বেরসিক মাছের গল্প নিয়ে আরো কিছু কথা

লিখেছেন লিখেছেন আহমদ মুসা ২৪ আগস্ট, ২০১৩, ০১:৪০:৫৫ দুপুর

কেইস স্টাডি-৪

শৈশবের কাহিনী। তখন কার বয়সের হিসেব কে রাখে! হয়তো সাত আট বছর হবে। বরশি দিয়ে মাছ ধরার বড়ই শখ। কলা গাছের গোড়ায় বাসা বেধে সংসার রচনা করেছে হাড্ডিহীন মাংশে ভরপুর চিকন চিকন লম্বা লম্বা একঝাক প্রাণী! এরা কি খাওয়ার নুডুলস নাকি কেচো? নিষ্ঠুর কোদালের এক কোপের আঘাতে চিন্নভিন্ন দেহ নিয়ে মাঠির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসলো কয়েকটি। ওখান থেকে একটির খন্ডাংশ দিয়ে বরশিতে গেথে তৈরী করা হল মাছের জন্য সুস্বাদু নুডুলস।



বাড়ীর সাথে লাগোয়া পিছনের পুকুরে সুবিধাজনক স্থানে মাছ শিকারের জন্য বরশি ফেলা হল। বেত গাছের সাথে বরশি বেধে দেয়া হল। ঐ দিকে শৈশবের বন্ধু বান্ধবদের ডাকাডাকিতে খেলার মাঠে নিজের শুন্যতা একদম কাম্য নয়। তাই বরশি দিয়ে মাছ ধরার জন্য বসে থাকার ইচ্ছাতে কিছুটা ভাটা পড়ল। এদিকে নুডুলসের সুগ্রাণ বিড়ালের খালাত ভাই ক্যাট ফিশ তথা দেশীয় জাতের মাগুড় মাছ সবার আগেই পেয়েছে। তাই ডানে বামে তাকানোর সময় নষ্ঠ করেনি। নুডুলস খেতে এসে আটকে গেল ফাটা কলে। শালা ক্যাটফিশ! তুই কি কালো বিড়ালের খালাতো ভাই? না হয় বেহায়ার মত এতো লোভাতুর হলি কেন? কালো বিড়ালের খালাতো ভাইকে খুজতেছিল তৈলাক্ত শেখদের বডিগার্ড বাঘ খাটাস বোয়াল মাছ। বন্দী অবস্থায় পেয়ে পেটের ক্ষুদা মিটানোর আশায় ঝাপিয়ে পড়লেন মাগুড় মাছের উপর। মাগুড় মাছের লম্বা দুই কাটা গেথে গেল বোয়াল মাছের গালের দু’পাশে। বেচারা আটকে গেল জনমের জন্য। বোয়াল মাছের অতিরিক্ত নাড়াচড়ার শব্দে বাড়ীর সবাই চলে আসলেন পুকুর পাড়ে। ওমা একি! পানির ভিতরের সব চেয়ে বড় আজরাইলটাই তো দেখি আটকে গেল বড়শির ফাদেঁ। বড়দের সহযোগীতায় সেই বোয়াল মাছটাকে পুকুর থেকে উঠানো হল। অনেক বড় সাইজের মাছ। বার তের সেরের কম হবে না। এতো বড় মাছ বরশিতে ধরা কিভাবে সম্ভব হলো! তাও আবার বোয়াল মাছ? রহস্য অনুসন্ধানের প্রয়োজন নেই। পুকুরের অংশীদার সবার জন্য মাছটি জবেহ করে কেটে টুকরা টুকরা করা হলো ভাগ করার জন্য। সহজেই রহস্য বেরিয়ে আসলো এই বিশাল আকৃতির মাছটি কেমনে ধরা পড়লো। যে শিশুটি বুদ্ধি খাটিয়ে নুডুলসের ফাদ ফেদে এতো বড় মাছটি ধরার সুযোগ হলো তার ভাগে একটু বেশি দেয়া হলো। ভাগের অংশ মা অত্যন্ত ভালভাবে রান্না করলেন। দেশীয় পুকুরের মাছ বলে কথা। স্বাদই আলাদা। দারুন মজাদার।



অল্প কিছুক্ষণ পর পরিবারের সবার সাথে আমিও রাতের আহার গ্রহণ করতে যাবো। আমার মা বেশ কয়েকটি আইটেম দিয়ে রাতের খাওয়া পরিবেশন করলেন। কিন্তু সেদিন কোন জাতের মাছের আইটেম ছিল না আমাদের ঘরে। মা’কে বল্লাম আমারে মাছ না হয় না দিলেন অন্তত মাছের একটু ঝোল দেন। দুধের স্বাদ গোলে মিটাবো। আমার মা একটু হাসলেন। মায়ের হাসির সাথে সবাই যোগ দিলেন। সবার হাসাহাসির সাথে আমি আর কি কিই বা করতে পারি! আমিও একটুখানি মুসকি হাসলাম। কি বুঝলেন আপনারা? আসলে এধরনের কোন ঘটনাই আমার ক্ষেত্রে ঘটেনি। এই ঘটনা ঘটেছিল আমার জন্মের অন্তত সত্তর বছর পূর্বে। এখন এটি একটি কাহিনী। এই কাহিনী আমার মা শুনেছিলেন আমার নানী থেকে। আমার নানিকে শৈশবের স্মৃতির আকর্ষণীয় ঘটনার বর্ণণা দিয়ে হয়তো নানাভাই নানির মন জয় করতে চেয়েছিলেন। হয়তো সফলও হয়েছিলেন। না হলে নানা নানির দাম্পত্য জীবন এতো সুখের হলো কেমনে? এই ঘটনার নায়কও আমার মরহুম নানাজান।

কেইস স্টাডি-৫

আফ্রিকান জাতের মাগুড় মাছ। জাতে বিদেশী হলেও এসব মাছের মধ্যে বৈদেশিক উন্নতমানের কোন রুচিবোধ বা সুন্দর শৃঙ্খলা নেই। এক্কেবারে আফ্রিকান জঙ্গলী আচারণ এদের। নোংরা পানিতে থাকতে পারে। নালা নর্দমার পানির চেয়েও পচাঁ পানিতে এদের বসবাস। খাদ্যাভ্যাসেও নেই কোন ধরাবাধা নিয়ম। যা পায় তাই খায়। কালো বিড়ালের খাটি বংশধর। বনের রাজা সিংহ বা রয়েল বেঙ্গল টাইগারও যদি এদের খপ্পরে পড়ে এক ঘন্টার মধ্যেই ছাবাড় করে দিবে। পিরানহা মাছের চেয়ে কোন অংশেই কম হিংস্র নয়। খাওয়া তো পরের কথা জীবনেও কোনদিন এই মাছ আমি খরিদ করিনি।



ছুটিতে আসা বিদেশফেরত আমার এক গনিষ্ঠ আত্মীয়ের অনুরোধে তার সফর সংগী হয়ে বাজারে গেলাম। বাজারে বড় বড় সাইজের মাগুড় মাছ দেখে সে কিনতে চাইল। আমি শত চেষ্টা করে তার আগ্রহে ভাটা ফেলাতে পারিনি। বড় সাইজের মাগুড় মাছ তার খেতে বড়ই শখ জেগেছে। কি আর করা। একটা মাছ খরিদ করলেন। আমি তারে অনুরোধ করলাম প্রফেশনাল মাছ কাটার লোক থেকে সাইজ করে বাসায় নিতে। কিন্তু না, তার আগ্রহ জ্যান্ত মাছটিকে বাসায় নিয়ে নিজ হাতে সাইজ করে নিজেই রান্না করে খাবেন এবং বাসার সবাইকে খাওয়াবেন। তাদের বাসায় কেউ সম্ভবত এই মাছ খেতে পছন্দ করে না। কিন্তু বিদেশ থেকে ছুটিতে আসা লোকটি মনে কষ্ট পাবে ভেবে কেউ মুখ খুলছে না। জ্যান্ত মাগুড় মাছটিকে অনভ্যস্ত হাতে সাইজ করতে গিয়ে নিজের হাতটাও সামান্য কেটে ফেললেন। তার পরেও নাচোড় বান্দা। অবশ্য তিনি ভাল রাধতেও জানেন। তার হাতের রান্না করা পাক অত্যন্ত সুশ্বাদু। অবস্থা বেগতিক দেখে একটি যৌক্তিক অজুহাত দাড় করিয়ে মাগুড় মাছ খাওয়ার অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার আশায় আমি সটকে পড়লাম। মোবাইলে যোগাযোগ হলেও তিনদিন পর্যন্ত আমি সেখানে যায়নি। অতিরিক্ত পিড়াপিড়ি করার কারণে চতুর্থ দিন গেলাম। আমার ধারণা ছিল বাসার সদস্যে সংখ্যার অনুপাতে এই চার দিনে মাছের ডেস্কি খালি হয়ে যাওয়ার কথা। রাতের ডিনারে খেতে বসলাম তার সাথে। অন্যন্যা আইটেমের সাথে দেখতে পাচ্ছি সেই মাগুড় মাছ! আমাকে বলা হলো কষ্ট করে তার সফর সংগী হয়ে বাজারে গেছি তাই আমাকে না খাওয়ালে তার কেমন যেন অপরাধবোধ জাগছে মনে। এজন্যই এই পরিবেশনা। আলাদা একটি বাটিতে একটি অপরিচিতি আইটেম দেখা যাচ্ছে। ওটা নাকি মাগুড় মাছে ডিম! দেখতে অনেকটা বিড়াল কিংবা কুকুরের অর্ধ শুকনো হাগুর মত। আমার তো বমি আসার আর বাকী নেই। দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে তারাতারি ডুকলাম বাতরুমে। একদিকে আমার বমির তীব্র আশংকা অন্যদিকে তিনি আমার জন্য ডাইনিং টেবিলে অপেক্ষায় আছেন সৌজন্যতাবশত। আহহারে মাছ তুই এবার আমারে মুক্তি দেয়!!!

কেইস স্টাডি-৬

আদরের পিচ্চি শ্যলক এবং শ্যলিকা। দু’জনই আমারে বেশ পছন্দ করে। কোন একদিন রাতের ডিনারের পর বায়না ধরেছে তাদেরকে গল্প শুনাতে হবে। আসলে তাদেরকে উস্কে দিয়েছে পর্দার আড়ালে থেকে সিনিয়র শ্যলিকা। আমি তো কোন গল্প বানাতে পারি না। মাথায় কিছুই আসছে না। আগুডুম বাগডুম কি আর বলবো? হঠাৎ মনে পড়লো আমার এক বন্ধুর মুখে শোনা পাঙ্গাস মাছের কাহিনী। বলা শুরু করলাম পাঙ্গাস মাছের সেই কিচ্ছা-



শশুর বাড়ীতে গেছে নতুন জামাই। জামাইকে মেহমানদারী করার জন্য শশুর পক্ষের লোকজনের ব্যস্ততার সীমা নেই। নামী দামি সব উন্নতমানের খাবারের পাশাপাশি আরাম আয়েশের একেবারে স্বর্গীয় ব্যবস্থাই করে রেখেছে। শশুর মশাই গেছেন বাজারে সওদা করার জন্য। বাজার থেকে অন্যন্যা আইটেমের সাথে একটি পাঙ্গাস মাছও বাজারের থলের বাইরে রশি বেধে হাতে করে নিয়ে আসলেন। শশুর মশাই সওদা নিয়ে ফেরত আসা নতুন জামায়ের দৃষ্টি এড়াইনি। খাওয়ার টেবিলে একে একে সব আইটেম পরিবেশ করলেন। নতুন জামাইসহ পরিবারের সবাই বসলেন এক সাথে খাবার টেবিলে। এতো বেশি আইটেম পরিবেশন করা হয়েছিল যে, একজনের ভাগের খাদ্য অন্তত দশজন খেতে পারবে। নতুন জামাই একটা বিষয় খেয়াল করলেন যে, সবম্ত আইটেম পরিবেশ করা হল কিন্তু তার স্বচক্ষে দেখা সেই পাঙ্গাস মাছ পরিবেশন করা হয়নি। নতুন জামাই মুখে রুমাল দিয়ে লজ্জা ডাকার ভাব দেখানোর একটা রেওয়াজ প্রচলিত আছে আমাদের সমাজে। আমি গল্প বলে যাচ্ছি। গল্প বলার ফাকে ফুকে তাদের বিভিন্ন প্রশ্নবানে আমাকে ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে বিস্তারিতভাবে। আমি বলে যাচ্ছি- নতুন জামাই ডিনার সেরে বিচনাতে গিয়ে আরামছে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আর ঘুমের ঘোরে আওড়াচ্ছে-

পাঙ্গঙ্গঙ্গাসসস

পাঙ্গঙ্গঙ্গাসসস

নতুন জামাইয়ের এই নাক ডাকা আওয়াজ শুনতে পেয়ে শশুর মশাইও তার উত্তর দিচ্ছে-

অনেকটা ঘুমের ঘোরে-

কাইল খাইস

কাইল খাইস

অর্থাৎ আগামী কাল খেতে পারবেন।

আমার কাহিনী বলা এখানেই শেষ করলাম। হাসি ঠাট্টা যা করার ছিল তা শেষ করে যার যার বিচনাতে গিয়ে ঘুমাতে গেছি। আমার গিন্নীকে বলতেছি- আচ্ছা আমি তো পাঙ্গাস মাছ পছন্দ করি না। কিন্তু পাঙ্গাসের কিচ্ছা বলে তোমার ভাইবোনদের আচ্চা মত হাসাতে পেরেছি। সকালে শাশুর বাড়ী থেকে অফিসে আসার মুহুর্তে গিন্নী খবর দিলো সিনিয়র শ্যলিকা আমার জন্য ভাত রেডি করেছে। খেয়েই অফিসে যাবেন। খাওয়ার টেবিলে বসে দেখি কাকতালীয়ভাবে পাঙ্গাস মাছের পরিবেশনা!!! আমার বৌয়ের মাধ্যমে খোজ নিয়ে জানতে পারলাম তাদের ঘরে পূর্ব থেকে পাঙ্গাস মাছ ছিল না। এটা আমার সিনিয়র শ্যলিকার কারসাজি। হায়রে মাছ! তুই বড়ই রহস্যময়ী।

মাছ নিয়ে লিখিত প্রথম ব্লগটি এখনে ক্লিক করুন

বিষয়: বিবিধ

৫৬৭৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File