না বলা কথা
লিখেছেন লিখেছেন বৃত্তের বাইরে ১৮ মার্চ, ২০১৪, ০২:৪৪:০৭ রাত
দৃশ্য -১
তমালের বয়স ১৩। সে শান্ত স্বভাবের,পড়াশোনায়ও অনেক মনযোগী। ক্লাসের অন্য বন্ধুদের মত কারো সাথে আড্ডা দেয়না, তার কোন মেয়েবন্ধুও নেই। সে কারো সাথে মিশতে পারেনা দেখে তার বন্ধুরা ভাবে সে বোকা। তমালের বন্ধুরা সুযোগ পেলে মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বাইরে গিয়ে সিগারেট খায়,মোবাইলে চ্যাটিং করে। তমাল বুঝতে পারে কিন্তু কিছু বলেনা। তমালের ক্লাসে সেক্স এডুকেশনের উপর ভিডিও দেখায়,অন্যরা সবাই সেই ক্লাসে যায়। এই ক্লাসের যাওয়ার জন্য স্কুল থেকে বাসায় অভিভাবকদের মতামত চেয়ে একটা ফর্ম পাঠিয়েছিল। তমালের বাবা-মা পারমিশন দেননি। তাই স্কুলে যখন সেক্স এডুকেশনের ক্লাস হয় তমাল সেই সময়টা লাইব্রেরীতে থাকে। এজন্য তার বন্ধুরা তাকে বুক ওয়ার্ম/ বইয়ের পোকা বলে ক্ষেপায়। তমাল বুঝতে পারে সে বড় হচ্ছে কিন্তু তার শরীরের এবং মনের যে পরিবর্তন আসছে তা বাবা-মায়ের সাথে শেয়ার করতে পারেনা। বাবা-মাকেও ঠিক বুঝতে পারেনা তমাল। বন্ধুদের সঙ্গে দূরে কোথাও যাওয়ার অনুমতি চাইলে বাবা-মা বলেন, ‘তুমি এখনো অনেক ছোট, বড় হলে তারপর যাবে।’ আবার কোন কাজ না করতে পারলে , তখন বাবা উত্তর দেন, ‘তুমি এত বড় হয়েছ,আর এই সামান্য কাজটি করতে পারো না?’ তমাল পড়ে যায় উভয় সংকটে—সে কি আসলে ‘বড়’ না ‘ছোট’? এখন কোন পার্টিতে গেলে ছোটদের সাথে খেলতে ভালো লাগেনা, আবার বড়রাও তাকে তাদের দলে ডাকেনা।
তমালের বাবা ছেলের সাথে বন্ধুর মত। শত ব্যস্ততার মাঝেও ছেলেকে সময় দেয়ার চেষ্টা করেন। ইদানিং তিনি বুঝতে পারছেন তমাল কিছুটা বিষণ্ণ থাকে, পড়াশোনায়ও আগের মত তেমন মনোযোগ নেই। সবকিছুতে বাবা-মায়ের খবরদারি একেবারেই পছন্দ করছেনা। নিজে নিজে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে চায় এবং কখনো মতের মিল না হলে বড়দের সঙ্গে রূঢ় আচরণও করে ফেলে। তার মধ্যে এই পরিবর্তন দেখে ছেলে যে বয়ঃসন্ধিকালের কঠিন সময় পার করছে এটা তিনি আঁচ করতে পারেন। আগে যৌথ পরিবারে বাবা-মা কাছে না থাকলেও বাড়ির মুরুব্বীদের কাছে ছেলেমেয়েরা অনেক কিছু জানতে পারতো। কিন্তু এখন একক পরিবারে বেশীরভাগ বাবা-মায়ের ব্যস্ততার কারনে সেটা আর সম্ভব হচ্ছেনা। তমাল যেহেতু একা বড় হচ্ছে তাই তিনি মনে করেন ছেলেকে আরও বেশী সময় দেয়া প্রয়োজন। বয়ঃসন্ধিকালে যে দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তন আসে সে ব্যাপরে আগে থেকে অবহিত না করলে তাদের ভেতর আচরণগত অস্বাভাবিকতা চলে আসতে পারে। এ বয়সে জানার যে কৌতূহল থাকে তা এড়িয়ে না গিয়ে বরং অভিভাবকদের আন্তরিকতার সাথে ছেলে-মেয়েদের বুঝিয়ে দেয়া উচিত তা না হলে তারা যদি কুসংসর্গ থেকে খারাপভাবে কিছু জেনে ফেলে, তা তাদের জন্য শঙ্কার কারন হতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের সাথে আলোচনা সহজ করার জন্য প্রত্যেক বাবা-মাকে শৈশব থেকেই গাছপালার বংশবৃদ্ধি , বিভিন্ন প্রাণীর প্রজনন এবং মানব দেহের গঠন সম্বন্ধে প্রাথমিক আলোচনার ভিতর দিয়ে স্বাভাবিকভাবে তার ছেলে-মেয়ে উভয়ের কৌতূহল উদ্দীপ্ত করা প্রয়োজন। প্রথম থেকেই জ্ঞানগর্ভ আলোচনা না করে সহজ ভাষায় বুঝানো যেতে পারে। এক্ষেত্রে বাবা-মাকেই হতে হবে তাদের প্রকৃত বন্ধু।
দৃশ্য -২
রিদিতার বয়স ১৮। ইদানিং রিদিতার মনে হচ্ছে তার বাবা-মা তাকে একটুও পছন্দ করে না। সে যাই করে তা তাদের ভাল লাগেনা। তার বাবা সারাদিন অফিস করে, শুধু রাতেই বাসায় থাকে আর সে সময় কিছু না কিছু নিয়ে বকাঝকা করে। তার মাও তাকে সারাদিনই এটা ওটা নিয়ে বকা দেন ‘ কাজ শিখ্, মেয়ে হয়ে জন্মেছিস আজ বাদে কাল বিয়ে হবে। কাজ না শিখে শ্বশুর বাড়িতে গেলে সবাই বলবে, কি মেয়ে বানিয়েছে যে একটা কাজও পারে না।! রিদিতার রাগ হয়, মেয়ে হয়ে জন্মানো কি তবে পাপ? ভাত খেয়ে প্লেটটা রেখে উঠেছে অমনি শুরু হলো ‘নিজের খাবারের প্লেটটা পর্যন্ত একটু ধুয়ে রাখতে পারিসনা! চাল চলন একদম নবাবের মেয়ের মত, একটা কাজ করতে চায়না! বান্ধবীর বাসায় একটু যেতে চেয়েছে সেখানেও নিষেধ, কারো সাথে ফোনে কথা বলছে অমনি ফোনটা টেনে নিয়ে 'দেখি কার সাথে কথা বলছিস এতক্ষণ! সবকিছুতে নিষেধ আর বারণ শুনতে শুনতে আর ভালো লাগেনা রিদিতার। মাঝে মাঝে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফেনের সাথে ঝুলে মরে যেতে ইচ্ছে করে।
নেহা রিদিতার ভাল বন্ধু। বাবা মা এর ডিভোর্স হয়ে গেছে, নেহা তার আত্মীয়ের সাথে থাকে। পরিবারে বাবা-মায়ের শাসন,ধর্মীয় অনুশাসন নেই বলে নেহা কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করে। রিদিতার মা জানেন নেহা ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে তাই নেহার বাসায় যাওয়া-আসা, রিদিতার সাথে মেলামেশা করাটা তিনি পছন্দ করেননা। আর তাছাড়া নেহার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠার পর থেকে তিনি তার মেয়ের মধ্যেও পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন। সে ঘরে থাকার চেয়ে নেহার সাথে ঘুরতে বেশী পছন্দ করে। তাহলে কি তিনি মেয়েকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশী শাসন করছেন যা মা-মেয়ের সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি করছে!
রিদিতার যা বয়স-এই বয়সে কাউকে না মানার মনোভাব ছেলে-মেয়ের মধ্যে প্রচণ্ড ভাবে জেগে ওঠে। এ সময় বাবা-মা কিংবা অন্য অভিভাবকদের সাথে তাদের বনিবনা হয় না। একটা দুর্বিনীত ভাব সবসময় উত্তেজিত করে রাখে। নেতিবাচক চিন্তা-চেতনা তাদের প্রভাবিত করে। পারিবারিক পরিবেশ, স্কুল-কলেজের পরিবেশ, বন্ধুবান্ধবের সাহচর্য এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক উপাদান যেমন টেলিভিশন, সিনেমা, নাটক তাদের মনে প্রভাব বিস্তার করে। তখন বাবা-মায়ের চেয়ে বন্ধুদের বেশী আপন মনে হয়। তাই অভিভাবকরা সচেতন না হলে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। রিদিতার মা বুদ্ধিমতী তাই ব্যাপারটা বুঝতে পারে তিনি মেয়েকে ব্যস্ত রাখার জন্য মেয়েকে পার্টটাইম কাজ করার পরামর্শ দেন। কিন্তু শর্ত হল, তার নিজের যাতায়াত খরচ, ফোন বিল নিজেকে দিতে হবে আর প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমান টাকা ব্যাংকে জমা রাখতে হবে। এই শর্তে রাজী হয় রিদিতা। এখন পড়াশুনা, পার্টটাইম জব, পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় সোশ্যাল ওয়ার্ক নিয়ে এত ব্যস্ত যে নেহার সাথে মেশার আর সুযোগ পায়না। রিদিতার মা ও মেয়ের এই পরিবর্তনে খুশী। রিদিতার মা বুঝতে পারেন আসলে দোষ রিদিতা বা নেহা কারোই নয়। অনেক বাবা-মা সন্তানদের যথাযথ সময় না দিয়ে শুধু শাসন করতে পছন্দ করেন। চাকরিজীবী বাবা-মায়ের সন্তানরা তাদের বাবা-মাকে কাছেই পায় না। কোনো কোনো অভিভাবক সন্তানকে অতি আধুনিক হিসেবে গড়ে তুলতে গিয়ে নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলে যায়। পরিবার থেকে যদি সন্তানকে সুশিক্ষা দেয়া হয়, ধর্মীয় অনুশাসন, নৈতিক শিক্ষার পরিবেশ দেয়া হয়, তাহলে এই বয়সে বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা অনেক কম থাকে। পরিবারে যদি নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামী পরিবেশ বজায় থাকে এবং সন্তানদের কুরআন-হাদিস চর্চায় অভ্যস্ত করা হয় তাহলে সে পরিবারের সন্তান অবশ্যই ভালো হবে।
বিষয়: বিবিধ
২০৪০ বার পঠিত, ৩০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সচেতনামূলক লেখাটির জন্য জাযাকিল্লাহ।
আবার শরীয়ত দিয়ে বোঝানোরও কিন্তু পদ্ধতি আছে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই শরীয়তের বিধি-নিষেধ এত জটিল-কঠিন করে উপস্থাপন করা হয় যে বাচ্চারা ঘাবড়ে যায়। শরীয়ত কি এবং কেন শরীয়তকে মেনে চলতে হবে সেটা প্রথমে বোঝাতে গেলে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। তারচেয়ে শরীয়তের মধ্যে থেকেও জীবনের সব রঙ সব রূপকে স্পর্শ করা না গেলেও,অন্তত অনুভব করা যায় এই নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারলে তারা অনেক বেশি আশ্বস্ত হতে পারে।
অনেক ভালো লাগলো। শুকরিয়া।
হুম, সামান্য হলেও ইসলামী পরশ পাথরের ছোয়াঁয় বাঙালি মুসলমানের চরিত্র এখনো বিশ্বে অতুলনিয়! অতি মুল্যাবান কথাটি মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
বাবা-মা এর দায়িত্ব শুধু খাওয়ানো আর পড়ানোই নয় এটা অনেক সময় ভুলে যান বাবা মায়েরা! সন্তানকে বন্ধুর মতো সময় দেয়া, সন্তান যেনো মনের সব কথা,প্রশ্ন,উদ্বেগ খুলে বলতে পারে সেই পরিবেশটা তৈরি করা প্রয়োজন সবার আগে। বাড়িতে ইসলামিক পরিবেশ থাকলে বাচ্চাদের সহ বাবাময়ের শরীয়ত বুঝানো খুব কঠিন হয় না! তবে হিকমাহ অবলম্বন করেই প্রতিটা পদক্ষেপ আগানো উচিত!
সবশেষে সন্তান একদিকে আমাদের জন্য নিয়ামত আবার আমানত । এই সন্তান সম্পর্কে প্রতিটি পিতামাতাকে জিজ্ঞাসিত হতে হবে কিয়ামতের ময়দানে। সঠিক ভাবে দুনিয়া ও দ্বীনের জ্ঞান আমরা কতটুকু পৌছিয়েছি সেটাও ভাবার বিষয়!এখানে না শিথিলতার সুযোগ আছে না আছে বাড়াবাড়ির! আল্লাহ আমাদের সন্তানদের সঠিকভাবে গড়ে তোলার তোওফিক দান করুন!
সুন্দর,বাস্তব সমস্যার আলোকে লিখাও সমাধানের জন্য শুকরিয়া!
অটঃ আপু,বলতে ভুলে গিয়েছি আপনার দেয়া রেসিপি দিয়ে রসমালাই বানিয়েছিলাম। ভালোই হয়েছে কিন্তু গুঁড়া দুধের গন্ধ দূর করতে আপনার বাসায় দাওয়াত নিতে হবে। তবে আপনার কারনে এখন সবাইকে বলতে পারি-- আমিও মিষ্টি বানাতে পারি। অসংখ্য শুকরিয়া এবং দোয়া রইলো। ভাল থাকেন আপু
আসলে সময়টাতে বিমর্ষতা এমন ভাবে আকড়ে ধরে বলার বাহিরে কিন্তু আমি এমন একজন ছিলাম যে সকাল বেলা ব্যাট নিয়ে খেলতে বের হতাম আর রাতে ব্যাডমিন্টন খেলে বাসায় ফিরতাম সেই একজেলা থেকে আরেক জেলায় খেলার জন্য গিয়েছি।
এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় চলে যেতাম।
আমার টিম ছিলো নেতৃত্ব দিতাম সেই টিমের।
এত ব্যাস্ত থাকতাম বলার বাহিরে কিন্তু এর মাঝেই যে কেমন বিষন্ন লাগতো মাঝে মাঝে। তবে চিন্তা করি এই তমালটা তো ওহ্!!!!!!
আমার আশে পাশে একটা পরিবার ছিলো ব্যাতিক্রম যিনি তার সন্তানদের সাথে এ ব্যাপারে বন্ধুর মত ছিলেন। আর সেটাই হওয়া প্রয়োজন।
অনেক ধন্যবাদ।
আলহামদু লিল্লাহ্! সন্তানদের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকার কারণে বেশ উপকৃত হয়েছি আমরা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন