রকমারী রোজা পালন
লিখেছেন লিখেছেন বৃত্তের বাইরে ২৫ জুলাই, ২০১৪, ১০:৪৬:১৫ রাত
দেখতে দেখতে শেষ হয়ে এল রমজান! গতকাল এ উপলক্ষে অফিসে ছিল প্রতীকী রোজা পালন দিবস। অফিসে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর লোকজন রয়েছে। প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য তাদের যে কোন একটি উৎসবকে বেছে নিয়ে অফিসে সেলিব্রেট করা হয়। স্টুডেন্ট হিসেবে পার্ট টাইম চাকরিতে যখন প্রথম ঢুকেছিলাম তখন অফিসে আমিই ছিলাম একমাত্র মুসলমান। সবাই অবাক হত এত লম্বা দিনে সারাদিন কোন কিছু না খেয়ে এমনকি পানি ছাড়া কিভাবে কাটাব! সুপারভাইজার, কলিগদের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি সবসময়ই থাকত আমার দিকে। অনেক সময় আমার কাজের লোডটাও অন্যরা ভাগ করে নিত। খাবারের গন্ধ বিশেষ করে চাইনিজদের খাবার থেকে নিজেকে বাঁচাতে লাঞ্চ টাইমটা বাইরে চলে যেতাম। এখন বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে অনেক মুসলমান। যেহেতু রোজা চলছে তাই সবাই ঠিক করেছে অফিসে আমরা যারা মুসলমান রয়েছি তাদের সম্মানার্থে প্রতীকী রোজা দিবস পালন করা হবে এবং সবার কফি এবং লাঞ্চের টাকাটা গাজায় ফিলিস্তিনিদের উদ্দেশ্যে দান করা হবে।
অফিসে সবার সাথে থেকে বিভিন্ন রকম মুসলমান এবং তাদের রকমারী রোজা পালন রীতি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। অন্য টিমের এক সুপারভাইজার আহমেদিয়া। তিনি রোজা থাকেন সকাল ৬ টা থেকে সন্ধা ৬ টা পর্যন্ত, যদিও আমাদের রোজা আঠার ঘন্টার বেশি এবং সূর্য অস্ত যায় ১০ টায়। আমার কলিগ হেজেল সে ইসমাইলী। পর্ক থেকে শুরু করে সবই খায়। তারা রমজানে রোজা থাকে না। বছরের বিশেষ তিন দিন রোজা রাখে। আমাদের এক সিনিয়ার পাকিস্তানী রোজা রাখেননা। তার কাছে এই লম্বা দিনে আমাদের রোজা রাখাটাও বেশি বেশি মনে হয়। তবে রোজা উপলক্ষে তার ঘরে আলেমদের দিয়ে কোরআন খতমের ব্যবস্থা করা হয়, মসজিদেও লোক দেখানো দান খয়রাত করে থাকেন। তিনি নিজে যেহেতু রোজা থাকেননা তাই সবার সামনেই লাঞ্চ খান। অফিসের নন মুসলিম সুপারভাইজার যেখানে আমাদের সামনে লাঞ্চ খেতে দ্বিধা করেন সেখানে আরেক সিনিয়ার প্রগতিশীল বাংলাদেশী নিজেকে স্মার্ট প্রমান করতে কফির মগ হাতে প্রতিদিন অফিসে আসেন এবং অন্য রোজাদারদের সামনে নিজের আধুনিকতা জাহির করতে ভালবাসেন। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে যেখানে রোজা নিয়ে নানা রকমফের সেখানে আমারই এক নন মুসলিম শ্রীলংকান বান্ধবী গত তিন বছর থেকে আমার সাথে সবগুলো রোজা রাখছে। রোজা রাখার পিছনে মুসলমানদের একটা মহৎ উদ্দেশ্য যে যাকাত দেয়া এটা বুঝতে পেরে সে প্রতি রোজায় তার মাসের বাজার খরচের পুরো টাকাটা তার দেশে গরিবদের জন্য পাঠিয়ে দেয়।
রমজান এলে দূর প্রবাসে বাবা, মা, ভাইবোনদের অনুপস্থিতি কষ্ট দেয় বেশী। বাসায় ফোন করলেই মায়ের কান্না সামলে ফ্যাঁসফেঁসে গলায় কী খেয়েছি, কী রেঁধেছি ইত্যাদির ফিরিস্তি চাওয়া। বাবার হাজারটা প্রশ্ন-এত লম্বা দিন না পারলে রাখিসনা, অসুস্থ হলে রোজা ছাড়া যায়... ইত্যাদি নানা উপদেশ। দেশে সবসময় মা জোর করে সেহরী করাতো, কিছুতেই শুনতো না। ভাইয়ারা ভাল খাবারের আয়োজনের লোভে সেহেরিতে উঠে বসে থাকত। কিন্তু এখানে কখনো আলসেমী করে এক গ্লাস পানি খেয়ে রাতে ঘুমিয়ে পড়ি। মনে পড়ে ছোটবেলায় রমজানের ছুটির জন্য তীর্থের কাকের মতো বসে থাকতাম কবে আসবে রোজা, কবে শুরু হ'বে বিশাল ছুটি.....! স্কুলের ক্যালেন্ডারে রোজার বন্ধের এক দু’সপ্তাহ আগে থেকেই গোনা শুরু করতাম আর কয়দিন বাকী স্কুল বন্ধ হতে? রোজা রেখেই সব ধরনের খেলা চলত। পাড়ার বড় ভাইয়েরা ভোররাতে হামদ, নাত, গজল এসব গেয়ে ঘুম ভাঙাত। বাবা-মা বা বাসার অন্যদের দেখাদেখি "রোজা রাখতে চাই, রাখতে চাই দিতে হবে" টাইপের আন্দোলন করার পর পারমিশন পেতাম। সবাই যখন কষ্ট করে তিরিশদিনে তিরিশটা রোজা রাখতো আমার তখন পাঁচবার আযানের সময় খেয়ে দিনে পাঁচটা করে দেড়শটা রোজা রাখা হয়ে যেত! এরপর অবশ্য শুরুতে, মাঝে আর শেষে এই তিনটা বা বিশেষ বিশেষ দিনে যেমন শুক্রবার, শবে কদর ইত্যাদিতে রোজা রাখার পারমিশন ছিল। তবে রোজা রাখার জন্য অনেক ঘ্যান ঘ্যান করা লাগত। না হয় সবাই চুপিচুপি সেহরি খেয়ে বলত -'তোমাকে অনেক ডেকেছিলাম, তুমি ওঠোনি'। সবচেয়ে বেশি মজা হত দাদা বাড়িতে গেলে। কাজিনরা কে কার চেয়ে বেশি রোজা করবে সেই কম্পিটিশন। সারাক্ষণ একজন আরেকজনের পিছনে লেগে থাকত। বাথরুমে গেলেই বলত ঐযে বাথরুমে লুকায়ে পানি খেয়ে আসছে, আমি যত বলতাম না আমি খাইনি শুধু মুখ ধুয়েছি। ওরা বলত না না খেয়েছ তোমার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে .... যতখন না আমি কান্নাকাটি শুরু করতাম সবাই মিলে চলত এই খোঁচান। এতসব বাঁধা অতিক্রম করে শেষমেষ সন্ধ্যের সাইরেণ বাজার পর বিজয়ীর হাসি হেসে খাবার মুখে দেয়া --সে এক অন্য রকমের এ্যাডভেঞ্চার!
স্টুডেন্টদের জন্য বিদেশে রোজা রাখাটা অনেক সময় কঠিন। মুসলিম দেশগুলোতে স্কুল-অফিসের টাইম রোজদারদের সুবিধার্থে পাল্টে দেয়া হয়, কিন্তু বিদেশে তো সেটা হয়না তাই অনেক সময় সবকিছু সামলে রোজা রাখাটা কঠিন হয়ে পড়ে। ইফতার অনেক সময় করা হয়না ঠিকমত। ফুল টাইম চাকরি, পার্ট টাইম পড়াশুনা করে ব্যাচেলরদের জন্য ইফতার বানানোও এক ঝক্কি! দেশের মত ঘরে বানানো ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনী দিয়ে ইফতার অনেকটা স্বপ্নের মত। ক্লাসে থাকলে কাছাকাছি হালাল রেস্টুরেন্ট না থাকলে সাথে থাকা বোতল থেকে দু’ঢোক পানি আর খেজুর খেয়ে রোজা ভাঙ্গতে হয়। বাসায় থাকলে নুডলস অথবা সুপের মত সহজ কিছু তৈরী করি। যখন কিছু করার সময় বা ইচ্ছে থাকেনা তখন ইফতারে ভাত আর ঘরে করা কোন তরকারী দিয়ে ইফতার সেরে ফেলি। মাঝে মাঝে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতেও হানা দেয়া হয়। এখন বোন সাথে থাকায় তাও কিছুটা রক্ষা। তবে সবচেয়ে সুবিধা কমিউনিটির কোনো মসজিদে গিয়ে ইফতার করা। প্রায় প্রতিদিনই কমিউনিটির মুসলমানেরা একসাথে মসজিদে ইফতারের আয়োজন করে থাকে। দূর পরবাসে থেকেও ভোজন রসিক বাঙালিরাও ইফতারে রাখেন বাহারি আয়োজন। অলসদের জন্য ফ্রি খাওয়ার এই আয়োজনটা মন্দ না। প্রতিদিনই কয়েকশ মুসল্লির জন্য বিনামূল্যে ইফতারের আয়োজন করা হয়। ব্যস্ত কিংবা ব্যাচেলর রোজাদারদের কেউ কেউ প্যাকেট ইফতারি দিয়ে সেরে নেন তাদের ইফতার পর্ব। এছাড়া মসজিদে সবাই একসাথে তারাবীহটাও পড়া হয়ে যায়। মসজিদে বড় দিনের রোজায় মুসুল্লিদের কষ্টের কথা চিন্তা করে ছোট সূরা দিয়ে আট রাকাত তারাবীহ পড়ানো হয়। ঘরের চাইতে সবার সাথে মসজিদে গিয়ে পড়লে মনের মধ্যে অন্যরকম একটা শান্তি অনুভব করি। সবচেয়ে বেশী ভালো লাগে প্রতিবেশী বড় বোনদের আন্তরিকতা। রোজায় কি খাচ্ছি, ঘরে কি রান্না হচ্ছে সবসময় খোঁজ খবর নেন। কিয়ামুল লাইলের উদ্দেশ্যে মহিলারা একসাথে রাত জেগে নামাজ পড়া হয়। পটলাক করে সবাই একটা করে ডিশ এনে একসাথে প্রতি উইকেন্ডে কারো বাসায় সারারাত জেগে কোরআন, হাদিস নিয়ে আলোচনা, নামাজ পড়া শেষে একবারে সেহেরি, ফজর শেষ করে বাসায় যাওয়া হয়। মায়েদের সাথে আসা পিচ্চিগুলাও সারারাত জেগে সমবয়সীদের সাথে আড্ডা দেয়। স্কুল বন্ধ, সকালে উঠার তাড়া নেই-বড়দের সাথে রাত জাগার সে কি আনন্দ!
প্রতি বছর সারা বিশ্ব থেকে অনেক মুসলিম ছেলেমেয়ে নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যায় উচ্চশিক্ষার আশায়, অনেকে আসে ইমিগ্রান্ট হয়ে। দেশের কথা সবসময়ই সবার মনে পড়ে আর বিশেষ করে মনে পড়ে রমজানের মত বিশেষ উপলক্ষ এলে। নিজের পরিবারে অনুপস্থিতি অনুভব করে, বান্ধবীদের সাথে স্মৃতিচারন করে দেশে ভাইবোনদের সাথে কাটানো ইফতারের সময়গুলো। কিন্তু আলহাদুলিল্লাহ এই অপরিচিতদের ভীড়েই সবাই নিজেকে আপন করে নেয়, নতুন দেশে নিজেদের মানিয়ে নেয়, পরবাসে নতুন জীবনে নিজেদের মত করে রমজান পালন করতে শিখে।
বিষয়: বিবিধ
২২৪৭ বার পঠিত, ৫১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ঈদে থাকছিনা তাই আপনাকেও অগ্রিম ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখলাম। ঈদ মো বারাক
আপনার অফিসের অভিজ্ঞতাও দারুন। তবে বাঙ্গালী এখনও মানুষ হলনা...
আপনারও তো মনে হয় প্রবাসে প্রথম রোজা। দেশে খালাম্মা না জানি খাবার সামনে নিয়ে আপনার জন্য কত আফসোস করছেন! ঈদে কি কি রান্না করছেন জানিয়ে পোস্ট দিয়েন। পোস্ট অবশ্যই খাওয়ার আগে দিবেন ধন্যবাদ আপনাকে। ভাল থাকেন
০ আপনাদের ওখানে কি হিন্দুদের দুর্গা পূঁজা বা অন্য কোন পূঁজা সেলিব্রেট করা হয় ? সেখানে পার্টিসিপেট করেন - মানে তাদের তৈরি করা প্রাসাদ কি খাওয়া হয় ?
আমাদের এখানে হিন্দু , বৌদ্ধ ও খৃষ্টানদের ধর্মীয় দিন গুলোতে ছুটি দেওয়া হয় । আপনার এই প্রবাসে কি সেরকম কিছু হয় ?
শৈশবের রোজা মনে হয় আনন্দদায়ক ছিল।ঈদে কখনও একসেট এর বেশি পোষাক কিনা হয়নি। রোজার আনন্দ ও ঈদের আনন্দ ছিল আলাদা।
এখনকার ছেলেরা সেই আনন্দটিও নিতে চায়না। এদেশেও একদল অতি আধুনিক আছে যারা রোজার সময় সবার সামনে খাওয়াদাওয়া করা কে মনে করে কৃতিত্ব।
আসলে সম্মান জিনিসটা আপনা থেকে আসে সেটা অন্যের প্রতি হোক আর নিজের ধর্মের প্রতিই হোক। যে সম্মান করতে জানে সে সব দিকেই খেয়াল রাখে। তাই যারা নিজেকে আধুনিক প্রমান করতে ধর্মকে অসম্মান করে তারা নিজেকেই অসম্মান করে আসলে
ধন্যবাদ ভাইয়া আপনাকে ঈদের শুভেচ্ছা রইলো
তাই ভাবছি, কখনযে আবার নিজেকে খুঁজে পাবো...।।
অসাধারণ আপু।।
ﺗﻘﺒﻞ ﺍﻟﻠﻪ ﻣﻨﺎ ﻭ ﻣﻨﻜﻢ
সব্বাইকে ঈদ মুবারক।
আপনার বাড়িতে রান্নাঘড়ের প্রতিটি হাড়িতে আমার ঈদের দাওয়াত রইলো।
আমার ঈদ বোনাস যেনো ঠিকঠিক পাই হামমম এটা যেনো মনে থাকে।
ঈদ বোনাস ভাইদের কাছ থেকে আদায় করতে হয়। ধন্যবাদ আওন কে
ব্লগে স্বাগতম
মন্তব্য করতে লগইন করুন