মেয়ের উদ্দেশ্য লেখা ড. বেলগাতীর সেই আবেগময়ী চিঠির উত্তর দিলেন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী এরদুগান নিজের চোখের পানি দিয়ে।
লিখেছেন লিখেছেন আহমদ মুসা ২৯ আগস্ট, ২০১৩, ১১:৪১:১০ সকাল
ড. বেলগাতীর সেই সাড়া জাগানো চিঠির উত্তর দিলেন তুর্মি প্রধানমন্ত্রী রজব তাইয়েব এরদুগান তার চোখের পানি দিয়ে।
মিসরের এক কিশোরীর মৃত্যুতে শোকে মূহ্যমান এখন বিশ্বের নানা প্রান্তের লক্ষ-কোটি মানুষ। তার নাম আসমা আল-বেলতাগি। মাত্র ১৭ বছর বয়সী এই কিশোরীর দেশের প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা, দেশের মানুষের প্রতি ছিল গভীর মমত্ববোধ। কোরআনে হাফেজ এই কিশোরী ইসলামকে গ্রহণ করেছিলেন জীবনের একমাত্র পাথেয় হিসেবে।
মানবসেবায় নিবেদিতপ্রাণ আসমা হতে চেয়েছিলেন চিকিত্সক। তার আর চিকিত্সক হওয়া হয়ে ওঠেনি। মিসরের বর্বর সেনাদের গুলিতে তিনি শহীদ হয়েছেন। অবিচলচিত্তে জীবন বিলিয়ে দেয়া আসমা নামটি এখন এক বিপ্লবের প্রতীক। এই নামটি এখন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদস্পন্দন।
গত ১৪ আগস্ট মিসরের রাজধানী কায়রোর বিখ্যাত রাবা আল-আদাবিয়ায় সেনাবাহিনীর গুলিতে গণতন্ত্রকামী যে শত শত মানুষ নিহত হয়, আসমা তাদেরই একজন।
আসমার মৃত্যুতে শুধু মিসরের লাখো-কোটি মানুষই মুষড়ে পড়েননি, তার মৃত্যুতে অঝোর ধারায় কেঁদেছেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েব এরদোগান। এরদোগানের কান্নার সাথে একাত্ম হয়েছেন বিশ্বের অগুনতি মানুষ।
অন্য দশজন থেকে আসমা ছিলেন ব্যতিক্রমী। উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া আসমা জীবনে কখনও দ্বিতীয় হননি। তিনি ছিলেন কোরআনে হাফেজ। কোনো কাজ না থাকলে তিনি মূলত কোরআন তেলাওয়াত করেই সময় কাটাতেন। ধর্মপরায়ণতায়, কমনীয় আচরণে তিনি ছিলেন ঈর্ষণীয় উচ্চতায়। অমায়িক আর বুদ্ধিমতী হিসেবে তার খ্যাতি ছিল কায়রোজুড়ে। মাত্র এক মাস আগে তিনি কোরআনে হাফেজ হন।
মিসরীয় ইসলামী আন্দোলনের এক বীর সিপাহশালার ড. মোহাম্মদ আল বেলতাগির একমাত্র কন্যা আসমা। মিসরের সেক্যুলার সেনাবাহিনী দেশটির ইতিহাসে প্রথম অবাধ নির্বাচনে জয়ী প্রেসিডেন্ট ড. মুহাম্মদ মুরসিকে সরিয়ে দেয়ার পর ব্রাদারহুডের যে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছেন, তাদের অন্যতম হলেন ড. বেলতাগি। কন্যার মৃত্যুর সংবাদ তিনি শুনেছেন আত্মগোপনে থেকে। তার জানাজায়ও তিনি শরিক হতে পারেননি।
তিনি নারীদের সচেতন করার জন্য ছিলেন সদাসচেষ্ট। ব্রাদারহুডের সব আন্দোলন বিক্ষোভে শরিক হওয়ার পাশাপাশি তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে অন্যান্য সংগঠনের আন্দোলনেও শরিক হতেন। তিনি তার বাবাকে গাজাগামী তুরস্কের ফ্লোটিলায় যেতে উত্সাহিত করেন। আসমা নিজেও সেই ফ্লোটিলায় শরিক হতে চেয়েছিলেন। ওই ফ্লোটিলায় ইসরাইলি কমান্ডোরা গুলি চালিয়ে নয়জনকে হত্যা করে। তিনি দাতব্য সংস্থা গ্লোবাল রিলিফের কার্যক্রমেও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
কীভাবে নিহত হন আসমা : ১৪ আগস্ট গণহত্যার খবর শুনে কায়রোর একটি অস্থায়ী হাসপাতালে আহতদের সেবা করতে ছুটে যান আসমা। পথেই তিনি সেনাদের গুলির মধ্যে পড়েন। সেনারা তার বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। গুলি লাগে তার মগজ, বুক ও বাম পায়ে। তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। প্রয়োজন হয় রক্ত দেয়ার। সেই চেষ্টাও চলতে থাকে। এরই মধ্যে তার জীবনপ্রদীপ নিভে জান্নাতের পথে রাওয়া দেন । তাকে রাখা হয় নসর সিটির অস্থায়ী হাসপাতালের মর্গে। পরদিন তার দাফন হয়। জানাজায় শরিক হন লাখো মানুষ। তার ভাই আম্মার আল বেলতাগি তার জানাজায় ইমামতি করেন। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন আসমার আত্মীয়রা। এই কান্নার ডাক ছড়িয়ে পড়ে গোটা মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে।
আসমাকে লেখা ড. বেলতাগির চিঠি : আসমার বাবা ড. মোহাম্মাদ আল-বেলতাগি মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টির মহাসচিব। তিনি একজন নির্বাচিত নেতা। আসমার মৃত্যুর খবরে স্বভাবতই শোকে মূহ্যমান বেলতাগি একটি আবেগময় চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি লেখেন :
আমার প্রিয় মা, সম্মানিত শিক্ষক আসমা আল-বেলতাগি, আমি তোমাকে বিদায় বলবো না। আমি বলবো শিগগিরই আমাদের দেখা হবে। মা আমার, স্বৈরতন্ত্র আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে তুমি বেঁচে ছিলে তোমার শির উঁচু করে এবং তুমি ভালোবাসতে মুক্ত জীবন। নতুন উচ্চতায় জাতি গঠন এবং জাতিকে সভ্যজগতে স্থান করে দিতে তুমি ছিলে এক নীরব বিপ্লবী। সমবয়সী আর কয়েকটা ছেলেমেয়ের মতো, তোমার চাওয়া-পাওয়া ছিলো না। তোমার চাওয়া-পাওয়া সবসময়ই ছিল ভিন্ন। ক্লাসে প্রথম স্থানটা সবসময় তোমারই ছিল।
আমার এ ছোট্ট জীবনে তোমার মূল্যবান সাহচর্য আমি খুব বেশি পাইনি। বিশেষ করে আমার ব্যস্ত জীবন তোমার সাহচর্য পাওয়ার সুযোগ আমাকে দেয়নি। তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় রাবা আল-আদাবিয়া স্কয়ারে। তুমি আমাকে বলেছিলে : ‘বাবা, আমাদের সঙ্গে থাকলেও তোমাকে সবসময় ব্যস্তই দেখি।’ জবাবে আমি বলেছিলাম, ‘এ ছোট্ট জীবনটা মনে হয় আমাদের দেখা-সাক্ষাতের জন্য বা কিছু স্নেহের মুহূর্ত কাটানোর জন্য খুব কম। তাই আল্লাহর কাছে দোয়া করি জান্নাতে যেন আমাদের দেখা হয়, যেখানে সময় হবে অফুরন্ত।’
তোমার শাহাদাতের দুদিন আগের ঘটনা। স্বপ্নে দেখি- তুমি ধবধবে সাদা বিয়ের পোশাক পরে আছো। সফেদ পোশাকে তোমাকে খুব সুন্দর লাগছিল। তুমি যখন আমার পাশে বসলে, আমি জিজ্ঞেস করলাম— ‘আজ কি তোমার বিয়ে?’ তুমি হেসে জবাব দিলে , হা বাবা, আজ বিকেলে।’ আমাকে যখন বলা হলো, বুধবার বিকেলে রাবা স্কয়ারে তুমি শাহাদাতবরণ করেছো, ‘আমি বুঝলাম কেন সেদিন তুমি বলেছিলে আজ বিকেলে। এখন আমার দৃঢ় বিশ্বাস আল্লাহর দরবারে তুমি শহীদ হিসেবে কবুল হয়েছো। আমি যে সত্যের পথে আছি আর আমাদের শত্রুরা যে মিথ্যায় নিমজ্জিত তুমি আমার এই বিশ্বাসকে আরো শক্ত করেছো।’
আমি তোমার জানাজায় শরিক হতে পারিনি সে এক অব্যক্ত কষ্ট ও কান্না। আমি তোমার মুখ শেষবারের মতো জানাজা শেষে দেখতে পাইনি, কপালে শেষ চুমু দেয়ার সুযোগ আমি পাইনি। তোমার জানাজার নেতৃত্ব দেয়ার সম্মান আমার হয়নি।
আমি আল্লাহর নামে শপথ করছি— হে আল্লাহ, আমি আমার জীবন এবং অন্যায় কারাজীবন নিয়ে শঙ্কিত নই। কিন্তু বিপ্লবের জন্য এবং এর উদ্দেশ্য সাধনে আমি তোমার (মেয়ে আসমা) বার্তা বহন করতে চাই, যা তুমি আত্মোত্সর্গ করার মধ্য দিয়ে রেখে গেছো।
স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধে উঁচু শির নিয়ে তুমি ঊর্ধ্বলোকে চলে গেছো। স্বৈরাচারের বুলেট তোমার বক্ষকে বিদ্ধ করেছে। কিন্তু তোমার আত্মা অত্যন্ত দৃঢ় এবং পুণ্যময়। আমি আত্মবিশ্বাসী যে, তুমি তোমার স্রষ্টার প্রতি সৎ এবং আমাদের মধ্য থেকে তিনি তোমাকে সম্মানিত করতে শাহাদাতের জন্য মনোনীত করেছেন।
সবশেষে বলবো, প্রিয় মা, আমার সম্মানিত শিক্ষক, আমি তোমাকে চিরবিদায় দেবো না। তবে বিদায়; জান্নাতে প্রিয় নবীর (সা.) সঙ্গে আমাদের দেখা হবে এবং তার সান্নিধ্যে আমাদের পরস্পরের সাক্ষাৎ হবে আর প্রিয়জনের সাহচর্য লাভ সত্য হয়ে আসবে।
আসমার জন্য এরদোগানের কান্না : গত ২২ আগস্ট তুরস্কের একটি লাইভ টিভি অনুষ্ঠানে কান্না করতে দেখা যায় মুসলিম বিশ্বের সাহসী কণ্ঠস্বর তুরস্কের ইসলামপন্থী প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েব এরদোগানকে। তাকে বেলতাগির চিঠিটি পড়ে শোনানো হয়। চিঠিটি শোনার পর তিনি বেশ কিছু সময় ধরে বাকরুদ্ধ ছিলেন, তাকে দেখা যায় টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়লে এরদোগানের বিরল সেই কান্নার দৃশ্য কোটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল।
সেই কান্নার কারণ গতকাল নিজ মুখেই বর্ণনা করেছেন এরদোগান, যাকে একজন শক্ত মনের শাসক হিসেবেই মানুষ মনে করে থাকে। এরদোগানের এই বর্ণনায় উঠে এসেছে ইসলামী আন্দোলন করতে গিয়ে একজন পিতার ত্যাগের দৃষ্টান্ত। পিতা হয়ে সন্তানদের সময় দিতে না পারার কষ্টের অব্যক্ত আকুতি।
সম্প্রতি তুরস্কের একটি টেলিভিশন চ্যানেল এরদোগানের কাছে গিয়ে বিষয়টি তার নজরে আনেন। টিভি স্টেশনটির প্রতিবেদক প্রশ্ন করেন, আপনার মেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছিল, আমার বাবাকে (এরদোগান) এভাবে কখনো কাঁদতে দেখিনি। কেন আপনি কেঁদেছিলেন কিংবা মিসরের কোন বিষয়টি আপনাকে এতটা গভীরভাবে স্পর্শ করেছে?
উত্তরে এরদোগান বলেন, ‘আসমাকে লেখা মিসরের ব্রাদারহুড নেতা মোহাম্মদ আল-বেলতাগির চিঠি পড়ে আমি কেঁদেছিলাম। কারণ এ ধরনের ঘটনা আমার জীবনের সঙ্গেও জড়িত।’
তিনি বলেন, ‘সংগঠনের কাজে বাসায় ফিরতে প্রায় সময় রাত একটা-দুটা বেজে যেতো। সে সময়ের মধ্যে আমার সন্তানরা ঘুমিয়ে পড়তো। এভাবে প্রায় সময় দেরিতে বাসায় ফিরতাম। আসমাকে লেখা তার বাবার চিঠি পড়ে আমার সেসব দিনের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। তার বাবাও কাজের কারণে তাকে সময় দিতে পারতেন না। তিনি চিঠিটা লেখার সময় এ কথাগুলো লিখেছিলেন। আর আমি এটি পড়ার সময় নিজের চোখের সামনে আমার ছেলেমেয়েকে কল্পনা করছিলাম।’
তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আসমার বাবা তার মেয়ের জানাজা পড়তে পারেননি। আসমার মৃত্যু এবং মৃত্যুর আগে রাবেয়া ময়দানে মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে বাবা আর মেয়ের আলোচনা আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘অবশ্য শাহাদাত ভিন্ন একটি ব্যাপার। আসমা তার দুনিয়ার জীবন পরিপূর্ণভাবে উপভোগ না করে শহীদ হওয়ার জন্য সংগ্রাম করে গেছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আসমা এবং তার বাবার মধ্যকার কথোপকথন ইসলাম এবং মুসলমান বিশ্বের দেশগুলোর তরুণ-যুবকদের জন্য একটা শিক্ষণীয় বিষয়। এই বাবা-সন্তানের সম্পর্ক আমাদের মতো সব বাবা-সন্তানের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে। আমি এ কথাগুলো একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, সাধারণ নাগরিক হিসেবে বলছি।’
এরদোগান বলেন, ‘অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তুরস্কবাসীর জন্য আমার সালাম জানাচ্ছি। আমরা যেন একে অপরকে শুধু আল্লাহর জন্যই ভালোবাসতে পারি। আর যারা আমাদের দেশ ও জাতির মধ্যে ফেত্না সৃষ্টি করতে চায়, তাদের যেন সে সুযোগ আমরা না দিই।’
আমরা সবাই আসমা আল-বেলতাগি : আসমার মৃত্যুর খবরটি শিরোনাম হয়েছে বিশ্বের প্রায় সব গণমাধ্যমে। এমনকি পশ্চিমা গণমাধ্যমও এই মহীয়সী কিশোরীর প্রতি জানিয়েছে অগাধ শ্রদ্ধা। ইসলামের প্রতি অবিচল অথচ আধুনিক চিন্তা-চেতনায় অগ্রগামী এই কিশোরী মিসরের সেনা অভ্যুত্থানবিরোধী বিপ্লবের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। তিনি বিখ্যাত রাবা আল-আদাবিয়া এবং তাহরির স্কয়ারের মতো এখন মিসরীয়দের আইকন।
তার মৃত্যুর পর রাজপথে বিক্ষোভ মিছিলে শোভা পেয়েছে ‘আমরা সবাই আসমা আল-বেলতাগি’ লেখা ফেস্টুন। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখা হচ্ছে শত সহস্র নিবন্ধ। আসমার পক্ষে ওমরা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বহু মানুষ। বহু ফিলিস্তিনি তার জন্য আল-আকসা মসজিদে নামাজ পড়ে দোয়া করেছেন।
এই লেখাটি ফেইসবুক সহ বিভিন্ন সামাজিক সাইটে বেশ পঠিত হয়েছে।লেখাটি পড়ে আমার খুব ভাল লেগেছে। ফেইস বুক থেকে সংগ্রহ করেছি এই লেখাটি। অনেকেই ড. বেলতাগীর আবেগময়ী সেই চিঠিটি পড়েছেন। ঠিটি এখানে প্রাসঙ্গিক বিধায় আবারো উল্লেখ করা হয়েছে।
বিষয়: বিবিধ
৩৫৭৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন