আজ ২৫ আগস্ট মিশরের ইখওয়ান নেতা সাইয়েদ কুতুব শহীদের শাহাদাত দিবস

লিখেছেন লিখেছেন সুন্দরের আহবান ২৫ আগস্ট, ২০১৩, ১০:৫৮:৫৪ রাত

সাইয়েদ কুতুব ১৯০৬ সালে মিশরের উসাইত জেলার মুশা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার আম্মা ফাতিমা হোসাইন অত্যন্ত দীনদার মহিলা ছিলেন। সাইয়েদের পিতা হাজী ইবরাহীম নিজ গ্রামেই চাষাবাদ করতেন। সাইয়েদ কুতুবরা পাঁচ ভাই বোন। সাইয়েদ কুতুব, মোহাম্মদ কুতুব, আমিনা কুতুব, ফাতিমা কুতুব, পঞ্চম বোনের নাম জানা যায় নি। উল্লেখিত চার ভাই বোনই উচ্চ মার্গের আলেম, ইসলামী চিন্তাবিদ, লেখক ও ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীল ছিলেন। চার ভাই বোনই মিশরের ইসলাম বিদ্দেশী সরকারের চরম জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মায়ের ইচ্ছানুসারে তিনি শৈষবেই কুরআন হিফজ করেন। পরবর্তীকালে সাইয়েদ কুতুবের বাবা কায়রো শহরের উপকন্ঠে হালওয়ান নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন। সাইয়েদ কুতুব তাজহিযিয়াতুল দারুল ইলুম মাদরাসায় ভর্তি হন। উনিশ শ উনত্রিশ সালে ঐ মাদরাসায় শিক্ষা সমাপ্ত করে কায়রোর বিখ্যাত মাদরাসা দারুল উলুমে ভর্তি হন। ১৯৩৩ সালে ঐ মাদরাসা থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করার পর উক্ত মাদরাসায়ই অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। কিছুকাল অধ্যাপনা করার পর তিনি শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের অধীনে স্কুল ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হন। শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের জন্য তাকে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে পাঠানো হয়। তিনি দুবছর উচ্চ শিক্ষার কোর্স শেষ করে দেশে ফিরে আসেন। আমেরিকা থাকা কালে তিনি বস্তুবাদী সভ্যতার অসারতা, আধুনিকতার আড়ালে তাদের সমাজের দুরাবস্থা প্রত্যক্ষ করেন। এ থেকে তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, একমাত্র ইসলামই মানব সমাজকে কল্যাণের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার পর তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমুনের ( মুসলিম ব্রাদারহুড) আদর্শ, উদ্দেশ্য লক্ষ্য, কর্মসূচী সম্পর্কে যাচাই করতে শুরু করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি ইখওয়ানের সদস্য হন। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় বৃটিশ সরকার মিশরকে স্বাধীনতা দানের ঘোষণা দেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে ইখওয়ানুল মুসলিমুন স্বাধীনতার দাবীতে বৃটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। এর ফলে ইখওয়ানের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে যায়। মাত্র দু বছরের মধ্যে ইখওয়ানের সক্রিয় কর্মী সংখ্যা দাড়ায় পচিশ লক্ষ, সাধারণ সমর্থক, শুভাকাংখীর সংখ্যা ছিল এর কয়েক গুণ। মিশরের তৎকালীন ইসলাম বিরোধী সামরিক সরকার ইখওয়ানের জনপ্রিয়তা দেখে ভীত হয়ে পরে। সরকার এ দলের বিরুদ্ধে সম্মিলিত ষড়যন্ত্র শুরু করে। ১৯৫০ সালে ইখওয়ানের প্রতিষ্ঠাতা মুর্শিদে আম (আমীর- বা দলীয় প্রধান) সাইয়েদ ইমাম হাসানুল বান্নাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আততায়ীর গুলিতে হত্যা করে এবং ইখওয়ানকে নিষিদ্ধ করে, এ সময় ইখওয়ানের পঞ্চাশ হাজার নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫২ সালে আরেকটি অভূত্থানে সরকার পরিবর্তন হয়। ইখওয়ান আবার সাংগঠনিক তৎপরতা চালাবার অনুমতি পায়। তখন ইখওয়ানের মুর্শিদে আম নির্বাচিত হন ডঃ হাসান আল হুদাইবী। এ সময় সাইয়েদ কুতুব ইখওয়ানের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে সাইয়েদ কুতুব ইখওয়ান পরিচালিত পত্রিকা ‘ইখওয়ানুল মুসলিমুন’ এর সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় স্বৈরাচারী জামাল নাসের সরকার বৃটিশ সরকারের সাথে নতুন করে চুক্তি করে। ইখওয়ানের পত্রিকায় এ চুক্তির সমালোচনা করায় নাসের সরকার পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করে। এর কিছু দিন পর একটি বানোয়াট হত্যা মামলায় ইখওয়ানকে নিষিদ্ধ করে এবং ইখওয়ানের নেতা কর্মীদের পাইকারী হারে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত নেতাদের মধ্যে সাইয়েদ কুতুবও ছিলেন। গ্রেফতারের সময় তিনি ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। সামরিক অফিসার তাকে সে অবস্থায়ই গ্রেফতার করে। এ অবস্থায় তার হাত পায়ে শিকল পড়ানো হয়। এবং মারাত্মক অসুস্থ হওয়া সত্বেও তাকে জেলখানা পর্যন্ত পায়ে হেটে যেতে বাধ্য করা হয়। পথে কয়েকবার তিনি বেহুশ হয়ে মাটিতে পড়ে যান। কিন্ত জালেম সামরিক অফিসারদের হৃদয়ে সামান্য অনুভূতি জাগেনি। জেলে প্রবেশের সাথে সাথে সরকারের নির্দেশে জেল কর্মচারীগণ তাকে বেদম প্রহার করতে শুরু করে। এরপর একটি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কুকুর তার উপর লেলিয়ে দেয়া হয়। কুকুর তাঁর পা কামড়ে ধরে জেলের আঙ্গিনায় টেনে নিয়ে বেড়ায়। এ প্রাথমিক নির্যাতনী অভ্যর্থনা জানানোর পর একটানা সাত ঘন্টাব্যাপী তাকে জেরা করা হয়। তাঁর স্বাস্থ্য এ রকম নির্যাতন ভোগ করার যোগ্য ছিল না। কিন্তু তার সৃদৃঢ় ঈমানের বলে প্রাচীরের ন্যায় সব অমানুষিক নির্যাতন অকাতরে সহ্য করেছেন। নির্যাতনে তিনি প্রায়ই বেহুশ হয়ে পড়তেন যখন হুশ ফিরতো তিনি শুধু বলতেন ‘ আল্লাহু আকবার অলিল্লাহিল হামদ’। জেলের অন্ধকার কুঠুরী রাতের বেলা বন্ধ করা হতো। আর দিনের বেলা প্রখর রৌদ্রের মধ্যে তাকে প্যারেড করানো হতো। হৃদপিন্ডের দুর্বলতা, বক্ষপীড়া, ও শরীরের প্রতিটি পেশীতে ব্যাথা বিভিন্ন রোগে তিনি কাতর হয়ে পড়েন। পুলিশের প্রশিক্ষিত কুকুরের কামড় অপর দিকে কারা পুলিশের নির্যাতন একটির পর একটি চলতে থাকে। তার শরীরে প্রচন্ড ঠান্ডা পানি ঢালা হতো, এর পরই আবার গরম পানি ঢালা হতো। লাথি, কিল, ঘুষি ইত্যাদি ছিল নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার। ১৯৫৫ সালের ১৩ জুলাই সামরিক সরকারের ক্যাঙ্গারু ট্রাইব্যুনাল তাকে ১৫ বছরের সশ্রম কারাদনড দেয়। এক বছর কারাভোগের পর জালিম শাহী নাসের সরকার ঘোষণা করে যদি সাইয়েদ কুতুব পত্রিকায় ঘোষণার মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করে তবে তাকে মুক্তি দেয়া যেতে পারে। এ প্রস্তাব শুনে তিনি বলেন, ‘‘আমি এ প্রস্তাব শুনে আশ্চর্যাম্বিত হচ্ছি যে, মযলুমকে জালিমের কাছে ক্ষমা চাইতে বলা হচ্ছে। আল্লাহর কসম! যদি ক্ষমা প্রার্থনার কয়েকটি শব্দ আমাকে ফাসির রশি থেকেও রেহাই দিতে পারে, তবুও আমি এ রুপ শব্দ উচ্চারণ করতে রাযী নই। আমি আল্লাহর দরবারে এমন অবস্থায় হাযির হতে চাই যে, আমি তার প্রতি এবং তিনি আমার প্রতি সন্তুষ্ট।’’ পরবর্তীতে তাকে যতবার ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলা হয় তিনি প্রতিবার একই জবাব দেন। ১৯৬৪ সালে ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মিশর সফরে গেলে তার অনুরোধে সাইয়েদ কুতুবকে মুক্তি দিয়ে তাকে গৃহ বন্দী করে রাখা হয়। কিন্তু এক বছর পরই জোর পূর্বক সরকার উৎখাতের মিথ্যা অভিযোগে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৫ সালে নাসের সরকার মস্কো সফরে থাকা অবস্থায় তিনি বললেন ইখওয়ানুল মুসলিমুন তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছিল। তার এ বক্তব্যের সাথে সাথে সারা দেশে ইখওয়ানের নেতা কর্মীদের গণ গ্রেফতার শুরু হয়। এরপর স্বৈরাচারী নাসের সরকার একটি আইন পাশ করেন যে প্রেসিডেন্টকে হত্যার প্রচেস্টা আইন। এ আইনের বলে হাজার ইখওয়ান কর্মীকে দীর্ঘ মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। ইখওয়ানের নেতা কর্মীদের সম্পদ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিদ্যালয়, হাসপাতাল সব কিছু বাজেয়াপ্ত করে। এবং এ আইন কোথাও চ্যালেঞ্জ করা যাবে না বলে ডিক্রি জারী করা হয়। এরপর শুরু হয় সামরিক সরকারের ক্যাঙ্গারু ট্রাইব্যুনালে বিচারের নাটক। এ বিচারে মিশরের কোন আইনজীবিকে আসামী পক্ষে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয়নি। ফরাসী বার কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি উইলিয়াম থর্প এবং মরক্কোর দু জন আইনজীবি আসামী পক্ষে বিচারে অংশগ্রহণ করতে চাইলে তাদের আবেদন না মঞ্জুর করা হয়। সুদানের দুজন আইনজীবি কায়রো পৌছে আদালতে হাজির হলে পুলিশ তাদের গলা ধাক্কা দিয়ে আদালত থেকে বের করে দেয় এবং তাদেরকে মিশর ত্যাগ করতে বাধ্য করে। ১৯৬৬ সালে সাইয়েদ কুতুব ও তার দুজন সঙ্গীকে ফাসির আদেশ শোনানো হয়। সারা দুনিয়ায় এ বিচারের প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও ১৯৬৬ সালের ২৫ আগস্ট ঐ রায় কার্যকর করা হয়। মূলত যে কারণে সাইয়েদ কুতুবের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠণ করা হয়। তা হচ্ছে তার লিখিত বই ‘মায়ালিমু ফিত তারিক’ যে বইয়ের ইংরেজী অনুবাদের নাম ‘ THE MILE STONE’ ইংরেজী থেকে বইটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মরহুম আবদুল খালেক, বইটির বাংলা অনুবাদের নাম দেয়া হয়েছে ‘ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা’। তিনি এ বইতে প্রচলিত সরকার ব্যবস্থা ও র্ট্রা ব্যবস্থাকে কুফরী রাস্ট্র ব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত করে এ সরকারের পরিবর্তন করে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ভিত্তিক রাস্ট্র গঠনের কথা বলেছেন। তাই সরকার তার বিরুদ্ধে সরকার উৎখাত ও রাস্ট্রদ্রোহ মামলায় ফাসি দেয়। তিনি আরো অসংখ্য বই লিখেছেন যা তার মূল আরবী ভাষা থেকে ইংরজেী ও বাংলায় অনুবাদ হয়েছে। বাংলায় অনুদিত তার কয়েকটি বিখ্যাত বই হচ্ছে ১.কুরআনের আকা কিয়ামাতের দৃশ্য ২. কুরআনের অলংকার ৩. ইসলামে সামাজিক সুবিচার ৪. তাফসীরে ফি জিলালিল কুরআন ৫. ইসলাম ও পুজিবাদের দন্দ ৫. বিশ্ব শান্তি ও ইসলাম ৬. ইসলামী রচনাবলী ৭. সাহিত্য সমালোচনার পদ্ধতি ৮. ভবিষ্যত সংস্কৃতি ৯. ইসলামী সমাজের চিত্র ১০. আমি যে আমেরিকা দেখেছি। এ ছাড়াও তিনি আরো অনেক বই রচনা করেছেন। সাইয়েদ কুতুব নেই, হাসানুল বান্না নেই, শহীদ আবদুল কাদের আওদাহ নেই। নাম না জানা ইখওয়ানের হাজার হাজার নেতাকে নির্যাতন করা হয়েছে শহীদ করা হয়েছে, ফাসি দেয়া হয়েছে কিন্তু ইখওয়ানের অগ্রযাত্রা বন্ধ হয়নি। আজো যারা ইখওয়ানের উপর নির্যাতন করছে তারা ইতিহাসের আস্তাকুরে নিক্ষিপ্ত হবে এবং ইখওয়ান বিজয়ী হবে ইনশাআল্লাহ। বাংলাদেশেও যারা ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের ফাসি দিয়ে, দল নিষিদ্ধ করে ইসলামের অগ্রযাত্রা রুখতে চায় তাদেরকে ইতিহাসের পাতা থেকে শিক্ষা নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের ফাসি দিয়ে হত্যা করে দল নিষিদ্ধ করে ইসলামের অগ্রযাত্রা রোখা যায় না। ।

বিষয়: বিবিধ

১৬৬০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File