বৃষ্টিগ্রস্ত
লিখেছেন লিখেছেন সুপণ শাহরিয়ার ০৩ আগস্ট, ২০১৩, ০৩:৫৫:৪৬ রাত
* * * * * * * * * *
উৎসর্গ
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
কষ্টে হলেও ভেবেই নিয়েছিলাম- আর লিখতে পারবো না। ক্লাস নাইন-টেনের পড়াশুনোয় অবহেলা করে যা ক’টা গল্প লিখেছিলাম, সেগুলোই স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে। একদিন সংসার হবে, বাচ্চা-কাচ্চা হবে, তারা বড়ো হবে, গল্পগুলো দেখে অবাক হয়ে বলবে- ‘বাবা, তুমি তো খুবই ভালো লিখতে, লেখালিখিটা বাদ দিলে কেনো?’ একসময় দাদু কিংবা নানু হবো, হয়তো তারাও একই প্রশ্ন করবে। এইসব প্রশ্নে বিদ্ধ হয়ে, লিখতে না পারার যন্ত্রনা নিয়ে কেটে যাবে আমার সারা জীবন। কিন্তু আমার পরম সৌভাগ্য এই যে, পরম করুণাময় আবার আমাকে কৃপা করলেন- প্রায় এক যুগ পরে এসে আবার আমি লিখতে পারছি। শাহবাগ আন্দোলনকে ভিত্তি করে লিখে ফেললাম ‘শাস্তি’ এবং তারপর এটা- বৃষ্টিগ্রস্ত।
একটা কথা না বললেই নয়- আমার এই লেখালিখির জগতে ফিরে আসতে আন্তরিকভাবে সাহায্য করেছে আমারই সহোদর ছোটো ভাই তুহিন। এবং এই লেখাটার জন্যে ওর নিকট আমার অপরিশোধ্য ঋণ।
তুহিন অর্ণব, স্নেহের তিড়িং বিড়িং ইস্পিরিং,
গ্রিক শর্টফিল্ম ‘দ্যা স্প্যারো’ অবলম্বনে তোর ছোট্টো ভাবনাটা ছিলো একটা অণুগল্পের ভাবনা, কিন্তু এতো বড়ো একটা গল্প লিখে ফেলবো- ভাবা যায়!?
সুপণ শাহরিয়ার
মিস্ত্রীপাড়া, খুলনা
+8801672794009; +8801676299169
* * * * * * * * * *
গল্পের শুরু
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
জুলাই মাসের এমন মন মাতাল করা বৃষ্টিবেলা ঘরের মাঝে চুপচাপ বসে থাকা কি সহজ কাজ?
বৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করবার ক্ষমতা আক্কাস সাহেবের নেই। ফজরের নামাজ শেষ করেই তিনি লাঠিটা হাতে নিয়ে ঠুক ঠুক করতে করতে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে, আস্তে আস্তে বারান্দার এক প্রান্তে গিয়ে এক হাত দিয়ে গ্রিলের একটা পাত ধরে ফেললেন, এবং দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি সেখানেই।
বাইরে ঝুম বৃষ্টি। মাঝে মাঝে এলোমেলো বাতাশের ঝাপটায় বৃষ্টির ছাট্ এসে পড়ছে আক্কাস সাহেবের চোখেমুখে, গায়ে। পরপরই তিনি কেঁপে কেঁপে উঠছেন। তারপরও তিনি দাঁড়িয়ে আছেন গ্রিল ধরে, দাঁড়িয়ে থাকতে তাঁর ভালো লাগছে, বেশ আনন্দ লাগছে। তাঁর চোখে-মুখে স্পষ্ট প্রসন্নতা।
বরাবরই তিনি বৃষ্টির প্রতি দুর্বল- শুধু দুর্বল না, বেশ চুড়ান্ত রকমের দুর্বল। পাখি সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘চাতক’ বলে একদল পাখি আছে- বৃষ্টিপাগল। বর্ষার মৌসুম এলেই এরা আকাশের দিকে ঠোঁট উঁচু করে বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা করে, অপেক্ষা করে বসে থাকে। মানব সম্প্রদায়ের মধ্যেও চাতকের মতো এমন বৃষ্টিপাগল মানুষ আছে কিছু- যারা বৃষ্টিকালে আকাশের দিকে চেয়ে বৃষ্টির জন্যে প্রার্থনা করে, অপেক্ষা করে বসেও থাকে।
ঠিক চাতকের মতো না, কিন্তু আক্কাস সাহেব বরাবরই বৃষ্টির প্রতি চুড়ান্ত রকমের দুর্বল।
অংকে একশ’তে ১০০ পাওয়া স্টুডেন্ট ছিলেন তিনি, এবং পড়াশুনোর প্রতি বেশ মনোযোগও ছিলো তাঁর। তাঁর ম্যাট্রিক পরীক্ষা (বর্তমানে এসএসসি) চলাকালীন সময়ে যেদিন অংক পরীক্ষা- দিনটি আষাঢ়-শ্রাবণের কোনো দিন ছিলো না, কিন্তু হঠাৎ করেই আকাশ ভেঙে হুড়মুড় করে বৃষ্টি নামলো সেদিন। তাঁর ছোটো বোন আতিকা বৃষ্টিতে ভিঁজতে ভিঁজতে দৌঁড়ে এসে বললো, ‘মা, মিয়া ভাই ঋষি হয়ে গেছে।’
আতিকার কথা মা ঠিক বুঝলেন না। মা বললেন, ‘মিয়া ভাই ঋষি হয়ে গেছে?’
‘হ্যাঁ, মা- মিয়া ভাই ঋষি হয়ে গেছে।’
‘ঋষি হয়ে গেছে মানে কী?’
‘আমার বইতে আছে না- ‘ঋ’তে ঋষি। ঋষি বসে ধ্যান করে। মিয়া ভাই সেই ঋষি হয়ে গেছে। পুকুর পাড়ে বৃষ্টির মধ্যে বসে ধ্যান করছে।’
‘পরীক্ষা দিতে না গিয়ে হারামজাদা ঋষি হয়েছে? ‘ঋ’তে ঋষি? ঋষিবাবা? ঋষিবাবার ধ্যান আমি ছুটোচ্ছি।’
ছাতি মাথায় দিয়ে মা বকতে বকতে বেরিয়ে পড়লেন বৃষ্টির মধ্যে। পুকুর পাড়ে গিয়ে দেখেন তাঁর বড়ো ছেলে সত্যি সত্যিই ঋষিবাবা হয়ে গেছেন- যিনি ভাঁজ করা দু’পায়ের হাঁটুর উপর মুঠো করা দু’হাত রেখে টানটান হয়ে বসে আছেন, চোখ বুজে আকাশের দিকে গাল হা করে আছেন, বৃষ্টির পানি সরাসরি তাঁর গালে এসে পড়ছে, তিনি তা’ সানন্দে পান করছেন।
ঋষিবাবা’র হা করে পানি পান করা দেখে মা’র রাগ আরো চড়ে গেলো। তিনি হনহন করে ঋষিবাবা’র কাছে গিয়ে বাবা’র কান ধরে টেনে দাঁড় করালেন। বললেন, ‘নমস্কার, ঋষিবাবা।’
হঠাৎ আক্রমনে ঋষিবাবা বোধহয় একটু হকচকিয়ে গেলেন, মুখ কাচুমাচু করতে লাগলেন। মা আবার বললেন, ‘তা ঋষিবাবার ধ্যানকার্যে বিঘ্ন ঘটাইবার জন্যে আমি যারপরনাই দুঃখিত। তা বাবা, আপনাকে আমি কি কিছু প্রশ্ন করিতে পারি?’
বাবা এবারও কিছু বললেন না। মা বললেন, ‘তা বাবার তো এখন পরীক্ষার হলে গিয়ে অংক খাতায় বসে ধ্যান করার কথা ছিলো, এই পুকুর পাড়টা কি বাবার পরীক্ষার হল নাকি?’
বাবা নিরুত্তর।
মা’র রাগ একেবারে সপ্তমে উঠে গেলো। ছেলের কান ছেড়ে দিয়ে তিনি গজগজ করতে করতে বললেন, ‘আপনার আজ থেকে খাওয়া-দাওয়া সব অফ। এখন থেকে আপনি এখানে বসে ধ্যান করবেন, আর হা করে বৃষ্টির পানি খাবেন। যখন বৃষ্টি থাকবে না, সূর্যের আলো থাকবে- হা করে কপকপ করে সূর্যের আলো গিলে খাবেন। আর আমি, আপনার বাপ আজকে স্কুল থেকে ফিরুক, তাঁকে বলে আপনার ধ্যানের ব্যাঘাত যেনো না ঘটে তার ব্যবস্থা নেবো। কেমন? পরীক্ষা বাদ দিয়ে উনি ধ্যানে বসে আছেন, হা করে বৃষ্টির পানি খাচ্ছেন- ঋষিবাবা। মাস্টারের ছেলে ঋষিবাবা। বদ কোথাকার।’
বালকবেলার সেই ঋষিবাবা খুব আগ্রহ নিয়ে গ্রিলের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আছেন বাইরের দিকে।
আগ্রহ নিয়ে তাকালেও আসলে তিনি চোখে তেমন দেখেন না- উনিশ শ’ বাহান্ন’র ২১ ফেব্রয়ারি, যখন তাঁর বয়স ১৮ কি ২০, ‘বাংলা’কে রাষ্ট্রভাষা দাবি করে ঢাকার রাজপথ মিছিল-মুখরিত হয়ে উঠেছিলো, তিনি দেখেছেন; ’৬৯ এর তুমূল গণঅভ্যুত্থানের ফলে আয়ুব খানের পতন ঘটেছে, তিনি দেখেছেন; ’৭০ সনে প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে হাজার হাজার মানুষ, তিনি দেখেছেন; ’৭১-এ পাকবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছে অসংখ্য মানুষ, মৃত্যুর সে নির্মম বিভৎসতাও তিনি দেখেছেন; ’৭৪ এর দূর্ভিক্ষ, ’৯০ এর গণঅভ্যুত্থান, সব, সব তিনি দেখেছেন, সব তিনি দেখতে দেখতে এসেছেন। এসবেরই মাঝে তিনি বিয়ে করেছেন, সন্তানের মুখ দেখেছেন, নাতি-নাতনী’র মুখ দেখেছেন। আর কতো? একসময়ের ঝকঝকে চোখ দু’টো তাঁর আজ বড়ো বেশি পুরাতন। দূর-অনতিদূর, সবকিছুই সে চোখে আজ ঝাপসা, অস্ফুট।
বৃষ্টিটা আরো একটু ধরে এসেছে। বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় চোখ দু’টো যেনো কেমন করে উঠলো আক্কাস সাহেবের। বিরক্ত হয়ে তিনি তাঁর ছেলের বৌ’কে ডাক দিলেন- ‘বৌমা। ও বৌমা।’
আক্কাস সাহেবের ডাক তাঁর বৌমা’র কান পর্যন্ত পৌঁছুলো বলে মনে হলো না- ভেতর থেকে সাড়া-শব্দ পাওয়া গেলো না কিছু। তিনি আবার ডাক দিলেন- ‘বৌমা। ও বৌমা, আমার চশমাটা একটু দাও না গো মা।’
প্রায় চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এলো তাঁর বৌমা নূপুর। বললো, ‘কী, এতো চেচাচ্ছেন কেনো? এই সাত সকালে কী হয়েছে আপনার? আর এভাবে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? বৃষ্টির পানি যে গায়ে লাগছে- সে খেয়াল আছে? অসুখ-বিসুখ বাঁধিয়ে শেষে আমাকেই তো যন্ত্রনায় ফেলবেন। দেখি দেখি, গ্রিলটা ছাড়েন, এবার ওই হাত দিয়ে আমাকে ধরেন, চুপচাপ এখানে বসে থাকেন।’
একরকম টানতে টানতে আক্কাস সাহেবকে বারান্দায় সর্বক্ষণ রাখা চেয়ারটাতে এনে বসালো নূপুর। শ্বশুরের প্রতি তার এমন আচরণ নতুন কিছু না- প্রাত্যহিক ঘটনা। প্রাত্যহিক যে কোনো ঘটনাই গা-সওয়া হয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু আক্কাস সাহেবের গা-সওয়া হয় না এসব কিছুই। মনে মনে তিনি বড়ো আহত হন। পরক্ষণে আবার মনে মনেই প্রবোধ খোঁজেন- কে বলবে, বয়স হয়ে গেলে হয়তো সামান্যতম কড়া ব্যবহারও অতি কর্কশ লাগে।
‘আমার চশমাটা এনেছো বৌমা?’
‘না, চশমা আনি নি। বসেন, এনে দিচ্ছি।’
গজগজ করতে করতে ঘরের ভেতর চলে গেলো নূপুর। এবং কিছুক্ষণ পর ফিরেও এলো। একটা পুরনো ফ্রেমের চশমা তার হাতে- শুধু আক্কাস সাহেবেরই বয়স বাড়ে নি, দেখলেই বোঝা যায় তাঁর চশমাটারও অনেক বয়স হয়েছে। কালো ফ্রেমটার বিভিন্ন জায়গা থেকে রঙ উঠে গিয়ে কেমন ছাই ছাই বর্ণের হয়ে গেছে।
চশমাটা কোনো রকমে হাতে ধরিয়ে দিয়ে ব্যস্ত ব্যস্ত আবার ভেতরে চলে গেলো নূপুর, চশমার গ্লাসটাও মুছে দেবার সময় হলো না তার।
চশমাটা চোখে দেবার আগে পাঞ্জাবির কোণা দিয়ে সেটাকে কিছু সময় ধরে মুছলেন আক্কাস সাহেব। নিজের চশমাটাকে এভাবে নিজেকেই মুছে নিতে হয় তাঁর নিয়মিত। এবং চশমাটাকে নিজ হাতে মুছতে গিয়ে নিয়মিতই বড়ো বেশি আহত বোধ করেন আক্কাস সাহেব, মৃত স্ত্রী’কে বারবার ফিরিয়ে আনেন তিনি স্মৃতিতে- কী অপরিসীম মমতায় সময় নিয়ে আঁচল দিয়ে ঘসে ঘসে চশমা মুছে দিতেন তাঁর স্ত্রী রোমেছা বেগম!
হয়তো স্কুল কিংবা বাজার থেকে ফিরেছেন, অথবা বাইরে কোথাও গিয়েছিলেন, সেখান থেকে ফিরেছেন তিনি- রোমেছা বেগম ছুটে চলে আসবেন তাঁর কাছে। ঘেমে ভিঁজে গেছে শরীর, শার্ট খুলে গায়ে বাতাস লাগানো জরুরি- রোমেছা বেগম প্রথমেই তাঁর শার্টের বোতাম খুলে দিবেন, তা’ না- প্রথমেই তাঁর চোখ যাবে চশমার উপর। চশমাটা খুলে নিতে নিতে বলবেন- আচ্ছা তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
আক্কাস সাহেব ঠিক ঠিকই জবাব দিবেন। পরপরই রোমেছা বেগম বলবেন- তোমার চশমায় যে পরিমাণ ধূলো-বালি তাতে তো মনে হয় তুমি আরব দেশে গিয়েছিলে। ফেরার পথে মরুভূমির উপর দিয়ে আসার সময় তুমি ভয়াবহ ঝড়ের সম্মুখীন হয়েছো। চশমা-টশমার খেয়াল না করে কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে বেঁচে এসেছো।
একবার রিকশার সংগে অ্যাক্সিডেন্ট করে চশমাটা ভেঙে ফেললেন আক্কাস সাহেব। সেবার তাঁর সংসারে সে কী নিদারুণ অভাব- ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ অবস্থা। চাকরি-বাকরি নেই। সারাদিন কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়ান, কোথাও কোনো কাজ মেলে না। মিললেও তা’ তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু না- কোনো দিন দু’বেলা খান, কোনো দিন বা এক বেলা- তিন বেলার খাদ্যসংস্থান করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। এমন অবস্থার মধ্যে চশমাটা ঠিক করা বা নতুন একটা চশমা কেনা দূরুহ ব্যাপার।
প্রায় তিন মাস পর- তখনও আক্কাস সাহেব বেকার- একদিন বিকেলে রোমেছা বেগমকে বেশ খুশি খুশি মনে হলো। দুপুরে গোসল করবার পর একটু সাজগোছ করেছেন তিনি- তোলা শাড়ী বের করে পরেছেন, চোখে কাঁজল দিয়েছেন, কপালের মাঝখানে একটা টিপ পরেছেন, ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক ঘসেছেন। সব মিলিয়ে বেশ সুদর্শনা লাগছে তাঁকে।
বাড়ি ফেরার পর রোমেছা বেগমের সাজগোছের রহস্য কিছু ধরতে পারলেন না আক্কাস সাহেব। ধরার চেষ্টাও বোধহয় করলেন না তিনি। হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে চুপচাপ খাওয়া শেষ করলেন। তারপর রোমেছা বেগম বললেন, ‘এখন তুমি কি কোনো কাজে বের হবা?’
আক্কাস সাহেব বললেন, ‘না। আজ আর বের হবো না।’
‘তাহলে চলো আজ আমরা একটু শহর থেকে ঘুরে আসি।’
‘কেনো?’
‘আমার একটা জরুরি কাজ আছে।’
‘কিন্তু-।’
‘আমি জানি, তোমার কাছে টাকা-পয়সা নেই। টাকা-পয়সা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না- আমার কাছে কিছু টাকা আছে। তুমি গত বছর যে মাটির ব্যাংকটা কিনে দিয়েছিলে, সেটা ভেঙেছি আর কিছু মুষ্টিচাল জমিয়েছিলাম, সেগুলো বিক্রি করেছি- সব মিলে বেশ কিছু টাকা পেয়েছি। দয়া করে ধার চাবা না- চাইলেও আমি দেবো না।’
‘কেনো কী কিনবা তুমি ওই টাকা দিয়ে?’
‘প্রথমে তোমাকে নিয়ে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যাবো- চক্ষু ডাক্তার। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে যাবো চশমার দোকানে- সুন্দর দেখে একটা ফ্রেম কিনবো। ডাক্তারের দেয়া প্রেসক্রিশন অনুযায়ী সেই ফ্রেমে গ্লাস সেট করবো। ব্যাস, এপর্যন্তই- আর কিছু না।’
‘তুমি বরং ওই টাকাগুলো আমাকে ধার দাও। এই মুহূর্তে আমার চোখ দেখানো লাগবে না।’
‘চোখ দেখানো লাগবে না- মানে কী?’
‘চোখ দেখানো লাগবে না মানে- চোখ দেখানো লাগবে না।’
‘অবশ্যই লাগবে। সংসারে যতো অভাব-অনাটনই থাকুক না কেনো- অবশ্যই তোমার চোখ দেখানো লাগবে। যে চোখে এতো সমস্যা, আজ তিন মাস ধরে সেই চোখ খালি করে তুমি ঘুরে বেড়াচ্ছো। ডাক্তার না দেখিয়ে আর ক’দিন এভাবে ঘুরে বেড়াও- এখন তো চোখ খালি করে ঘুরছো, তখন চোখের গর্তও খালি করে ঘুরে বেড়াতে পারবা। এখন বলো- তুমি কী যাবা?’
‘চোখ আর ক’দিন পরে দেখালে হয় না?’
‘না, হয় না। আচ্ছা যাও, চোখ তোমাকে দেখানো লাগবে না। তুমি অন্ধ হয়ে যাও- আমার কী? কিন্তু এই টাকা আমি তোমাকে দিচ্ছি নে। এই টাকা আমি ফকির-মিসকিনকে দান করে দেবো। তোমার জন্যেই যখন খরচ করতে পারবো না, তখন তোমার সংসারের জন্যেও এই টাকা আমি খরচ করবো না।’
রোমেছা বেগম এমনই- একটু পাগলাটে গোছের। নিজের প্ল্যান-প্রোগ্রামের প্রতি আক্কাস সাহেবের যদি কখনো অসম্মতি ধরা পড়ে- তাঁর মাথাটা এলোমেলো হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। পরপরই কেমন উল্টোপাল্টা আচরণ করতে থাকেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে আক্কাস সাহেবকেই শেষমেষ হার স্বীকার করতে হয়।
‘ঠিক আছে। চলো, আর কি করা। কী ব্যাপার- বসে পড়লে কেনো? আহা কাপড় খুলছো কেনো?’
‘কাপড় খুলছি কেনো বুঝতে পারছো না? কাপড় খুলছি তোমার সাথে এখন আমি ফষ্টিনষ্টি করবো, এই জন্যে।’
‘ও, তাই নাকি? তাহলে তো মন্দ হয় না।’
‘মন্দ হয় না- তাই না? আবার মিচমিচ করে হাসে! বেহায়ার মতো হা করে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বুঝতে পারছো না- আমি কাপড় বদল করবো? যাও, বাইরে যাও। বদ কোথাকার।’
‘বাবা দরজা লাগিয়ে দিলে কেনো? দরজা খোলো।’
‘আমার কাপড় বদলানো হয়ে গেলে দরজা এম্নিতে খুলে যাবে।’
‘কাপড় বদলানো লাগবে না।’
‘লাগবে। কারণ, তোমাকে ডাক্তার দেখাতে হবে না। তুমি অন্ধ হয়ে যাও- আমার কী?’
‘আচ্ছা বাবা, তুমি যা বলবে, তাই হবে। আমি দুঃখিত। দরজা খোলো।’
অবাক হলে আমাদের চোখ কপালে ওঠে। ডাক্তারের রুম থেকে বের হবার পর চশমার প্রেসক্রিপশন দেখে রোমেছা বেগমের চোখ মাথার ব্রক্ষ্মতালুতে উঠে গেলো- আক্কাস সাহেবের ডান চোখের পাওয়ার আগে যেখানে ছিলো মাত্র মাইনাস পয়েন্ট ফাইভ, এখন সেখানে মাইনাস টু পয়েন্ট ফাইভ! পাঁচ গুণ অবনতি!
সবকিছু কমপ্লিট করে বাড়ি ফিরে রোমেছা বেগম বললেন, ‘দেখেছো- যা ধারণা করেছিলাম তাই হয়েছে? কোথায় মাইনাস পয়েন্ট ফাইভ আর কোথায় মাইনাস টু পয়েন্ট ফাইভ! মাত্র তিন মাসে এতো অবনতি! তোমার কথা শুনে যদি আরো দেরি করতাম, তাহলে কী ক্ষতিটাই না হয়ে যেতো!’
আক্কাস সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা, আমি বুঝি নে- জগতে এতো বিষয় থাকতে তুমি আমার চশমা নিয়ে এতো মাতামাতি করো কেনো? তুমি জানো, আমার দিনগুলো ভালো যাচ্ছে না- বললাম টাকাগুলো আমাকে ধার দাও, দিলে না। এতো অভাবের মধ্যে এতো টাকা খরচা করে চোখ দেখানো কি ঠিক হলো?’
রোমেছা বেগম বললেন, ‘তুমি দেখো, আমাদের এই অভাব চিরদিন থাকবে না। কিন্তু, এই অভাবের দোহাই দিয়ে আজ তোমার চিকিৎসাটা যদি না করাতাম, আর আল্লাহ না করুক- তোমার চোখ দু’টো যদি নষ্ট হয়ে যেতো, তবে সেই ক্ষতির ক্ষতিপূরণ কি কোনোভাবে হতো?’
আক্কাস সাহেব প্রসঙ্গ পাল্টালেন। বললেন, ‘আচ্ছা, ধরো, কোনোভাবে আমি অন্ধ হয়ে গেলাম- তোমার কি কোনো ক্ষতি হবে?’
রোমেছা বেগম রেগে গিয়ে বললেন, ‘না, কোনো ক্ষতি হতো না। ক্ষতি হবে কেনো? আমার তো বরং লাভ হতো- তোমার হাত ধরে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে পারতাম। দেশের লোকের কাছে আমার সঙ্গিতপ্রতীভাও বিকশিত হতো, গলা ছেড়ে গাইতে পারতাম-
দুইডা খয়রাত দিয়া যান
আমরা অন্ধ ইনসান।’
আমাদের সারা জীবনের আফসোস- আমরা যখন যা চাই, তখন তা’ পাই নে। দূর্ভাগা আক্কাস সাহেবও চেয়েছিলেন- তাঁর ‘ধরো কোনোভাবে আমি অন্ধ হয়ে গেলাম’ কথার জাবাবে রোমেছা বেগম রেগে যাবেন না- আবেগে তাঁর চোখ ছলছল করে উঠবে। আস্তে করে সরে আসবেন আক্কাস সাহেবের অতি নিকটে। মাথাটা তাঁর বুকে ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে কথা বলা শুরু করবেন, যে কথা আবেগ ছাড়িয়ে রোমান্টিকতায় গিয়ে ঠেকবে, এবং একসময় লজ্জাশরমের বাঁধাও পার করে যাবে যে কথা-
“এই যে প্রায়ই আমি সাজসজ্জা করি- কপালে সুন্দর করে টিপ পরি, চোখে কাঁজল দিই, ঠোঁটে যত্ন করে লিপস্টিক লাগাই- এসব আমি কেনো করি? তোমাকে দেখাবো বলে করি। দিন শেষে বাড়ি ফিরে তুমি আমার দিকে তাকিয়ে ফট্ করে বলো- তোমাকে সুন্দর লাগছে তো! তুমি অন্ধ হয়ে গেলে এই মধুর কথাটা আমাকে কে শুনোবে? তুমি অন্ধ হয়ে গেলে প্রতি পূর্ণিমার রাতে আমাকে যে আগ্রহ করে, যত্ন করে জোছনা দেখাও, তোমার মতো অমন করে আমাকে জোছনা দেখাবে কে? তুমি অন্ধ হয়ে গেলে প্রায় রাতে আচমকা ঘুম ভাঙিয়ে গোঁফের তলায় ফাজিল ফাজিল হাঁসি নিয়ে লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে বুকের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে ব্লাউজের বোতামে হাত রেখে কে বলবে- বৌ, আমি তোমাকে দেখবো।?”
স্মৃতি মাত্রই কষ্টদায়ক- হোক তা’ সুখস্মৃতি, কিংবা দুঃখস্মৃতি।
উপরোক্ত ঘটনার মতো স্ত্রী বিষয়ক যতো স্মৃতি আক্কাস সাহেবের মস্তিষ্কে জমে আছে, তার বেশির ভাগই সুখস্মৃতি। তবুও এসব স্মৃতি মনে পড়লে তিনি কখনো সুখ কিংবা আনন্দ অনুভব করেন না; বরং ভেতরে ভেতরে কোথায় যেনো এক ধরণের ব্যথা বেজে চলে নিভৃতে। ক্রমশ সে ব্যথা দ্রবীভুত হতে থাকে ভেতরের সর্বময়। সবখানটায়।
মেঘে মেঘে সারা আকাশ ঢেকে দিয়ে যখন চারপাশ অন্ধকার করে ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি নেমে আসে- ফেলে আসা আনন্দ-বেদনার দিনগুলো আক্কাস সাহেবের স্মৃতিতে এসে বড্ডো ভিড় করে। দিনগুলোর জন্যে বড্ডো মন পোড়ে, কষ্ট হয়। বৃষ্টি বাড়ে, তাঁর কষ্টও বর্ধিত হয়। বৃষ্টি কমার সাথে সাথে কষ্টও কমতে থাকে একটু একটু করে। কে বলবে- বৃষ্টির সাথে আক্কাস সাহেবের পুরাতন আনন্দ-বেদনার দিনগুলোর কেনো এতো সখ্য?
এলোমেলো বাতাস থেমে গেছে। বৃষ্টিটাও কমে এসেছে অনেকটা- আপাতত ঝিরঝির করে ঝরে চলেছে তা’। কাছাকাছি কোথাও কোনো গাছের ডালে বসে একটি পাখি বিরামহীনভাবে ডেকে চলেছে- কু-উ-ক্। কু-উ-ক্।
অনেকগুলো বছর পর ডাকটা আবার নতুন করে শুনলেন আক্কাস সাহেব। ডাকটা শোনার পর তিনি কতোক্ষণ ধরে চেষ্টা করলেন পাখিটির নাম মনে করবার। মনে পড়লো না নামটা। কিন্তু, তিনি হাল ছাড়লেন না- চোখ বুজে চেষ্টা করতে থাকলেন। ইদানীং তাঁর যে কী হয়েছে- পুরনো কিছুই মনে পড়তে চায় না। এই যেমন গত সপ্তায় তুহিন নাম করে একটি ছেলে এলো তাঁর কাছে। পা ছুঁয়ে সালাম করে ছেলেটি বললো, স্যার, আপনি কী আমাকে চিনতে পেরেছেন?
আক্কাস সাহেব কিছুই বললেন না- ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন ছেলেটির দিকে। তাঁর তাকাবার ভাব দেখেই বোঝা গেলো- তিনি ছেলেটিকে চিনতে পারেন নি। অথচ, এই ছেলেটিই ছিলো তাঁর শিক্ষকজীবনে দেখা একমাত্র রেকর্ড- দরিদ্র ঘরের হলেও যে ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত কখনো সেকেন্ড হয় নি। রোল নং ১ এর দখল ছিলো যার টানা দশ বছর। এবং যার ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফরম ফিলাপের পুরো টাকাটা নিজের বেতন থেকে বহন করেছিলেন আক্কাস সাহেব নিজেই।
‘দাদু!’
আক্কাস সাহেব চোখ খুললেন। দেখলেন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর নাতি রেহান। কাপটা এগিয়ে দিয়ে সে বললো, ‘নাও দাদু, চা খাও।’
আক্কাস সাহেব অবাক হলেন। বললেন, ‘চা?’
‘হ্যাঁ। আম্মু বানিয়েছিলো আব্বুর জন্যে। আব্বু খাবে না। তাই আম্মু চা’টা তোমাকে দিতে বললো।’
কাপটা হাতে নিতে নিতে আক্কাস সাহেব বললেন, ‘একটা পাখি ডাকছে, শুনতে পাচ্ছিস দাদু?’
রেহান দাদু’র কথা কানে করলো না, চলে গেলো কাপটা তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়েই। কাপে চুমুক না দিয়ে আক্কাস সাহেব তাকিয়ে রইলেন নাতির চলে যাবার পথের দিকে। তাঁর দৃষ্টিটা ঝাপসা হতে লাগলো, চেহারাটা আস্তে আস্তে বিষাদে ভরে উঠতে থাকলো।
আক্কাস সাহেবের ঠিক মনে নেই- কতো দিন পরে তিনি এক কাপ চা পেলেন। আমাদের সবার প্রতিদিন চা-বিস্কিটের একটা রুটিন থাকে, আক্কাস সাহেবের তা’ নেই। কে তাঁকে রুটিনমাফিক চা করে দেবে? আছে ছেলের বৌ। বৃদ্ধ শ্বশুরের প্রতি তার কিসের এতো দায়? পরের মেয়ে হয়ে যেটুকু করে- সে-ই অনেক (?)। তবে এমন এক কাপ করে চা তিনি কদাচিৎ পেয়ে থাকেন- দেখা যায়, আসিফের জন্যে চা বানানো হয়েছে, অফিসযাত্রার তাড়াহুড়োয় চা মুখে না দিয়েই সে বেরিয়ে পড়লো, তখন অপ্রত্যাশিতভাবেই চায়ের কাপটা আক্কাস সাহেবের হাতে এসে পড়ে।
নিয়মিত চা পানের অভ্যেসটা আক্কাস সাহেবেরও ছিলো একসময়। রোমেছা বেগম বেঁচে থাকতে কতো যত্ন করেই না তাঁকে চা করে দিতেন! চা’য়ে চুমুক দেবার আগ পর্যন্ত সামনেই দাঁড়িয়ে থাকতেন। এবং প্রথম চুমুক দেবার পরপরই জিজ্ঞেস করতেন, ‘চা কেমন হয়েছে?’
আক্কাস সাহেব কাপে দ্বিতীয়বারের মতো চুমুক দিয়ে বলতেন, ‘চা চমৎকার হয়েছে। আচ্ছা, আমাকে একটা কথা বলো তো- তুমি নিজে চা খাও না, অথচ এতো সুন্দর করে চা বানাও কীভাবে?’
রোমেছা বেগম আক্কাস সাহেবের কথা অস্বীকার করে বলতেন, ‘সুন্দর করে চা বানাই না ছাই বানাই।’
রোমেছা বেগম সত্যি সত্যিই খুব সুন্দর করে চা বানাতেন। সেই চা খেতে খেতে একসময় আক্কাস সাহেবের নেশার মতো হয়ে গেলো। সকালে নাস্তার শেষে, এবং বিকেলে আসরের নামায শেষ করে এসে স্ত্রী’র হাতের এক কাপ চা না পেলে পুরো দিনটাই মাটি হয়ে গেলো বলে মনে হতো। আরো এক সময় স্ত্রী’র হাতের চা তাঁর জন্যে অপরিহার্য ছিলো- স্কুলের পরীক্ষা শেষে রাত জেগে পরীক্ষার খাতা দেখা লাগতো। খাতা দেখার ফাঁকে ফাঁকে এক কাপ করে চা না হলে চলতো না। রোমেছা বেগম’কে ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা বানিয়ে তাঁর সামনে এনে রাখতে হতো। সেই চা তিনি নিজে হাতে ঢেলে খেতেন না। রোমেছা বেগম’কে তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে জেগে থাকতে হতো- কাজের ফাঁকে ফাঁকে কাপ ভর্তি করে তিনি চা ঢেলে দিতেন।
‘বাবা!’
নূপুর কখন তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তিনি খেয়াল করেন নি। এইমাত্র খেয়াল করলেন। আক্কাস সাহেব চা খান নি, হাতে নিয়ে বসে আছেন দেখে নূপুর একটু রাগান্বিত হলো। বললো, ‘চা’টা খাচ্ছেন না কেনো?’
আক্কাস সাহেব তার কথার জবাব দিলেন না- সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। বললেন, ‘একটা পাখি ডাকছে, শুনতে পাচ্ছো মা?’
রাগী রাগী কন্ঠেই নূপুর বললো, ‘হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি।’
‘তুমি কি বলতে পারবা- পাখিটা কী পাখি?’
‘না। আমি বলতে পারবো না। সারাদিন সংসারের কাজ করে কুল পাই নে- কোনটা কী পাখি তা’ জানার সময় কোথায় আমার? দাঁড়ান আপনার ছেলেকে পাঠিয়ে দিচ্ছি- কোনটা কী পাখি ওকে জিজ্ঞেস করবেন।’
নূপুর চলে গেলো ভেতরে। পরপরই আক্কাস সাহেবের ছেলে- আসিফ দাঁত ব্রাশ করতে করতে বেরিয়ে এলো বারান্দায়। তাকে দেখে আক্কাস সাহেবের চেহারাটা ঝলমল করে উঠলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আসিফ, একটা পাখি অনর্গল ডাকছে, শুনতে পাচ্ছিস?’
আসিফ হয়তো খেয়াল করলো না। তাই কোনো জবাবও পেলেন না আক্কাস সাহেব। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘একটা পাখি অনর্গল ডাকছে, শুনতে পাচ্ছিস বাবা?’
আসিফ এবার বললো, ‘হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি।’
‘পাখিটাকে খুব পরিচিত পাখি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু পাখিটার নাম মনে করতে পারছি নে। তুই কি বলতে পারবি- কী পাখি ওটা?’
‘কোকিল মনে হয়।’
‘না না, কোকিল না। কোকিলের মতো করেই ডাকে। কিন্তু ওটা কোকিল না। অন্য কী যেনো একটা নাম পাখিটার।’
‘তাহলে বোধহয় শালিক।’
‘না না, শালিকও না। শালিকের ডাক এরকম না।’
‘তাহলে ঘুঘু হবে হয়তো।’
‘না না, ঘুঘুও না। ঘুঘু কখনো বৃষ্টি-বাদলার মধ্যে এমন ডাকাডাকি করে না।’
আর কোনো পাখির নাম প্রস্তাব করলো না আসিফ। কিছুক্ষণ পর আক্কাস সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা, কম্প্যুটার দিয়ে ইন্টার্নেটের মাধ্যমে সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ দিয়ে কিভাবে কিভাবে যেনো তুই সব তথ্য বের করে ফেলিস। ইন্টার্নেটের মাধ্যমে পাখিটার নাম কি কোনোভাবে বের করা যাবে? ধর পাখির ডাকটা অর্থাৎ ‘কু-উ-ক্, কু-উ-ক্’ আক্ষরিকভাবে লিখে গুগলে সার্চ দিলি, তাহলে এই ডাকটা কোন পাখির ডাক, সেটা বের হয়ে আসবে না?’
আসিফ নিরুত্তর- কিছুই বললো না।
আক্কাস সাহেব নাছোড় বান্দার মতো বললেন, ‘ইন্টার্নেটের মাধ্যমে পাখিটার নাম কি কোনোভাবে বের করা যাবে বাবা? যেভাবে বললাম সেভাবে না হোক, অন্য কোনোভাবে?’
ঠিক কী কারণে বোঝা গেলো না- বাবার প্রতি হঠাৎই বিরক্ত হয়ে উঠলো আসিফ। খেঁকিয়ে উঠে বললো, ‘তুমি যা বিরক্ত করো না বাবা! যে পাখি ডাকছে ডাকুক গে। তোমার কী? ওটার নাম জেনে তোমার কাজই বা কী? ডাকছে, বসে বসে ডাকটাই শোনো। নাম জানা লাগবে না। যত্তোসব!’
ঠিক এই মুহূর্তে, আক্কাস সাহেবের ভেতরটাতে কি ঘটে গেলো- আমরা দেখতে পেলাম না। শুধু দেখলাম তাঁর ঝলমল করে ওঠা চেহারাটা বিবর্ণ হয়ে যেতে থাকলো আস্তে আস্তে। তাঁর সব ক্ষণের কাঁপন লাগা শরীর নিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে, টলমল পায়ে এগিয়ে গেলেন গ্রিলের কাছে। দু’হাত দিয়ে শক্ত করে গ্রিলের একটা পাত ধরে ঝাপসা দৃষ্টিটা তিনি ছড়িয়ে দিলেন বাইরে।
পাখিটির বিরামহীন ডাক থেমে গেছে ততোক্ষণে। পূনরায় ধরে এসেছে বৃষ্টিটা। ধূসর হয়ে এসেছে সমস্ত চরাচর। একটুখানি দূরবর্তী দৃশ্যও ধোয়াটে, অস্পষ্ট। সুস্পষ্ট কেবল বৃষ্টির অবিরাম শব্দ। ঝমঝম। ঝমঝম। ঝমঝম।
* * * * * * * * * * * * * * * * *
একটি ডায়েরি, এক খন্ড জীবন
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
(পাঠক, ঘটনার এপর্যায়ে আমাদের গল্পের স্বার্থে আমরা বর্তমান সময়ে স্থির হয়ে থাকবো না- আমরা চলে যাবো ভবিষ্যতে, সুদূর ভবিষ্যতের কোনো এক নির্দিষ্ট দিনে।)
১৬ জুলাই ২০৪৫। রোববার।
আজকের এই কৃত্রিমতার দিনে ব্যাপারটা বোধকরি অলৌকিক- অশীতিপর আসিফ সাহেব এখনো অনেক শক্ত-সমর্থ। সর্বক্ষণ শরীর কাঁপলেও তিনি নিজে নিজে হাঁটতে পারেন লাঠি ভর দিয়ে। হাতে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিতে পারেন সুড়ুৎ সুড়ুৎ করে। কানে মোটামুটি ভালো শোনেন। শুধু চোখ দু’টো একটু বেশি রকমের ঘোলাটে- চশমার গ্লাস ভালো করে মুছে নিয়ে চোখে দিলেও সবকিছুই ঝাপসা, নিকট-দূর সবই অস্পষ্ট।
ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে।
২০১৩ সালের জুন মাসের এমনই এক বৃষ্টিদিনে মারা যান আসিফ সাহেবের বাবা মুহাম্মদ আক্কাস আলী। এবং একই বছর জুলাই মাসের আরেক বৃষ্টিদিনে বাবা’র পুরনো ট্রাঙ্ক ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে আসিফ সাহেব অন্য অন্য জিনিসপত্র ছাড়াও পেয়ে যান একটা ডায়েরি। আমরা যারা ডায়েরি লিখি- আমাদের প্রতিদিনের জীবনে ঘটে যাওয়া ইম্পর্টেন্ট ঘটনাবলি তারিখের ক্রমানুসারে লিখে রাখি আমরা নিয়মিত। কিন্তু আক্কাস সাহেবের ডায়েরিটা খুলে দেখা গেলো প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শুরু করে কয়েকটা পৃষ্ঠা জুড়ে কিছু লেখা। এবং সেই একাধিক পৃষ্ঠাজোড়া লেখা কেবল একটা নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত। একেক করে ডায়েরিটার পৃষ্ঠা উল্টোতে থাকলে লিখিত দ্বিতীয় কোনো তারিখ খুঁজে পাওয়া যায় না, কোনো লেখাও না। পৃষ্ঠা উল্টোতে উল্টোতে কেবল প্রথম পৃষ্ঠাতেই ফিরে আসতে হয় বারবার।
আসিফ সাহেব সেদিনই প্রথম পড়লেন ডায়েরিটা। একবার না, কয়েকবার পড়লেন। সেই শুরু। তারপর ডায়েরিরটা থেকে চোখ সরাতে পারেন নি তিনি আজও- যখনই মেঘে মেঘে ছেয়ে যায় সমস্ত আকাশ, অথবা বৃষ্টি নেমে আসে আকাশ ভেঙে, কিংবা টিপির টিপির করে বৃষ্টিপাত চলে দিনভর- আসিফ সাহেবকে দেখা যায় বারান্দার চেয়ারে বসে আছেন, দু’হাতের উপর মেলে ধরা একটা পুরনো ডায়েরি, তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ ডায়েরির পাতায়। ঝাপসা কিংবা অস্পষ্ট দৃষ্টিতে কিছু পড়তে না পারলেও সমস্যা হয় না- সুদীর্ঘ ৩২ বছরের এমন অসংখ্য বৃষ্টির দিনে অজস্রবার পঠিত ডায়েরিটা অন্ধচোখেও পড়া যায় নির্ভুল।
বৃষ্টিটা ঝরেই চলেছে আগের মতো। বারান্দার চেয়ারে বসে আছেন আসিফ সাহেব। বাবা’র পুরনো ডায়েরিটা দু’হাতের উপর মেলে ধরে আছেন। তাঁর দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে সে ডায়েরির পাতায়।
সন: ১৯৬৮ ইং
মাস: জুলাই। তাং: ১৯। দিন: শুক্রবার
আমি মুহাম্মদ আক্কাস আলী। পিতা- মুহাম্মদ ওমর আলী। গ্রাম- তেঘরিয়া। ডাকঘরÑ গাজীর দরগাহ। থানা- কোতোয়ালি। জেলা- যশোহর।
আজ ছিলো আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। প্রত্যেক সপ্তাহের আমার এই দিনটা আসিফের জন্যে বরাদ্দ থাকে। আসিফ, আমার একমাত্র ছেলে, বয়স ৩ বছর। সারা সপ্তাহ আমি ওকে একদমই সময় দিতে পারি নে। ওর সাথে খেলা করা হয় না। ওকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না। কোনো রেস্তোরায় বসে ওর প্রিয় কোনো খাবার কিনে খাওয়ানো হয় না। প্রতি সপ্তাহে এই দিনটা এলে ওর মনে খুশি আর ধরে না। কারণ, আজ সারা দিন সে বাবার সাথে ঘুরবে, আনন্দ করবে। পুরোপুরি একটা দিন বাবাকে নিজের মতো করে পাওয়া- একজন শিশুর নিকট এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে?
কিন্তু, সমস্যা করলো বৃষ্টি। প্রস্তুতি শেষ করে আমরা যখন বের হবো- অম্নি ঝমঝম করে সে কী বৃষ্টি! ইংরেজিতে যাকে বলে ‘Cats and Dogs’- মুষলধারে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি থামলো দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর। সূর্যের মুখ আর দেখা গেলো না, তবে সারা দিনের গুমোট গরমটা সরে গিয়ে ফুরফুর করে হাওয়া দিতে লাগলো।
বিকেল বেলার দিকে আসিফকে নিয়ে আমি একটু বের হলাম। ছেলেটা মনমরা হয়ে ছিলো, ওর মুখে এবার হাসি ফুটলো। দূরে কোথাও যেতে ইচ্ছে করলো না। কাছাকাছি একটা পার্কে গিয়ে বসলাম। পার্কটা বেশ নির্জন, বৃষ্টির কারণেই বোধহয় লোকজনের সমাগম নেই। পার্কের এক কোণে একটা ভ্রাম্যমান আইচক্রীমের গাড়ি দাঁড়িয়েছিলো। গাড়িটা থেকে দুইটা আইচক্রীম কিনে এনে ওর হাতে দিয়ে বললাম, আজ যদি আর কোথাও না যাই, তাহলে কি তুমি রাগ করবা, বাবা? ও মাথা ডাইনে-বাঁয়ে ঘুরিয়ে বললো, না।
আজকের খবরের কাগজটা তখনো শেষ করা হয় নি। বেঞ্চে হেলান দিয়ে খবরের কাগজটা মেলে ধরলাম। আসিফ আমার পাশে বসে চুপচাপ আইচক্রীম খাচ্ছিলো। হঠাৎ করে ও আমাকে ঝাঁকি দিয়ে বললো, বাবা, ও বাবা!
আমি খবরের কাগজটা নামিয়ে বললাম, কী? আর কিছু খাবা তুমি? আর কিছু এনে দেবো?
ও বললো, না।
আমি বললাম, তাহলে কী?
ও প্রশ্ন করে বললো, কু-উ-ক্ কু-উ-ক্ করে ওইটা কী ডাকছে, বাবা?
আমি হঠাৎ করে খেয়াল করলাম, একটা পাখি কু-উ-ক্, কু-উ-ক্ করে ডেকে চলেছে অনর্গল। এই ডাকটা সচরাচর শোনা যায় না। কেবল বর্ষাকাল এলেই ডাকটা শোনা যায়। একটানা বৃষ্টি হবার পর যখন নিরব হয়ে আসে চারিপাশ, অথবা, যখন ঝিরঝির করে অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ে, তখন এই পাখিটা বিরতীহীনভাবে ডাকতে থাকে। ডাকতে ডাকতে হঠাৎ করে একসময় চুপ হয়ে যায়। খানিক ক্ষণ পরে হঠাৎ করে আবার ডাকা শুরু করে, আবার চুপ- এভাবে ডাকাডাকি চলতে থাকে ক্রমাগত। পাখিটার নাম হচ্ছে- ডাহুক।
আসিফও, এম্নিতে তেমন কথা বলে না, কিন্তু, যখন প্রশ্ন করা শুরু করে, তখন একটার পর একটা প্রশ্ন করতেই থাকে। মাঝেমধ্যে এমনও হয়- প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সত্ত্বেও একই প্রশ্ন তিন-চারবারও করে। অনেক ধৈর্য্য নিয়ে সেসব প্রশ্নের জবাব দিতে হয়। এই মুহূর্তে শুরু হয়েছে ওর সেই প্রশ্নবান। ধৈর্য্য সহকারে আমাকে সে প্রশ্নসমূহের জবাব দিতে হবে।
আমি: ওইটা একটা পাখি, বাবা। ডাহুক পাখি।
আসিফ: কিন্তু, পাখিটাকে তো কোথাও দেখছি নে, বাবা। পাখিটা কোথায় বসে ডাকছে?
আমি: হয়তো কোনো গাছের পাতার ফাঁকে বসে ডাকছে- এইজন্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি নে।
আসিফ: কী বললে, বাবা- পাখিটার নাম ডাহুক?
আমি: হ্যাঁ, বাবা- ডাহুক। ডাহুক পাখি।
আসিফ: বাবা, কাল রাতে আমি ১০টা পাখির নাম শিখেছি, ডাহুক নামটা তো তার ভেতর নেই, বাবা। এটা মনে হয় চড়–ই পাখি, বাবা।
আমি: না বাবা, এটা চড়–ই পাখি না- এটা ডাহুক পাখি।
আসিফ: চড়–ই পাখি না? তাহলে এটা শালিক পাখি।
আমি: না, বাবা, এটা শালিক পাখিও না- এটা ডাহুক পাখি।
আসিফ: শালিক না? তাহলে এটা মনে হয় টিয়া পাখি।
আমি: না, বাবা, এটা টিয়া পাখিও না- এটা ডাহুক পাখি।
আসিফ: টিয়া পাখি না? তাহলে বোধহয় এটা ময়না পাখি
আমি: না, বাবা, এটা ময়না পাখিও না- এটা ডাহুক পাখি।
আসিফ: কিন্তু, বাবা, কাল রাতে আমি ১০টা পাখির নাম শিখেছি, ডাহুক নামটা তো তার ভেতর নেই, বাবা। এটা মনে হয় দোয়েল পাখি, বাবা।
আমার বিরক্ত হওয়া সংগত ছিলো। কিন্তু, কথোপকথনের ঠিক এই পর্যায়ে আমার মনটা মায়ায় ভরে গেলো। খুব আদর করতে ইচ্ছে করলো আসিফকে। আমি খবরের কাগজটা নামিয়ে একপাশে রেখে দিলাম। আস্তে করে আসিফকে কোলে তুলে নিলাম। ওর মাথাটা নিয়ে আলতো করে আমার বুকে চেপে ধরে বললাম- এটা দোয়েল পাখিও না, বাবা- এটা ডাহুক পাখি। তুমি যে ১০টা পাখির নাম শিখেছো, সেই ১০টা পাখি ছাড়াও আমাদের দেশে আরো অনেক পাখি আছে। সেই অনেক পাখির মধ্যে এই ডাহুক নামের পাখিটাও আছে। এটা চড়ুই না, এটা শালিক না, এটা টিয়া না, এটা ময়না না, এটা দোয়েলও না। এটা ডাহুক। এই পাখিটার নাম- ডাহুক। বুঝেছো, বাবা? এটা ডাহুক পাখি।
আসিফ আমার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়েই বাধ্য ছেলের মতো বললো, হ্যাঁ, বাবা, বুঝেছি। এটা ডাহুক পাখি। ১১ নম্বর পাখি।
ঠিক এই মুহূর্তে, আমার ইচ্ছে করলো- আমার বাচ্চাটাকে আরো একটু আদর করি। ওর ছোট্টো মাথাটা আরো কঠিন করে চেপে ধরি, এমনভাবে চেপে ধরি- যেনো বুকের পাঁজর ভেঙে মাথাটা একেবারে আমার হৃৎপিন্ডে গিয়ে ঠেকে।
ডায়েরিটা ক্লোজ করে আসিফ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে, টলমল পায়ে এগিয়ে গেলেন গ্রিলের কাছে। দু’হাত দিয়ে শক্ত করে গ্রিলের একটা পাত ধরে ঝাপসা দৃষ্টিটা তিনি ছড়িয়ে দিলেন বাইরে।
ততোক্ষণে ধরে এসেছে বৃষ্টিটা। ধূসর হয়ে এসেছে সমস্ত চরাচর। একটুখানি দূরবর্তী দৃশ্যও অস্পষ্ট। সুস্পষ্ট কেবল বৃষ্টির অবিরাম শব্দ। ঝমঝম। ঝমঝম। ঝমঝম।
* * *
বৃষ্টিগ্রস্ত । সুপণ শাহরিয়ার
গ্রীক শর্টফিল্ম 'দ্যা স্প্যারো' অবলম্বনে নির্মিত
২১ জুন ২০১৩
বিষয়: সাহিত্য
১১২২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন