প্রসঙ্গ ঃ জামায়াতে ইসলমীর নিবন্ধনের বৈধতা
লিখেছেন লিখেছেন সুন্দরের আহবান ০৭ আগস্ট, ২০১৩, ০৬:১৫:৫৯ সকাল
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ একটি অতলান্ত খাদের প্রান্তদেশে এসে দাড়িয়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক অবস্থা সব কিছুই যেন গোটা রাস্ট্রেীয় কাঠামোর দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য এবং সুন্দর সংস্কৃতিকে ধ্বংসের মুখে এনে দাড় করিয়েছে। বাতিল করো, নিষিদ্ধ করো, ফাঁসি দাও, নির্মূল করো এ শ্লোগান এখন বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম অনুসংগ হয়ে দাড়িয়েছে। খতম আর নির্মূলের রাজনীতি জাতিকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাবে তা বলা না গেলেও এ রাজনীতি জাতি গঠনের নয়, এটা কল্যাণের রাজনীতি নয় বরং এটা জিঘাংসা এবং ধ্বংসের রাজনীতি। যে অতলান্ত খাদের প্রান্তদেশে আজ বাংলাদেশের রাজনীতি এসে দাড়িয়েছে এ থেকে জাতিকে উদ্ধার করার কোন কর্মসূচী এবং কার্যক্রম আদৌ দেখা যাচ্ছে না। বরং সর্বত্র ধ্বংসের হ্রেসাধ্বনি শোনা যাচ্ছে। জাতি বিধ্বংসী শক্তিগুলো উদ্যত হায়েণার মতো আজ সব কিছু ধ্বংসের জন্য লম্ফঝম্ফ করছে। জাতির মূল সত্বা থেকে বিচ্ছিন্ন পতিত বাম-কমিউনিস্ট, মাজার পূজারী আর বিদায়াত পন্থীরা সরকারের আস্কারা পেয়ে একদিকে রাজনীতিকে গিলে খাওয়ার উপক্রম করছে অন্য দিকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আদর্শ, বিশ্বাস, চিন্তা, চেতনা ও মৌলিক আদর্শকে ধ্বংসের মহড়া দিচ্ছে। শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে ইসলামী আদর্শ নিয়ে বসবাস করা যাবে কি না, ইসলামী আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করা যাবে কি না, ইসলামী শিক্ষা সংস্কৃতির যতটুকু ক্ষয়িষ্ণু ধারা এখনো টিকে আছে সেটুকুও আগামী দিনে টিকে থাকবে কি সে প্রশ্ন আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কেয়ার টেকার সরকার মানা না মানার প্রশ্নে রাজনীতি যখন টলটলায়মান তখন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচন করার বৈধতাকে আদালত কর্তৃক অবৈধ হিসেবে রায় দিয়ে রাজনীতিকে আরো জটিল করে তোলা হয়েছে। তরিকত ফেডারেশন ও জাকের পর্টির দুজন নেতা ২০০৯ সালে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে দেয়া নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন কেন অবৈধ নয় তা জানতে চেয়ে একটি রীট আবেদন করে। রীটে নির্বাচন কমিশন ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে বিবাদী করা হয়। তখন হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামী ও নির্বাচন কমিশনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। ঐ সময়ে জামায়াত ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জবাব দেয়া হয়েছিল, এরপর আর এই রীটের কোন অগ্রগতি হয়নি। তার মানে তরীকত ফেডারেশন ও জাকের পার্টির করা রীট আবেদনটি তামাদি হয়ে গেছে এটাই সবাই ধরে নিয়েছে। কিন্তু সরকার যখন দেখলো কোনভাবেই জামায়াতকে নিঃশেষ করা যাচ্ছে না তখন আবার এই রীটের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে জামায়াতকে দমন ও নিঃশেষ করার এক মহা পরিকল্পনা হাতে নেয়। জামায়াত নির্মুলে তাদের মহা পরিকল্পনার অন্যতম হচ্ছে যুদ্ধাপরাধ বিচারের নামে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মাধ্যমে শেষ করে দেয়া। আওয়ামী সরকার গঠিত আন্তর্জাকিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল নামে আন্তর্জাতিক হলেও এর সাথে আন্তার্জিক অথবা দেশীয় আইনের কোনটিরই দুরতম কোন সম্পর্ক নেই। দেশী বিদেশী সকল আইনজ্ঞ এবং যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞগণ এই ট্রাইব্যুনালকে ত্রুটিপূর্ণ এবং দলীয় ট্রাইব্যুনাল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। কিন্ত সরকার সকল মহলের আপত্তি উপেক্ষা করে একতরফা বিচার কাজ পরিচালনা করে আসছে এবং জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মধ্যে অধ্যাপক গোলাম আযমকে নব্বই বছর ও আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছে এবং মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাসির দন্ডাদেশ দিয়েছে। তাদের মামলা এখন আপীল বিভাগে বিচারাধীন। অন্যান্য নেতাদের মামলাও ট্রাইব্যুনালে বিচারের প্রক্রিয়াধীন। সরকার, আওয়ামীলীগ এবং আওয়ামী বাম বুদ্ধিজীবীরা ভেবেছিল ট্রাইব্যুনালের বিচারের মাধ্যমে যখন জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে রায় দেয়া হবে তখন জাময়াতের কর্মীরা হতাশ হয়ে যাবে এবং জামায়াতে ইসলামী নিঃশেষ হয়ে যাবে। কারণ বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতির ধারা হচ্ছে নেতা মারা গেলে নেতার পরবর্তী প্রজন্ম দলের নেতা হয় অথবা সেই দল শেষ হয়ে যায়। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর এবং তথাকথিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর অনেক আওয়ামী এবং বাম বুদ্ধিজীবী বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাদের সাক্ষাৎকারে এবং টকশোতে বলেছেন যে ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর এমনিতেই জামায়াতে ইসলামী শেষ হয়ে যাবে একজন আওয়ামী বুদ্ধিজীবি এক টেলিভিশন টক শোতে বললেন যে, ‘কর্ণেল ফারুক গংদের ফাঁসির মাধ্যমে যেমন ফ্রিডম পার্টি শেষ হয়ে গেছে তেমনি ট্রাইব্যুনালর রায়ের মাধ্যমে জামায়াতও শেষ হয়ে যাবে।’ কিন্তু ঐ আওয়ামী বুদ্ধিজীবী বুঝতে ভুল করেছেন যে কর্ণেল ফারুক আর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এক নয়, একই ভাবে ফ্রিডম পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামী এক নয়। শত নির্যাতন, নিপীড়ন, অপপ্রচার বাধা প্রতিবন্ধকতা কোন কিছুতেই জামায়াতের অগ্রগতি রোধ করা যাচ্ছে না। জামায়াতকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য বর্তমান আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার এক বছরের মাথায় একত্রে বেশ কয়েকটি ফ্রন্টে কাজ শুরু করে।
১. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনাকাংখিত এবং ছাত্রলীগের দলীয় কোন্দলে খুন হওয়া কর্মী ফারুকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সারাদেশে চালানো হয় ব্যাপক গ্রেফতার অভিযান। একটি হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে সারাদেশের প্রায় দশ হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়। যা ইতিহাসে নজিরবীহীন। এরপর একের পর এক চলতেই থাকে গ্রেফতার অভিযান। জামায়াত শিবিরকে দমন করার জন্য গণ গ্রেফতার এবং গণ মামলা গণ রিমান্ড সরকারের এক মোক্ষম অস্ত্র।
২. জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভা সমাবেশ মিছিল মিটিংয়ের উপর আরোপ করা হয় অঘোষিত নিষধোজ্ঞা, সারাদেশে যেখানেই কোন প্রকার সভা সমাবেশ করা হয় তাতে পুলিশ হামলা করে গ্রেফতার করে এক বিভিষিকাময় পরিবেশ তৈরী করে।কেন্দ্র থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত সকল কার্যালয়ে পুলিশ তালা লাগিয়ে দেয়। বাসা বাড়ি মেস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত চলে পুলিশি অভিযান। তল্লাশির নামে চলে পুলিশের তান্ডবলীলা এবং লুটপাট। শুরু থেকে অদ্যবধি এ ঘৃণ্য কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। প্রতিনিয়ত গ্রেফতার, মিথ্যা মামলা, রিমান্ড, আদালত থেকে জামিনের পর জেল গেটে আবার গ্রেফতার এখন নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা।
৩. সরকারের প্রধান থেকে শুরু করে সকল মন্ত্রী, এম পি, নেতা, কর্মী আওয়ামী বাম নেতা এবং বুদ্ধিজীবিরা সবাই একযাগে একসুরে জামায়াতের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদান করে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে প্রচার এবং প্রপাগান্ডা শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে যাতে জামায়াতকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়।
৪. আওয়ামী ঘরানার লোকেরা নামে বেনামে বিভিন্ন সংগঠন খুলে অখ্যাত বিভিন্ন সংগঠনের নামে প্রতিদিন গোল টেবিল বৈঠক, সভা, সমাবেশ, সেমিনার, মানব বন্ধন, করে জামায়াতের বিরুদ্ধে তাদের প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে।
৫. দু একটি ব্যতীত সকল মিডিয়াই আওয়ামী সমর্থক হওয়ায় সকল পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলে একযোগে অব্যাহতভাবে চালানো হচ্ছে জামায়াত বিরোধী অপপ্রচার।
৬. মিছিল সমাবেশে হামলা, গুলি, গ্রেণেড নিক্ষেপ, টিয়ার সেল এবং গ্রেফতার পুলিশ বাহিনীর নিয়মিত কাজে পরিণত হয়েছে।
৭. পোস্টার লাগানো, লিফলেট বিতরণ যে কাজ করা হয় না কেন পুলিশ যাকে যেখানে যেভাবে পায় তাকেই গ্রেফতার করে পুলিশের কর্তব্য কাজে বাঁধা,ভাংচুর অথবা রাস্ট্র দ্রোহিতার মামলা দিয়ে জেল হাজতে পাঠায়।
৮. সর্বশেষ সাঈদীর রায়ের পরে সরকার আরো একধাপ অগ্রসর হয়ে চালায় ইতিহাসের নজিরবিহীন গণহত্যা।
এত কিছুর পরও যখন জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরকে দুর্বল করা যাচ্ছে না, তাদেরকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাচ্ছে না তখন ২০০৯ সালে করা অপরিপক্ক ও তামাদি রীট আবেদনটির কার্যক্রম পুনরায় সচল করা হয়। ২০১৩ সালের শুরুর দিকে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন জামায়াত নিষিদ্ধের ব্যাপারে হাইকোর্টে একটি রীট আবেদন করা হয়েছিল সেটির কার্যক্রম আবার চালু করা হবে এবং এটির রায়ের পর সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। আইনমন্ত্রীর এ বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে মুলত দুটি বিদায়াতী সংগঠন জনস্বার্থের নামে রীট করলেও তা করা হয়েছে সরকারের তথা আওয়ামী বাম ইসলাম বিদ্ধেশীদের স্বার্থে। তাই এ রীট আবেদনটির আবেদনকারীদের ইচ্ছার চেয়ে এখানে সরকারের ইচ্ছা এবং স্বার্থ বড় হয়ে দেখা দেয়। রীট আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১ আগস্ট বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্টে ডিভিশন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে দেয়া নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনকে অবৈধ ঘোষনা করেছে। রায় ঘোষণার আধা ঘন্টার মধ্যেই জাময়াতের পক্ষ থেকে স্টে চেয়ে চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করা হয়েছিল কিন্তু ৫ আগস্ট বিচারপতি শামছুদ্দিন চৌধুরী মানিক কোন বক্তব্য প্রদানের সুযোগ না দিয়ে সে আবেদন খারিজ করে দেয়। এখন স্বাভাবিকভাবেই এ মামলা চলে গেছে আপিল বিভাগে। আপিল বিভাগের রায়ের পরই চূড়ান্ত স্বিদ্ধান্ত হবে জামায়াতের নিবন্ধন থাকবে কি থাকবে না। তবে আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে নিবন্ধন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন কিন্তু তার ফায়সালা চাওয়া হয়েছে আদালতে। হাইকার্টের কারণ দর্শানো নোটিশের জবাবেও নির্বাচন কমিশন বলেছে যে যখন নিবন্ধন দেয়া হয়েছে তখন তারা সন্তুষ্ট হয়েই জামায়াতকে নিবন্ধন দিয়েছে। এরপরও সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এ কথা বলে জামায়াতের নিবন্ধকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। রায়ের পর পরই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতের আইনজীবী ব্যরিষ্টার আবদুর রাজ্জাক বলেছেন “ হাইকোর্টের রায় সঠিক নয়। ভুল রায়। এর কারণ-প্রথমত রিট আবেদনটি অপরিপক্ক। নিবন্ধনের পুরো প্রক্রিয়াটি এখনো নির্বাচন কমিশনের বিবেচনাধীন। এমতাবস্থায় রিট চলতে পারে না। এই বিষয়ে বাংলাদেশ এবং ভারত ও যুক্তরাজ্যের উচ্চতর আদালতের অনেক নজির আমরা উপস্থাপন করেছিলাম কিন্তু সে সমস্ত নজির আদালত অগ্রাহ্য করেছেন। নিবন্ধন বাতিলের মানে হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী একটি দল হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না যদি আপিল বিভাগে আপিলের চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ের ফলে জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণে কোন বাধা নেই। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের অধীনে জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করতে পারবে। দ্বিতীয়ত ২০১০ সালের জানুয়ারী মাসে নির্বাচন কমিশন তাদের একটি স্মারকে উল্লেখ করেন যে, শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ছাড়া বাকি যে ১১ টি দলকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে সবারই গঠনতন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ -এর সাথে সাংঘর্ষিক। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই ১১টি দল ছাড়াও আরও কয়েকটি দলকে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন দিয়েছে যাদের গঠনতন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ। সুতরাং আমরা মনে করি জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে আদালত প্যান্ডোরার বক্স উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। গঠনতন্ত্র এবং আইনের শাসনের জন্য এটি খুবই ক্ষতিকর হবে বলে আমরা মনে করি। তৃতীয়ত জনস্বার্থে দায়েরকৃত সকল রিট পিটিশনের আবেদনকারী ক্লিন হ্যান্ডে বা স্বচ্ছ হাতে আদালতে আসবেন। এটাই আইনের বিধান। এই বিধান সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। আবেদনকারীদের বক্তব্য হচ্ছে ইসলামী রাজনীতি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। অথচ মূল আবেদনকারী সংগঠন তরিকত ফেডারেশনের গঠনতন্ত্রে স্পষ্টভাবে জিহাদের কথা উল্লেখিত আছে যা কিনা জামায়াতে গঠনতন্ত্রেও অনুপস্থিত। চতুর্থ কারণ হলো-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ সিদ্ধান্ত নেয় তারা কোন দলকে ভোট দেবে। এটাই গণতন্ত্রের মূল কথা। বাংলাদেশের পরিবর্তিত সংবিধানেও ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল আছে। এমতাবস্থায় ধর্মীয় দল হিসেবে জামায়াতের রাজনৈতিক নিবন্ধন বাতিল করার প্রশ্নই উঠে না। ব্যরিস্টার রাজ্জাক বলেন,আমি নির্দ্বিধায় বলতে চাই এই রায় আইনের শাসন, গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার ও সংবিধানের পরিপন্থী। শুনানি চলাকালে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের দুটি রায়ের নজির আদালতে পেশ করেছিলাম। এর মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ানা মামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট বলেন, কমিউনিস্ট আদর্শ মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে হলেও সংবিধান প্রদত্ত রাজনৈতিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তার কারণে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ সঠিক হবে না। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর বরাত দিয়ে বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শ বা বিশ্বাসে বিপজ্জনক কিছু থাকলেও যতদিন রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকবে সুপ্রিম কোর্ট ততোদিন রাজনৈতিক দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ বা হস্তক্ষেপ করবে না।’’
এ ব্যাপারে বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, ‘‘এ রায় দিয়ে হাইকোর্ট নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছে। কারণ ইসি জামায়াতকে নিবন্ধন দিয়েছিল। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসি যে নিবন্ধন দিয়েছিল এ রায়ের মধ্য দিয়ে ইসির অক্ষমতাকেই প্রকাশ পেয়েছে। ইসি দলের যে কোনো গঠনতন্ত্র দেখে নিবন্ধন দেয়। এ নিবন্ধনের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে রাজনৈতিক বিষয় আদালতে টেনে আনা অনভিপ্রেত।”
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা মহসিন রশীদ এই রিটের শুনানিতে বলেছিলেন, ‘‘২০০৮ সালের ৪ নবেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িক নিবন্ধন দেয়া হয়। সে সময় সংবিধানে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের কথা ছিল। তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সাময়িক নিবন্ধন দেয়া হয়। গঠনতন্ত্রকে শক্তিশালী করার জন্য সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার লক্ষ্য নিয়েই তখন ইসি সিদ্ধান্ত নেয়। জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রে সন্তুষ্ট হয়ে সাময়িকভাবে নিবন্ধন দেয়া হয়েছিল। জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের যেসব স্থানে অসঙ্গতি রয়েছে বলে বলা হচ্ছে, তা নিবন্ধন নেয়ার সময় প্রতিনিধির মাধ্যমে কেটে দেয়া হয়। তখন জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়, দলের কাউন্সিলে অনুমোদনের পর সংশোধিত গঠনতন্ত্র ইসিতে দাখিল করবে। এ বক্তব্য বিবেচনায় নিয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০ (ডি) ধারা অনুসারে দলটিকে সাময়িক নিবন্ধন দেয়া হয়। তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী সন্তুষ্টি সাপেক্ষে যে কোনো দলকে নিবন্ধন দেয়া যায়। তিনি বলেন, এ রিট করার আগে বাদির উচিত ছিলো ইসিতে আবেদন করা। কিন্তু তা না করে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। ’’
১২ জুন শেষ কার্যদিবসের শুনানিতে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘‘যখন রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন দেয়, তখন সংবিধানের যে অবস্থায় ছিলো, সে অনুসারে জামায়াতের নিবন্ধন বৈধ ছিলো। কারণ, তখন সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি ছিলো সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন। সে সময় নির্বাচন কমিশন সবগুলো দলকেই সাময়িক নিবন্ধন দেয়। এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি। আরো একটি বিষয় হলো- নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সংস্থা। তারা এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি। তারা কোনো সিদ্ধান্তে না আসা পর্যন্ত এ রিটটি চলতে পারে না।’’
কিন্তু কোন এক আদৃশ্য শুতোর টানে এ রায় হয়েছি কি না তা জানি না। আদালতের রায়ের ব্যাপারে মন্তব্য করা আদালত অবমাননার শামিল তবে কোন রায়ে কেউ সন্তুষ্ট হতে না পারলে তার অসন্তুষ্টির কথা জানানোর অধিকার সবারই আছে। এ রায়ের পর বি এন পির ভারপ্রাপ্ত মাহসচিব বলেছেন “ জামায়াতের নিবন্ধনের বিষয়টি সাবজুডিস এ বিষয়ে আমরা কথা বলতে চাই না, তবে বি এন পি কোন দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয়। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবেলা করতে হবে।” বি এন পি নেতা তরিকুল ইসলাম বলেছন “সরকার হাইকোর্টের ঘাড়ে বন্দুক রেখে প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিলের চক্রান্তে লিপ্ত। এসবের পরিণতি ভালো হয় না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।বিএনপি কোনো রাজনৈতিক দল বা সংবাদমাধ্যম বন্ধ করাকে সমর্থন করে না। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এটা হতে পারে না। সরকারের দলীয় লোকদের দুর্নীতি-লুণ্ঠনে দেশ রসাতলে গেছে। অপশাসনে মানুষ অতিষ্ঠ। বিরোধী মতের মিডিয়াগুলো একের পর এক বন্ধ করে দিয়ে সরকার দেশের প্রকৃত অবস্থা আড়াল করতে চাইছে। এখন আবার তারা প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পাঁয়তারা করছে। এর মাধ্যমে তারা দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’’ এ রায়ের পর জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারী জেনারেল এক বিবৃতিতে বলেন “জামায়াতে ইসলামী দেশের প্রধান ইসলামী দল। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের অধীনে জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করার অধিকার রাখে। এই অধিকার অব্যাহত আছে। হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বৃহত্তর বেঞ্চে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের যে রায় ঘোষিত হয়েছে তা একটি ভুল রায়। এ রায়ের মাধ্যমে সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটেছে। এই রিট আবেদনটি সম্পূর্ণ অপরিপক্ব, কারণ নিবন্ধনের পুরো প্রক্রিয়াটি এখনো নির্বাচন কমিশনের বিবেচনাধীন। এ অবস্থায় রিট চলতে পারে না। ভারত, ইংল্যান্ড এমনকি আমাদের দেশেও এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের অনেক নজির রয়েছে। জামায়াতের আইনজীবীগণ সে সব নজির আদালতে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু আদালত সে সব অগ্রাহ্য করেছেন।
তিনি বলেন, ২০১০ সালের জানুয়ারী মাসে নির্বাচন কমিশন তাদের একটি মেমোতে উল্লেখ করেন যে, দু’টো দল ছাড়া বাকি যে ১১টি দলকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে সবারই গঠনতন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ এর সাথে সাংঘর্ষিক। আদালত জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে অন্যান্য দলেরও নিবন্ধন বাতিলের যে দরজা উন্মুক্ত করলেন তা গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে আমরা মনে করি। তিনি বলেন, কোন দলের নিবন্ধন সম্পর্কে পদক্ষেপ গ্রহণ করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আর নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন সংক্রান্ত কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পূর্বেই আদালত নিবন্ধন বাতিল করায় আমরা বিস্মিত। তিনি আরো বলেন, আমরা মনে করি, এটা আইনের শাসন, গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার ও সংবিধান পরিপন্থী। এ রায়ে সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের প্রকাশ ঘটেছে। সরকার জামায়াতকে নির্বাচনের বাইরে রাখার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং একদলীয় নির্বাচনের যে চক্রান্ত করছে এ রায়ের মাধ্যমে সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নেরই ব্যবস্থা হয়েছে মাত্র। জনগণ এ রায় মানে না। সরকার জনগণকে আদালতের মুখোমুখি দাঁড় করানোর যে কুটিল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তিনি সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকার জন্য দেশবাসির প্রতি আহ্বান জানান।’’
বি এন পির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবেলা করতে হয়। কোন রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা অথবা তাদের নিবাচন করার বৈধতা কেড়ে নেয়াকে বি এন পি সমর্থন করে না।’ কিন্তু যে বিষয়টি রাজনৈতিক এবং যা নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারাধীন তাকে আদালতে টেনে এনে এক জটিল পরিস্থিতির সৃস্টি করা হয়েছে।
বাংলা মেইলের সাথে এক সাক্ষাৎকারে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও জাতীয় সংসদ সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ এম পি- বলেছেন ‘সরকার রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে জামায়াতকে মোকাবেলা করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে’। তাই এটা আজ স্পষ্ট জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করতে সম্পূর্ণরুপে ব্যর্থ হয়েই সরকার আজ সকল বিষয়কে পেশী শক্তির মাধ্যমে যা পেশী শক্তির মাধ্যমে সম্ভব না হচ্ছে তা আদালতের দাড়স্থ করে এক অনাকাংখিত পরিবেশের সৃষ্টি করছে।
তরিকত ফেডারেশন ও জাকের পার্টির পক্ষ থেকে করা রীটে যে চারটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে -
১.জামায়াত নীতিগতভাবে জনগণকে সকল ক্ষমতার উৎস বলে মনে করে না। সেই সঙ্গে আইন প্রণয়নে জনপ্রতিনিধিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকেও স্বীকার করে না।
২.জামায়াত একটি সাম্প্রদায়িক দল। কিন্তু গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুসারে কোনো সাম্প্রদায়িক দল নিবন্ধন পেতে পারে না।
৩. নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের কোনো বৈষম্য করতে পারবে না। কিন্তু জামায়াতের শীর্ষ পদে কখনো কোনো নারী বা অমুসলিম যেতে পারবেন না।
৪. কোনো রাজনৈতিক দলের বিদেশে কোনো শাখা থাকতে পারবে না। অথচ জামায়াত বিদেশের একটি সংগঠনের শাখা। তারা স্বীকারই করে, তাদের জন্ম ভারতে। বিশ্বজুড়ে তাদের শাখা রয়েছে।
যে চারটি বিষয়ে রীট করা হয়েছে তার -
প্রথমটি হচ্ছে- জামায়াত জনগণকে সকল ক্ষমতার উৎস মনে করে না, সেই সঙ্গে আইন প্রণয়নে জনপ্রতিনিধিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে স্বীকার করে না। এ বিষয়ে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে একটি ইসলামী দল হিসেবে শুধুই নয় একজন মুসলমান হিসেবে কারো আল্লাহর অস্তিত্বে, তার নিরংকুশ ক্ষমতায়, তার সার্বভৌমত্বে অস্বীকার করার কোন সুযোগ আছে কি না? এ বিষয়ে জামায়াতের গঠণতন্ত্রের ভুমিকায় বলা হয়েছে-
‘‘যেহেতু আলাহ ব্যতীত নিখিল সৃষ্টির কোন ইলাহ নাই এবং নিখিল বিশ্বের সর্বত্র আল্লাহরপ্রবর্তিত প্রাকৃতিক আইনসমূহ একমাত্র তাঁহারই বিচক্ষণতা, শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্বের সাক্ষ্য দান করিতেছে;
যেহেতু আল্লাহ মানুষকে খিলাফতের দায়িত্ব সহকারে পৃথিবীতে প্রেরণ করিয়াছেন এবং মানব রচিত মতবাদের অনুসরণ ও প্রবর্তন না করিয়া একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধানের অনুসরণ ও প্রবর্তন করাকেই মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করিয়া দিয়াছেন;
যেহেতু আল্লাহ তাঁহার প্রদত্ত জীবন বিধানকে বাস্তব রূপদানের নির্ভুল পদ্ধতি শিক্ষাদান ও উহাকে বিজয়ী আদর্শ রূপে প্রতিষ্ঠিত করিবার উদ্দেশ্যে যুগে যুগে নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করিয়াছেন;
যেহেতু বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সাল্লাম) আলাহর সর্বশেষ নবী ও রাসূল এবং আলাহর প্রেরিত আল-কুরআন ও বিশ্বনবীর সুন্নাহই হইতেছে বিশ্ব মানবতার জীবনযাত্রার একমাত্র সঠিক পথ--সিরাতুল মুস্তাকীম;
যেহেতু ইহকালই মানব জীবনের শেষ নয় বরং মৃত্যুর পরও রহিয়াছে মানুষের জন্য এক অনন্ত জীবন যেখানে মানুষকে তাহার পার্থিব জীবনের ভাল ও মন্দকাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হইবে এবং সঠিক বিচারের পর জান্নাত বাজাহান্নাম রূপে ইহার যথাযথ ফলাফল ভোগ করিতে হইবে;
যেহেতু আলাহর সন্তুষ্টি অর্জন করিয়া জাহান্নামের আযাব হইতে নাজাত এবং জান্নাতের অনন্ত সুখ ও অনাবিল শান্তি লাভের মধ্যেই মানব জীবনের প্রকৃত সাফল্য নিহিত;
যেহেতু আলাহর বিধান ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি দিক ও বিভাগে প্রতিষ্ঠিত করিয়াই মানুষ পার্থিব কল্যাণ ও আখিরাতের সাফল্য অর্জন করিতে পারে;
যেহেতু স্বাধীন বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ এবং বাংলাদেশের জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়া বাংলাদেশ বিশ্বেও মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম জাতিÑরাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করিয়াছে;
সেহেতু এই মৌলিক বিশ্বাস ও চেতনার ভিত্তিতে ইসলামী সমাজ গঠনের মহান উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী-এর এই গঠনতন্ত্র প্রণীত ও প্রবর্তিত হইল। এ বিশ্বাসের আলোকে জামায়াতের গঠণতন্ত্র প্রণিত হয়েছে ।
গঠণতন্ত্রের ২ নং ধারায় জামায়াতের মৌলিক আকীদা বর্ণিত হয়েছে এ ধারায় বলা হয়েছে ‘‘ ইসলামের মৌলিক আক্বীদাই জামায়াতে ইসলামীর মৌলিক আকীদা ...(লা-ইলাহা ইলাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ) অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নাই, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল।
ব্যাখ্যাঃ (ক) এই আক্বীদার প্রথমাংশ অর্থাৎ আল্লাহরএকমাত্র ইলাহ হওয়া এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাহারও ইলাহ না হওয়ার অর্থ এই যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে যাহা কিছু আছে সেই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, প্রতিপালক, মা’বুদ এবং প্রাকৃতিক ও বিধিগত সার্বভৌম সত্তা হইতেছেন একমাত্র আল্লাহ। এই সবের কোন এক দিক দিয়াও কেহই তাঁহার সহিত
শরীক নাই। এই মৌলিক সত্য কথাটি জানিয়া ও মানিয়া লইলে নিম্মলিখিত বিষয়গুলি অনিবার্যরূপে গ্রহণ করিতে হয়।
১। মানুষ আল্লাহ ব্যতীত আর কাহাকেও নিজের পৃষ্ঠপোষক, কার্য সম্পাদনকারী, প্রয়োজন পূরণকারী, বিপদ দূরকারী, ফরিয়াদ শ্রবণকারী ও গ্রহণকারী এবং সাহায্যদাতা ও রক্ষাকর্তা মনে করিবে না। কেননা তিনি ব্যতীত আর কাহারও নিকট কোন ক্ষমতা নাই।
২। আল্লাহ ব্যতীত আর কাহাকেও কল্যাণকারী মনে করিবে না, কাহারও সম্পর্কে অন্তরে ভীতি অনুভব করিবে না, কাহারও উপর নির্ভর করিবে না, কাহারও প্রতি কোন আশা পোষণ করিবে না এবং এই কথা বিশ্বাস করিবে না যে, আল্লাহর অনুমোদন ব্যতীত কাহারও উপর কোন বিপদ- মুসীবত আপতিত হইতে পারে। কেননা সকল প্রকার ক্ষমতা ও
ইখতিয়ার একমাত্র আল্লাহরই।
৩। আল্লাহ ব্যতীত আর কাহারও নিকট দোয়া বা প্রার্থনা করিবে না, কাহারও নিকট আশ্রয় খুঁজিবে না, কাহাকেও সাহায্যের জন্য ডাকিবে না এবং আল্লাহর ব্যবস্থাপনায় কাহাকেও এতখানি প্রভাবশালী বা শক্তিমান মনে করিবে না যে, তাহার সুপারিশে আল্লাহর ফায়সালা পরিবর্তিত হইতে পারে। কেননা তাঁহার রাজ্যে সকলেই ক্ষমতাহীন প্রজা মাত্র।
৪। আল্লাহ ব্যতীত আর কাহারও সম্মুখে মাথা নত করিবে না এবং কাহারও উদ্দেশ্যে মানত মানিবে না। কেননা এক আল্লাহ ব্যতীত ইবাদত (দাসত্ব, আনুগত্য ও উপাসনা) পাইবার অধিকারী আর কেহই নাই।
৫। আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহাকেও বাদশাহ, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানিয়া লইবে না, কাহাকেও নিজস্বভাবে আদেশ ও নিষেধ করিবার অধিকারী মনে করিবে না, কাহাকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধানদাতা ও আইন প্রণেতা মানিয়া লইবে না এবং আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁহার দেওয়া আইন পালনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয় এমন সকল আনুগত্য মানিয়া লইতে অস্বীকার করিবে। কেননা স্বীয় সমগ্র রাজ্যেও নিরঙ্কুশ মালিকানা ও সৃষ্টিলোকের সার্বভৌমত্বের অধিকার আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহারও আসলেই নাই।’’
রীটকারীদের প্রথম অভিযোগ জামায়াত নীতিগতভাবে জনগণকে সকল ক্ষমতার উৎস বলে মনে করে না। সেই সঙ্গে আইন প্রণয়নে জনপ্রতিনিধিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকেও স্বীকার করে না -কারণ, জামায়াত বিশ্বাস করে আল্লাহর নিরংকুশ ক্ষমতা ও অস্তিত্বে-এখানে একটি বড় প্রশ্ন শতকরা নব্বই ভাগ মুসলামানের দেশে আল্লাহর স্বার্বভৌমত্বে আস্থা স্থাপন করা কি অপরাধ? যদি এ অপরাধে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হয় তবে তো সংবিধান লংঘনের দায়ে বাংলাদেশের প্রতিটি মুসলিম নাগরিকের নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যাবে। কারণ কোন প্রকৃত মুসলমানই আল্লাহর দেয়া বিধান, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, তার নিরংকুশ ক্ষমতা অস্বীকার করে না, বরং আল্লাহর নিরংকুশ ক্ষমতার বিরোধী যে কোন বিষয়কে মানতে অস্বীকার করে। আদালতের এ রায় মোতাবেক নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত আরো যে সাতটি ইসলামী দল আছে তাদের নিবন্ধনও বাতিল হয়ে যায়। সরকার মুলত দেশেকে ইসলাম শুন্য করার এবং ইসলামী রাজনীতি মুক্ত করার ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে এ কাজটি বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। বিপরীত পক্ষে জামায়াতের গঠণতন্ত্র যদি সংবিধানের বিরোধী হয় এবং সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয় তবে বাংলাদেশের সংবিধানে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস বাদ দিলেও এখনো বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম এবং রাস্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রয়েছে । এ দুটি ধারার কারণে যারা সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শে বিশ্বাস করে তারাও তো রাস্ট্রধর্ম ইসলাম স্বীকার করে না। তবে তাদের নিবন্ধনও তো বাতিল হওয়ার যোগ্য। মূলত সরকার ইসলাম নির্মূলের অংশ হিসেবে সর্ববৃহৎ ইসলামী দল জামায়াতকে প্রথমে ঘায়েল করতে চায়। জামায়াতকে শেষ করতে পারলে এক ধাক্কায় অন্যান্য ইসলামী দলকে কুপোকাত করা যাবে। এরপর তারা তাদের ইসলাম বিরোধী এজেন্ডা শতভাগ বাস্তবায়ন করবে এটাই হচ্ছে সরকারের লক্ষ্য। মূলত, একজন ব্যাক্তি কালেমা পাঠের মাধ্যমে যখন ইসলামে প্রবেশ করে তখন সে তখন সে আল্লাহ ব্যতীত সকল ইলাহকে অস্বীকার করে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন মনিব ও মাবুদ না থাকার সাক্ষ্য দানে করে। এই যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ না থাকার সাক্ষ্য দান করা এর অর্থ হচ্ছে-সকল প্রকার সার্বভৌম ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর নিকট সমর্পণ করা।প্রচলিত সকল প্রকার মানব রচিত রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সকল কিছুর বিরুদ্ধে এক আল্লাহর দাসত্ব ও বন্দেগী করার ঘোষণাই কালেমা তাইয়্যেবার মাধ্যমে দেয়া হয়। আজ জামায়াতের গঠণতন্ত্রকে এবং তাদের রাজনীতি করার অধিকার থাকবে কি থাকবে না এ বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে মুলত আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, তার কর্তৃত্ব, তার নিরংকুশ ক্ষমতা এবং তার উলুহিয়াতকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। জামায়াতের গঠণতন্ত্র সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এ কথা বলে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে-একইভাবে প্রশ্ন আসে প্রতিটি ঈমানদার মুসলিম আল্লাহর সার্বভৌমত্বে ও নিরংকুশ ক্ষমতায় বিশ্বাস করার কারণে কি তাদের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে? অথবা তাদেরকে সংবিধান বিরোধী ও রাস্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে? অবস্থা দৃস্টে আজ সে সব প্রশ্ন বড় আকারে আমাদের সামেন হাজির হয়েছে।
দ্বিতীয় যে অভিযোগ করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে জামায়াত একটি সাম্প্রদায়িক দল। যা মোটেও সত্য নয়। জামায়াত শুধুমাত্র কোন একটি নির্দিস্ট সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করে না। জামায়াত তার দাওয়াত ও কল্যাণমূখী কার্যক্রম করে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য। এমনকি জামায়াতের গঠণতন্ত্রে অমুসলিমদের সদস্য হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। যা অপরাপর ইসলামী দল যারা নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেয়েছেন তাদের দলেও নেই। এমনকি জামায়াতের বিভিন্ন শাখায় অনেক অমুসলিম সদস্য রয়েছে। জামায়াতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে অমুসলিমদের নিয়ে সমাবেশ এবং চা চক্রেরও আয়োজন করা হয়। তাই এ অভিযোগটি আদৌ সত্য নয়। এমনকি জামায়াত যে সকল সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক কাজ করে তখন ধর্ম, বর্ণ, জাতি বিভেদ করে না, বরং সবাইকে আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ হিসেবে বিবেচনায় এনে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে।
তৃতীয় অভিযোগ - নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের কোনো বৈষম্য করতে পারবে না। কিন্তু জামায়াতের শীর্ষ পদে কখনো কোনো নারী বা অমুসলিম যেতে পারবেন না। বৈষম্য করা আর শীর্ষ পদে অধিষ্টিত করা এক কথা নয়। যারা এ বিষয়ে আবেদন করেছে তাদের দলেও কোন নারী এবং অমুসলিম শীর্ষ পদে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। জামায়াতে ইসলামী যেহেতু একটি ইসলামী রাজনৈতিক দল সেহেতেু ইসলামী বিধান মোতাবেক এ দলে এ বিধানটি রাখা হয়নি। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী নারী অধিকার, নারীর মর্যাদা রক্ষা এমনকি মহিলা বিভাগের জন্য মহিলা দায়িত্বশীল নিয়োগ এমনকি জামায়াতের সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে নারী পুরুষ কোন ভেদাভেদ করা হয় না। একইভাবে অমুসলিমদের ধর্মীয় মর্যাদা রক্ষা এবং তাদের নাগরিক অধিকার রক্ষায় জামায়াত সদা তৎপর এবং সক্রিয়। এমনকি জামায়াত এ কথা দৃঢ়তার সাথে প্রচার করে যে আজ সমাজে যে নারী বৈষম্য, নারী নির্যাতন, যৌতুক, ইভটিজিং এ সব সমস্যার সমাধান হতে পারে কেবলমাত্র ইসলাম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। একইভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে অমুসলিমরা সকল প্রকার নাগরিক ও সামাজিক এবং ধর্মীয় অধিকার ভোগ করবে। যা অধ্যাপক গোলাম আযম রচিত অমুসলিম নাগরিক ও জামায়াতে ইসলামী বইতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। তাই এ কথা নির্দিধায় বলা যায় জামায়াত কোন প্রকার বৈষম্যে বিশ্বাস করে না, বরং ইসলামের সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় জামায়াতে ইসলামী অঙ্গীকারাবদ্ধ। মূলত যারা ইসলামকে সহ্য করতে পারে না, ইসলামী বিধি বিধানকে মনাতে চায় না তারাই জামায়াতের বিরুদ্ধে এ সব অভিযোগ উত্থাপন করে।
চতুর্থ অভিযাগ-কোনো রাজনৈতিক দলের বিদেশে কোনো শাখা থাকতে পারবে না। অথচ জামায়াত বিদেশের একটি সংগঠনের শাখা। তারা স্বীকারই করে, তাদের জন্ম ভারতে। বিশ্বজুড়ে তাদের শাখা রয়েছে। এ অভিযোগটি আদৌ সত্য নয়- ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ নামে বাংলাদেশেই শুধু সংগঠন আছে। পৃথিবীর অন্য কোন দেশের শাখা সংগঠন ‘বংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ নয়। জামায়াতে ইসলামী যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন পুরো উপমহাদেশ ভারত নামেই পরিচিত ছিল। এরপর ভারত পাকিস্তান পৃথক দুটি রাস্ট্র হওয়ার পর এর নাম হয়েছে ‘জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান’। আবার ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর এর নাম হয়েছে ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’। সর্বশেষ ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধনের নিয়ম চালু করার সময় নামের ব্যাপারে আপত্তি জানালে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ নামকরণ করা হয়। জামায়াতের জন্ম ভারতে অভিযোগ যদি করা হয় তবে প্রশ্ন আসে আওয়ামীলীগের জন্ম কোথায়? আওয়ামীলীগও তো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পাকিস্তান নামক রাস্ট্রে তখন আওয়ামীলীগের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ। এমনকি তাদের দলের নামটি পর্যন্ত উর্দু এবং ইংরেজী শব্দের সংমিশ্রনে। কমিউনিষ্ট পার্টি একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। কমিউনিষ্ট পার্টির জন্ম রাশিয়ায়। তাদের দলের নাম সি পি বি- ( কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ) অথবা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্ত জামায়াতে ইসলামী কখনো বলে না বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী অন্য কোন দেশের শাখা নয় এবং পৃথিবীর অন্য কোন দেশে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কোন শাখা নেই। জামায়াতে ইসলামীর গঠণতন্ত্রে কিংবা বক্তব্যে কখনো এমন কথা বলা হয় না যে জামায়াতে ইসলামী অন্য কোন দেশের শাখা সংগঠন অথবা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শাখা আছে। এই নামে ভারত পাকিস্তান এবং শ্রীলংকায় দল আছে, সেটা থাকতেই পারে যেমন কংগ্রেস নামে, লেবার পার্টি নামে কমিউনিস্ট পার্টি নামে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক দল রয়েছে।
অতএব যারা রীট করেছে তারা যদিও বলেছে জনস্বার্থে তারা এই রীট করেছে তাদের এই বক্তব্য আদৌ সত্য নয়। কারণ জামায়াতে ইসলামী -বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণেই রাজনীতি করে, জনস্বার্থেই তাদের রাজনীতি পরিচালিত হয়। রীটকারীরা জনগণের কল্যাণে এমন কোন কাজ করে নাই যা উল্লেখ করা যায়। বরং জামায়াতে ইসলামী তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে জনগণের কল্যাণেই রাজনীতি পরিচালনা করে আসছে। যে কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জামায়াত সব সময় ভূমিকা পালন করেছে। স্বৈরাচারী আইউব বিরোধী আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামী ন্যাপ, পিডিপি এবং আওয়ামীলীগের সাথে একত্রে আন্দোলন করেছে। আইউবের কুরআন বিরোধী মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার কারণে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন আইউব খানের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব রাজনৈতিক দলের নেতারা। মাওলানা ভাসানী,মোজাফ্ফর আহমদ, ওয়ালি খান, তাতে সই করেছিলেন। শুধু তাই নয়, উনারা সেই সময় বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, "জামায়াত নিষিদ্ধকরণ গণতন্ত্রের ওপর বর্বর হামলা"। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে ডাকসুর তৎকালীন ভিপি রাশেদ খান মেনন ও জিএস মতিয়া চৌধুরীর স্বাক্ষর ছিলো। আরো স্বাক্ষর করেছিলেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, হায়দার আকবর খান রনো প্রমূখ। স্বাধীনতা পরবর্তী এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, কেয়ার টেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সব আন্দোলনেই জামায়াতে ইসলামী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। একইভাবে দেশের যে কোন দুর্যোগ মূহুর্তে জামায়াতের নেতা কর্মীরা ত্রাণ এবং চিকিৎসা কার্যক্রম নিয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। অতএব দেশ জাতির কল্যাণের যদি প্রশ্ন আসে জামায়াতে ইসলামী সব সময়ই দেশ জাতি ও জনগণের কল্যাণে ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমান কঠিন এবং প্রতিকুল পরিবেশেও বিগত চার বছরে যখন জামায়াতে ইসলামীকে নির্বিঘেœ কোন প্রকার রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেয়া হয় নাই এমন অবস্থায়ও দেশের প্রতিটি জেলা উপজেলায় জামায়াতের পক্ষ থেকে তীব্র শীতে শীতার্ত মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ, বিভিন্ন যায়গায় অগ্নিকান্ডের পর ক্ষতিগ্রস্থদের মাঝে আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং প্রতি বছর ঈদে দরিদ্র জনগণের মাঝে ঈদ সামগ্রী বিতরণ করেছে। যারা জনস্বার্থে রীট করেছেন তারা এমন কোন প্রকার কার্যক্রম কখনোই করেন নাই। অতএব তাদের রীট জনস্বার্থে নয়, হীন রাজনৈতিক স্বার্থে, তারা ব্যবহৃত হয়েছেন ক্ষমতাসীনদের ক্রীড়নক হিসেবে। ক্ষমতাসীনরা আজ ক্ষমতার জোরে আদালতকে হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের যে ঘৃণ্য খেলা শুরু করেছেন তা তাদের জন্য কখনোই শুভ ফল বয়ে আনবে না। হাইকোর্টে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার পর পতিত বাম আর আওয়ামীলীগের ঘাড়ে সওয়ার হওয়া পরজীবীরা নির্বাহী আদেশে জামায়াতকে নিষিদ্ধের জন্য রাজনীতির মাঠ গরম করছেন। যারা আজ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের জন্য পাড়া মাতাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই গণবিচ্ছিন্ন বাম কমিউনিস্ট। জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতা যে পরিমাণ ভোট পান এ সব কমিউনিস্ট নেতারা দলের সবাই মিলে সে পরিমাণ ভোট পান না। অথচ তারা আজ জামায়াত নিষিদ্ধের জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছেন আর তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে আওয়ামী বাম এ্যাকটিভিস্ট ইয়োলো জার্নালিস্টরা। যারা বাস কাউন্টার আর ভাঙ্গা রাস্তা পরিদর্শনে গেলেও সরকারী দলের মন্ত্রীদের প্রশ্ন করছেন জামায়াতকে কখন নিষিদ্ধ করা হবে? ভাবখানা এমন যে দেশে এটাই আজ সবচেয়ে বড় সমস্যা অথচ এই সমস্ত ইয়োলো জার্নালিস্টরা কখনো প্রশ্ন করে না সিরিয়াল কিলার, টেন্ডারবাজ, দখলবাজ এবং ভয়ংকর খুনীদের সংগঠন যুবলীগ ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা হবে কি না? অথচ যুবলীগ আর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসে জনজীবন অতিষ্ঠ, দখল, টেন্ডারবাজী, খুন, হামলা, চাঁদাবাজি এ সবই এখন ছাত্রলীগ যুবলীগের মূল কাজ। তাদের ব্যাপারে কোন কথা নেই। নিষিদ্ধ করার প্রশ্ন আসলে গণবিরোধী এ সব সংগঠন সবার আগে নিষিদ্ধ করা উচিৎ। যারা আজ জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার কথা বলছেন, জামায়াতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, জামায়াতকে নিষিদ্ধের ঘৃণ্য খেলায় মেতেছেন তাদের জেনে রাখা উচিৎ নিষিদ্ধ করে কোন আদর্শিক দলকে নিঃশেষ করা যায় না। ইতিপূর্বে জামায়াতে ইসলামীকে তিনবার নিষিদ্ধ করা হয়েছে কিন্ত জাময়াতে ইসলামীকে শেষ করে দেয়া যায়নি বরং দিনে দিনে জামায়াতের প্রতি জনগণের সমর্থন এবং আগ্রহ বেড়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জামায়াতে ইসলামীর উপর চরম জুলুম নির্যাতন, নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড, চোখ উপড়ে ফেলা, পঙ্গু করে ফেলা,গুম,খুন, গণহত্যা এবং সর্বপ্লাবী অপপ্রচার চালিয়েও জামায়াতে ইসলামীকে গণবিচ্ছিন্ন করা যায়নি। বরং এত কিছুর পরও আগের তুলনায় জামায়াতের সাংগঠনিক শক্তি যেমন বেড়েছে তেমনি জামায়াতের প্রতি জনগণের সমর্থনও বেড়েছে। এর বাস্তব প্রমাণ বিগত ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন। জামায়াতের সংশ্লিস্টদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জামায়াত সমর্থিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছিল দেড় শতাধিক কিন্তু বর্তমান আওয়ামী আমলে জামায়াত সমর্থিত আড়াই শতাধিক চেয়ারম্যান প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন, একইভাবে বেড়েছে মেম্বার সংখ্যা। ইতিপূর্বে মাত্র চারজন পৌর মেয়র ছিল জামায়াতের কিন্তু সাম্প্রতিক নির্বাচনে জামায়াত সমর্থিত আটজন পৌর মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। চার সিটি করপোরেশনে ছয়জন কাউন্সিলর ছিল কিন্তু এবারের নির্বাচনে জামায়াত সমর্থিত বারো জন কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। তাই এ কথা নির্দিধায় বলা যায় জুলুম নির্যাতন করে, গুম, খুন করে নিষিদ্ধ করে আদর্শিক আন্দোলনকে শেষ করে দেয়া যায় না। বিশেষ করে কোন ইসলামী আন্দোলনকে জুলুম নির্যাতন আর নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে শেষ করে দেয়া যায় না। জামায়াতে ইসলামীকে ইতিপূর্বে তিনবার নিষিদ্ধ করে যেমন শেষ করে দেয়া যায়নি ঠিক তেমনি পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও যারাই ইসলামী আদর্শকে ধারণ করে আন্দোলন করছেন তাদেরকে নিষিদ্ধ করে শেষ করে দেয়া যায়নি। তুরস্কে সাঈদ বদিউজ্জমান নুরসীর প্রতিষ্ঠিত রেসালাই নূর পার্টিকে বহুবার নিষিদ্ধ করা হয়েছে প্রতিবার নতুন নামে আবার সে আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়েছে বর্তমানে সে সংগঠনের নাম এ.কে. পার্টি, যারা দীর্ঘ পনের বছর যাবৎ সরকার পরিচালনা করছে। মিশরে চল্লিশ বছর যাবৎ সামরিক সরকার মুসলিম ব্রদারহুডকে নিষিদ্ধ করে রেখেছিল, তারা বিগত নির্বাচনে ৫৩% ভোট পেয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পশ্চিমা এবং ইউরোপীয় ষড়যন্ত্রে আবার সেখানে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে সেখানকার গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। কিন্তু তাই বলে মিশরের আদর্শিক আন্দোলন শেষ হয়ে যায়নি। সুষ্ঠু এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ পেলে ইসলামী আন্দোলন যেমন দ্রুত সম্প্রসারিত হয় আবার চরম বিরোধীতা, হামলা, মামলা নির্যাতন এবং বৈরী পরিবেশে ইসলামী আন্দোলনের যোগ্য লোক তৈরী হয়। আদর্শিক আন্দোলনের উপর যখন চরম জুলুম নির্যাতন পরিচালনা করা হয় অথবা তাদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য নিষিদ্ধ করা হয় এ আন্দোলনের প্রতি তখন জনগণের আগ্রহ, সমর্থন এবং ভালবাসা আরো বৃদ্ধি পায়। তাই যারা জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার শ্লোগান দিয়ে এ আন্দোলনকে নিঃশেষ করার দিবাস্বপ্ন দেখছেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। জামায়াতে ইসলামী আজ বিরাট এক রাজনৈতিক শক্তি। হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা কোন হঠকারী সংগঠনের নাম জামায়াতে ইসলামী নয়। জামায়াতে ইসলামীতে যেমন পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞ কর্মী রয়েছে তেমনি যুবক ছাত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের জনশক্তি এ আন্দোলনের সাথে জড়িত। বিগত সব কয়টি জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় সংসদে জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব ছিল, এখনো আছে। ১৯৯১ সালে জামায়াতে ইসলামী ২১৬ আসনে নির্বাচন করে তখন মোট ভোটের ১২% এর অধিক ভোট পেয়েছিল, এরপর ১৯৯৬ সালে ৩০০ আসনে নির্বাচন করে জামায়াতে ইসলামী ভোট পেয়েছিল ৯% এরপর আর জামায়াতের পক্ষ থেকে আলাদা নির্বাচন করার সুযোগ হয়নি। ২০০১ সালে জামায়াত মাত্র পয়ত্রিশটি আসনে নির্বাচন করেছে বাকী ২৬৫ আসনে চারদলীয় জোটের প্রার্থীদের ভোট দিয়েছে,তখন জামায়াতের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫.৫%। ২০০৮ সালে জামায়াত ৩৯ আসনে নির্বাচন করেছে এতে জামায়াতের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৬%। ১৯৯৬ সালের চেয়ে বর্তমানে জামায়াতের সহযোগী সদস্য, কর্মী এবং সদস্য বেড়েছে চারগুন এরও বেশী সে পরিসংখ্যানে জামায়াতের ভোট কমপক্ষে দিগুন বেড়েছে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। । তার মানে আমরা যদি ১৯৯১ সালের ১২% অথবা ১৯৯৬ সালের ৯% এর হিসেব ধরি তবে জামায়াতের ভোট ১৮-২৪%। এত বিশাল জনশক্তির এবং এত বিশাল পরিমাণ জনসমর্থনের অধিকারী দলকে নিষিদ্ধ করা মানে গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করা। যারা গণতন্ত্রের স্বাভাবিক যাত্রা ব্যহত কওে এবং রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে গণরোষেই তাদের বিদায় নিতে হয়। নিকট অতীতের বেশ কয়েকটি ঘটনাই তার বাস্তব স্বাক্ষী। জামায়াতকে নিষিদ্ধের মতো আত্মঘাতি কোন সিদ্ধান্ত নিলে তা বরং সরকারের জন্য বুমেরাং হবে এবং জামায়াতের প্রতি জনগণের সমর্থন ও ভালবাসা আরো বৃদ্ধি করবে এবং জনগণের আরো বেশী সমর্থন নিয়ে জামায়াত আবার গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ফিরে আসবে পক্ষান্তরে নিষিদ্ধের দাবীদাররা ইতিহাসের আস্তাকুরে নিক্ষিপ্ত হবে। ¯্রােতাস্বিনী নদীর ¯্রােতকে বাধ দিয়ে আটকাতে চাইলে আটকিয়ে রাখা যায় না তা বরং বাধকে ভেঙ্গে নিয়ে আরো বেশী শক্তিতে প্রবাহিত হয়। জামায়াত একটি ¯্রােতাস্বীনী নদীর মতো, নিষিদ্ধকরণ আর নিবন্ধন বাতিলের অস্ত্র দিয়ে এ সংগঠনের অগ্রযাত্রা রুখে দেয়া সম্ভব হবে না।
courtesy : মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান
বিষয়: বিবিধ
১৮১২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন