সময়ের প্রকাশঃ আমি বাঙালি এবং আমার স্বভাব

লিখেছেন লিখেছেন হাবীব ১৩ জুন, ২০১৩, ০৮:৩০:২২ রাত

সমাজ ও সংস্কৃতি যদি একটি মুদ্রা হয় তাহলে ভালো ও মন্দ তার দুটি পিঠ । ভালকে আরও ভালো করার উৎসাহে এবং মন্দকে শুধরানোর রসহীন চিন্তায় সময়ের প্রয়োজনে আমি ও আমাদের উদ্দেশ্যে লিখছি । বিবেক দিয়ে উপলব্ধি করার পর প্রতিটি লাইন নিজের সাথে, সমাজ ও দেশের অতিত এবং চলমান ঘটনা প্রবাহের সাথে মিলিয়ে বুঝার চেষ্টা করলে আশাকরি বিবেকের দ্বার উম্মচিত হতে সহায়তা করবে ।

আমরা বাঙালি সমাজ, সংস্কৃতি, শিল্পকলা এবং হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণ সহ বহুগুনের প্রশংসার দাবিদার । তারপরও আমরা ভিতরে ও বাইরে সমান নই । উত্তেজিত হলে নিজেদের নিরাপত্তার কথাও আমরা চিন্তা করিনা । আমরা যা নিজেদের জন্য নির্যাতন মনে করে নিন্দার ঝড় তুলি আর ঠিক একই ধরনের অপরাধ আমরাও অন্যদের সাথে করে তার বৈধতা দিতে মরিয়া হয়ে উঠি, আত্ন তৃপ্তিতে ভুগি, আনন্দে অন্যের জন্য তা প্রাপ্য মনে করি । অথচ অন্যায় আচরণে অন্যদের সাথে আমাদের পার্থক্য খুবই সামান্য । আর এই সব কিছুর মূলে রয়েছে ক্ষুদ্র মতভেদের যুক্তি খণ্ডন । ভুলেই গেছি অপরাধ কোন পক্ষীয় বিষয় নয় । একটি অপরাধের প্রশ্রয়ে অনেক অপরাধের সৃষ্টি করবে স্বাভাবিক । এর ফলে বাংলাদেশ সহিংসতার সংস্কৃতিতে দিশেহারা ।

পর্যালোচনা ছাড়াই ঘটনার বর্ণনা দিতে আমাদের দেশে প্রতিযোগিতা চলে । নিরপেক্ষ চিন্তার অভ্যাস এখানে গড়ে ওঠেনি । অতিমাত্রায় ঘৃণা, আবেগ ইত্যাদি স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের কারণে নিজেদের বিরুদ্ধে যায় এমন সব কিছু চেপে রাখতে আমরা অভ্যস্থ । অথচ সেখানে সচেতন হওয়ার সুযোগ এবং শিক্ষা নেয়ার বিষয় আছে । একই সমাজে বসবাস করার পরেও নীতি-নৈতিকতা, মুক্ত সমাজ, নিয়ম কানুনের প্রতি মানুষ অনাগ্রহি হয়ে পড়েছে ।

আদর্শের ও নিয়মের কথা বলি কিন্তু সবার আগে নিজেই আদর্শচ্যুত হই এবং নিয়ম ভাঙ্গতে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে উৎসাহিত করি । অন্যের প্রতি অভিযোগ আনতে যথেষ্ট পারদর্শিতার কারণে জীবনের ক্ষেত্রগুলোতে বাস্তব পদক্ষেপ ও পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিযোগিতার পরিবর্তে অন্যের বা অন্য কিছুকে সামনে রেখে নিজের অপারগতা প্রকাশ করার প্রয়াস প্রায় নিত্য ঘটনা । পরস্পর বিরোধী চর্চা এবং সমক্ষতা লাভের দাবী আমাদেরকে প্রতিনিয়ত বিভক্ত করছে ।

দায়িত্ববোধের চেয়ে কর্তৃত্ব আমাদের কাছে বেশি প্রিয় । যেহেতু নিজের অবস্থার চেয়ে বেশি প্রকাশ করি তাই আমাদের চিৎকার দ্রুত শেষ হয়ে যায় । বাস্তবতার সাথে আমাদের প্রকাশিত গর্ব মেলানো কঠিন হয়ে গেছে । অন্যায় ও সকল প্রকার মন্দকে ঘৃণা করতে আমাদের নিয়মিত ব্যর্থতার ফলে আমরা অসত্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করতে ভুলেগেছি । ভালমন্দের পার্থক্য বুঝি এবং স্বীকারও করি কিন্তু স্বার্থের বিরোধী হলে ভালকে যুক্তি ছাড়াই মন্দ বলে প্রচার করতে দ্বিধা করিনা ।

কিছু কথা যেমন – ষড়যন্ত্র, ছিনিমিনি খেলা, পূর্বপরিকল্পিত ইত্যাদি হাস্যকরভাবে আমাদের প্রধান কথায় পরিণত হয়েছে । ক্ষমতা আর অস্ত্র মানুষকে পাশবিক বানায় । তারপরও অতীত ও বর্তমান কৃতকর্মের প্রতিক্রিয়া আমরা সহজে ভুলে যাই আর আফসোস করি । আবার সামর্থের বাইরে প্রতিবাদ করে গোটা সমাজকে বিপদে ঠেলে দেয়া আমাদের অতীত অভ্যাস । একথাও ঠিক এখানে অনেক মানুষ আছে যারা কঠিন সময়েও নীতি ও নৈতিকতা পরিপন্থী কাজ থেকে সচেতন ভাবে দূরে থেকেছেন, অন্যরাও তাদেরকে দেখে উৎসাহিত হয়েছে এবং হচ্ছে । ফলে মৃত্যুও তাদের আদর্শকে অসম্মানিত করার সুযোগ পায় না ।

স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও চিন্তার দৈন্যতার কাছে প্রায় অসহায় হয়ে উদ্দেশ্য অভিন্ন হলেও বেশিরভাগ মানুষ তার নিজের স্বত্তাকে বিকিয়ে দেয় । একই সাথে সবাই ভালো বা সবাই খারাপ নয় বরং সংখ্যায় কম বেশি থাকাটা যুক্তিসঙ্গত । আমরা এক দু’জনকে দিয়ে পুরো একটি বিষয়কে চিন্তাহীন ভাবে বিশ্লেষণ করে মজা পাই । ধ্বংসের নরক সৃষ্টি হলেও নিজের পছন্দ বা স্বার্থের কারণে সাফাই গাই । অথচ শৃঙ্খলিত, চিন্তা ও জ্ঞানে সমৃদ্ধ এবং সুপ্রশিক্ষিত একটি জাতি কম সংখ্যক মানুষকে নিয়েও স্থিরতা ও কর্ম কৌশলের মাধ্যমে অনায়াসে প্রভাব বিস্তার করে মর্যাদার উচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারে । অনৈক্য আমদেরকে প্রকট ও প্রচ্ছন্ন ভাবে বারবার পরাজিত জাতিতে পরিণত করেছে ।

আমাদের কাছে মানবতার চেয়ে শত্রুতার বিচার প্রধান । বৈষয়িক লাভের নেশা আমাদের নির্দ্বিধায় অমানবিক হতে উৎসাহিত করে । প্রতিবাদি মানুষের সামান্য প্রতিক্রিয়া সমস্ত মন্দের ধ্বংসে যথেষ্ট । কিন্তু আমরা মুখ লুকিয়ে ঝড় থেকে বাচতে চাই, ফলে আরও বেশি ধ্বংস আমদের গ্রাস করছে প্রতিনিয়ত । স্থায়ী কল্যাণের জন্য নিরলস প্রচেষ্টার বড়ই অভাব এখানে । আমরা আত্নত্যাগ, কৌশল এবং আদর্শের বাস্তব প্রকাশের গুরুত্ব ভুলতে বসেছি । সোনার বাংলাদেশে যুবকরা আজকে জ্ঞান স্বল্পতা, বিচার-বিশ্লেষণে অদক্ষতা, চিন্তার দৈন্যতা এবং অন্যের দ্বারা সহজে প্রভাবিত হয়ে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে কেমন যেন মিথ্যে মায়াজালে আবদ্ধ হচ্ছে । নিজেদের আচার-আচরণে প্রকাশ ও রুচিশিলতায় মিথ্যে অনুকরণ চিন্তার জগত সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে ।

এখন প্রশ্ন আমাদের রক্ষায় কে আদর্শের নমুনা হবে ? মহানুভবতা আর ক্ষমার দৃষ্টি এখানে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে । পক্ষ ও বিপক্ষ আমাদেরকে ভেঙ্গে চৌচির করছে । মানবতার উদ্দেশ্যে জীবন বিলিয়ে দেয়ার মানবীয় আদর্শের দৈন্য দশা । যার ফলে মহৎ উদ্দেশ্যের সাথে সাফল্য যথার্থ হচ্ছে না । আবার সময়ের সঠিক মূল্য না দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিযোগিতা অত্যান্ত মূর্খতার প্রকাশ । বন্ধু ও শত্রু চেনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার ফলে নানামুখি হুমকির ভীতি, অসংলগ্ন সিধান্ত সমস্যা সমাধানের বিপরীতে আরো বেশি সমস্যার মুখোমুখি করছে । উন্নতির চেয়ে অবনতি যার বাস্তব ফলাফল ।

ঘুমে দেখা স্বপ্নের জগতে আমরা ভেসে বেড়াচ্ছি । আমাদের স্বপ্নে পরিকল্পনা, বাস্তবতা এবং বিবেকের তাড়না নেই । তাই আমাদের বাস্তবতা আফসোসে পরিণত হচ্ছে । নিজের উদ্দেশ্য ও করণীয় সম্পর্কে আমাদের অধিকাংশই বেখেয়াল । বুঝেও বুঝি না ! মেনেও মানি না ! সামান্য সভ্যতার বিকাশ হয়েছে এই ধারনার দাবিদার হলেও এখনও আত্নকেন্দ্রিকতার গণ্ডি থেকে বেড়িয়ে আসার সৌভাগ্য তো হয়নি বরং চরিত্রের নিন্দনীয় দিকগুলো কেন যেন আগের চেয়ে প্রকট আকার ধারণ করছে !। প্রকট বলছি কারণ আজকের আধুনিক পৃথিবীতে আমারা আধুনিকায়নের গোলক ধাঁধায় পড়ে চিন্তা ও চরিত্রে অসভ্যতা লালন করছি ।

বুদ্ধিভিত্তিক প্রতিযোগিতার বিপরীতে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে নিজের সুনাম বৃদ্ধির কুৎসিত প্রচেষ্টা একটি স্বাভাবিক পদ্ধতি এখানে । মানুষের আবেগ নিয়ে আমাদের প্রতিহিংসার প্রতিক্রিয়া । আমাদের কথা ও কাজের অমিল আমাদের নিন্দিত করে অথচ ভাবখানি এমন লোকে আমাদের প্রশংসা করছে । সত্যি বলতে কি ! সেরকম ভাবার কারণ আছে – আমরা অপকর্মগুলো সহজেই মুখরোচক কথার ফাঁদে পড়ে ভুলে যাই । আর যারা প্রচার ব্যাবস্থার সাথে জড়িত তাদের অনেকে স্বার্থের প্রসার নীতিতে আত্নমর্যাদা ও ভালো মন্দের বিবেচনা ভুলে যান ।

বাংলাদেশে সংঘাত বা বৈপরিত্যের যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে তার ফলে বিপরীত পক্ষের যে ভালো দিক আছে সেটা স্বীকার করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছি আমরা । আশ্চর্য্য রকম ভাবে অতিধারণা , অতিকথা, গুজব ছড়াতে পুরো জাতিই আজকে দারুণ পারদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছে । তথ্য বিভ্রাট, আনুমানিক কথাবার্তা, যন্ত্রণাদায়ক মিথ্যে দোষারোপ আসলে লজ্জার বিষয় । মিথ্যাচারের কারণে অনেকে ভিতর-বাহির বিবেচনা না করে চোখে যা পড়ছে তাই নিয়ে মাতামাতি করছে । কি চমৎকার ! আমাদের সর্বময় জানার ও জ্ঞানের ক্ষমতা ।

আসলে শিক্ষা ব্যাবস্থা ও সামগ্রিক জানার ব্যাবস্থার মাধ্যমে আমাকে, আমার জাতিকে একটি পর্দার পেছনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । শিক্ষা লাভ করছি কিন্তু শিক্ষিত হতে পারছিনা । জ্ঞানী হবার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায় কিন্তু জ্ঞানের প্রয়োগ করার ক্ষমতা বা মানবিক শক্তি আমাদের নেই । জানি কিন্তু জানার মাঝে সত্যতা এবং সততা নেই । কেন ? কী করছি ? সে প্রশ্ন আমাদের সামনে আসছে না । নিরর্থক স্বপ্নচারিতা আর হতাশার অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে আমাদেরকে । বেড়ে যাচ্ছে অশুভ প্রতিযোগিতা । যেখানে সবাই দৌরের মধ্যে আছে কিন্তু কেউ বিজয়ী হতে পারছেনা ! কারণ আমাদের প্রতিযোগিতা লক্ষ্যহীন আর মিথ্যায়ভরা লক্ষ্যবস্তু ।

ক্ষমতার নিয়মহীন লড়াই, উগ্রতা এবং নির্দিষ্ট পরিচয়ের গণ্ডি থেকে বেড়িয়ে আসতে না পারলে জটিলতা আরও ঘনীভূত হবে নিশ্চিত করে বলা যায় । উগ্রতা এজন্য বলছি কারণ এখানে অসহিস্নুতা, ভীতি এবং প্রতিপক্ষকে নির্মূলের মানসিকতা দিবালোকের মত প্রকাশিত । এত কিছুর পরেও যদি কেউ বুঝতে না পারেন তাহলে আপনাকে বোকা বলতেও আমি লজ্জা বোধ করি । তাই বলে ‘নির্বোধ’ বলে বিদ্রুপ করব না । বোধোদয় তো আর সবার এক সাথে হয় না !। আদর্শের মৌখিক এবং বাস্তবায়নের প্রতিযোগিতা আমাদের কাম্য ।

কে আমাকে সচেতন করবে ? অন্যেরা ! নাকি আমি নিজেই ? সত্য ও সুন্দর কী নিজের বিবেক কে প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া যায় কিন্ত সামান্য বৈষয়িক লাভের আশায় মতিভ্রম হওয়ার কারণে জাতি হিসেবে আমরা নিজেই আমাদের আত্নহনন করছি । মিথ্যে আত্নতৃপ্তিতে মলিন করে ফেলছি আমাদের অনাগত সময়ের প্রকাশ । আমি এই “বাঙালি” থাকতে চাই না !! আসলে এত অভিযোগের মাধ্যমে আমি আমাকেই শাসন করছি । এখনও সময় আছে নিজেকে জানার এবং চেনার । আমি আমার আমিকে বলছি ! আপনি ?

মোঃ হাবিবুর রহমান

বিষয়: বিবিধ

১৮৭৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File