কি ঘটবে সিরিয়ার ভাগ্যে ? যদিও সব ঘটনারই গল্প এক

লিখেছেন লিখেছেন সিকদারমোহাম্মদ ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৮:৫৫:০৩ সকাল



সিকদার মোহাম্মদঃ

সিরিয়ায় মার্কিন হামলার সম্ভাব্যতা নিয়ে দেশী বিদেশী গণমাধ্যমে নানা রকম খবর পরিবেশিত হচ্ছে । ফলে সবার মাঝে একদিকে যেমন আতঙ্ক বিরাজ করছে, অন্যদিকে অজানা আশংকা ভর করছে বিশ্বময়, আমেরিকা ও তার মিত্ররা আসলেই কি সিরিয়ায় হামলা চালাবে?

সিরিয়া সরকারের পক্ষ থেকে রাসায়নিক হামলার অজুহাতে দেশটির ওপর আগ্রাসন চালানোর জন্য ব্যাপক তোড়জোড় দেখাচ্ছে আমেরিকা, ফ্রান্স ও ব্রিটেন। কিন্তু ইতালি ও জার্মানি এ হামলার বিরোধিতা করে বলেছে, জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়া সিরিয়ায় কোনো হামলা করা যাবে না।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সরকার এ অভিযোগ কঠোর ভাষায় প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, দেশটিতে হামলা চালানোর অজুহাত দাঁড় করানোর জন্য এ অভিযোগ তোলা হচ্ছে।

তবে বুধবারের দিনটি ছিল ঘটনা বহুল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন,আরবলীগ ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক পরিস্থিতিকে পাল্টে দেয় ।

ব্রিটেনের আহ্বানে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য দেশের প্রতিনিধিরা নিউইয়র্কে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন । সিরিয়ায় হামলার বিষয়টিকে ভোটাভুটিতে দেয়ার আগে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে রাশিয়াকে রাজী করানো ছিল ব্রিটেনের রুদ্ধদ্বার বৈঠক ডাকার মূল উদ্দেশ্য । কিন্তু বৈঠক শুরুর পরপরই তীব্র মতানৈক্যের কারণে রাশিয়া ও চীনের প্রতিনিধিরা ওয়াকআউট করেন।

এর আগে এক দশকের মধ্যে এই প্রথম ভূমধ্যসাগরে রাশিয়া তার মিত্রকে রক্ষা করতে যুদ্ধ-জাহাজ মোতায়েন করে । ভূমধ্যসাগরে মোতায়েন রাশিয়ার প্রায় ১৬টি যুদ্ধ-জাহাজ সিরিয়ায় সম্ভাব্য মার্কিন হামলার পথে প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ।

বুধবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টেরও এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি ইলমার ব্রোক বলেছেন, সিরিয়ার সরকার যে ওই রাসায়নিক অস্ত্র পরীক্ষা চালিয়েছে মার্কিন সরকারকে তার প্রমাণ দিতে হবে। তিনি ইউরোপকে এ প্রমাণ দেখানোর জন্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

ব্রোক বলেন, যদি সিরিয়ায় একতরফাভাবে আমেরিকা হামলা করেও বসে তারপরও আমরা মনে করি, কূটনৈতিক উপায়ে সিরিয়া সংকটের সমাধান করা উচিত।

ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বলেছে, সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের কাছে রাসায়নিক হামলার জন্য যে দেশটির সরকার দায়ী তার প্রমাণ বের করতে হবে।

মার্কিন মিত্রদের তরফ থেকে এই ঘোষণার পর দৃশ্যতঃ মনে হচ্ছে,ওবমা যে সিদ্ধন্তে ইসরাইল ও যুক্তরাজ্যকে নিয়ে সিরিয়া আক্রমনে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন তাতে কিছুটা ভাটা পরে, মূলত ইরান অনেক পূর্ব থেকেই ইউরোপের ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত; শুরু থেকেই ইরান ও রাশিয়া সিরিয়া পক্ষে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে সামস্যা সমাধানের কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখে । আর এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সিরিয়া হামলার বিপরীতে দাড় করানোর ক্ষেত্রে ইরান অনেক কার্যকর ভূমিকা রেখেছে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন ।

সিরিয়া বিষয়ে আরব লীগ ও জাতিসংঘের বিশেষ দূত আখজার ব্রাহিমি বলেছেন, সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমতি নেয়া জরুরি। তিনি বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কেবল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর সামরিক হস্তক্ষেপ করা যেতে পারে।

জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনও বুধবার বলেছেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে এবং এ পরিষদের উচিত তার দায়িত্ব পালন করা।

এদিকে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের দাবি সম্পর্কে জাতিসংঘের তদন্ত শেষ না হওয়ার আগেই এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেখানো ঠিক নয়।

বুধবারই বিবিসি টেলিভিশন এক আকস্মিক সংবাদে জানা যায়, মার্কিন সরকার সিরিয়ার ওপর একতরফা হামলার পরিকল্পনা বাতিল করেছে এবং হোয়াইট হাউজ এ ব্যাপারে মিত্র সরকারগুলোর সঙ্গে আলোচনা ও শলা-পরামর্শ চালিয়ে যাচ্ছে।

সুর পাল্টিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র যুক্তরাজ্য জানায়, তারা সিরিয়ার রাসায়নিক হামলার ব্যাপারে জাতিসংঘের পরিদর্শকদের রিপোর্ট দেখতে চান।

তবে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার অবস্থান সংহত রাখার জন্য বলেছেন, সিরিয়ার সরকারই যে গত সপ্তাহে দামেস্কে রাসায়নিক হামলা চালিয়েছে সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। তবে এখনো হামলার ব্যাপারে তিনি সিদ্ধান্ত নেননি।

অন্যদিকে অনেক সংবাদমাধ্যম যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে অভ্যন্তরীণ প্রবল বিরোধিতাকে সিরিয়ায় হামলা থেকে পিছু হটেছে মন্তব্য করা হয়েছে ।

অভ্যন্তরীণ চাপের বিষয় ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল প্রকাশ করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের স্পিকার জন বোহেনার ওবামার কাছে একটি খোলা চিঠিতে সিরিয়ায় হামলা নিয়ে আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে সংলাপ না করার জন্য তার সমালোচনা করেছেন।

এছাড়াও পৃথক একটি চিঠিতে হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভের ৯৮ জন রিপাবলিকান এবং ১৮ জন ডেমোক্র্যাট আইনপ্রণেতা কংগ্রেসের সমর্থন ছাড়া সিরিয়ার সামরিক হামলা না চালাতে ওবামার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

ডেইলি মেইল তরফে জানা যায়, যুক্তরাজ্যেও সিরিয়ায় হামলার বিরুদ্ধে তীব্র মত বিরোধ দেখা দিয়েছে। বিরোধীদলীয় নেতা এড মিলিব্যান্ড হামলায় সমর্থন দেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। এছ্ড়াও নিজ দলের মধ্যেও তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। দলীয় সংসদ সদস্য ছাড়াও চারজন মন্ত্রীও হামলার বিরোধিতা করছেন।

ক্যামেরনকে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়েছে যে, সিরিয়ার হামলার অনুমোদন হাউজ অব কমন্সে মিলতে না-ও পারে।

আইনপ্রণেতাদের এমন হুমকির মুখে তড়িঘড়ি করে সিরিয়ায় হামলার পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছেন ক্যামেরন।

সিরিয়ায় হামলার বিষয়ে আগামী সপ্তাহে সংসদে ভোটাভুটির আয়োজন করা হতে পারে। তবে নৈতিকভাবে সিরিয়ায় হামলার একটি প্রস্তাবে আজ ব্রিটিশ সংসদে ভোটগ্রহন করা হতে পারে।

নিজ দল ও বিরোধী দলের প্রবল বিরোধিতার মুখে ব্রিটিশ সরকার ওবামা প্রশাসনকে জানিয়ে দিয়েছে, এই মুহূর্তেই সিরিয়ায় হামলা চালাতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রকে একাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যুক্তরাজ্য তাতে অংশ নেবে না।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম পিবিএস টিভি চ্যানেলের বরাতে পরিবেশিত খবরে আবার এক ধরনের অজানা আশংকা থেকেই যাচ্ছে, এতে পিবিএস টিভি চ্যানেলের নিউজআওয়ার অনুষ্ঠানে দেয়া সাক্ষাতকারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, তার প্রশাসন এ সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছে যে, সিরিয়ার সরকারই সেদেশে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে; কাজেই দেশটির ওপর ‘সীমিত আকারের’ হামলা চালিয়ে তিনি দামেস্ককে এ ‘শিক্ষা’ দিতে চান যে, ওয়াশিংটন রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ সহ্য করে না।

আর সর্বশেষ মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যারি হার্ফ বলেছেন, ওয়াশিংটন সিরিয়ায় হামলা চালানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতিসংঘের বাধা তা থেকে মার্কিন সরকারকে সরাতে পারবে না। ম্যারি হার্ফ বলেন, “রাশিয়া যেভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে তার ফলে আমরা বসে থাকতে পারি না। বিষয়টি এতটা গুরুত্বপূর্ণ যে, রাশিয়ার তাতে সাড়া দেয়া উচিত ছিল।”

এখন এটা নিশ্চিত যে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব তোলা হলে রাশিয়া তাতে ভেটো দেবে তা একরকম নিশ্চিত হয়ে রয়েছে। এ অবস্থায় সিরিয়ায় হামলা করতে হলে জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়েই মার্কিন প্রশাসনকে তা করতে হবে।

তবে ইউরোপের মিত্ররা তার সাথে কতটা যুক্ত হয় তা নিশ্চিত নয়, কারণ দীর্ঘ দিন ধরে চলা ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা এখনও কেটে উঠেনি । সে অবস্থায় যদি আবার নতুন এক যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্য অস্থির হয়ে উঠে, তবে তা কারো জন্যই মঙ্গলজনক হবেনা তা ইউরোপের নেতারা ভাল করেই বুঝেন, তবে সব ঘটনারই গল্প এক, আর তা হল বিশ্বব্যাপী মার্কিন স্বার্থ ।আর এই স্বার্থ রক্ষার জন্য মার্কিন নেতারা কখন কাকে বন্ধু বা শত্রু বানায় সে গল্পের কোন শেষ নাই। তাই সিরিয়ার ভাগ্যে কি ঘটবে তা এখনই বলার সময় আসেনি ।(২৯ আগষ্ট ২০১৩ তারিখ লেখা)

বিষয়: আন্তর্জাতিক

১৪৭৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File