স্মৃতিময় শৈশব
লিখেছেন লিখেছেন বৃত্তের বাইরে ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৩:৪৩:২৬ রাত
আম্মা বলেন, পড়রে সোনা
আব্বা বলেন, মন দে;
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।
আমার কেবল ইচ্ছে জাগে
নদীর কাছে থাকতে,
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মতো ডাকতে।
------ হুম, এমন ইচ্ছে কি শুধু কবির! কাঁঠালচাঁপার মন পাগল করা গন্ধে পড়ায় কি আর মন বসে কারো! এ যে সারাটা দিন দস্যিপনা করে বেড়ানো দুরন্ত শৈশব! চিন্তা নেই, দায়িত্ব নেই, অনেক শাসনের মাঝেও যা খুশি করার স্বর্ণালী দিন। জীবনের মুগ্ধ হওয়ার মত অনেক স্মৃতি জড়িয়ে থাকে শুধু শৈশবকালে। এক কালে সকালে আমাদের ঘুম ভাঙতো মোরগের কুককুরুকু ডাকে। দাদাজান মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে এসে নাতি নাতনিদের নিয়ে হাঁটতে বের হতেন। পথে শিউলি-বকুল কুড়ানোর সময়টা ছিল আনন্দের। তবে ফিরে এসে প্রতিদিন নানা রকম লতাপাতার রস আর চিরতার পানি খাওয়ার পর্বটা ছিল দারুণ কষ্টের। কোন রকম চোখ বন্ধ করে বিষাদ পানীয় গলাধঃকরন করে দাদাজানের কাছে পড়তে বসতে হত। বিশেষ করে ইংরেজী আর অংক না পারলে পিঠ বাঁচাতে খাটের নীচে লুকিয়েও ভাই বোনরা কেউ তেমন একটা সুবিধা করতে পারেনি। কাজে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দাদার ভয়ে প্রতিদিনের সকাল টা থাকতো হুমওয়ার্কে ঠাঁসা। দুপুরে দাদী নানা রকম কিচ্ছা কাহিনী শুনিয়ে জোর করে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করতেন। আমাদের ঘুম পাড়াতে গিয়ে দাদী নিজেই যখন ঘুমিয়ে পড়তেন অমনি চুপি চুপি উঠে এক দৌড়ে মাঠে দে ছুট!
বাড়ির কাছেই বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যায় ভাইরা বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে কতবার যে সাঁতরে এমাথা-ওমাথা করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। নদীর পাড়ে মনুষ্য প্রজাতির প্রাকৃতিক কাজ সারার নিদর্শন আমাকে সাঁতারে উদ্বুদ্ধ করেনি কখনও। কি জানি হয়তো ভয়ও পেতাম! তবে বালুচরে খেলেছি গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্দা, বউচি সহ -আরো কত কি! সহচরীদের নিয়ে লুকোচুরি খেলার কথা বেশ মনে পড়ে। বাঁশঝাড়ে লুকোতে গিয়ে কী ভয়ই না পেতাম। মনে হলে এখনো গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। শৈশবের সাথীদের মধ্যে ভাইয়ার বন্ধু সুশান্তদা বিভিন্ন পশুপাখির ডাক নকল করতে পারতো। জানালার কাছে এসে পাখির ডাক দিলে আমরা অমনি খেলার জন্য বের হয়ে যেতাম। রাজন টা ছিল নিরীহ, নাদুস নুদুস টাইপের। খেলাধুলা একদমই পারতোনা। মোরগ লড়াইয়ে কেউ ল্যাং মেরে ফেলে দিলে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদত। মাখনের ছিল অনেক বুদ্ধি, ভাল ইংরেজী বলতে পারতো। কেউ ইংরেজীতে কথা বলতে বললে গরু রচনা পুরাটা মুখস্ত বলে দিত। ওদের চার ভাই ননী, মাখন, ছানা, পনির মজাদার এই নামগুলা নিয়েও ওদের ক্ষেপাত সবাই। আর ছিলেন ঝর্ণাদি। সবাই ডাকত বুজি। সারাক্ষন মাথা থেকে উঁকুন এনে পুটুস পুটুস মারত। কেউ বুজির সাথে দুষ্টামি করেছে কি উঁকুন এনে ছেড়ে দিত। এপাড়া ওপাড়া মিলে আরও ছিল অনেকে। এত নাম কি আর মনে থাকে!
বাবা সরকারি চাকরি করায় বাবার শাসন ও আদর ভাগ্যে জুটেছে কম। রাশিয়া থেকে পড়া শেষ করে দেশে ফিরে আসার পর বাবার প্রথম পোস্টিং হয় ঠাকুরগাঁয়ে। আমার প্রথম স্কুল। একই স্কুলে পড়ুয়া আমার বড় দুই ভাই ছিল দুষ্টের সেরা। একবার কাকে যেন নাক ফাটিয়ে দিয়েছিল বলে স্কুলের হেড স্যার দুই হাতে দুই ইট দিয়ে রোদে এক ঘন্টা নীলডাউন করে রাখেন। দুপুরের কড়া রোদে কিছুক্ষন থাকার পর অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় সবাই পানি এনে,বাতাস করে ক্লাসে সে এক হুলুস্থুল কান্ড! আরেকবার বাড়িতে কোরবানির জন্য কিনে আনা ছাগল সারারাত ম্যা ম্যা করে দেখে পুরো এক বোতল কফ সিরাপ খাইয়ে দেয়। ছাগলের টানা দুইদিন মরার মত পড়ে থাকতে দেখে আমরাও টেনশনে পড়ে যাই। এরপর ঈদের দিন সকালে ছাগল মহাশয় হঠাৎ ম্যা-অ্যা-অ্যা করে উঠায় ভাইয়ারা ঐ যাত্রায় পিটুনি থেকে বেঁচে যায়। মনে আছে সে বছর বন্যায় কলোনির পাশের বস্তির এক পরিবার আমাদের বাইরের বারান্দায় আশ্রয় নেয়। প্রতি বেলা খাবার আমাদের ঘর থেকে দেয়া হত। কারো উপকার করছি ভেবে আমাদেরও সে কি উৎসাহ! এক রাতে বাসায় বিদ্যুৎ নেই। দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ ‘আমি ফকির’। আমরাও ভাবলাম আশ্রয় নেয়া পরিবারটির কেউ। দৌড়ে রান্নাঘর থেকে ভাইবোনরা ভাত তরকারী নিয়ে এসে দরজা খুলে দেখি বাবার অফিসের কলিগ ফকির চাচা সেই পরিস্থিতি মনে হলে হাসি পায় এখনও।
বাবার চাকরি সূত্রে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বদলি হতেন সাথে এক স্কুল থেকে আরেক স্কুলে আমাদেরও বদলি হত। প্রতিবারই সাথীদের ছেড়ে আসার জন্য কান্নাকাটি করতাম। সব স্কুলে বিচিত্রা অনুষ্ঠান এবং বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ভাইবোন সকলেই অংশগ্রহণ করেছি, পুরস্কারও পেয়েছি অনেক। গানে প্রথম পুরষ্কার পেয়েছিলাম ‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ’ এই গানটা গেয়ে। জীবনে প্রথম পুরস্কার ছিল সুন্দর একটা প্লাস্টিকের বক্সে বারোটা রঙ পেন্সিল আর একটা ছড়ার বই। স্টেজে প্রাইজ নিতে যেয়ে এক ওস্তাদজী জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এই যে বুড়ি! তুমি যে গান টা গেয়েছো তার অর্থ জানো? মাথা নেড়ে বললাম ‘অর্থ জানিনা, শুনে শিখেছি’। সেদিন থেকেই মাকে অনেকটা জোর করে রাজী করিয়ে হয়ে গেলেন আমাদের বাড়ির গানের ওস্তাদজ্বী। সেই সময় মাথায় গোবরের চেয়ে সারের পরিমান বেশী ছিল বলে পড়াশুনা, গান দুটোই চলেছে পাশাপাশি।
বারবার স্কুল পাল্টানোতে পড়াশুনায় ক্ষতি হচ্ছে ভেবে মা আমাদের নিয়ে চলে এলেন ঢাকায়। মা ডাক্তার ছিলেন বলে হয়তো আমাদের মগবাজারের ছোট্ট বাসাটা ছিল একপ্রকার লঙ্গরখানা। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে গ্রাম থেকে আসা নিকট এবং দূর সম্পর্কের আত্মীয় স্বজনে গিজগিজ করতো সবসময়। বছরখানেক থাকার পর আবার সপরিবারে পাড়ি জমালাম প্রবাসে। প্রাইমারীতে থাকাকালীন এটাই ছিল আমার দেশে কাটানো শেষ বছর, বাকী সময়টা কেটেছে প্রবাসে।
শৈশব-কৈশোরে নানা জায়গায় ঘুরলেও দাদার বাড়ি স্মৃতিটুকু জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। মধুর সেই স্মৃতিগুলো রেখে এসেছি গ্রামের মেঠো পথে, প্রজাপতির ডানায়, গ্রামের হাটে-মেলায়, দীঘির সেই শান বাঁধানো ঘাটে, ছিপ দিয়ে মাছ ধরার শিহরণে, ঠাকুরমার ঝুলি শোনানো দিদির কোলে। ইশ্...আবার যদি শিশু হতে পারতাম!!!
বিষয়: সাহিত্য
৩৩১৫ বার পঠিত, ৫৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
"শৈশব-কৈশোরে নানা জায়গায় ঘুরলেও দাদার বাড়ীর স্মৃতিটুকু জড়িয়ে আছে অষ্টেপৃষ্টে।মধুর সেই স্মৃতিগুলো রেখে এসেছি গ্রামের মেঠো পথে, প্রজাপতির ডানায়, গ্রামের হাটে-মেলায়, দীঘির সেই শান বাধানো ঘাটে, ছিপ দিয়ে মাছ ধরার শিহরণে, ঠাকুরমার ঝুলি শোনানো দিদির কোলে। ইশ...আবার যদি শিশু হতে পারতাম!!!"
অসাধারণ ব্যন্জনময়তায় শৈশবের মধুরতা আকর্ষণীয় ভাবে উপস্হাপন করায় অনেক ধন্যবাদ
সোনালী সেই অতীতের টুকরো টুকরো স্মৃতির জানালা খুলে গেলো যেন! নস্টালজিয়ায় ভোগাবার মত এমন দুর্দান্ত লিখনির অনবদ্য প্রকাশে মন ছুঁয়ে গেলো!!
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
==========
আপনার স্মৃতি পড়ে আমার এগুলা মনে হলো
==========
স্মৃতি বিজরিত হয়ে কাদতে চাইনা আর।
==========
তবে সবারটা আরো পড়তে চাই
==========
আম কুড়ানোর কোন ঘটনা নাই বৃত্তাপু
==========
অনেকদিন লিখেন্না। আপনার শৈশব নিয়ে লিখে ফেলেন
সবাই দেখি শেষে এই ইশ্শ্ টা টানে ?
তবে সুন্দর লিখেছেন|
আমি আপুর সাথে একমত। ব্যাথা সমাপনে শৈশব নিয়ে লিখতে হবে
আমি কেন এমন আমার কেন ইচ্ছে করে শৈশবে ফিরে যেতে !! ফিরে যাওয়া সন্বব ও নয় ।
আপু অনেক ভাল হয়েছে ।
বিশেষ করে কুরবানির ছাগল এর অংশটা!!!
ধন্যবাদ ভাইয়া আপনাকে
আপু আপনাদের ইউরোপের শৈশব নিয়ে লিখেন। শুভেচ্ছা রইল আপনাদের সকলের জন্য
আপনার শৈশব নিয়ে লেখা কই!
আল্লাহ আপনাকে ভালো রাখুন, শুভ কামনা রইলো
এতদিন পর যে ধন্যবাদ
আমি খুব মিনমিনা ভদ্র দুষ্টু ছিলাম।
যেমন আমি অকারেন্স ঘটাবো ধরা + মাইর খাবে আরেকজন এমন আরকি।
যেমন রোজাপুর অকারেন্সে ধরা খেতো আরুপু।
যেমন এখন হারিকেন ধরা খায়।
আপনার শৈশব খুব ভালো লাগলো আর লিখনীতো মাশাআল্লাহ ।
আপনার লেখার প্যাটার্ন ই আলাদা।
অনন্যরকম।
শুভকামনা রইলো লিখুন মন খুলে শুকরিয়া সুন্দর লিখাটির জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন