ব্যর্থতা আড়ালের আখেরি কৌশল জঙ্গিবাদের প্রচারণা

লিখেছেন লিখেছেন সিকদারমোহাম্মদ ২১ অক্টোবর, ২০১৩, ১২:১৭:৪১ দুপুর



সিকদার মোহাম্মদঃ ৯০ পরবর্তি দ্বিতীয় দফার আওয়ামীলীগ সরকারের ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও লুটপাট আড়াল করার শেষ অস্ত্র হিসেবে দেশকে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার লেবাস পড়ানোর গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে বিশ্লেষক মহল মনে করছেন ।

সাম্প্রতি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়াতুল উলুম আল ইসলামীয়া মাদরাসায় ঘটে যাওয়া একটি দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকার যে ভুমিকা নিয়েছে এবং মিডিয়াতে যে খবর পরিবেশিত হয়েছে তার সাথে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের দাবি বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে । সরকার একে জঙ্গি তৎপরতা বলেই প্রমান করার চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় তো এক ধাপ অগ্রসর হয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন ।

তিনি লিখেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে জঙ্গি তৎপরতা বাড়ে, আর আওয়ামী লীগ থাকলে জঙ্গি নির্মূল হয়। জয় আরো লিখেছেন, জঙ্গি দলগুলো বিএনপি-জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আসছে। অন্যদিকে আগামি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলে তারা দেশে নির্বিচারে বোমা হামলা চালিয়ে প্রাণহানি ঘটাবে।

প্রধানমন্ত্রীপুত্র তাঁর ফেইসবুকে আরও উল্লেখ করেছেন, গত কয়েক মাসে দেশে সন্ত্রাসী তত্পরতা বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ের দু’টি ঘটনার উদাহরণ দিয়েছেন তিনি।

এরমধ্যে চট্টগ্রামে মুফতি ইজাহারুলের মাদ্রাসায় বিস্ফোরণ, বোমা ও অ্যাসিড উদ্ধার। এ ছাড়া গাজীপুরে বিপুল অস্ত্র ও বোমাসহ নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হুজির কয়েকজন নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার।

আওয়ামী লীগ সরকারের জঙ্গিবাদবিরোধী শক্ত অবস্থানের কারণেই এ ধরনের অপতত্পরতা নস্যাৎ করা সম্ভব হয়েছে দাবি করে তিনি লিখেছেন, এই জঙ্গি দলগুলো বিএনপি-জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আসছে এবং বিএনপির গত শাসনামলেও একের পর এক জঙ্গি হামলা হয়েছে দেশে।

তারা আদালতে বোমা হামলা চালিয়েছে, ময়মনসিংহে সিনেমা হলে বোমা হামলা চালিয়েছে, আমার মায়ের ওপর গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে, দেশব্যাপী ৫০০ স্থানে একই সঙ্গে সিরিজ বোমা হামলা চালিয়েছে এবং এই তালিকা চলমান।

জয় দাবি করেন, ‘আপনি ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আমাদের সরকারের সমালোচনা করতে পারেন, কিন্তু জঙ্গিবাদ নির্মূল ও জাতীয় নিরাপত্তা বিধানে আওয়ামী লীগই একমাত্র ভরসাস্থল। আপনি যদি বিএনপিকে ভোট দেন, তাহলে আপনি যেমন রাস্তাঘাটে নিরাপদ নন, তেমনি আপনার সন্তানেরাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপদ নয়। তারা নির্বিচারে বোমা হামলা চালাবে, যা সবার প্রাণহানি ঘটাতে পারে। একমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারই আপনাকে এই পাঁচ বছর নিরাপদ রেখেছে।’

তবে মাদরাসার ঘটনা নিয়ে রাজনীতিও কম হচ্ছেনা, হেফাজত নেতারা পাল্টা অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী পুত্রের কিছুদিন আগে দেয়া মাদ্রাসার ছাত্র কমিয়ে আনার বক্তব্যে প্রতি ইঙ্গিত করে একে মাদরাসা বন্ধের পরিকলাপনা বাস্তবায়নের অংশ বলেই বর্ণনা করেন ।

আর মাদরাসা কর্তৃপক্ষের কথা হলো,মাদরাসার সম্পত্তি গ্রাসে লোভী একটি মহল ও স্থানীয় যুবলীগ নেতা চিহ্নিত সন্ত্রাসী দিদারুল আলম মাসুম প্রশাসনের সহযোগিতায় গ্রেনেড পাওয়া গেছে বলে প্রচার করে। সেখানে দেশের সকল মিডিয়া প্রতিনিধিবর্গ প্রস্থানের পর বিকেলের দিকে গ্রেনেড নাটক সাজিয়ে মাদরাসার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে বলে মাদ্রাসার তরফ থেকে অভিযোগ করা হয়। উক্ত সন্ত্রাসী মাসুমই গ্রেনেড সরবরাহ করে পুলিশকে দিয়ে মামলা সাজানোর প্রচেষ্টা চালায়। গ্রেনেডের খবর প্রচারিত হওয়ার পর এলাকায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের আনন্দ উল্লাসও করেছে বলে মাদ্রাসার কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায় ।

নিছক দূর্ঘটনাকে জঙ্গি তৎপরতা বরে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা হলেও মূলত ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে উদীচি ও রমনা বটমূলে হামলার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের জন্ম দেওয়া হয় এবং বিগত ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে তার মূলোৎপাটন করা হয়। অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার জাতিসংঘের ভাষণে বিগত ২০০১ সালে ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে দেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের বিষয়ে যে বক্তব্য প্রদান করেন তা নিয়ে বিস্তর মতভেদের অবকাশ রয়েছে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।

ধর্মীয় সম্প্রীতিবিরোধী তৎপরতা ও জঙ্গিবাদ নিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রচারণা

সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে এসে বাংলাদেশে হঠাৎ করেই কথিত ধর্মীয় জঙ্গিবাদের তৎপরতা বৃদ্ধির প্রচারণা শুরু হয়েছে। এখানে ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা চালানোর অভিযোগ উঠেছে। এই প্রচারণার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের অন্যতম রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামীর প্রতি অভিযোগের তীর ছোড়া হচ্ছে। বিশ্ব রাজনীতিতে ইসলামি শক্তির নতুন উত্থান এবং মুসলিম দেশগুলোতে গড়ে ওঠা জাগরণ বিশ্বের প্রভাবশালী ও শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোকে শঙ্কিত করে তুলেছে কয়েক বছর ধরে। পরাশক্তিগুলো এ কারণে দীর্ঘ দিনের মিত্রদেরও এখন সন্দেহের তালিকায় ফেলেছে। অনেকের কাছ থেকে তারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশ এসবের মধ্যে যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রেখেছিল বর্তমান সরকার সেখান থেকে সরে এসেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা সরকারের এই সরে আসা এবং উদার সামাজিক অবস্থানকে উগ্রতার আবরণে ঢেকে ফেলার চেষ্টাকে আত্মঘাতী বলে উল্লেখ করেছেন। তারা বলেছেন, সরকার নিছক রাজনৈতিক স্বার্থেই বাংলাদেশের ইমেজ ও স্বচ্ছ অবস্থানকে কলুষিত করার চেষ্টা করছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের বেশির মানুষ ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান হলেও এখানে সব সময়ই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজমান। সব ধরনের মানুষই এখানে তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করে। রাষ্ট্রীয় আইন ও সংবিধান সব নাগরিকের সমানাধিকার নিশ্চিত করেছে। জনগণও শান্তি সম্প্রীতি বরাবরই বজায় রেখে চলেছে। এ নিয়ে কখনোই প্রশ্ন ওঠেনি। এমনকি প্রতিবেশী দেশের কোনো সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাত বাংলাদেশে প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু সম্প্রতি এ অবস্থাকে ভিন্ন দিকে নেয়ার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

কিন্তু কেন এই চেষ্টা? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এর কারণ স্পষ্ট। বর্তমান বাংলাদেশে যারা ক্ষমতাসীন তারা একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় এসেছে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পেছনে তারা বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থানের কথা প্রচার করে তা কাজে লাগিয়েছিল। কথিত উগ্র মৌলবাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে তারা প্রচারণা চালিয়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোকে কোণঠাসা করতে সক্ষম হয়। তা ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাবকের ভূমিকা পালনকারী প্রতিবেশী রাষ্ট্রটিও বরাবরই এখানে ইসলামি শক্তির উত্থান এবং তাদের শক্তি সঞ্চয়ে সতর্ক ছিল। বিগত সরকারের শেষ দিককার দুর্বল অবস্থানের তারা বাংলাদেশে মিত্রশক্তিকে কাজে লাগায়। আগামী নির্বাচনের আগে একই কৌশল নিয়ে তারা অগ্রসর হচ্ছে। এই কৌশলের অংশ হিসেবে বিদেশীদের সামনে বাংলাদেশকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। নতুন এই কৌশলে জঙ্গিবাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা হিসেবে বিরোধী দলকে চিহ্নিত করে প্রচারণা জোরদার করা হবে।

এ ব্যাপারে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, বাংলাদেশ এমন এক দেশ যেখানে সাম্প্রদায়িকতার যেমন কোনো সুযোগ নেই, তেমনি কোনো জঙ্গিবাদেরও জায়গা নেই। এটি এমন একটি দেশ যেখানে ধর্মীয় চিন্তাভাবনা এমন যে এখানে জঙ্গিবাদের উত্থান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এখানে সবচেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রয়েছে। তিনি বলেন, এটি যেটুকু উত্থানের চেষ্টা হয়েছিল, তা বিএনপি ক্ষমতার সময় কঠোর হস্তে নির্মূল করা হয়েছে। তিনি বলেন, পশ্চিমা সভ্যতা জঙ্গিবাদকে ভয় পায়। তাই সরকার তাদের কাছে যেতে এবং তাদের আরো বেশি আপন হওয়ার জন্যই বিদেশে ও জাতিসঙ্ঘে গিয়ে জঙ্গিবাদের কথা বলছে। জাতিসঙ্ঘে গিয়ে কোনো দেশের সরকারপ্রধান তার বিপরীত কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের খারাপ কথা বলেছে বলে আমার জানা নেই।

ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক ড. পিয়াস করিমের মতে, দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনা করা কুরুচিপূর্ণ মনোভাবের পরিচয়। এটি করে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করা হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ হলো আন্তর্জাতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার জায়গা। সেখানে নিজ দেশের বিরোধী দলের বিষোদগার করার জায়গা না। বিশ্বব্যাংকের সাথে বিরোধসহ সরকার যেসব ঘটনা ঘটিয়েছে একের পর এক তাতে দেশের ভাবমর্যাদা বাইরের বিশ্বে নষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশে যেখানে সরকার সাধারণ মানুষের বিদ্যুৎ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতা, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে পারছে না, সেখানে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতেই সরকার এটি করছে।

তিনি বলেন, এ মুহূর্তে জঙ্গিবাদ বাংলাদেশের রাজনীতির সমস্যা নয়। জঙ্গিবাদ পাশের দেশ ভারতেও আছে। কিন্তু আমাদের দেশের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতেই সরকার নতুন করে জঙ্গিবাদের কথা বলছে। তিনি বলেন, সরকার পাশ্চাত্য দেশগুলোর কাছে যাওয়ার জন্য এবং ভারতের আনুগত্য স্বীকার করার জন্যই এ কথা বলছে। সরকার নিজেই বহির্বিশ্বের কাছে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করছে।

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপিকা দিলারা চৌধুরী বর্তমান অবস্থার ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী আগামী নির্বাচনের প্রচারণা শুরু করেছেন। মাসখানেক ধরে তিনি জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এসব কথা বলছেন। তিনি পাশ্চাত্য দেশগুলোর কাছে যেতে চাচ্ছেন। তাদের বোঝাচ্ছেন, আমি পুরোপুরি জঙ্গি নির্মূল করতে পারিনি। তাই আমাকে আবারো সুযোগ দাও। তিনি বলেন, নিজের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী দেশের ভাবমর্যাদা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষুণ্ন করছেন। তিনি বলেন, আমার কাছে যতটুকু তথ্য আছে, সে অনুযায়ী বড় আকারের কোনো জঙ্গি তৎপরতা দেশে দেখছি না। তবে মাঝে মধ্যে দু-একটা জঙ্গিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করছে বলে টিভিতে দেখছি। এটি সব দেশেই কম-বেশি আছে।

বিষয়: রাজনীতি

১২৪৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File