গরুময় ঢাকা; কারো পৌষমাস কারো সর্বনাশ
লিখেছেন লিখেছেন সিকদারমোহাম্মদ ২০ অক্টোবর, ২০১৩, ১০:৫৭:২৯ সকাল
সিকদার মোহাম্মদঃ
১.গতকাল এক বন্ধুকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করলাম তার অফিসে খোলা কিনা, উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে জানাল 'ঢাকায় কি এখন কোন মানুষ আছে?' ঢাকায় এখন গরু আর গরু' -কথাটা মজার হলেও এর বাস্তবতাটা হল এ বছর ঢাকা শহরে রেকর্ড পরিমান গরু দেশের বিভিন্ন জেলা এবং ভারত থেকে এসেছে । ঢাকার কোরবানীর পশুর হাটগুলো এখন গরুময় । গাবতলী, আফতাবনগর, খিলগাঁও রেলওয়ে কলোনী মাঠ, মেরাদিয়া গরুর হাটে গিয়ে দেখা যায়, পুরো হাট গরু-ছাগলে পরিপূর্ণ। একে একে ট্রাক আসছে। গরু নামানো হচ্ছে। একই দৃশ্য ঢাকার অন্যান্য পশুরু হাটেও। তবে আফতাব নগরে আজ সকালে দেখা গেল আরো একটু ভিন্ন চিত্র । চিত্রটা ছিল এরকম -একতো গরুতে হাট সয়লাব, অন্যদিকে আফতাবনগরে প্রবেশের মূল ফটক থেকে ভেতরে লোহার ব্রীজ পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার জুড়ে গরু বোঝাই বিশাল বিশাল ট্রাকের লাইন । কখন নাগাদ তা অফলোড হবে ধারণা করা যাচ্ছিলনা । ব্যবসায়ীরা জানান, কোরবানি সামনে রেখে এবার প্রচুর গরু আমদানি হয়েছে। গত বছরের মতো এ বছরও গরুর দাম কম হতে পারে বলে আভাস দিলেন বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ব্যাপারীরা । তারা জানান, শেষের দিকে গরুর দাম কম হতে পারে। গাবতলীর স্থায়ী হাট বাদে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে এবার মোট হাট বসেছে ১৯টি। বেশির ভাগ হাটের ইজারা পেয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা। দরপত্র অনুযায়ী রোববার থেকে তিন দিন ও ঈদের দিন মিলিয়ে মোট চার দিন রাজধানীর অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাট বসার কথা। কিন্তু গত কয়েক দিন হাটে প্রচুর গরু আসতে শুরু করেছে, ধারণা করা যায় মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত এই আসা অব্যাহত থাকবে।
২. ঢাকার আফতাব নগর হাটে নাটোর থেকে নিয়ে আসা এক প্রান্তিক গরু চাষী জানান, এবার অনেক গরু ব্যবসায়ীকে 'হাটফেল' করতে হবে । কারণ হিসেবে তাদের খরচের টাকা না উঠে আসার আশংকা প্রকাশ করেন । তিনি একই হাটে গত বছরও গরু বিক্রি করতে নিয়ে আসার অভিজ্ঞতা বর্ননা করে বলেন, ফির বছর তিনি কোন মতে চালান বাঁচিয়ে বাড়ি ফিরতে পেছেলেন এবার হয়ত তা সম্ভব হবেনা বলে দীর্ঘ নিঃস্বাস ছেড়েছেন ।
৩.আজ ভোর ৬ টার দিকে আফতাবনগরের হাট পরিদর্শনে দেখা গেল জামালপুর থেকে আসা এক ব্যাপারী ১০টি গরু নিয়ে এসেছেন কিন্তু রাতের আধাঁরে তার দুটি গরু চুরি হবার বর্ণনা করছেন আর তার সারথিরা গরু আগলে রাখার ব্যর্থতার জন্য তার নিজ অযোগ্যতাকে দোষারোপ করছেন। ব্যাপারী তার দশটি গরুতে সম্ভাব্য ক্ষতির সাথে হারানো গরু দু'টির চালান সমেত লোকসানের বিষয় দুঃখকরে কেবলই তার দুটো গরুর মধ্যে শেষে লাল গরুটা চুরি হবার কথা বলেই যাচ্ছিলেন । আর হাটের সব ব্যাপারী আর প্রান্তিক কৃষকরা বলা বলি করছিল সারা রাত জেগে তাদের নিজ নিজ গরু পাহাড়াদেবার কথা ।
৪. গতকাল দুপুরের পর ঢাকাতে এক পসরা বৃষ্টি হয়েছিল । এতে হাটের পরিবেশ কর্দমাক্ত হয়ে উঠে অনেক পশুর গায়ে কাঁদা মাটি একাকার হয়ে আছে যা পরিস্কার করার জন্য পানির জন্য গরু বিক্রেতাদের পানি সংগ্রেহের জন্য দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে দেখা যায় ।
৫.এবার হাট গুলোতে সরকার দলীয় লোকজনদের ইজারা দেবার বিষয় আগেই মিডিয়াতে এসেছে, তবে এর সাথে যুক্ত হয়েছে- যাদের হাট ইজারা দেয়া হয়েছে তারা যথাযথ ব্যবস্থাপনায় সক্ষম নন । তার বাস্তবতা আফতারবনগরের হাটে দৃশ্যমান হলো, এখানে খাবার বা বিশ্রামের জন্য ক্রেতা বা বিক্রেতার কোন ব্যবস্থা তারা করেনি ।নেই কোন টয়লেটের ব্যবস্থা এমনকি গরু বাধার জন্য পর্যাপ্ত বাস পর্যন্ত পুতেনি । আর রাত্রিতে আলোর ব্যবস্থা এতটাই অপর্যাপ্ত যে, এর সুযোগেই হাটে গরু চুরির মতো ঘটনা সংগঠিত হচ্ছে । আর এই রিপোর্টে যে স্পটে গরু চুরির কথা বিবৃত হয়েছে সেখানে লাইটের ব্যবস্থা থাকলে হয়ত ব্যাপারীরা নিজেরাই চুরি রোধ করতে পারতো। তবে ইজারাদারের লোকজন কেবল হাসিল উসুলের কাউন্টারে বসে হাসিল গ্রহণের অপেক্ষায় প্রহর পার করছিল । অন্য সব বিষয় ব্যবস্থাপনার চরম ঘাটতি থাকলেও এক্ষেত্রে ব্যাপক প্রস্তুতি লক্ষ্য করা গেছে ।
৬.পাড়া-মহল্লায় সবস্থানে এখন রাজনৈতিক আলোচনাকে ছাপিয়ে সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্ন্দুতে পরিণত হয়েছে কোরবানী পশুর দরদাম । হাটে পশুর আমদানী ও দরদামে পৌষমাস বোধ করছেন ত্রেতা পক্ষ আর সর্বনাশে আশংকায় সংকিত বিক্রেতারা । বিক্রেতার বুঝেই উঠতে পারছেননা হাটে এত পশুর আমদানী কোথা থেকে হল । তবে খোঁজ খবর রাখেন এমন বিক্রেতাদের অভিযোগ সরকার সীমান্ত পথে গরু আসতে দেবার ফলে এত আমদানী আর এতেই দাম পড়ে গিয়েছে । তবে এটাও অনেকে বলেছে দেশের মধ্যেই এই বিষয় লাভজনক দেখে অনেকেই পশুপালনের কাজে এগিয়ে আসাতে দেশের অভ্যন্তর থেকেই পশুর যোগান বেড়ে গেছে ।
পশুর দামের বিষয় অবশ্য অনেক ক্রেতাসাধারণের বিশ্লেষণ হল, বিগত ২০১১ সালে ঢাকার কোরবাণী পশুরহাটে পশুর দাম অস্বভাবিকভাবে চড়া হয়ে গিয়েছিল । সে বছর এক কেজি গরুর মাংসের দাম হাজার টাকা করে পরতা পরেগিয়েছি । ব্যাপারী ও গরু চাষীরা ব্যাপক মুনাফা করেছিল । তাদের প্রত্যাশা এখন সহজে সেখান থেকে নামছেনা । যার কারণে বিক্রেতাদের দাম নিয়ে হতাশা । অন্যদিকে যদিও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কোরবাণীর পশুর দাম বেশীই থাকে । এর কারণ হলো এ সময় যারা ক্রেতার ভুমিকায় থাকেন তারা পেশাদার কষাইদের মতো অভিজ্ঞ নন । চোখের দেখায় বা পছন্দের উপর নির্ভর করে বেশি দাম দিয়েই পশু কিনে থাকেন । আর বিক্রেতার যতটা সম্ভব দাম হাতিয়ে নেবার চেষ্টা করেন । এক্ষেত্রে সরবরাহ বেশি থাকলে ক্রেতারা শক্ত অবস্থানে থাকেন আর সরবরাহ কম হলে বিক্রেতারা ক্রেতাদের পেয়ে বসেন । তবে গতবারের ন্যায় এবার সরবরাহ ভাল থাকায় ক্রেতাদের অবস্থান শক্ত । তবে বেচাবিক্রি শুরু হয়নি এখনো। আজ না হলেও কাল বেচা বিক্রি জমার অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে গ্রাম থেকে আসা এক একটি ক্লান্ত, শ্রমশিক্ত মানুষ। আর তার পরেই পরিস্কার হবে আসলে কার পৌষ মাস গেল আর কার সর্বনাশ হল ।
বিষয়: বিবিধ
১৫৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন