‘‘বাপ বেটা একত্রে শহীদ হতে চাই’’
লিখেছেন লিখেছেন সুন্দরের আহবান ২৪ জুন, ২০১৪, ০৯:৫১:২৩ রাত
আমিনুল ইসলাম সাহেব বাংলাদেশ জুট করপোরেশনের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা ছিলেন। কর্ম জীবনে অনেক বড় বড় দায়িত্ব পালন করেছেন। কর্ম জীবনের শেষ দিকে খুলনা ক্রিসেন্ট জুট মিলের ডেপুটি ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেছেন। সুন্দর সুমোহিত চেহারার এ ব্যাক্তি উচ্চতায় ছিলেন সাত ফিট। একজন ইংরেজী শিক্ষিত মানুষ হওয়া সত্বেও কুরআন তেলাওয়াত ছিল খুবই সহীহ। দরজা কন্ঠে যখন কুরআন তেলাওয়াত করতেন সবাই আবিভুত হয়ে যেতেন। ক্রিসেন্ট জুট মিলের যখন ডেপুটি ডিরেক্টর ছিলেন তখন তিনি সেখানকার বড় মসজিদে জুমুয়ার নামাজ পড়াতেন। তিনি যখন মোনাজাত করতেন মনে হতো যেন সরাসরি আল্লাহর সাথে তার হৃদয়ের আকুতিভরা আবেদনগুলো পেশ করছেন এবং পরম প্রিয় বান্দার মতো মহান প্রভুর সাথে কথা বলছেন। একই মোনাজাতে একবারে আল্লাহর নিরানব্বই নাম নিয়ে তাকে ডাকতেন আর একটি একটি আবেদন পেশ করতেন। ইংরেজী শিক্ষিত লোক হওয়া সত্বেও সব সময় বড় জোব্বা এবং পাগড়ি ব্যবহার করতেন। মূখে ছিল অজানুলম্বিত দাড়ি। কোন যায়গায় দ্বীনের কোন আলোচনা শুরু করলে সাধারণ জনগণ প্রশ্ন করতেন মাওলানা সাহেব কোন মাদরাসারা মুহাদ্দিস? অথচ তিনি তার ছাত্র জীবনে মাদরাসায় পড়ার সূযোগ পাননি। দীন কায়েমের আন্দোলন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দাওয়াত পাওয়ার পর তিনি ব্যাক্তিগত উদ্যোগে ক্বারী সাহেবের কাছে প্রাইভেট পড়ে সহীহ কুরআন শিখেছেন। বিভিন্ন তালিম তারবিয়াতে আলেমদের সংস্পর্শে এসে কুরআন হাদীসের জ্ঞান অর্জন করেছেন। আর বাকীটা ব্যাক্তিগতভাবে বাসায় কুরআন, হাদীস, ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়ন করেছেন। একজন বড় মাপের সরকারী কর্মকর্তা হওয়া সত্বেও দীন কায়েমের আন্দোলনে পাহাড়াদারের ভূমিকা পালন করেছেন। বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সমাবেশের শৃংখলা বিভাগের সদস্য হিসেবে প্রচন্ড খড়তাপে দাড়িয়ে লাািঠ হাতে দায়িত্ব পালন করেছেন। মিছিলের অগ্রভাগে তিনি বীর সেনানীর মতো অগ্রসর হতেন। মিছিলে যেমন থকাতেন সামনের কাতারে আবার নামাযের জামাতেও থাকতেন সামনের কাতারে। দায়িত্বশীলদের আনুগত্যের ক্ষেত্রে কখনো কোন হীনমন্যতা তার মধ্যে কাজ করেনি। ওনার সাথে আমার পরিচয় ১৯৯৭ সালে। তখন সারুলিয়া ইউনিয়ন জামায়াতের সভাপতি ছিলেন মরহুম মাওলানা আতাউর রহমান ফারুকী ভাই। ফারুকী ভাই আমিনুল ইসলাম সাহেবের একটি ঘটনা আমাকে বললেন। ইসলাম ও মুসলিম জাতিসত্বার চির দুশমন নাস্তিকবাদী চিন্তার ধারক ও বাহক বাম কমিউনিস্টরা ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ থেকে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবীতে আন্দোলন করছে। তারা ইসলাম ও ইসলামী রাজনীতি নির্মূলের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার জন্য প্রথমে জামায়াতে ইসলামীকে টার্গেট করে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবী জানায় এক পর্যায়ে তারা ঘোষণা দেয় সারা দেশে জামায়াতের কার্যালয়ে হামলা করবে। কমিউনিস্ট এবং বামদের এ সন্ত্রাসী ঘোষনার কারণে সারাদেশে কমিউনিস্ট সন্ত্রাসীরা এবং তাদেও সাথে আওয়ামী পান্ডারা মিলে শতাধিক যায়গায় জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরের কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। বহু যায়গায় কুরআন হাদীসে অগ্নি সংযোগ করা হয়। তারা এক পর্যায়ে মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং পুরানা পল্টনে মহানগরী অফিসে হামলার ঘোষণা দেয়। বাম, রাম, কমিউনিস্ট ও ঘাদানিকদের এ সন্ত্রাসী ঘোষনার পর জামায়াতে ইসলামীর নেতা কর্মীরা অফিস পাহাড়া দিতে শুরু করে। যেদিন তারা ফাইনাললি অক্রমন করার প্রস্তুতি নিয়েছে সেদিন ঢাকা মহানগরীর সকল জনশক্তি দুভাগ হয়ে মগবাজারে এবং পল্টনে অবস্থান নেয়। সে কর্মসূচীতে আমিনুল ইসলাম সাহেব তার ছোট ছোট তিন ছেলেকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। তখন তার বড় ছেলের বয়স আনুমানিক তের/চৌদ্দ, বাকী দুটো দু বছর করে ছোট হবে।তার মানে তার তৃতীয় ছেলের বয়স তখন আনুমানিক সাত/আট বছর। সবাই অবাক হয়ে কেউবা রাগ করে তাকে প্রশ্ন করলেন আজকে এই টেনশনের মধ্যে- যেখানে ঘাদানিকরা হামলা করতে পারে সেখানে ছোট ছেলেদের নিয়ে আসছেন কেন? আামিনুল ইসলাম সাহেব তার পাগড়িটি কোমড়ে শক্ত করে বেঁধে উত্তর দিলেন ‘‘বাপ বেটা একত্রে শহীদ হতে চাই’’। এরপর থেকে তার নামের সাথে সবাই উপাধি যোগ করে দেয় আমিনুল ইসলাম জিহাদী। আমিনুল ইসলাম জিহাদী আমাদের মাঝে নেই। তিনি তার কর্মের মাধ্যমে আমাদের মাঝে অনেক স্মৃতি রেখে গেছেন। যে কোন সময় আন্দোলনের কঠিন মূহুর্তে যত বড় বিপদই আসুক না কেন তিনি যেমন সামনের সাড়িতে থাকতেন আবার ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহর কাজেও ছিলেন অগ্রণী। তিনি এত দরজা কন্ঠের অধিকারী ছিলেন যে দু’চার’শ লোকের সমানে মাইক ব্যতীত বক্তব্য দিতে পারতেন। মিছিলে তার শ্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হতো। ১৯৯৭ সালে ঘাদানিকদের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে লন্ডনের চ্যানেল-ফোর থেকে একটি বানোয়াট ও মিথ্যা সাজানো ডকুমেন্টারী প্রকাশিত হয়। যার মাধ্যমে প্রমাণ করার চেস্টা করা হয় যে জামায়াত যুদ্ধাপরাধের কাজে জড়িত ছিল। এ সময় জামায়াতের বেশ কিছু মিছিলের ছবি তারা দেখায় ১৯৯৬ সালে বায়তুল মোকররমে অনুষ্টিত একটি মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন আমিনুল ইসলাম জিহাদী । তার ছবি চ্যানেল ফোরের ডকুমেন্টারীতে দেখানো হয়। এ ডকুমেন্টারী আবার বিটিভি প্রচার করে। বিটিভিতে এ বানোয়াট ডকুমেনটারী প্রচারের পর ডেমরার স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তার বাসায় হামলার অপচেস্টা চালায় পরবর্তীতে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এ বিষয়ে তিরস্কার করার পর আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ক্ষ্যান্ত হয়। আমলে আখলাকে আচরণে আমিনুল ইসলাম জিহাদী ছিলেন একজন প্রকৃত ঈমানদারের মূর্ত প্রতীক। তাক্বওয়া ভিত্তিক জীবন গঠনে তিনি ছিলেন আর দশ জনের চেয়ে ব্যাতিক্রম। যে বড় পদে চাকুরী করেছেন তিনি ইচ্ছে করলে অনেক সম্পদের মালিক হতে পারতেন। জুট করপোরেশনের অনেক পিওনেরও ঢাকা শহরে দু-তিনটি বাড়ি আছে। তিনি সারা জীবন টিনশেড ঘরে বসবাস করেছেন। জীবনের শেষ দিকে এসে আল্লাহর এ গোলাম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তার শরীরে প্রস্টেড ক্যান্সারের জীবনু ধরা পরে। জীবনের শেষ দিকে তিনি রোগ যন্ত্রনায় কস্ট করেছেন। সম্ভবত আল্লাহ তার এ প্রিয় গোলামকে যা ভুল ত্রুটি করেছেন তা মাফ করার জন্যই দুনিয়াতে এ কস্টটুকু দিয়েছেন। অনেক দিন রোগে কস্টের পর আল্লাহর এ প্রিয় গোলাম ২০০৯ সালে ইন্তেকাল করেছেন...... ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আমরা দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতে সর্বোচ্চ মর্যাদা প্রদান করেন। আমীন।
বিষয়: বিবিধ
১২২৫ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন