ল্যাবরেটরিয়ান!

লিখেছেন লিখেছেন শুকনা মরিচ ১৫ মার্চ, ২০১৬, ০৬:৫৪:৪৬ সকাল

বুকের ঠিক মাঝখানটা এখনো মোচড় দিয়ে উঠে- স্কুলের নাম শুনলে। ক্লাস ওয়ান থেকে টেন , টানা দশটি বছর আমি এই স্কুলে ছিলাম। ছিলাম বললে ভুল বলা হবে, এখনো আছি। অন্য সব স্কুলের প্রাক্তনরা নিজেদের এক্স বলে, আমারা বর্তমান কিংবা সাবেকরা মাথা উঁচু করে নিজেদের পরিচয় দেই ল্যাবরেটরিয়ান!

বাংলাদেশের সব থেকে বিখ্যাত স্কুলটার যাত্রা শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রায় দশ বছর আগে। ১৯৬১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার ধানমণ্ডির ১নং সড়কের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল।

৫৫ বছর পরও এখনো স্বমহিমায় উজ্জ্বল ।১৯৬৪সালে বের হয়েছিল প্রথম এসএসসি ব্যাচ । আর তখন থেকেই দেশের সব পাবলিক পরীক্ষায় সব থেকে উঁচুতে নাম থাকে ল্যাবের। প্রথম দিকে এক শিফট থাকলেও ১৯৯১সালে মর্নিং ও ডে - দুইটি শিফট চালু করা হয়।

প্রায় ১০.৭ একর জায়গার এই স্কুলের বর্তমান একাডেমিক ভবন দুইটা। একটি হল প্রধান ভবন, আমরা এখানেই স্কুল জীবনটা পার করছি। এখানে ক্লাসরুম মোট ২২ টি । ( ২২ সংখ্যাটি আমাদের স্কুল লাইফ এ বিশেষভাবে ব্যবহার করতাম, অনেকটা সাংকেতিক, আরও আছে যেমন ৫৬, ৯৯...এ গুলোর অর্থ বলা যাবে না!) আর নতুন ভবনে ক্লাসরুম আছে ২০ টি। এছাড়া বিশাল মাঠের পশ্চিম পাশে আছে প্রায় ৫০০ আসন বিশিষ্ট অডিটেরিয়াম। কয়েক বছর ধরে ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে কলেজ শাখা চালু হয়েছে।

এই স্কুলটার রেসাল্ট নিয়ে আসলে বলার কিছু নাই! এসএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের প্রায় সব টপ পজিশন থাকতো এই স্কুলের দখলে। প্রাথমিক আর জুনিয়র এর ধানমণ্ডি আর নিউমার্কেট থানার ছেলেদের কোটার সব স্কলারশিপ এই স্কুলের। এখন হয়ত ছাত্র সংখ্যা কম বলে জিপিএ কম পাই আমরা, পেপার-টিভি তে এখন আর সেভাবে ল্যাব আসে না। কিন্তু যদি আগের লেটার সিস্টেম থাকতো, খোদার কসম করে বলতেছি- ল্যাবের ধারে কাছে কোন স্কুল আসতে পারতো না!আর তাই প্রতি বছর এরকম ভর্তিযুদ্ধ করে সেরারাই কেবল এখানকার ইতিহাসের অংশ হতে পারে!শুধু কিন্তু পড়াশোনা না, খেলাধুলাতে এই স্কুল সামনে ছিল। আমরা স্কুলের বিশাল মাঠেতো খেলতামই,পাশের ঢাকা কলেজ আর টিচার্স ট্রেনিং কলেজের মাঠেও যাইতাম। স্কুলের এরকম করিডরে আমরা ক্লাসের ফাঁকে ফুটবল- শর্টপিচ ক্রিকেট খেলতাম!

স্কুলে হাউজ ছিল মোট চারটা- আল বিরুনী, আল মামুন, ওমর খৈয়ম , সালাহ উদ্দিন। এছাড়া এখন প্রধান ভবনের ২য় তলায় কম্পিউটার ল্যাবে পিসি আছে ২৮ টি। আমাদের সময় লাইব্রেরি ছিল প্রধান ভবনে, এখন সেটা নতুন ভবনের ২য় তলায়, বই আছে প্রায় ৮ হাজার এর মতো।

ল্যাবে পড়ছে- তা সে যতই ভালো ছাত্র হউক- জীবনেও স্কুল পালাই নাই- এমন ছাত্র একজনও পাওয়া যাবে না! সাহসীরা টিফিনের পর এমনিই পালাই যাইত। ভীতুরা স্কাউট, বিএনসিসি, রেড ক্রিসেন্ট, বিতর্ক ক্লাব (DCL), কুইজ ক্লাব (QCL) – এদের যে কোন একটির প্রোগ্রাম আছে বলে পালায়তো।

আর সব কিছুর মতো ল্যাবের ছেলেরা মারামারিতেও ওস্তাদ!

সরকারি স্কুলের একটা বড় সুবিধা - টিফিন! এই টিফিন আমাদের কাছে ছিল অমৃতের মতো। আমাদের সময় একটা টিফিন দিত – পরোটার মধ্যে বুটের ডাল । এই জিনিসটার সাথে আর কোন কিছুরই তুলনা চলে না! বিশেষ সৌভাগ্যবানরা মাঝে মাঝে এর মধ্যে মাংস আর হাড্ডি খুইজা পাইত! আরেকটা ছিল রুটির সাথে বুন্দিয়া। কলা- সিঙ্গারা, পুরি-জিলাপি ছিল কমন আইটেম। কোন কোন দিন শুধু এই টিফিন এর জন্য স্কুলে যাইতাম। বৃহস্পতি বার ছিল দুঃখের দিন, হাফ স্কুল বলে এই দিন টিফিন দেয়া হতো না।

আমি আমার পুরো শিক্ষাজীবনে সব থেকে মমতাময়ী শিক্ষকদের পেয়েছি এই স্কুল জীবনে।

১৯৬১সালের ৫ই জুন, খান মোহাম্মাদ সালেক নামের একজন মহান শিক্ষাবিদ এই স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক হিসাবে কাজ শুরু করেন। অসামান্য শ্রম আর মেধা দিয়ে এই পদ তিনি মহিমান্বিত করে গেছেন ১৯৭৩সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত। ১৯৯২ সালে একুশে পদক প্রাপ্ত এই মনিষী ১৯৯৫ সালে পরলোকগমন করেন। জন্মদিনের মতো তাঁর মৃত্যুদিনও ছিল ৫ জুন।২০০৪-০৫ এর বার্ষিকী টি তাঁকে উৎসর্গ করা হয়।

এ পর্যন্ত প্রায় ১৬ জন প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তবে কিছু কিছু নিচু মানসিকতার শিক্ষকও ছিলেন। এরা প্রভাবশালী অভিভাবকদের সহায়তায় ল্যাবের ভালো ভালো শিক্ষকদের ঢাকার বাইরে বদলি করাই দিতো । এমন কি এদের নোংরা রাজনীতির জন্য নাইন-টেনের বিজ্ঞান শিক্ষককে নাইন টেনের ক্লাস না দিয়ে ওয়ান টুর ক্লাস নিতে হতো।

প্রতিটি ল্যাবরেটরিয়ানই এক একজন যোদ্ধা। তবে আকরাম-মুনির-মাযহার , এই তিন বীর ল্যাবরেটরিয়ান কে নিয়ে আমাদের গর্বটা সব থেকে বেশি। ৭১ এ এই তিন তরুণ শহীদ হয়েছেন।

তাঁদের মতো , বাকি সব ল্যাবরেটরিয়ানদের মধ্যেও দেশপ্রেমটা মিশে আছে বুকের পুরোটা জুড়ে। দেশের প্রতি মমতা আর ভালবাসা বুকে নিয়ে শত শত ল্যাবরেটরিয়ান আজ তাই ছড়িয়ে আছে দেশে –বিদেশে ।

স্কুলের সেই শিক্ষা- সেবার জন্য বেরিয়ে যাও- বুকে ধারণ করে নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসামান্য রেখে চলেছে ল্যাবরেটরিয়ানরা।

কেউ কেউ আমদের বলে চ্যাম্পিয়ন, কেউ বলে হিরো, কিন্তু আমরা নিজেদেরকে বলি – ল্যাবরেটরিয়ান!

বিষয়: বিবিধ

১৭১৭ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

362500
১৫ মার্চ ২০১৬ সকাল ১০:০৫
হতভাগা লিখেছেন : আমাদের সময়েও গভঃ ল্যাব এর জয়জয়কার ছিল । স্ট্যান্ড করা প্রথম ২০ জনের প্রায় ১৭-১৮ জন ওদের ওখান থেকেই আসতো । মাঝে সাঝে ক্যাডেট কলেজগুলো বাগড়া দিয়ে বসতো ।

গভঃ ল্যাব এর দাপট ছিল এস.এস.সি. লেভেলে আর ঢাকা কলেজের ছিল এইচ.এস.সি.লেভেলে । নটরডেমও সমান তালে ছিল ।

মেয়েদের মধ্যে হলিক্রস ও ভিকারুন্নেসা ছিল টপে উভয় স্টেজেই ।

কালের পরিক্রমায় গভঃ ল্যাবের নাম এখন দেখা যায় না , সেখানে স্থান করে নিয়েছে রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল ও কলেজ । গত কয়েক বছরে এই প্রতিষ্ঠানটি অস্থির সাফল্য পেয়ে যাচ্ছে ।

ইন্টারে ঢাকা কলেজের টিকিটাও এখন খুঁজে পাওয়া যায় না ।

এত নামকরা প্রতিষ্ঠান গুলোতে এখন মনে হয় আর পড়াশুনা হয় না ।

১৫ মার্চ ২০১৬ বিকাল ০৫:৫৬
300466
শুকনা মরিচ লিখেছেন : ল্যব থেকে আগের মতই এ+ তবে আমাদের ছাত্র কম বলে আমাদের আর আগের পজিসন নাই।...
362529
১৫ মার্চ ২০১৬ দুপুর ০২:৫৫
কুয়েত থেকে লিখেছেন : ভালো লাগলো লেখাটি অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File