। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ইচ্চুক। তৃতীয় সন্তান ছেলে আগামীবার এস. এস. সি পরীক্ষার্থী। তিনি গতকাল মেয়েকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় নিয়ে যাওয়ার জন্য চট্টগ্রামে আসার পথেই আকশ্বিক সড়ক দূর্ঘনায় ইন্তেকাল করেন।
সবার প্রতি আবেদন করছি তার রুহের মাগফিরাত কামনার।
বিষয়: বিবিধ
৩৫২৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন