গ্যাঁড়াকল
লিখেছেন লিখেছেন বৃত্তের বাইরে ০৬ মার্চ, ২০১৪, ০২:৪৯:১১ রাত
আমাদের অফিসে মাসখানেক হল বাংলাদেশী এক ভদ্রলোক নতুন জয়েন করেছেন। অফিসে সাধারনত নতুন কেউ জয়েন করলে সাপ্তাহিক মিটিংয়ে তাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু গত দু’সপ্তাহ যাবত ম্যানেজার অসুস্থতার কারনে ছুটিতে থাকায়, আমাদের সাপ্তাহিক মিটিং না হওয়ায় নতুন যোগদানকারীর সাথে পরিচয়ের সুযোগ হয়ে উঠেনি। কোম্পানিতে যোগ দেয়ার পর থেকে এই অব্দি সাদা-কালো নানা ধর্ম-বর্ণের সংমিশ্রনে আমি একমাত্র বাঙালী ছিলাম বলে নতুন একজন বাংলাদেশীর কথা শুনে মনে মনে একধরনের আনন্দ অনুভব করলাম। তাই স্বাভাবিকভাবেই পরিচিত হওয়ার আগ্রহটাও ছিল প্রবল। কিন্তু না দেখেই ভদ্রলোককে বেশ বুদ্ধিমান মনে হল কারন, ম্যানেজার পরিচয় করিয়ে দেয়ার আগেই তিনি নিজে থেকে সবার মাঝে পরিচিত হয়ে উঠলেন এবং দুই সপ্তাহের মধ্যে অফিস জমিয়ে ফেললেন। তার এই সাফল্যের পিছনে রহস্য হল তিনি কারো মুখের দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন। মানে যে কেউ এই মুহূর্তে সুখী না দুঃখী, চাকরী-পরিবার নিয়ে কি ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এ থেকে উত্তরণের উপায় সহ নানা উপদেশ মালা মুখ দেখেই বলে দিতে পারেন।
পাশ্চাত্যে লোকজন এমনিতে নানা ধরনের কুসংস্কারে বিশ্বাসী। তার মধ্যে একটা হল ১৩ সংখ্যাটা যা কিনা আনলাকি বা দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে মনে করে। তারা যে এটা প্রবলভাবে বিশ্বাস করে তা আমি প্রথম জানতে পেরেছিলাম নর্থ অ্যামেরিকার কিছু হাইরাইজ বিল্ডিঙয়ে ১৩ নম্বর ফ্লোর নেই দেখে। এমনকি লিফটেও ১২ এর পর ১৪ নম্বর ফ্লোর মাঝে ১৩ উধাও। যাদের ধর্মের ভিতটা নড়বড়ে তারা খুব স্বাভাবিকভাবেই ভাগ্য গননায় বিশ্বাসী হয়। তাই বাসে, ট্রেনে, মেট্রোতে পত্রিকা খুলেই আগে রাশিচক্রে দিনটি কেমন যাবে এই নিয়ে সবার আগ্রহ থাকে বেশী। আর লটারি কিনে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করার নেশাটাও রয়েছে অনেকের ভিতর। এমন অনেক ভবঘুরেকেও দেখেছি কাজ করেনা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন ভিক্ষা করছে কিন্তু ভাগ্য পরিবর্তনে আর কিছু না করুক প্রতি সপ্তাহে একটা লটারীর টিকিট ঠিকই কিনবে।
আমার অফিসেও আমি ছাড়া সবাই টিকেট কিনে। অনেকে আবার গ্রুপ করে কিনে। যদি জিতে যায় তাহলে টাকাটা সবাই ভাগ করে নিবে এই শর্তে। এ পর্যন্ত অবশ্য পাঁচ/দশ ডলারের বেশী কেউ জিতেছে তা শুনিনি/দেখিনি। টাকার পরিমান যাই হোক এতেই এরা খুশী কারন সবাই মিলে মজা করে কফি খাওয়ার আনন্দটা উপভোগ করে এটাই ওদের কাছে অনেক। কিন্তু আমাদের বাঙালীদের তো আর এত ছোট ছোট স্বপ্নে মন ভরেনা ! আমাদের স্বপ্নগুলোও হয় বড় ধরনের। বাঙ্গালী ভদ্রলোক এমনিতেই অফিসে মোটামুটি সবার ভাগ্য গননা করে এবং তার মধ্যে ঝড়ে 'বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে' এর মত ২/১ জনের সাথে লেগে যাওয়ায় কৌশলে নিজের কেরামতিটা বাগিয়ে নিয়েছেন। তাই সবাইকে কথার জাদুতে পটিয়ে এই রকম এক বিশাল সাইজের এক স্বপ্ন নিয়ে উক্ত ভদ্রলোক একদিন আমার রুমে এসে হাজির হলেন, হাতে লটারীর টিকিট। ওনাকে দেখার পর আমার ওনার সাথে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছাটা মুহূর্তেই বেলুনের মত চুপসে গেল। মনে পড়লো এই জনপ্রিয় ব্যক্তিটি আমার পূর্ব পরিচিত এবং উনার সাথে আমার পরিচয়ের পর্বটাও ছিল স্মরণীয়।
সেই সময় সবেমাত্র ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। সামারে ইঞ্জিনিয়ারিং এসোসিয়েশনের উদ্যোগে বাঙালীরা বনভোজনের আয়োজন করেন। এই আয়োজনে চাকুরিজীবি, চাকুরিরতদের সাথে কিছু বেকার, ভার্সিটি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেই সময় বিশেষ কাউকে চিনতাম না বলে পিকনিকে আগত লোকজনের কর্মকাণ্ড দেখা, বাচ্চা-বুড়োদের ছবি তুলে দেয়া, সময়মত খাবারের সময়ে প্লেট নিয়ে হাজির হয়ে যাওয়া ছাড়া কিছু করার ছিলনা। চারপাশের সৌন্দর্য্য অবলোকন করতে করতে আমাদের চোখ যখন প্রায় ক্লান্ত তখন ওই পার্কেরই এক কোনের সুশীতল গাছের ছায়ায় উক্ত ভাগ্য গণনাকারীকে চোখে পড়ে যার হাতের প্রতিটা আঙুল ছিল নানা রঙয়ের অষ্ট ধাতুর মিশ্রনে তৈরি আংটির বন্ধনে আবদ্ধ। ভদ্রলোকের ওয়াইফ এবং ছেলে দূরে থাকায় তাকে বেশ কয়েকজন ঘিরে বসে ভাগ্য গননায় ব্যস্ত ছিল। আমার সাথের বান্ধবীরা আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে গেল। ‘একই দৃশ্য দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। সময় কাটানোর মত কিছু পাচ্ছিনা, চল দেখি ভদ্রলোক সবাইকে কি পাঠ পড়াচ্ছে'। যাওয়ার পর উনি বেশ আগ্রহ সহকারে আমাদের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। সবার পরিচয়, নাম, কি পড়ছি এইসব জানার পর শুরু হল ভাগ্য গননা পর্ব। শুনলাম উনি বাঙালীদের অনেককে এমন ভবিষ্যৎ বানী দিয়েছেন যা হুবুহু মিলে গেছে। কারো হাতে কষ্টি পাথরে জীবন বৃত্তান্ত লেখা ব্রেসলেটও দেখলাম। একজন আবার জিজ্ঞেস করলেন ‘ভাই কোম্পানি থেকে যেভাবে ছাঁটাই শুরু হয়েছে আমার চাকরিটা থাকবে তো! আপনার কি মনে হয়! উনি আবার নিজের উদাহরণ টেনে বললেন ‘এই জন্যই আমি কিছুদিন পর পর চাকরী বদলাই। কোন কোম্পানির অবস্থা কেমন যাবে আগে থেকে বুঝতে পেরে সরে পড়ি। যাই হোক, আমিও যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বৈ মিথ্যা বলিবনা, কোন কিছু গোপন করিবনা টাইপের আইনী বয়ান দিয়ে কথোপকথন শুরু করলামঃ
--আপনার জীবনে এমন কি কোন দুর্ঘটনা আছে যার উপর শনির প্রভাব ছিল?
--আমার এক্সিডেন্টের কথা মনে পড়ায় বললাম, শনির প্রভাব ছিল কিনা জানিনা তবে রবির প্রভাব ছিল।
--ভদ্রলোক কপালে প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। সম্ভবত রাশিচক্রের বইতে রবির প্রভাব জাতীয় কোন শব্দ নেই। তাই আবারো প্রশ্ন করলেন রবির প্রভাব জিনিসটা কি?
--রবির প্রভাব মানে রবি বাবুর প্রভাব। আমার এক বান্ধবী দেশ থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা সিডি গিফট করেছিল। অনেকদিন বাংলা গান শুনিনা তাই গান শুনতে শুনতে ড্রাইভ করছিলাম,এত বেশী মগ্ন ছিলাম যে খেয়াল করিনি। এরপর অবশ্য আমার বোন সবগুলো সিডি নিয়ে গারবেজে ফেলে দেয়। এখন আমি মোটামুটি রবি বাবুর প্রভাব থেকে মুক্ত।
--ভদ্রলোক সম্ভবত এই ধরনের উত্তর প্রত্যাশা করেননি। উনি আরও বিভিন্ন টাইপের প্রশ্ন করে যখন আমার ভাগ্যের সাথে নিলা না রুবি পাথরের আংটি ম্যাচ করবে তার হিসাব কষছিলেন ঠিক সেই সময়, প্রশ্ন-উত্তর পর্বের একেবারে শেষের দিকে আমার তখনকার রুমমেট ‘ফাজিল দ্যা গ্রেট’ বান্ধবী’ যে বানিয়ে কথা বলায় চ্যাম্পিয়ান এমন এক বিষয় যোগ করলো যা আমার পরিবারের সদস্যরা কেন আমিও জানতাম না। সে হঠাৎ বলে বসলো, ‘ভাইয়া ও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা গোপন করেছে। ও বিবাহিত, ছেলে-মেয়ে আছে, ইদানিং হাজব্যান্ডের সাথে বনিবনা হচ্ছেনা, ডিভোর্সেরও হুমকী দিয়েছে। আমার মনে হয় নীলা-রুবিতে কাজ হবেনা ওর ডায়মন্ড লাগবে। আমি পুরা থ হয়ে কিছুক্ষন শুনলাম এবং পরে দেখলাম ভদ্রলোক সত্যি সত্যি ওর কথা বিশ্বাস করে ডায়মন্ডের আংটির দর কষাকষি করছেন। আগে ভাবতাম অশিক্ষিত, বোকা লোকেরা সম্ভবত রাশিচক্রে বিশ্বাস করে এবং এ নিয়ে ব্যবসা করে সহজ-সরল লোকদের ফাঁদে ফেলে। কিন্তু দেশে এবং দেশের বাইরে স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিধারী উচ্চ শিক্ষিত কেউ যে এতটা বোকা হতে পারে এবং অন্যকেও এভাবে বোকা বানাতে পারে নিজে না দেখলে হয়তো বিশ্বাস করতাম না। নিজের দেখা অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে ধর্মের ভিতটা নড়বড়ে হলে শিক্ষিত-অশিক্ষিত যে কেউই এমন ফাঁদে পড়তে পারে।
যাই হোক, এরপর আর দীর্ঘদিন কোন পিকনিকে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। শুনেছি উক্ত ভদ্রলোক এখন বাঙালীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় এবং ভাগ্য ব্যবসায়ও সফল। অন্যের ভাগ্যের খবর জানিনা, আমি আমার নিজের ভাগ্য নিয়ে এখন শংকিত। কারন, কর্মস্থলে উনি এখন আমার নতুন রিপোর্টং বস। সেদিন লটারীর টিকিট বিক্রি করতে এসে ঠিকমত চিনতে পারেননি মনে হয়। কিন্তু এরপর! আমার বান্ধবীর দুষ্টামি কি এখনও মনে রেখেছেন কিনা কে জানে! ভাবছি, নতুন করে আবার কোন গ্যাঁড়াকলে পড়ছি নাতো!
বিষয়: বিবিধ
১৭৩৪ বার পঠিত, ৪৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কিছু পাওয়ার আনন্দটা মনে হয় অন্যরকম। ভালো লাগলো আপনার ছোট্ট অনুভুতিটা। ধন্যবাদ আপনাকে
এক জ্বিনের 'আসর' ব্যবসায়ী একবার আমার কপ্পরে পড়ে বেচারার সব ঝাড়িঝুড়ি ফাস হয়ে যাওয়ার ফলে তার অনেক পুরাতন আস্থানা ত্যাগ করে নতুন আস্তানার সন্ধানে যে গেছে আর কোনদিন তার হদিস মেলেনি।
এখানে একটা লাইন মনে হয় বলতে চান নি ।
এত মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন বলে ধন্যবাদ আপনাকে
মনে করিয়ে দিব ...
রবির প্রভাব .... মানে রবি ঠাকুরের প্রভাব ..রবিন্দ্র সংগীত .. রবীন্দ্র সংগীতের সিডি ... গাড়ির সিডি প্লেয়ারে সেই গান চালিয়ে শুনছিলেন ( রবি ঠাকুরের গান কোন কোন বিখ্যাত নারী কবির মতে ইবাদতের সমতুল্য [নাউজুবিল্লাহ] ) এত বেশী মগ্ন হয়ে .... তারপর ... তারপর !
কিছু মনে প
মনে করিয়ে দিব ...
রবির প্রভাব .... মানে রবি ঠাকুরের প্রভাব ..রবিন্দ্র সংগীত .. রবীন্দ্র সংগীতের সিডি ... গাড়ির সিডি প্লেয়ারে সেই গান চালিয়ে শুনছিলেন ( রবি ঠাকুরের গান কোন কোন বিখ্যাত নারী কবির মতে ইবাদতের সমতুল্য [নাউজুবিল্লাহ] ) এত বেশী মগ্ন হয়ে .... তারপর ... তারপর !
কিছু মনে প
মনে করিয়ে দিব ...
রবির প্রভাব .... মানে রবি ঠাকুরের প্রভাব ..রবিন্দ্র সংগীত .. রবীন্দ্র সংগীতের সিডি ... গাড়ির সিডি প্লেয়ারে সেই গান চালিয়ে শুনছিলেন ( রবি ঠাকুরের গান কোন কোন বিখ্যাত নারী কবির মতে ইবাদতের সমতুল্য [নাউজুবিল্লাহ] ) এত বেশী মগ্ন হয়ে .... তারপর ... তারপর !
কিছু মনে পড়ছে না !? বাংলা সিনেমার মত মাথায় আরেকটা আঘাত করতে হবে ?
আমি অবশ্য এখনও এমন কাউকে দেখিনি। অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
আসলেই গ্যাঁড়াকল। আল্লাহ'র উপর তাওয়াক্কুল করুন।
ভাবছি, নতুন করে আবার কোন গ্যাঁড়াকলে পড়ছি নাতো! - ঐ ভদ্রলোককেই বলুন না দেখে দিতে
ওল্ড ইজ গোল্ড
হায় হায় এদের ১৩ নিয়ে এতো ভয়। হা হা হা
বৃত্তাপুজ্বী আপনার এই গননা কিন্তু অস্বিকার করি না আমি।
কিন্তু এই বিদ্যাটা অনেকে শিখেছেন যারা রিয়াল (ভন্ড) আছেন। তবে (ফেক) ভন্ডের সংখ্যাই বেশি।
আবার অনেকে জ্বীন বশীকরণ এর মাধ্যমে এটা করেন। (পূর্ব ঘটনা বলে দেয়া)
তাই এদের থেকে দুরত্ব অবলম্বন করাটাই ভালো মনে করি।
কিন্তু ভবিষ্যত বানী পুরাটাই ভুয়া।
মজবুত ইমান আল্লাহ আমাদের দান করুন। আমিন।
বৃত্তাপুজ্বী এই ব্যাটাকে কনট্রোলিং হবে টোটালি নিউ এক্সপ্রিয়েন্স
পিকলু পিকুলিয়ার পিকলু ।
জ্বীন ছাড়ানো স্বচক্ষে দেখিনি,বড়দের কাছে বিভিন্ন কাহিনী শুনেছি। অনেক ধন্যবাদ রাহ'বার কে
মন্তব্য করতে লগইন করুন