রাজনৈতিক উত্তাপে মানুষের ঈদ-উৎসব কাটছে বিষাদে
লিখেছেন লিখেছেন সিকদারমোহাম্মদ ১৯ অক্টোবর, ২০১৩, ০৪:২৮:৩৬ বিকাল
সিকদার মোহাম্মদঃ
সারা বছর দেশের মানুষ সারা বছর কতটা স্বস্তিতে থাকে সে প্রশ্নের কোন স্থায়ী উত্তর না মিললেও অন্তত ঈদ উৎসবে জনগণের শান্তি-স্বস্তির প্রত্যাশা কোন বিলাসিতা নয়। আর এই শান্তি-স্বস্তি বিধান করার দায়িত্ব দেশের সরকারের । অথচ সরকার যখন এই শান্তি বিধানের চাইতে হরণেরই অন্যতম অনুসঙ্গ হন তখন মানুষের আনন্দও বিষাদে পরিনত হয়। বিগত সময়গুলোর ন্যায় রাজনৈতিক উত্তাপে মানুষের এই ঈদ-উৎসবও কাটছে বিষাদে ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বর্তমানে চলছে টানটান উত্তেজনা। আগামী ২৪ বা ২৫ অক্টোবরকে সামনে রেখে বিরোধীদলগুলো একরকম প্রস্তুতি নিচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে নানা কর্মসূচি ও পরিকল্পনার কথা। একবার শোনা যাচ্ছে, ২৪ অক্টোবর পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া হবে এবং এরপর তিন মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আবার বলা হচ্ছে, পার্লামেন্ট ভাঙা হচ্ছে না; এটি বহাল থাকবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত এবং সরকার ক্ষমতায় থাকবে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়া পর্যন্ত।ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২৪ অক্টোবর ডেডলাইন ধরে ঠিক পরের দিন ২৫ অক্টোবর রাজধানীতে সমাবেশ ডেকেছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও একই দিন সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের (ডিএমপি) বরাবর আবেদন জমা দিয়েছে।বরাবরের ন্যায় ডিএমপির তরফ থেকে এখনও সমাবেশের অনুমতি প্রধান বিরোধীদলকে দেয়া না হলেও ২৫ অক্টেবরের কর্মসূচী ঠেকাতে ধরপাকর করা হচ্ছে । সংবাদ সম্মেলন থেকে আগামী ২৫ অক্টোবরের জন্য দা, বটি, কুড়াল নিয়ে নেতাকর্মীদের প্রস্তুতির নির্দেশের পর বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান ও ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকাকে খুঁজছে পুলিশ। রাতে খোকা গুলশানের বাসায় সাদা পোশাকে পুলিশ ‘হানা’ দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি।
অন্যদিকে প্রধান বিরোধীদলের বর্ধিত সভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেছেন,ইতোমধ্যে কোয়াটার ও সেমি-ফাইনাল শেষ হয়ে গেছে ‘আগামী ২৫ তারিখ খেলা ফাইনাল।’ এ সময় তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ‘ওই ফাইনালের জন্য দলের নেতা কর্মিদের প্রস্তুতি নিতে আহ্বান জানান এবং যে কোনো উপায়ে ফাইনালে জেতার প্রস্তুতি নেবার কথা বলেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আরো বলেন, ‘কোয়াটার ও সেমিফাইনাল শেষ। ফাইনাল রাউন্ড খেলার বাকি মাত্র সাত দিন। এর মধ্যেই সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে হবে। এর বিকল্প নেই। এই খেলায় আমাদের জিততেই হবে। অন্যথায় টিকে থাকা যাবে না। ব্যর্থ হলে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।’
গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে শেখ হাসিনা ক্ষমতাকে দীর্ঘয়িত করার জন্য নতুন ভাবে সংবিধান ব্যাখ্যা করে বক্তব্য প্রদান করে জনমনে অসস্তির পরিমানকে দ্বিগুন করেছেন ।
তিনি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা পর্যন্ত সংসদ অধিবেশন চালিয়ে যাওয়ার তথা ক্ষমতা আকড়ে ধরে রাখার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী অধিবেশন চালানোয় কোনো বাধা নেই।’ ‘আগামী ২৪ অক্টোবরের পর সংসদ চলতে পারবে না, এটা সংবিধানের কোথাও লেখা নেই। শুধু ৬০ দিনের বাধ্যবাধকতা শিথিল করা হয়েছে।’ ‘পার্লামেন্ট বসতে পারে শিডিউল (নির্বাচনের তফসিল) ঘোষণার আগের দিন পর্যন্ত। আর সংসদে ভেঙে দিলেও রাষ্ট্রপতি চাইলে অধিবেশন ডাকতে পারেন’ যোগ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
তিনি যে কেবল ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সংবিধান নিজেরমত করে ব্যাখ্যা করছেন তাই নয়, এর জন্য প্রয়োজনে যে কোন ধরনে ব্যবস্থা গ্রহণে পিছু হটবেননা বলে বিরোধীদলের প্রতি হুঁশিয়ারি জানিয়ে দিয়েছেন ।যদিও জনগণকে রক্ষায় যা করার তাই করবে, অতীতেও যা করেছেন’ বলে তিনি প্রকারান্তে আরেকটি ২৮ অক্টোবর তথা লগি বৈঠার তান্ডব চালাবেন কিনা সে বিষয় জনমতে প্রচন্ডভীতি বিরাজ করছে।
বিরোধী দল গত তিন মেয়াদ ধরে চলে আসা পদ্ধতিতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে না হলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছেন। বিপরীতে, ক্ষমতায় এসে ওই পদ্ধতি বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে সরকার নির্বাচন প্রতিহতের চেষ্টা হলে ‘ব্যবস্থা’ নেয়ারও হুমকি দিচ্ছে।বিরোধী পক্ষের দাবি, সরকারী দলের ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার ইচ্ছার কারণে এ সংঘাতময় পরিস্থিতর সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর উচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেশকে সংঘাতের হাত থেকে রক্ষা করা।সে হিসেবে তারা এটাও মনে করেন ২৪ অক্টোবরের পর আওয়ামীলীগ সরকারের কোন নৈতিকভিত্তিই থাকবেনা সরকার পরিচালনার । ফলে জনগনই এখন সিদ্ধন্ত নিবে কিভাবে তাদের বিদায় করা হবে ।
এছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠানের ৯০ দিনের মেয়াদ সামনে রেখে ২৪ অক্টোবরের মধ্যে নবম জাতীয় সংসদের চলতি ১৯তম অধিবেশনের সম্পন্ন করার মধ্যদিয়ে এই সংসদের ইতি টানার ঘোষণা দিয়েছিলেন স্পিকার। তবে সরকারি দলের পক্ষ থেকে অধিবেশন চালিয়ে যাওয়ার জোর দাবি তোলা হয়।
শেখ হাসিনা দলের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, "২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। ৬ জানুয়ারি তিনি শপথ পড়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। ২৫ জানুয়ারি সংসদের অধিবেশন শুরু হয়েছে। এর ৯০ দিন পূর্বের সময় ২৫ অক্টোবর। সুতরাং ২৪ অক্টোবরের পর ক্ষমতায় থাকা অসাংবিধানিক নয়।" তবে বিশ্লেষেকদের মতামত হচ্ছে সরকার তার ক্ষমতাকে বাড়িয়ে নেয়ার জন্য নিজেদের ইচ্ছেমত হঠাৎকরে সংবিধানের ব্যাখ্যা করছেন ।তবে তাদের এ ব্যাখ্যা কতটা আইনসিদ্ধ এবং ক্ষমতা আকড়ে রাখার প্রচেষ্টা দেশে এবং দেশের বাইরে গ্রহণযোগ্য হবে তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে এ প্রসঙ্গে রেডিও তেহরানের সাথে এক কথা বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি ও খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা বলেন, পার্লামেন্ট থাকবে না অথচ সরকার থাকবে- ইত্যাদি ধরনের কতগুলো বিষয় আছে যা আইনসম্মত বলে আমার মনে হয় না। প্রধানমন্ত্রী সব সময় দাবি করছেন যে, এর মধ্য আইনগত কোনো গোলমাল নেই। কিন্তু এ রকম তো আমরা আগে দেখিনি।
সরকার কি চাচ্ছে কি তাদের উদ্দেশ্য তা নিয়ে জনমনে রয়েছে নানা প্রশ্ন এ প্রসঙ্গে বলেন, আমার মনে হয় যে, তারা আইন-কানুনের খুব কমই তোয়াক্কা করছে, বরং কোন রকমে নির্বাচন করে নিজেরা ক্ষমতায় আসতে পারে। তবে জনগণ কিভাবে নেবে, কতটা অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে- এ নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। যদিও তারা বলছে অসুবিধা নেই। অসুবিধা নেই কেন? আবার তারা এমন কথাও বলছে, পৃথিবীর অন্য জায়গাতে যেভাবে হয় সেভাবে নির্বাচন হবে।
কোরবানির ঈদের পর একদফা আন্দোলন দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো হবে বলে বিরোধী শিবির থেকে বলা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, আগামী ২৫ অক্টোবরের সমাবেশে কোন রকম আক্রমণ করা হলে পাল্টা আক্রমণ চালানো হবে ।
রাজধানীর ঢাকা মহানগর বিএনপির যৌথ সভায় তিনি জানিয়েছেন, "২৫ তারিখের জনসভায় আমরা কোন প্রকার আক্রমণের শিকার হলে কিংবা বিগত সময়ের মতো লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যার চেষ্টা হলে প্রয়োজনে দলের নেতাকর্মীরা দা, কুড়াল, বল্লম, সরকি, টেটা নিয়ে সারা দেশে পাল্টা আক্রমণ করবে।"তিনি জানান, "আমরা আগে হাতে অস্ত্র তুলে নেব না। আক্রমণ হলে যে কোনভাবে মোকাবিলা করা হবে। কোন ছাড় দেয়া হবে না। দরকার হলে কোরবানি হয়ে যাব, তবুও আন্দোলন সফল করব।" রাজধানীতে ভিন্ন এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেছেন, নির্বাচন পর্যন্ত সংসদ বহাল রাখার কথা বলে প্রধানমন্ত্রী দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। এ দেশে তত্ত্বাবধায়কের জন্য যদি রক্তপাত হয়, এর দায় দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হবে।
অন্যদিকে, আওয়ামীলীগ সরকারের আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সতর্ক করে বলেছেন, বিরোধী দল যদি ২৫ অক্টোবর কোনো ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করে তাহলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করবে। আর আওয়ামী লীগ রাজপথে থেকে জনগণকে নিয়ে বিরোধীদলকে মোকাবেলা করবে।
এরকম একটি অস্থির অবস্থায় রাজনীতির ভবিষ্যত কী হতে পারে তা নিয়ে উসৎসবের আনন্দের মাঝে দেশের মানুষের দিনগুলো কাটছে বিষাদে । রাজনীতিতে চলমান অস্থিরতার ফলে দেশের মধ্যে যে সংকট আওয়ামীলীগ সৃষ্টি করেছে তার শেষ কোথায় তা জানা নেই কারোরই ।
বিষয়: রাজনীতি
১১০৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন