সীমানা ছাড়িয়ে
লিখেছেন লিখেছেন বৃত্তের বাইরে ২১ আগস্ট, ২০১৪, ০৩:১২:৩১ রাত
সামারটা আসে খুব অল্প সময়ের জন্য। দেখতে দেখতে যেন চোখের নিমিষেই শেষ হয়ে যায় সামার! সবাই একসাথে ছুটি মেলানোও মুশকিল! গত বছর থেকেই প্ল্যান করে বছরের ছুটি, ঈদ, লং উইকেন্ডের বন্ধ সব মিলিয়ে আত্মীয়-স্বজন সবাই মিলে একসাথে ঘুরার প্ল্যান করা হল। প্লেনে গেলে কিছু দেখা হয়না বলে ছয়/সাত ফ্যামিলি মিলে বাই রোডে এবারের মিশন ছিল কানাডার ওয়াটার লু শহর ঘুরে নায়াগ্রা হয়ে ফেরার সময় আমেরিকার মন্টানা ঘুরে আসা। এক সপ্তাহের খাবার সহ লাগেজ প্যাক করা হল। পথে চলতে চলতে যেখানে সন্ধ্যা নামবে সেখানেই রাতে হোটেলে থাকা হবে, আর তা না হলে ক্যাম্পিং।
গাড়ি প্রশস্ত হাইওয়ে দিয়ে চলতে শুরু করলে রাস্তার দুধারের শোভা দর্শনে মনোনিবেশ করলাম। একদিকে লেক আর অন্যপাশে ঘন বনানী আচ্ছাদিত পাহাড়ের সারির মাঝখান দিয়ে সরু পথ। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। প্রথমে গেলাম ওয়াটার লু। শান্ত নিরিবিলি ছোট্ট শহর। আমাদের দেশের মফস্বল শহরের মত পরিবেশ কিন্তু আধুনিকতায় এবং প্রযুক্তিগত উন্নতিতে এতটুকু পিছিয়ে নেই। এই শহরের দালান, রাস্তাঘাট এবং প্রসিদ্ধ ওয়াটার লু ইউনিভার্সিটির সেই পরিচিত ক্যাম্পাসের লাইব্রেরী, হল, ল্যাব, ক্লাসরুমের প্রতিটা ইট পাথরের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠা, বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দেয়া সেই যে আমার নানা রঙয়ের দিনগুলির কথা মনে পড়ে গেল। ক্যাম্পাসে পিএইচডিতে অধ্যয়নরত আমাদের এক কাজিনের বাসায় থেকে পরদিন সকালে নাস্তা সেরে রওনা হলাম টরন্টর উদ্দেশ্যে। পথে হাইওয়েতে মাঝে মাঝে হেলেদুলে চলা হরিণ এবং বুনো ছাগল মহাশয়ের সাথে দেখা হল।
হাইওয়েতে গাড়ি চালানোর সুবিধা হল সিগন্যালে পড়ার ঝামেলা কম। শুধু গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকলেই মনে হয় গাড়ি আপন মনে ছুটে চলছে। একটু বৃষ্টি হয় আবার একটু পরেই থেমে রোদ উঠে। এভাবে হাইওয়েতে রোদ ও বৃষ্টির খেলা একসঙ্গে দেখে ছোটবেলার শেখা সেই খনার বচনটির কথা মনে পড়ল। রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে খেঁক শিয়ালির বিয়ে হচ্ছে। রাস্তার দুপাশের দৃশ্যপট দেখতে দেখতে মিল্টন, হ্যামিল্টন ছাড়িয়ে এলাম টরন্টর উপকণ্ঠে মিসিসাগা শহরে। মিসিসাগা শহরটি বেশ বড়, অভিজাত এবং বাড়িগুলোও উন্নতমানের। প্রতিটা বাড়ির সামনে নানা রঙয়ের ফুল আর ঘাসগুলো এমন সতেজ আর সজীব যে দেখলে মনে হয় ওগুলোর উপরে ঘন সবুজ রঙয়ের আস্তরণ দেয়া হয়েছে। প্রচন্ড গরমের দাপট ছিল। যদিও হঠাৎ কখনো বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কিছুক্ষন পরেই আবার মেঘের কোলে রোদের হাসি ছড়িয়ে বাদল গেছে টুটি। ঝিরঝির বৃষ্টিতে বেড়াতেও ভাল লেগেছে। আরেক খালাত বোনের বাসায় রাতে থেকে তাদের সাথে মিসিসাগা থেকে আবার রওনা হলাম নায়াগ্রার উদ্দেশ্যে।
ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় যখন ১২ টা, আমরা পৌঁছে গেলাম নায়াগারা ফলস্-এর পার্কিং লট-এ। গাড়ি থেকে নামতেই নায়াগারা ফলস্-এর পানির ঝাপটা আমাদের স্বাগতম জানালো। ফলসের পানি বাতাসের তীব্রতায় উড়ে এসে প্রায় ভিজিয়ে দিলো আমাদের। পৌঁছার পর টের পেলাম ক্ষুধার জ্বালায় পেট চোঁ চোঁ করছে। চারিদিকে খাবারের দোকান কিন্তু আগুন দাম। নায়াগ্রার পার্কের একপাশে বার-বি-কিউ করা হল, সাথে ঘর থেকে আনা বিরিয়ানী আর সালাদ। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।খেয়ে পেট ঠাণ্ডা করে ওয়েলকাম সেন্টারের গেট থেকে বের হয়েই দেখি সামনে দাঁড়িয়ে গর্জে উঠছে পৃথিবীর বৃহত্তম জলপ্রপাত ‘নায়াগারা ফলস। জলরাশি যেখানে পতিত হচ্ছে সেখানে পানিতে প্রচন্ড স্রোত। মাথায় সাদা ফেনারাশি নিয়ে প্রচণ্ড বেগে বয়ে চলেছে। পানি পতনের প্রচন্ডতায় চারিদিক বাষ্পাচ্ছন্ন । টরন্ট থাকতে এর আগেও নায়াগ্রা দেখতে গিয়েছি কয়েকবার কিন্তু প্রতিবারই মনে হয়েছে নায়াগ্রার বয়স একটুও বাড়েনি। চির যৌবনা নায়াগ্রা জলপ্রপাত।
১৬৭ ফুট উঁচু নায়াগ্রা ফলস প্রকৃতপক্ষে তিনটি জলপ্রপাতের সমষ্টি; হর্সসু ফলস, আমেরিকান ফলস এবং ব্রাইডাল ভ্যালি ফলস। এর মধ্যে হর্সসু ফলস পড়েছে কানাডার মধ্যে আর বাকি দুটো ফলস আমেরিকায়। তবে তিনটি ফলসের মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে হর্সসু ফলস; নায়াগ্রা জলপ্রপাতের প্রায় ৯০% পানিই এই জলপ্রপাত দিয়ে পড়ে। পানির সার্বক্ষণিক কল কল শব্দের এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্য! চারদিকে মানুষের ঢল। কত বিচিত্র মানুষ! ক্যামেরার ফ্ল্যাশ পড়ছে তো পড়ছেই। মানুষের ছবি বাদ দিয়ে শুধু ফলসের ছবি তুললাম অনেক।
সন্ধ্যার পর বিভিন্ন রং এর আলো ফলস্ এর উপর দেয়া হয়। কখনো লাল। কখনো নীল। কখনো রংধনু সাত রং এর। লাল-নীল-কমলা নানা বর্ণের আলোকচ্ছটায় ফলসের পানি বর্ণীল এক স্বপ্নের জগতে পরিনত হয়।
নায়াগ্রা ফলসের অন্যতম আকর্ষণ হলো মেইড অব দ্যা মিস্ট। জাহাজে করে ফলসের কাছাকাছি ঘুরতে যাওয়া।
ওপারেই নিউইয়র্কের বাফেলো সিটি। ব্রিজ দিয়েই আমেরিকা যাওয়া যায়। বড় মামা এবং তার পরিবারের সাথে দেখা হল। সেই ছোটবেলায় ৩/৪ বছর বয়সে দেশে একবার দেখেছিলাম। এত বছর পর সামনাসামনি দেখা হওয়ায় আনন্দাশ্রু মিশ্রিত আবেগ, মান-অভিমান, কুশল বিনিময় চলল কিছুক্ষন। এরপর সেখানে দু’দিন অবস্থানের পর ফেরার পথে টানা ড্রাইভে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসা হল কানাডা-আমেরিকা বর্ডারে ছোট্ট শহর মন্টানায়। পথে চেরী বাগানে চেরী তোলা হল।
মন্টানায় প্রধান আকর্ষণ ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৪,০০০ ফুট উপরে উঠে Going-to-the-Sun এর অপরূপ দৃশ্য দেখা। গাড়ি পাহাড়ে উঠছে, আর আমাদের সামনে অপার সৌন্দর্য উন্মোচিত হচ্ছে। পাহাড়ি আঁকা বাঁকা পথ, পাহাড়ী নদী, নদীতে বিশাল বিশাল পাথর সব মিলিয়ে অদ্ভুত সুন্দর একটা পরিবেশ। আমরা যত উপরে উঠতে থাকি, আস্তে আস্তে তাপমাত্রা কমে যেতে থাকে। উপরে উঠার পর মনে হল পাহাড়ে প্রকৃতি তার সৌন্দর্যকে যেভাবে ঢেলে দিয়েছে তা না দেখলে বলে বুঝানো খুব কঠিন।
দীর্ঘদিন পর কাজিনদের সাথে বেড়ানো, দেখা হওয়া, মিলনমেলার আনন্দে কাটিয়ে অবশেষে ঘরমুখো হলাম। ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী হল অসংখ্য ছবি। মন ভরে রইল আনন্দ সুধায়।
বিষয়: বিবিধ
৩৬৭৬ বার পঠিত, ৬৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পোষ্ট দেখিয়া
বৃত্তের বাইরে
ফাস্টু আওণ
তোমার কপালে ৪৫ এর আগে বউ নাই।
অপটপিকঃ যখন তোমার ছেলে তোমার হাত ধরে ঘুড়বে তখন সবাই বলবে এটা আপনার নাতি নাকি?
২য় কথা হচ্ছে ... আপুরা ঘ্যান ঘ্যান না করলেও আম্রা ভাইয়াদেরও চিন্তার অন্ত নেই ....... আবিয়্যাতা বোনদের জন্য কবে যে একজন আদর্শ সঙ্গীর হাতে তুলেদিয়ে নিজেরা একটু শান্তির ঘুম দিতে পারবো ...... সেই টেনশ্যনে বাচি না.... তো মাথায় টাক না পড়ে আর কি পড়বে? @বৃত্তমণি
লেকচার শিখে গেছো
কে বলবে.... যে বলতো সেতো এখনও আসে নাই আমার জীবনে....... অদ্রিতাপুর কচ্ছপের গাড়িতে সাওয়ার হয়েছে মনে হচ্ছে কবে যে আসবে কে জানে
মাধবকুণ্ডের ভ্রমণকাহিনী আপনি লিখেন দেশে আছেন আমি তো লিখলাম একটা
অনেক সুন্দর লেখাটির জন্য শুভেচ্ছা রইলো !
অপেক্ষায় রইলাম আপুজ্বি।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ প্রিয় আপুকেআপনাদের সামার নিয়েও লিখবেন
আমিও খুরতেছিলাম আপনার সাথে কিন্তু
ফেরার সময় মন খারাপ হয়ে গেল আমার
আরো কিছু ছবি দিলে মনটা খুশি হতো।
ধন্যবাদ ভাইয়া আপনাকে
থাকলে অবশ্যই বেরাতে আসবো
আগামী বছর থাকবো কিনা জানিনা এতো অনেক দুর একটু পড়ে থকবো কিনা জানিন।
ভুল করলে মাফকরে দিয়েন সবাই।
অন্য কারো সাথে যেতে বলেন
লাইন কয়টা বেশ দারুন লাগল। লেখাটা স্টিকি হওয়া উচিৎ ছিল। ভ্রমন সত্যিই ভাল লাগে। আর হোটেলে থাকলে সেটা কোনো ভ্রমনের জাতই না। আমার মাঠে ঘাটে ক্যাম্পিং ভাল লাগে। যদি প্রিয় মানুষেরা সাথে থাকে তাহলে জবাব নেই....
মাঝে মাঝে সুন্দর কিছু দেখলে মন ভাল হয়ে যায়। তাই সুন্দর ছবি সংগ্রহে রাখতে ভাল লাগে। কোন ছবি পুরনো অনেক আগের, কোনটা আগেও কোথাও শেয়ার করেছিলাম সেখান থেকে নেয়া, আর যেটা ক্যামেরায় ভাল আসেনি সেটা ধার করা ধন্যবাদ আপনাকে
যেন আমিও ঘুরে আসলাম নায়গ্রা থেকে!!
গিয়েছি হারিয়ে
বৃত্তের বাইরে।
যেখানে উচু থেকে পানিরা নামে,
শেয়ালের বিয়ে দিয়ে,
ভাইদেরকে একা রেখে,
রৌদ্রবৃষ্টিতে খেলা করে।
গিয়েছি হারিয়ে, বৃত্তের বাইরে।
খেয়েছি বিরানি উড়েছি সূর্যপানে যেতে হারিয়ে,
বৃত্তের বাইরে একেবাড়ে সূর্যের ধারে।
কিছু ছবি নিজে তুলে কিছু ধার করে,
এসেছি তব ব্লগের তুলিতে বৃত্তের ভিতরে।
কবিতাটি বৃত্তাপুকে উপহার স্বরূপ আওণ এর পক্ষ থেকে।
অপূর্ব ছবি আর চমৎকার বর্ণনা।
লিখাটি আওণের ব্লগে স্টিকি হয়ে রইলো।
থ্যাংকু
১ - এইচটিএমএল কোডিং ক্রা
২ - লেখা বা নিক রঙ্গীন অথবা ছোটবড় করা
ব্লগ নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক
তবে বৃত্তমণির সাথে একমত....
বৃত্তের বাইরে লিখেছেন : হুম...তাহলে তো আমাদের আফরামণির জন্য মনের মত কোন সঙ্গী খুঁজে দিতে হপে যে সাথে নিয়ে ঘুরবে
একটু ক্রে এডিক ক্রেছি
@আফরা, ডেনমার্কে কি কোন ঘোড়ার যায়গা নাই
তাহলে নিজদেশ-বাংলাদেশে আসো আমাদের এখানে যথেষ্ট খালবিল,নদীনালা,পাহাড়পর্বত,বনজঙ্গল আছে
@হ্যারি, কমেন্টস চোর
"ক্যাম্পাসে পিএইচডিতে অধ্যয়নরত আমাদের এক কাজিনের বাসায় থেকে পরদিন সকালে নাস্তা সেরে রওনা হলাম টরন্টর উদ্দেশ্যে।... ........................................................................ রাস্তার দুপাশের দৃশ্যপট দেখতে দেখতে মিল্টন, হ্যামিল্টন ছাড়িয়ে এলাম টরন্টর উপকণ্ঠে মিসিসাগা শহরে।"
কিন্তু Waterloo ইনিভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে Mississauga আসার পথে আপনি Hamilton(!?) পেলেন কোথায়?? Hamilton তো আরেক দিকে। আর ছবি গুলো যে গুগুল মামা থেকে কাট/পেষ্ট বুঝাই যাচ্ছে। নাকি??
যাক, তারপরও ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন