রোহানের পাঠশালা
লিখেছেন লিখেছেন বৃত্তের বাইরে ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৪, ১১:৪৪:৫১ রাত
স্কুলের গেটে অনেক ভিড়। কে কার আগে ঢুকবে এ নিয়ে ধাক্কাধাক্কি। গেট দিয়ে ঢুকলেই টিচাররা এসে ওদের নিয়ে যাচ্ছেন। যে যেই শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে তাকে সেই ক্লাসে বসিয়ে দিয়ে আসেন। এই স্কুলটা বাসার মত নয়, দৌড়ঝাঁপ করার কিছুটা জায়গা আছে। সমস্যা হলো এই স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় এবং ভর্তি পরীক্ষায় আবার টিকতে হয়। শহরের নামকরা স্কুলের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে রোহান। আজ ইন্টারভিউ। রোহান জানেনা ইন্টারভিউ কাকে বলে? ছোটদের কেন ইন্টারভিউ দিতে হয়! ইন্টারভিউ বলতে সে টিভিতে দেখেছে, বড়দের বসিয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়। তাহলে কি তাকেও টিভিতে দেখাবে? কিন্তু স্যার যে সাথে বাবা-মাকে যেতে বলেছে! বাবা-মাকেও টিভিতে দেখাবে? কিন্তু তা কি করে হয়! সে তো বড়দের মত বিখ্যাত কেউ না। তবে ইন্টারভিউ মানে যে বড় রকমের কিছু রোহান সেটা বাবা-মাকে দেখে বুঝতে পারছে। সপ্তাহে সাতদিনই অফিসে কাজ করা আব্বু অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। রাস্তায় যেতে যেতে আম্মু সারাক্ষণই ঝালিয়ে নিচ্ছেন বাংলা, ইংরেজী, সাধারন জ্ঞান।কোনটা না পারলে আম্মুর ঝাড়ি ‘তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা। দেখ গিয়ে পাশের বাড়ির অন্তু কত ভালো স্কুলে ভর্তি হয়েছে। এমন করলে আর ভালবাসবনা। শুধু কি তাই! স্যার কী জিজ্ঞেস করলে কী জবাব দেবে, কেমন করে সালাম দেবে, কেমন করে বসবে ইত্যাদি আরো কত কি! স্যারদের এত সব প্রশ্ন, ভুল হলে আব্বুর রাগী চোখ, আম্মুর বকা...উফ্, ইন্টারভিউ দেয়া যে এত কঠিন কে জানত?
কাঁধে ভারী ব্যাগ। গলায় ঝুলানো টম অ্যান্ড জেরির ছবিঅলা পানির পট। চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা। স্কুলের ইউনিফর্ম পড়ে নতুন স্কুলে প্রথম পা রাখল রোহান। মাঠ পেরিয়ে স্কুলের বারান্দায় উঠে এলো সে। বারান্দার চেয়ারে বসে ঝিমুতে থাকা ডাকপিয়নের মতো পোশাক পরা দারোয়ান কাকা বিরক্তমুখে ক্লাস রুমটা দেখিয়ে দিল তাকে। দরজায় দাড়িয়ে জিগ্যেস করলো
‘মে আই কাম ইন, স্যার?’
‘ইয়েস, গেট ইন।’ বই থেকে মুখ না তুলেই জবাব দিলেন স্যার।
দুই বেঞ্চের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কেউ একজন টিটকারি মেরে বলল, কি রে কানা বাবু! পাশেরটা আবার দাঁত বের করে ফিক করে হেসে বলল, কানা বাবু না মটু রাম! দেখছিস না কেমন টোপা টোপা গাল! বলে দুজনে হি হি করে হাসলো কিছুক্ষণ ।এক পা-দুই পা করে সামনে এগিয়ে সবার শেষ বেঞ্চে গিয়ে মুখ ভার করে বসে রইল। টিফিন পিরিয়ডেও দুজনকে দেখে ভয়ে সিটিয়ে গেল রোহান। মনে হল তার পায়ে যেন শিকড় গজিয়ে গেছে। ওরা ক্লাসের লাস্ট বয় কিন্তু দুষ্টামিতে দুজনেই ফার্স্ট। ইচ্ছে করে দুজনে তার ব্যাগটা টেনে নিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। জ্ঞান হারানোর আগে রোহান শুধু একবার তাদের মুখটা দেখতে পেল। তারপর সব কিছু অন্ধকার।
এখন আর আগের মত স্কুলে যেতে ভালো লাগেনা রোহানের। স্যারের বাজখাই গলা, বন্ধুদের দুষ্টামির কথা মনে হলে শরীর অবশ হয়ে আসে, মাথা ঝিঁঝিঁ করে। রোহান আম্মুর কাছে একটা গল্প শুনেছে, একটি ছোট্ট ছেলে খেলতে গিয়ে দামী ফুলদানী ভেঙ্গে ফেলে। মা বকুনি দিলে দৌড়ে গিয়ে বাড়ির পাশের টিলাটার উপর উঠে মাকে উদ্দেশ্য করে বলল ' আই হেইট ইউ, আই হেইট ইউ।' ছেলেটি এর আগে কখনো প্রতিধ্বনি শোনেনি। সে ভয় পেয়ে দৌড়ে মার কাছে ফেরত গেল এবং বলল ' জানো মা, ওই টিলাটায় একটা দুষ্ট ছেলে আছে যে আমাকে বলল, 'আই হেইট ইউ'। মা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হেসে ছেলেকে বললেন, ' তুমি আবার টিলার উপর গিয়ে বল 'আই লাভ ইউ'। ছেলেটি তাই করল।এবার প্রতিধ্বনি ফেরত এল 'আই লাভ ইউ'। এই ছোট্ট ঘটনা থেকে রোহান শিখেছে, আমরা পৃথিবীকে যা দিব, পৃথিবী আমাদের তাই ফেরত দিবে। আমরা যদি আমাদের চারপাশের জগতটিকে ভালবাসায় ভরিয়ে দিতে পারি তবে জগতটিও আমাদের তাই দিবে। একই ভাবে চারপাশের পরিবেশকে যদি বিদ্বেষে ভরিয়ে তুলি তবে আমাকেও তার শিকার হতে হবে। তাই কারো বিদ্বেষের জবাবে হিংসা বা বিদ্বেষ নয়, ভালবাসা দিয়ে পূরণ করে দিতে হয়। এভাবেই রোহান ওই দুষ্ট বন্ধুদের দুষ্টুমির জবাবে কিছু না বলে আপন করে নিল, তাদের প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠলো
রোহানের খুব খুশি লাগছে আব্বু আজ তাকে স্কুলে পৌছে দিতে এসেছে। আব্বুর দেখাতো ও পায়ই না বলতে গেলে। সেই ভোর বেলা, যখন আকাশ ঠিক মতো ফর্সাও হয় না, তখনই বেরিয়ে যান। রোহান তখনও ঘুমে থাকে। আবার অনেক রাতে যখন ফিরে আসেন তখন ও রোহান ঘুমে। আজ আব্বুকে কাছে পেয়ে জমে থাকা কত কথা আব্বুর সাথে! স্কুলের কথা, বন্ধুদের কথা, দুষ্ট বন্ধুদের কি করে ভালো বন্ধু করতে হয়...আরো কত্ত কত্ত কি! রোহানের গল্প শুনতে শুনতে আব্বুও কখন যেন হারিয়ে গেছেন শৈশবে, তার ছেলেবেলার পাঠশালায়…
পরিশিষ্ট: রোহান (কাল্পনিক নাম) আমার বোনের ছেলে যে এ বছর স্কুলে ভর্তি হয়েছে। প্রথম কয়েকদিন স্কুল ভালো লাগলেও পরে তার মধ্যে স্কুল ভীতি কাজ করতে শুরু করে। কোনো রকম ভুলিয়ে ভালিয়ে স্কুলে ছেড়ে আসলেও কান্নাকাটি শুরু করে এবং পরে বাধ্য হয়ে স্কুল থেকে ফেরত আনা হয়। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম কোনরকম স্কুলে বসিয়ে দিয়ে এলে বন্ধুদের দেখলে ঠিক হয়ে যাবে। পরে দেখা গেল এই ভীতির কারণে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। স্কুল থেকে অভিভাবকদের জন্য কাউন্সিলিং এর ব্যাবস্থা করা হয়। প্রথম ধাপে ছিল স্কুল সম্পর্কে তার মনোভাব জেনে সে সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরী করা। নতুন পরিবেশে, নতুন বন্ধুদের যাদের সঙ্গে মিশতে পারছেনা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করানো। এরপর ছিল স্কুলে সাথে নিয়ে গিয়ে বাবা অথবা মাকে একসাথে বসে ক্লাস করা। প্রথম দিন তিন ঘন্টা। ক্রমান্বয়ে ….দু ঘন্টা….এক ঘন্টা… এভাবে সময়টা আস্তে আস্তে কমিয়ে আনা হল। এর পরের সপ্তাহে তাকে রেখে আসার সময় সময় বেধে দেয়া হল ১০ মিনিট পরে নিতে আসবো এবং ঘড়ি ধরে ঠিক ১০ মিনিট পরে যাওয়া এবং এভাবে এক ঘন্টা, দু ঘন্টা করে ধীরে ধীরে সময় বাড়ানো হল। এভাবে দেখা গেল প্রথমে না বলে আসাতে সে যেমন কান্নাকাটি করত পরে যখন দেখল আব্বু, আম্মু তাকে বলে যাচ্ছে এবং ঠিক সময়মত ফিরে আসছে তখন তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠলো এবং স্কুলের ভীতিটা আস্তে আস্তে কেটে গেল।
আমরা বড়রা যেমন আশা করি বাচ্চারা আমাদের কথা শুনবে, তারাও বড়দের কাছে তেমনটা আশা করে।তাই তাদের মন ভুলানোর জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়া ঠিক নয়। স্কুলে কোনো সমস্যা আছে কি না, তাকে কেউ বিরক্ত করে কি না, ঠিকমতো সে পড়ালেখার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে কি না সেদিকে নজর দিতে হবে। অযথা তাকে কোনো প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে না দিয়ে, ভালো ফল করতেই হবে এমন কোনো শর্ত বেঁধে না দিয়ে বরং সাহস দিতে হবে এবং তাকে বোঝাতে হবে যে মা-বাবা তাকে সত্যি ভালোবাসেন। মাঝে মাঝে স্কুলে গেলে তাকে ছোট ছোট পুরস্কার দেয়া যেতে পারে। স্কুলভীতি দূর করার জন্য অভিভাবক ও শিক্ষকদের উদ্যোগই যথেষ্ট। তারা চায় বন্ধুত্ব গড়তে, ঝগড়া করতে আবার ভালবাসতে। ঝগড়া-বন্ধুত্ব-ভালবাসার বন্ধনে প্রতিটি স্কুল হোক তাদের প্রানের সেই পাঠশালা।
বিষয়: বিবিধ
২৩০৭ বার পঠিত, ১৩০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো পড়ে ফাকি দেয়না আপু সেটা জানে
ঠিক খাম্মুনি
আপনাকেও ফুল আপু
আপপু, আপনার ছেলের নাম কি?
যাই আগে মাথাটা বাচাই ।
তো......এতদিন পরপর লিখা দিলে হবে?নিয়মিত লেখা চাই।
It's a very important message for all of us. Thank you so much . Keep continue
আমি কিন্তু খুউব পড়েছি পোষ্ট কমেন্টস রেডি হচ্ছে ওয়েট কমেন্টস নিয়ে আসতেছি।
গতকাল রাতেই মনে করেছিলাম আপনার পোষ্টটি স্টিকি হবে
আপনাকেও ফুল ভাইয়া।
স্কুলে থাকার সময়টাও এমন একটু একটু করে বাড়ানো হয়। যেমন প্রথমদিন আধঘন্টা, এরপর পঁয়তাল্লিশ মিনিট, এরপর এক ঘন্টা.. এভাবে একটু একটু করে। যাতে বাচ্চারা মনে বাড়তি চাপ অনুভব না করে!
আসলে স্কুলে যাওয়া শুরু করাটাও কিন্তু জীবনে নতুন একটা বন্ধন, নতুন একটা সম্পর্কের শুরুর মতোই। নতুন একটি সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হয় শিশুরা স্কুল শুরু হবার পর। আর যে কোন নতুন সম্পর্কই থ্রীল যেমন থাকে তেমনি থাকে চ্যালেঞ্জও! শিশুদের যেহেতু থ্রীল বা চ্যালেঞ্জ সেভাবে বোঝার, মেনে নেবার বা উপভোগ করবার মত জ্ঞান থাকে না! সেহেতু ওদের মনের অবস্থা বুঝে সেভাবেই নতুন সম্পর্কের সাথে মানসিক বন্ধন গড়ে তোলার চেষ্টা করাতে হবে! এবং এটাই আসলে সঠিক পদ্ধতি!
অনেক বাবা-মা বা অভিভাবকরাই এটা বুঝতে চান না! আর শিশুদের সাথে এমনটা কিন্তু প্রতেক্যেটি স্টেজেই হয়! যখন প্রাইমারি ছেড়ে সেকেন্ডারীতে যায়, এরপর যখন কলেজ শুরু করে তখনো! এমন পরিস্থিতিগুলো যাতে সহজে বাচ্চারা মোকাবিলা করতে পারে সে ব্যাপারে ওদেরকে সহায়তা করতে হবে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই!
স্টিকি পোষ্টের অনেক অনেক শুভেচ্ছা......
আপুদের জন্যও ফুল
আদরের ভাগ্নের জন্য অনেক অনেক আদর রইলো! মিষ্টি খালামনির জন্য অনেক অনেক শুভকামনা
আপুদের জন্যও ফুল
আপনি এবং সবাই ভালো আছেন তো?
আপুদের জন্যও ফুল
আপনি এবং সবাই ভালো আছেন তো?
আপনাকেও অনেক শুকরিয়া।
আপুদের জন্যও ফুল
হুম, বুঝেছি তাইতো আমার দেয়া ব্লুবেরী গ্রহণ করেন নাই! @বড় আপুণি বৃত্তমণি
স্টিকি পোষ্টে অভিনন্দন আপু।
মন্তব্য করতে লগইন করুন