এরশাদের বারবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বদলের পশ্চাতে !
লিখেছেন লিখেছেন সিকদারমোহাম্মদ ০৪ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১০:৪০:৩১ রাত
সিকদার মোহাম্মদঃ
সব মহলকে অবাক করা এরশাদের সিদ্ধান্তে একটাই প্রশ্ন- হঠাৎ এমন কী কারণে এবং কেন নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন এরশাদ। তবে এরশাদ তার বারবার সিদ্ধান্ত বদলের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে এবারের নেয়া সিদ্ধান্তকেই আখেরি সিদ্ধান্ত বলে অজ্ঞাত স্থান থেকে জানিয়েছেন ।
নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর অনেক কারণের মধ্যে রয়েছে । যেমন-আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি, মঞ্জুর হত্যা মামলা থেকে মুক্তি, দলীয় প্রতীক 'লাঙ্গল' মার্কা দাবি করে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর করা মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য দরকষাকষিতে সুবিধাজনক অবস্থা তৈরির জন্য নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে সরকারকে চাপে ফেলে ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে সুবিধা আদায়ে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় এরশাদের এই ঘোষণা । বিভিন্ন পর্যায়ের জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে আলাপে বেড়িয়ে আসে এসব তথ্য । তবে সরকার কেন তার সব দাবি আমলে নেবে? উত্তরটা খুবই সাধারণ, আর তা হল, জাতীয় পার্টিই আওয়ামী লীগের শেষ ভরসা, এরশাদের দল যদি নির্বাচনে না আসে তবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার আগেই তার বৈধতা পুরোপুরিই হারিয়ে যাবে। আর যদি এরশাদসহ নির্বাচন করে একটা সন্তোষজনক ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায় তবে সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে আন্তর্জাতিকভাবে দেনদরবার করেও হলে আরো কিছুদিন এমনকি আরেক দফা ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করা যাবে ।
বিগত ১৮ নভেম্বর নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন এরশাদ। ২০ নভেম্বর মঞ্জুর হত্যা মামলার সব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ায় রেহাই পাবেন এমনটাই আশা করেছিলেন তিনি। কিন্তু মামলাটির পরবর্তী তারিখ আগামী বছরের জানুয়ারিতে ধার্য করা হয়েছে। একইভাবে লাঙ্গল প্রতীক দাবি করে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মামলাটিও ঝুলে আছে। ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে এসব সমস্যার সমাধান চান এরশাদ।
জাপা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গতকাল ক্ষোভের সাথে জানান, জেনারেল মঞ্জুর হত্যার জন্য আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ঘটনার ১৪ বছর পর। কোনো মামলায় যখন আমাকে আটকানো যাচ্ছিল না তখন মঞ্জুর হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। সে মামলা আজ ১৮ বছর ধরে চলছে। ১৩ জন বিচারক বদল হয়েছেন, কিন্তু মামলার গতি-প্রকৃতি বদলানো হয়নি। অর্থাৎ আমাকে ঝুলিয়ে রাখতেই হবে। কোনো সাক্ষী আমার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি তথাপিও মামলা শেষ হচ্ছে না। তিনি বলেন, আমার দলীয় প্রতীক লাঙ্গল। তাও কেড়ে নেওয়ার জন্য মামলা হয়েছিল। সে মামলা এখনো উচ্চ আদালতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
জাতীয় পার্টির কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব কারণ ছাড়াও রয়েছে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর এরশাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে দলকে আবার ভাঙ্গনের থেকে রক্ষা করার জন্য তার এই সিদ্ধান্ত ।
এছাড়াও সারা দেশে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের ওপর হামলা ও অফিস ভাঙচুর হলেও নিরাপত্তা পাওয়া যায়নি। পার্টির ৩৮ জন মনোনীত প্রার্থী ইসির বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি এবং সরকারবিরোধী আন্দোলন বেগবান হওয়ায় সব মিলিয়ে নির্বাচন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি।
জানা যায়, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকায় প্রধান বিরোধী দলে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল জাতীয় পার্টির। আবার আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার ধসকে কাজে লাগিয়ে সরকার গঠনেরও স্বপ্ন দেখত দলটি। এ লক্ষ্যে জাতীয় পার্টিকে ৭০টি আসন আওয়ামী লীগ ছেড়ে দেবে এমন কথাও শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে ২৯৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করায় হাসিনার উপর খেপে যান এরশাদ।
এরশাদ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চরিত্রের বিষয় সন্দিহান কারণ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে মহাজোটগতভাবে ৪৬টি আসন দিলে ১৭টি আসনে নৌকা প্রতীকে তাদের প্রার্থী দাঁড় করিয়ে রাখে। এই কারণে গত নির্বাচনে এরশাদের আসন কমে যায় । এবারও সে রকম কিছু করতে পারে চিন্তা করে এরশাদ নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ।
জানা যায়, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার আরও কারণের মধ্যে রয়েছে কাজী জাফর আহমদের স্ট্যান্ডের সঙ্গে অনেক নেতা-কর্মীর আনুগত্য প্রকাশ। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের প্রার্থীর বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সিলেটে জকিগঞ্জে উপজেলা চেয়ারম্যান ও মনোনীত প্রার্থীর বাড়ির সামনে বোমা বিস্ফোরণ, কুড়িগ্রামে সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে নাজেহাল, সিলেটে বাবলুল ইসলাম বাবুলের বাড়ির সামনে বোমা বিস্ফোরণ, পার্টির মহাসচিব, বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের বাসভবনের সামনে বোমা বিস্ফোরণ, এরশাদের বনানী অফিসের সামনে বোমা বিস্ফোরণ। এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য ধর্ম মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি পার্টির সাতবারের নির্বাচিত এমপি মজিবুর রহমান, সাবেক মন্ত্রী মোস্তফা জামাল হায়দার, প্রেসিডিয়াম সদস্য এস এম এম আলম, ফকির আশরাফ, এস এম আবদুল মান্নান এমপিসহ প্রথম সারির ৩৮ জন নেতা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেননি। তারা বিভিন্নভাবে পার্টির চেয়ারম্যানকে নির্বাচন থেকে সরে আসার চাপ দিচ্ছিলেন।
তিনি আগেই বলেছিলেন পরিবেশ না থাকলে নির্বাচন বয়কটও করতে পারেন। গতকালে সংবাদমাধ্যমকে বারবার এই কথাটিই জানিয়ে নিজের অবস্থানকে এরশাদ সংহত করার চেষ্টা করেন ।
সর্বশেষ তথ্যমতে অজ্ঞাত স্থান থেকে মুঠোফোনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একটি জাতীয় দৈনিককে জানিয়েছেন, তিনি তার সিদ্ধান্তে অনড়, এক চুলও নড়বেন না। বিকালের মধ্যে তিনি বাড়ি ফিরবেন। ফিরে তিনি ঢাকায় সফররত ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং-এর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হবেন। এরপর এক সংবাদ সম্মেলনে তার দলের মন্ত্রীদের পদত্যাগের নির্দেশ দেবেন।
নির্বাচনকালীন সরকারে থাকা জাতীয় পার্টির ছয় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে চারজন আজ বুধবার সকাল থেকে সচিবালয়ে তাঁদের দপ্তরে উপস্থিত হননি। তাঁরা হলেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী রওশন এরশাদ, পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রুহুল আমিন হাওলাদার এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সালমা ইসলাম।তবে বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মজিবুল হক আজ নিজ নিজ দপ্তরে যান।
বার বার সিদ্ধান্ত বদল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনেকে বলেন- আমি সিদ্ধান্ত বদলাই। কিন্তু তারা জানেন না কোন প্রেক্ষাপটে বা পটভূমিতে আমাকে এভাবে সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়। একদিকে মামলার ভয়, অন্যদিকে নানাভাবে হয়রানির কারণেই আমাকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এবার আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কেউ আমাকে টলাতে পারবে না। কারণ মানুষ এই সরকারের সঙ্গে নেই। নির্বাচনেও নেই। আমি আগেই বলেছিলাম, নির্বাচনের পরিবেশ থাকলেই আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবো। এখন দেখেছি পরিবেশ নেই। তাই নির্বাচনে যাচ্ছি না।
গতকাল দুপুরের পর থেকে এরশাদ কোথায় আছেন এ বিষয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়। দলের নেতারাও তার অবস্থান সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেননি। জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না- মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১২টায় এক সংবাদ সম্মেলনে এমন ঘোষণা দেন এরশাদ। বনানীতে তার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন শেষে সাবেক এই প্রেসিডেন্টের মোবাইলে একটি ফোন আসে। এরপর একটি কালো রংয়ের গাড়িতে করে দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করেন তিনি। এর পর থেকেই তার অবস্থান নিয়ে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়। এমন ধুম্রজালের মধ্যেই সকালে মোবাইল বার্তা ।
তবে এরশাদ নিজে ও দলগতভাবে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে চাইলেও ইসির আইনি ঝামেলায়েএই নাটক কোথায় গিয়ে থামে বা এরশাদের আসলেই আখেরি ইচ্ছা বা সিদ্ধান্ত কি তা জানতে বা বুঝতে হলে আরো কিছুটা দিন অপেক্ষা করতে হবে বৈকি ।
(এই লেখাটি ০৪ ডিসেম্বর ২০১৩, বুধবার, এওয়ান নিউজ২৪ডট কম এ প্রকাশিত )
বিষয়: বিবিধ
১১১৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন