দূর আকাশের তারা
লিখেছেন লিখেছেন বৃত্তের বাইরে ২২ এপ্রিল, ২০১৪, ০৮:৫৭:৫৪ রাত
পরশ তোমার সকল খানে,সকল কাজে,সকল ধ্যানে
দখিনা হাওয়ার শীতল ছোঁয়ায়,সকাল দুপুর সারাবেলায়
বাবা আমায় দেখাত যে সত্য পথের আলো
বাবা আমায় বুঝিয়ে দিত মন্দ আর ভালো
বাবা মানে আমার আকাশ,আকাশভরা নীল
সেই আকাশে চাঁদ ও তারা করে যে ঝিলমিল।
বাবা মানে আমার আলো, আমার রোদ ও হাওয়া
বাবা মানে আমায় রেখে হঠাৎ চলে যাওয়া
হইনি বলা যে কথাটি আজ শুনে নাও বাবা
ভালবাসি তোমায় আমি, আমার প্রিয় বাবা
ভদ্রলোকের সাথে সম্পর্কটা আস্থার, বিশ্বাসের, ভালোবাসার আর কিছুটা ভয়ের। তিনি কখনও রাশভারী, গম্ভীর, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। কখনো আবার বন্ধুর মত। সবকিছু মিলিয়ে ভাল লাগা এক দূরের তারা। সেই সকালে বের হয়ে যান কাজের উদ্দেশ্যে, ফিরেন সেই রাতে। কারো কাছে বাবা মানে তার পৃথিবী। কারো জীবনে বাবা মানে ছবি। বছরের পর বছর সেই ছবি আগলে বাবার প্রতীক্ষায় প্রহর গোনা। এভাবে লোকটির সঙ্গে যে সম্পর্ক দানা বেঁধে উঠে মানসিকভাবে এ সম্পর্ক খুব গভীর কিন্তু দৃশ্যত এটি অনেক দূরের । অনেকটা আলো ছায়াময়। একটু ভয়, একটু ভালবাসাবাসির। তার আশ্রয় ছাড়া চিন্তা করা যায়না এক মুহূর্তও । আবার খুব কাছে গিয়ে জড়িয়েও ধরা যায়না ।
অদিতির কাছে বাবা হল বন্ধুর মত। শুক্রবারটা বরাদ্ধ থাকতো বাবার জন্য। খেলাধুলা, বন্ধু বান্ধব বাদ দিয়ে তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা শুধু বাবা আসার মুহূর্তটির জন্য। বাবা কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরতেই বাবার হাত থেকে অফিসের ভারী ব্যাগটি সরিয়ে নেয়া, মাথাব্যাথা হলে মাথা টিপে দেয়া, বাবা কি খেতে বেশী পছন্দ করেন, কোন কাজটা বাবার অপছন্দ, কি করলে বাবা বেশী খুশি হন, কোন কাপড়টায় বাবাকে বেশী স্মার্ট লাগে সব দিকে খেয়াল অদিতির। কখনও অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলে মায়ের সাথে রাত জেগে বসে থাকতো বাবার অপেক্ষায়। বাবা বাসায় অথচ বাবাকে ছাড়া কেউ কখনও খেয়েছে মনে পড়েনা। আর বাবাও কি কম! মেয়ের পড়াশুনা ঠিকমত হচ্ছে কিনা, অসুখ হলে রাত জেগে বসে থাকা, মেয়ের শখ কতটুকু পূরণ হচ্ছে, ভবিষ্যৎ কেমন হবে, কোথায় পাত্রস্থ করতে হবে-ইস কত কি চিন্তা বাবার! কখনও বাবা বাইরে থেকে এলে হাতে থাকতো জাদুর ব্যাগ। যখন সেই ব্যাগ খোলা হয়, অমনি সেখান থেকে বের হয়ে আসে খেলনা, গল্পের বই, চকলেট অথবা নতুন পোশাক। বাবার ভালবাসা মাপার যদি কোন যন্ত্র থাকতো তাহলে সে নিশ্চিত সবার চেয়ে অদিতির প্রতি ভালবাসার পরিমান অবশ্যই বেশী হত।
অদিতির সাথে বাবার সম্পর্কটা যতটা কাছের নেহালের কাছে ঠিক ততোটা দূরের। কিছুটা শ্রদ্ধা আর ভয় মিশ্রিত। ভার্সিটির হলে থাকার সময় বন্ধুদের কেউ কেউ লুকিয়ে কাঁদত। প্রতি সপ্তাহন্তে তাদের লেখা লম্বা লম্বা চিঠি পেয়ে বাবারা আর থাকতে পারতেন না গ্রামে, ছুটে আসতেন তাদের ছেলেকে দেখতে। কত ধরনের আবদার আর ভাললাগা মিশ্রিত সেই চিঠি—বাবা তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, তোমার কথা শুনতে ইচ্ছে করে, যখন রাত জেগে পড়ি তুমি এসে কেন বাতি নিভিয়ে কেন বলোনা ‘এত রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে, ঘুমাতে যাও— আরও কত কি! কেউ লিখত পরিক্ষার ফলাফল জানিয়ে। নেহাল লিখত শুধু টাকা চেয়ে পিতার নিকট পুত্রের পত্র যেখানে সম্পর্কটা যেন কাছে থেকেও অনেক দূরের। আসলে বাবার সাথে সেই হৃদ্যতার সম্পর্কটা তৈরি হয়নি তাঁর। কখনো মনে হয় বাবা অনেক বেশী শাসন করেন। আবার কখনো মনে হয় বাবার কথাই ঠিক, আসলে সে-ই ঠিকমত বুঝতে পারেনা বাবাকে। মনে পড়ে ছোটবেলায় এক হাতে বাবার চুল আর আরেক হাতে গলা শক্ত করে বাবার কাঁধে চড়ে কত ঘুরে বেড়িয়েছে শহরময়! সেই কাঁধ ছুঁতে এখন আর চেয়ারে কিংবা টেবিলে উঠে দাঁড়াতে হয়না, যে কোন অবস্থায় দাঁড়িয়েই ছুঁয়ে ফেলতে পারে । অথচ এখন সেই প্রশস্ত কাঁধে চড়া তো অনেক দূর, ছুঁতেও পারেনা। মনের মধ্যে কি এক সংকীর্ণতা কাজ করে। মাঝে মাঝে সে নিজেকেই প্রশ্ন করে--আচ্ছা বাবা, সন্তানেরা বড় হলে কি লাজুক হয়ে যায়! মায়ের অনুপস্থিতিতে অভিমানী, ঝগরুটে, বোকা বোকা বাবা সবসময় ছিলেন সেবাময়ী মায়ের ভূমিকায়। হসপিটালের শেষের দিনগুলোর কথা মনে হলে এখনো চোখ ভিজে উঠে। দেখলেই দু হাত প্রসারিত করতেন। এখন মনে হয় কেন তখন একটু জড়িয়ে ধরলামনা! সারা বাড়িতে তাঁর স্মৃতিচিহ্ন। তাঁর ব্যবহৃত জামা কাপড়, চশমা, সেলফে সাজানো বইপত্র—সব জায়গায় তাঁর অনুপস্থিতিতে বুকের ভিতরটা কেমন যেন হু হু করে উঠে।
আসলে সবার কাছেই সবার বাবা একটা বিশেষ জায়গা দখল করে থাকে। সেটা কখনও ভালবাসার, কখনও আবেগের,কখনও বা অভিমানের-অভিযোগের। শৈশবে বাবাকে মনে হয় সর্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। একটু বয়স হলেই মনে হয় বাবা কিছু বিষয়ে জানেন, কিছু বিষয়ে জানেন না। তারপর বয়স যখন আর একটু বাড়ে, তখন মনে হয়,বাবার ভাবনা-চিন্তা সবই সেকেলে। বয়স যখন ত্রিশের কোঠায়,তখন মনে হয়,বাবার সঙ্গে একটু আলাপ করে নিলে হতো, কিছু কিছু বিষয়ে তো বাবার মতামতের গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। আর নিজে বাবা হলে তখন বুঝা যায় আসলেই বাবা অনেক কষ্ট করেছেন, বাবা যে কথাগুলো বলেছিলেন সেগুলোর সত্যিই মূল্য আছে। সন্তানের সাথে বাবাদের সম্পর্ক যা-ই হোক না কেন গভীর মনোযোগের সাথে তার মুখের দিকে তাকালে দেখা যায় তার মুখের প্রতিটি ভাঁজে ক্লান্তি, ক্লান্তি আর ক্লান্তি। ঘর্মাক্ত মুখ, ঘামে ভিজে যাওয়া শার্ট আর দিনভর দৌড় ঝাঁপের পর রাত করে বাসায় ফেরা। সন্তান ও পরিবারের জন্যই বাবারা দূর আকাশের তারা।
বিষয়: Contest_father
৩০৯৩ বার পঠিত, ৪১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বাবা নামের আমাদের সবার দূর আকাশের তাঁরাটার এনাটমির পুরোটা পড়লাম! খুবি হৃদয়-ছোঁয়া বাস্তব বর্ণনা! শুরুতে একটি কবিতা দিয়ে পাঠককে পোস্ট পড়াতে গাড়ি থেকে রিসিভ করে ড্রয়িংরুমে বসানো হয়েছে দেখলাম...ভালোই! শেষে কোথাও আবার একটু নিয়ে যেতে চেয়ে শুধু ইশারাতেই সারা হয়েছে! সবশেষে 'পরিণত'দের মূল্যায়ন বাবাকে! অ্য কম্প্রিহেন্সিভ প্রেজেন্টেশন! ধন্যবাদ...
দখিনা হাওয়ার শীতল ছোঁয়ায়,সকাল দুপুর সারাবেলায়
বাবা আমায় দেখাত যে সত্য পথের আলো
বাবা আমায় বুঝিয়ে দিত মন্দ আর ভালো
পৃথিবীর সব বাবাই মনে হয় এরকম হয়।
আমার নাম আফরা সাইয়ারা মানে সাদা তারা । ছোট্ট বেলায় মাকে যখন বাবার কথা বলতাম মা বলত তুমি তো একটা তারা তোমার বাবা তোমাকে আকাশ থেকে আনতে গিয়ে তোমাকে আমার কাছে ফেলতে পারছে ঠিকই কিন্তু তোমার বাবা আকাশে আটকে তারা হয়ে আছে ।
ধন্যবাদ আপু ।
তবুও বাবা কখনো হয় দূর আকাশের তারা
চিন্তা করতে পারি না এ ভুবন বাবাকে ছাড়া
বাবাই শিখিয়েছিল মনকে উড়তে বাঁধনহারা......
রাব্বির হামহুমা কামা রব্বায়ানি ছাগিরা!
অনেক ভালো লাগলো লেখাটি।
@রোজাপু রাব্বির হামহুমা কামা রব্বায়ানি ছাগিরা।
তাই একটুকরো অভিনন্দন দিয়ে গেলাম বাকি অভিনন্দন গুলো জমা রইলো।
পরে দিয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ।
শুরুতে আমি মনে করেছিলাম এটা বুঝি কবিতা। স্ক্রল করে নীচে নামার পর আসল স্বাদটা পেলাম। দারুণ লিখেছেন। ধন্যবাদ।
আপনার জান্নাতবাসী বাবার জন্য দোয়া রইল। প্রথম হওয়ায় অভিনন্দন আপনাকে
আপনাকে অভিনন্দন..........
সব সন্তানদের সাথে বাবার সম্পর্ক যেন অদিতির মত হয়। আর নেহালের মত ভয় আর শ্রদ্ধা ও থাকুক তবে সেটি যেন হয় ভালবাসায় মিশ্রিত।
অনেক অনেক অভিনন্দন আপনাকে ,
আর আমার নাম বিজয়ীর তালিকায় এসেছে সেটি ও আপনার কারণে। সত্যি করে বলছি আপনি যদি বারবার আমার লিখার ব্যাপারে তাগাদা না দিতেন তাহলে হয়ত এত তাড়াতাড়ি ব্লগে এসে লিখার মন নিয়ে বসা হতনা।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনার বাবাকে নিয়ে লেখাটা অনেক ভালো লেগেছে। তাগাদা না দিলে জানা হতনা আপনাকে বিজয়ীর তালিকায় দেখে অনেক ভালো লেগেছে। অনেক অনেক অভিনন্দন রইলো
আগের মত নিয়মিত লিখবেন,মন্তব্য করবেন। রমজান মোবারক
মন্তব্য করতে লগইন করুন