কোটি তরুণের কাফেলা এগিয়ে যাবে সামনে সত্য সুন্দরের পতাকা নিয়ে-সৃজন করবে আলোয় ভরা নতুন ভূবন
লিখেছেন লিখেছেন সুন্দরের আহবান ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ১২:৩৮:১৫ দুপুর
হৃদয়ের জানালায় স্মৃতির পাখিরা ডানা মেলে আমাকে নিয়ে যায় অতীতে। অতীত থেকে আমি আবার ফিরে আসি বর্তমানে। অসংখ্য স্মৃতির ভীড়ে কত আনন্দ, হাসি, কান্না, সূখ দুঃখ বেদনা- সব মিলিয়ে জীবনের এই অধ্যায়ে আমার আগমণ। আজ এক দুঃসহ বেদনার দুঃসহ সময়ে ভাবি আমি অতীত থেকে বর্তমান অনেক কিছুই। জীবনে না পাওয়ার অনেক হিসেব যেমন আছে তেমনি আছে পাওয়ার অনেক হিসেব। আজ যে পথে আমার জীবন পরিচালিত হচ্ছে সে পথে না হয়ে হতে পারতো অন্য কোন পথে। আজ প্রতিটি সকাল আর সন্ধ্যা যেভাবে আমার কাছে ধরা দেয় তা হতে পারতো অন্য কোনভাবে। জীবনের সূচনায় আমি আকর্শিত হয়েছিলাম এক হেরার রাজতোরণের দিকে যার নাম ‘ইসলাম’। এ কালজয়ী আদর্শ আমার কাছে এসেছে এক বিপ্লবী কাফেলার মাধ্যমে যার নাম ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির’। আজ ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। ১৯৭৭ সালের এমন দিনে এ মহান কাফেলা যাত্রা শুরু করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ থেকে। কোটি তরুণ আজ এ মুক্তির কাফেলায় শামিল। মাত্র গুটিকয়েক তরুণের সম্মিলিত প্রচেস্টায় হাজারো প্রতিবন্ধকতা, জুলুম, নির্যাতন আর বাঁধার পাহাড় মাড়িয়ে তা আজ এক বিশাল মহীরুহ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় আমি প্রথম ইসলামী ছাত্র শিবিরের নাম শুনি। ইসলামী ছাত্র শিবির রাজনৈতিক সংগঠন, না কি ছাত্র সংগঠন সেটি আমার কাছে কোন মূখ্য বিষয় ছিল না। আমার কাছে মূখ্য বিষয় ছিল যারা ইসলামী ছাত্র শিবিরের দায়িত্বশীল ছিলেন তাদের প্রত্যেকের আচরণ, চলা ফেরা কথাবার্তা, ব্যক্তিগত জীবন প্রণালী আর চারিত্রিক মাধুর্য্য। সামজের আর দশটি যুবক তরুণের চেয়ে তারা ছিলেন ব্যতিক্রম। এক অনুপম আদর্শ আর আকর্ষণীয় চরিত্রের একদল মেধাবী তরুণের বাস্তব মুখচ্ছবি আমাকে ইসলামী ছাত্র শিবিরের দিকে আকর্ষণ করে। প্রথমে যে কাফেলাকে ভাল লেগেছিল, যে কাফেলার তরুণদের আকর্ষণীয় চরিত্র ভাল লেগেছিল সেই কাফেলার প্রতি হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রীতে ভালবাসার যে বীজ রোপিত হয়েছিল তা আজো আছে আগের মতো অটুট বরং একটু বেশী। আজ সে কাফেলায় আমি নেই, নেই আমার মতো আরো অনেকেই। ছাত্র জীবনের সে সময়ের সাথীরা আজ নানা যায়গায় আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কিন্তু সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া আজো যেন সবাই সমান ভালবাসা অনুভব করে এ কাফেলার জন্য। প্রথমে ভাল লাগা তারপর ভালবাসা এরপর সে কাফেলার সমর্থক, কর্মী, সাথী, সদস্য হিসেবে বিভিন্ন যায়গায় দায়িত্ব পালন অতপর বিদায়। কিন্তু আদর্শ আর মন থেকে বিদায় নেয়নি ইসলামী ছাত্র শিবির। ইসলামী ছাত্র শিবির আমাকে শিখিয়েছে ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম, একটি আদর্শের নাম, যা অনুসরণ করতে হবে জীবনের প্রতিটি পড়তে পড়তে। দুনিয়ার লোভ ভালবাসকে তুচ্ছ গণ্য করে মহান ¯্রস্টার ভালবাসা এবং তার প্রতি তাওয়াক্কুল হবে জীবন চলার পথের পাথেয়। জাগতিক কোন সাফল্যই চূড়ান্ত নয় আসল সাফল্য নির্ণিত হবে আদালতে আখিরাতে। আখিরাতের সফলতাই প্রকৃত সফলতা। এ চরম এবং পরম সত্যকে ধারণ করেই আজো তাই আদর্শিকভাবে মিশে আছি ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাথে। আমি এখন আর শিবিরের কোন জনশক্তি নই, কিন্তু এ কাফেলার আদর্শিক সাথী। তাই আজো ভাবি বসে ছাত্র জীবনের সেই সোনঝড়া দিনগুলোর কথা। দায়িত্ব পালনকালে ছুটে বেড়িয়েছি এ মহল্লা থেকে ও মহল্লা। এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে। কলেজ ক্যাম্পাসে মাত্র বিশ বাইশ জনের মিছলে যে মানসিক শক্তি অনুভব করতাম তা আজো ভোলার নয়। ছাত্রলীগ অধ্যুষিত কলেজ ক্যাম্পাসে যারা প্রতি নিয়ত শ্লোগান দিতো ‘একটা দুইটা শিবির ধর সকাল বিকাল নাস্তা কর’- তাদের মিছিলে লোক থাকতো তিন থেকে চারশো। এর পাশাপাশি আমরা তাদের তাদের নাস্তা হওয়ার শ্লোগানকে তুচ্ছ মনে করে ২০/২২ জন নারায়ে তাকবীর শ্লোগান দিয়ে জানান দিতাম হে বন্ধুরা তোমরা যারা নরখাদক হয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছো আমরা তোমাদের জানিয়ে দিচ্ছি ‘আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় পাই না’। তবে সে সময়গুলো এখনকার মতো এতো জঘন্য ছিল না। যারা আমাদের সকাল বিকাল নাস্তা করার শ্লোগান দিতো তারাই আবার আমাদের সাথে একত্রে বসে চা খেতো। বর্তমানে আওয়ামীলীগ নেতা আমাদের সময়ে বরগুনা সরকারী কলেজের ভিপি ওয়ালীউল্লাহ ওলী ভাই আমাকে প্রায়ই বলতো তোমাকে খুব ভালো লাগে কিন্তু তুমি শিবির করো কেন? তখন মুচকি হেসে বলতাম ওলী ভাই ‘সম্ভবত শিবির করি বিধায়ই আমার কথা বার্তা এবং আচরণ আপনার কাছে ভাল লাগে’। তিনি কোন জবাব দিতেন না। সময়ের পরিবর্তনে আজ সব কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। আমি যে মফস্বল শহরে বড় হয়েছি ইন্টারমেডিয়েট পাশ করা পর্যন্ত ছিলাম সেই শহরে। জীবনের এ গুরুত্বপূর্ণ সময়টি কাটিয়েছি যে শহরে সেখানকার হাজারো স্মৃতি আজ মনের মাঝে ঢেউ তুলে। এ লেখাটি আমি এখন লিখছি কম্পিউটারে টাইপ করে তখন কি কম্পিউটারের কথা কল্পনা করা যেতো? জেলা থেকে থানায় চিঠি প্রেরণ, শিক্ষা শিবির, শিক্ষা বৈঠকের চিঠি, রিপোর্টিং, বার্ষিক পরিকল্পনা এমনকি ডেলিগেট কার্ড করা হতো হাতে লিখে- বিভিন্ন রঙ্গিন কালি দিয়ে নানান কারুকাজে এ সব ডেলিগেট কার্ড করা হতো। উপশাখার ইফতার মাহফিলের চিঠি করতাম হাতে লিখে। সেই চিঠি দিয়ে মহল্লার সবার কাছে দাওয়াত নিয়ে যেতাম, কালেকশন করতাম, মসজিদের মাইক ব্যবহার করে ইফতার মাহফিল করতাম। একটি উপশাখার ইফতার মাহফিলে ১০০-১৫০ লোক হতো। এতে অংশগ্রহণ করতো মহল্লার ছাত্ররা ব্যতিত স্থানীয় মুরুব্বীরা পর্যন্ত। আজ ডিজিটাল ব্যানার দিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রাম করা হয়, সে সময়ে বিভিন্ন ধরনের রঙ্গিন কাগজে প্রথম পেন্সিল দিয়ে লিখে তা ব্লেড দিয়ে কাটা হতো এরপর তা গাম দিয়ে কাপড়ে লাগানো হতো। একবার একটি ব্যনারের কাপড় কিনলে তা ব্যবহার করা হতো অনেক দিন। জেলা শহরের বাইরে যে কোন গ্রামে যাওয়ার অধিকাংশ ছিল কাচা রাস্তা, তবে বেলে মাটির রাস্তা হওয়ার কারণে বর্ষার সময়েও খুব কম রাস্তায়ই কাদা হতো। এ সব রাস্তায় যাতায়াতের বাহণ ছিলো রিক্স্রা অথবা বাই সাইকেল। বাই সাইকেল নিয়ে একদিন সফরে বের হলে একদিনেই ৫/৭টি স্কুলে প্রোগ্রাম করে শহরে ফিরতাম। বহু যায়গা এমন ছিল বাই সাইকেল কাধে করে নিয়ে সাকো পাড় হতাম। একবার এক স্কুলে একটি সাধারণ সভা করার জন্য গেলাম। গিয়ে সে স্কুলের প্রধান শিক্ষককে বললাম স্যার আমরা (৩জন) এসেছি ছাত্রদের কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আমাদেরকে কিছু সময় দিবেন। জানতে পারলাম তিনি ছাত্র জীবনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র মৈত্রীর কর্মী ছিলেন- তিনি আমাদের সময় দিতে চাইলেন না। কিন্তু পরবর্তীতে অন্যান্য শিক্ষকদের অনুরোধে আমাদেরকে একটি পিরিয়ড অফ করে ৪৫ মিনিট সময় দিলেন। স্কুলের প্রায় পাঁচশত ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে মাইক ছাড়াই সাধারণ সভা করেছিলাম। সকল ছাত্রই শুধু নয় এমনকি ছাত্রীরাও আমাদের বক্তব্য শুনে বললো যে তারা শিবিরের সমর্থক হতে চায়। আমাদের হাতে যে পরিমাণ সমর্থক ফরম ছিল তা শেষ হয়ে যাওয়ায় সাদা কাগজে তাদের নাম লিখে দিয়েছিল। আর একদিন অন্য একটি স্কুলে সাধারণ সভা শেষ করে ফেরার পথে গ্রামের এক মধ্য বয়সী মহিলা হাত উচু করে আমাকে থামতে বললেন, আমি সাইকেল থেকে নামার পর তিনি বললেন আমি যদি আজ দুপুরে তার বাড়িতে খেয়ে যাই তবে তিনি খুশী হবেন। মহিলাকে দেখতে আমার মায়ের বয়সীই মনে হলো, আমি ইতস্তত করতে লাগলাম অবশ্য তখন বেলা তিনটা বেজে গেছে দুপুরের খাবার সময় অনেক আগেই পেড়িয়ে গেছে। আমি তাকে বললাম আমি আপনাকে চিনি না। আপনিও আমাকে চেনেন না- কিন্তু আপনি কেন আমাকে খাবারের দাওয়াত দিচ্ছেন। তিনি বললেন ‘বাবা তোমাকে ভালভাবেই চিনি- তুমি একমাস আগে এসে স্কুলে ছাত্রদের নিয়ে মিটিং করে গিয়েছো, তাদের ইসলামী বই দিয়েছো, একটি ফরম দিয়েছো তখন থেকে আমার ছেলে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ছে- আমার ছেলে প্রায়ই তোমার কথা বলে-তুমি যখনই এই রাস্তা দিয়ে যাও আমি বাই সাইকেলের বেল বাজার টুং টাং শব্দ পেলে রাস্তার দিকে তাকাই, কোন দিন তোমার নাগাল পাইনি- আজ তোমাকে পেয়েছি-তুমি অবশ্যই আমার বাড়িতে খেয়ে যাবে-আমি যতোই না বলি, তিনি ততো আরো বেশী অনুরোধ করছেন- শেষ পর্যন্ত তার বাড়িতে ঢুকতে হলো-ছোট তিন রুমের টিনের ঘড়, সামনে বড় উঠোন, তিনি তার বাড়িতে পালিত মুরগী জবাই করলেন, পাশের বিল থেকে ধরা মাছ রান্না করলেন-পরম মমতায় আমাকে খাওয়ালেন। উদ্দেশ্য একটাই তার ছেলেটা ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাথে মিশে যদি ভাল হয়। আজ যারা শিবির নিধনের মিশনে নেমেছে তাদেও কাছে প্রশ্ন তোমরা কতজন ছাত্রকে এভাবে ভালো পথে আনার কারণে মায়েরা তোমাদের জন্য অপেক্ষা করে? না কেউ করে না। বরং ছাত্রলীগ নামক ফ্রাংকেনস্টাইন দানবের হাত থেকে বাঁচার জন্য খোদার দরবারে প্রার্থনা জানায়। সে দিনের সে স্মৃতিগুলো আজো আমাকে অবেগে আপ্লুত করে তোলে। গ্রামের মেঠো পথ, রাখালিয়া বাশির সূর, বিলের ধারের শাপলা শালুক, সবুজ ধান খেত এ সব দেখেতে দখেতেই পেড়িয়ে যেতাম মাইলের পরম মাইল। একটি বাই সাইকেলকে মনো হতো ময়ুর পঙ্খী- আর আমি পঙ্খীরাজ হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছি মাঠ বন বাদার তেপান্তর। মনে পড়ে আজো--একদিন সকালে নাস্তা না করে বেড়িয়েছি ৪০ঢ২ = ৮০ মাইল পথ বাই সাইকেল চালিয়ে আটটি স্কুল এবং মাদরাসায় প্রোগ্রাম করেছি। সাকালে এক টাকার মুড়ি, আট আনা দিয়ে কলা খেয়ে নাস্তার কাজ সেরেছি। দুপুরে গ্রামের এক বাজারে ছোট একটি রুটির দোকানে দু টাকায় একটি রুটি ( বর্তমানে আমরা যে রুটি খাই তার তিনটির সমান) আর গুড় দিয়ে দুপুরের খাবারের কাজ সম্পন্ন করেছি। ছুটে বেড়িয়েছি এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে। বর্ষায় বেলে মাটির রাস্তায় স্লিপ খেয়ে পড়ে যাওয়া পাশের জোয়ার ভাটার খালের পানিতে কাদা পরিস্কার করে আবার পথ চলা। স্মৃতিগুলো আজ শুধু এ কথাই বলে এ পথ চলা থামবে না। যুগের পর যুগ চলবে এ কাফেলা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এ কাফেলায় শামিল হবে লাখো কোটি তরুণ, তারা মানবতাকে আহ্বান জানাবে সত্য সুন্দরের দিকে, কালজয়ী আদর্শ আল ইসলামের দিকে।
বিষয়: বিবিধ
১২৭৮ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন