শেকড়ের সন্ধানে
লিখেছেন লিখেছেন বৃত্তের বাইরে ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ১১:৪১:২৮ রাত
এ বছর অয়নদের বাংলা স্কুলে ভাষা দিবস উপলক্ষ্যে বাচ্চাদের গল্প বলা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। অয়ন গতবার দেশে গিয়ে তার দাদুভাইয়ের কাছে একটা গল্প শিখেছিল। প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাবার সময় সে দাদুভাইয়ের কাছে শুনতো গল্পটা। অয়ন অর্থগুলো ঠিকমত বুঝতে পারতোনা কিন্তু দাদুভাই এত আগ্রহ নিয়ে মজা করে বলতেন যে অয়ন কিছু জিজ্ঞাসা না করে চুপ করে শুনতো। অয়ন এবার স্কুলে গল্প বলা প্রতিযোগিতায় এই গল্পটা বলবে ঠিক করেছে। কি যেন ছিল গল্পটা! ওয়ান্স আপন এ টাইম দেয়ার ওয়াজ এ গার্ল_ অনেকদিন আগে একগুয়া ফুরি আছিল...তারপরে যেন কি...নাহ ঠিক মনে করতে পারছেনা! ইংরেজিতে হলে অনর্গল বলতে পারতো কিন্তু বাংলা অনেক কঠিন লাগে অয়নের। আম্মু তো সারাক্ষণই বকে। আহ অয়ন! দেশে গিয়ে কি সব ভাষা শিখে এসেছো! শুদ্ধ করে কথা বলতে পারোনা। কিন্তু দাদুভাই তো এভাবেই কথা বলে। আমি কি জানি কোনটা ভুল আর কোনটা শুদ্ধ! আম্মু যে কি, সারাক্ষণই বকে। এইতো গতকালও যখন পাশের বাসার আন্টি ফোন করেছিলেন আম্মু তখন নামাজ পড়ছিল। অয়ন আন্টিকে বলেছে, ‘আম্মু ইজ নামাজিং। আর সেটা শুনেও আব্বু, আম্মু দু'জনই হাসছিল। অয়নের বাংলা শুনে সবাই রাগ করে আর হাসে এ জন্যই বাংলা বলতে চায়না অয়ন।
এই সমস্যা শুধু প্রবাসে বেড়ে উঠা অয়নের নয়, দেশেও একই অবস্থা। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া বাচ্চাদের অভিভাবকরা গর্ব করে বলেন, ‘আমার ছেলে/মেয়েটা কেবল ইংরেজি বলে। বাংলা একদম বলতে চায় না। বাসাবাড়িতে সারাদিন চলছে হিন্দী সিরিয়াল। বাসার ছোট বাচ্চাটাও এই সিরিয়াল দেখতে দেখতে হিন্দীতে কথা বলে। নিজের নামের বানানটা ঠিকমত শেখার আগে হিন্দীতে কথা বলা শিখে যায়। উচ্চতর ডিগ্রীর জন্য ইংরেজী তবু মেনে নেয়া যায় কিন্তু হিন্দী কেন! অনেক বাবা-মা ছোটবেলা থেকে বাচ্চাদের ইংরেজিতে এক্সপার্ট করার জন্য বাংলা গল্পের বই পড়তে দেন না। ইদানিং স্কুল, ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা নিজেদের স্মার্টনেস দেখানোর জন্য আড্ডায় বাংলার ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটা ইংরেজী শব্দ জুড়ে দিয়ে কথা বলাটাকে ফ্যাশন মনে করে। ফেসবুকে, মোবাইলের ম্যাসেজ সহ সামাজিক সাইট গুলোতে বাংলা-ইংরেজী মেশানো বিচিত্র সব বাংলিশ ভাষা ব্যবহার করে। কেন দুই লাইন বাংলা লিখতে কি খুব বেশী কষ্ট হয়! সবচেয়ে বড় কথা তাদের এটা নিয়ে মনে কোন মাথাব্যাথা নেই। অথচ এরাই একুশ এলে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘটা করে দিবস পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ইংরেজী অবশ্যই দরকার কিন্তু নিজের মাতৃভাষাকে ভুলে গিয়ে নয়। বরং যে দেশ যত বেশী উন্নত সে তার মাতৃভাষার প্রতি তত বেশী মনোযোগী। প্রবাসে জার্মান, রাশিয়া, চীন সহ বিভিন্ন দেশ থেকে যারা পড়তে আসে তারা নিজের ভাষাটাকে আগে ভালভাবে রপ্ত করে পরে ইংরেজী শিখে। কিন্তু যত আদিখ্যেতা শুধু বাঙ্গালীদের। এখন এমন হয়েছে যে সাধারন একটা বাংলা বানান লিখতে গেলেও মাথা ঘামাতে হয়। প্রবাসে যারা বড় হচ্ছে তাদের কথা না হয় মেনে নেয়া যায় কিন্তু যারা দেশে আছে তাদের এই অবস্থা হবে কেন? ইংরেজী মিডিয়ামে পড়লেই কি বাংলা ভুলে যেতে হবে! ইংরেজী থাকুক ইংরেজীর জায়গায়, মাতৃভাষা থাকুক মায়ের মত। সমস্যা তো নেই।
অয়নের বাবা রফিক সাহেব প্রবাসে এসেছেন অনেক বছর হলো। ছেলেমেয়েদের জন্ম, বেড়ে উঠা সবই দেশের বাইরে। ছুটি পেলে দেশে বেড়াতে যান। তিনি প্রবাসে সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত বলে একুশ এলে তার ব্যস্ততা বাড়ে। প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে ছেলেমেয়েদের নিয়ে শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পণ, বাংলা শেখার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা সহ নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। উনি নিজে এখনও সময় পেলে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল চর্চা করেন। তাঁর ঘরের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে দেশের বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকদের বই শোভা পায়। কিন্তু জীবন জীবিকার জন্য ডলারের পিছনে এতটাই ব্যস্ত সময় কাটান যে ছেলেমেয়েদের কাছে পূর্ব পুরুষদের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলার সময় খুব একটা পান না। ছেলেমেয়েরা জানেনা কিভাবে বাংলা পড়তে বা লিখতে হয়। তারা কথা বলে ইংরেজিতে, স্বপ্নও দেখে ইংরেজিতে। তিনি জানেন, তিনি যখন থাকবেন না পাঠকের অভাবে অযত্ন-অবহেলায় তার এই শখের লাইব্রেরীর বইগুলোর উপর ধুলো জমবে। রফিক সাহেব মনে করেন স্বদেশে বসবাসকারী একজন মানুষের ভাষা বা সংস্কৃতির প্রতি যতটা ভালবাসা বা মমত্ববোধ কাজ করে, তার চাইতেও অনেকাংশে বেশী ভালবাসা বা মমত্ববোধ কাজ করে প্রবাসের অভিবাসী বাঙালীদের ভেতর। জন্মভুমি থেকে দূরে থাকা হয় বলেই হয়তো এতটা অনুভব করে তারা। কিন্তু একই ছাদের নীচে থেকেও পারিবারিক ঐতিহ্য এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা, ব্যক্তিগত আচার-আচরণ, খাদ্যাভাস সব কিছুতে নিজের দেশের মত চলার চেষ্টা করলেও ছেলে-মেয়েরা বেড়ে উঠছে সম্পূর্ণ ভিন্ন মানসিকতা নিয়ে। নিজেরা বাংলা গান শুনা, বাংলা টিভি চ্যানেল দেখা, কমিউনিটিতে বাংলাদেশী কেউ আছে কিনা, কোথায় দেশী দোকান আছে খুঁজে বের করে বাজার করা সব কিছুতে নিজের দেশের প্রতি যে টান অনুভব করেন তা থেকে প্রবাসে বেড়ে উঠা সন্তানরা অনেক দূরে। তাদের চিন্তাভাবনা বার্গার, পিৎজা, আইফোন, আইপ্যাড, কম্পিউটার গেমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই কারন, ঘরের বাইরে শিক্ষক-বন্ধু সবার সাথেই সে কথা বলছে ইংরেজীতে। পাশ্চাত্যের আর দশজনের মতই সে বেড়ে উঠছে। সঙ্গত কারনেই ইংরেজী বলছে কারন, ইংরেজী তাদের ভাষা। তারা বুঝতে পারছেনা নিজের দেশে নিজের ভাষায় কথা বলায় মানসিক কি প্রশান্তি! তারা জানতে পারছেনা বৃষ্টি কাদায় মাখামাখি হয়ে গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে ঘুরে বেড়ানোর কি আনন্দ!
রফিক সাহেব জানেন তাদের দুই প্রজন্মের মধ্যে চিন্তার ব্যবধান অনেক বেশী। আজ তারা আছেন বলে ভাষাটা টিকে আছে। কিন্তু আর কয়েক বছর পর তারা যখন থাকবেন না তখন প্রবাসে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত তৃতীয় প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষাটা হয়তো চিরতরে হারিয়ে যাবে। তিনি মনে করেন বাচ্চাদের জন্য ঘরে অন্তত বাবা-মায়ের সাথে বাংলায় কথা বলাটা বাধ্যতামুলক করা উচিত। ছুটিতে তাদের নিয়ে দেশে যাওয়া, যে যেখানে আছেন নিজেদের দেশের লোকজনের সাথে পরিচিত হওয়া যাতে বাচ্চারা নিজের সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারনা পায়। স্কুলে বা বন্ধুদের সাথে কি করছে তা বাংলায় অল্প করে হলেও শেয়ার করা। বাংলা বলার জড়তা কাটানোর জন্য যেখানে বাংলা স্কুল আছে সপ্তাহে একদিন হলেও সাথে নিয়ে যাওয়া, নিয়মিত চর্চা করানোর জন্য প্রতিদিন বাংলা পেপারের অন্ততএকটা হেডলাইন হলেও পড়ানোর চেষ্টা করা ইত্যাদি। সর্বোপরি মাতৃভাষার চর্চাটা নিজের ঘর থেকেই শুরু হোক। এ ব্যাপারে দেশে এবং প্রবাসে অভিভাবকরা আরেকটু সচেতন হোক, আরও যত্নশীল হয়ে এগিয়ে আসুক। কেননা আমরা যতই বিদেশের অপসংস্কৃতি আঁকড়ে থাকিনা কেন একদিন নাড়ীর টানে আমাদেরকে আমাদের মূল শিকড় বাংলাদেশের কাছেই ফিরে যেতে হবে।
বিষয়: বিবিধ
১৭৪৪ বার পঠিত, ২৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে
ধন্যবাদ আপু সুন্দর লেখার জন্য ।
পড়ে মন্তব্য করার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ
ধন্যবাদ
সুন্দর লিখেছেন আপুনি । অনেক ধন্যবাদ
উত্তরঃ ভাইয়া ঘাড় পাড় নেহিহে ডোরেমন কনসেপ্ট।
এই পুচকাটা ডোরেমন না দেখলে ওর পেটে ভাত যাওয়া কষ্টকর হয়ে যায়।
এর জন্য পুঁচকাগুলোর মা আর বাবাকে মাথায় দুইটা ব্যাম্বোর বাড়ি দিতে পারলে মনটা ভালো হতো।
ভাষার সাথে সাথে ওভার স্মার্ট হয়ে যাচ্ছে যাকে বলে ইঁচরে পাঁকা।
বয়স ছয় বছর। ক্লাস টু এর একটি মেয়ে খাতায় লিখেছে "লাভ মানে ছলনা ইউ আমায় ভুলনা" "এলাহী ভরসা তুমি করো কার আসা? আমি করি তুমার আশা তুমি আমার ভালোবাসা" টমেটো নিয়ে আরেকটা ছন্দ লিখেছিলো বাট সেটা লিখলাম না। নিজের চোখে না দেখলে আমি জিন্দেগীতে বিশ্বাষ করতাম না। কিন্তু নিজের চোখে দেখা।
হায় আল্লাহ আপনি আমাদেরকে পানাহ দান করুন।
আর সিরিয়াল হিন্দী সিরিয়াল অভিশপ্ত কুটনী সিরিয়ালকে না বলি।
লুকিং ফর শত্রুজ
দিস ইজ বেয়াদবি একদম বেয়াদবি
হাসি পায় খুব।
পিলাচ পিলাচ আপনার পোষ্টটিকে।
আমি আমার ঘড় থেকে আলহামদুলিল্লাহ টিভিকে বিদায় দিয়েছি।
এবং অনেক উত্তম নিয়ত করেছি আল্লাহ কবুুল করুন।
সুন্দর পোষ্ট শুকরিয়া।
আজকে আফসোস নেই এই এখন মিস্টি খেয়ে কমেন্ট করলাম।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য রাহবার কে ধন্যবাদ। এখনকার বাচ্চাগুলো অনেক চালাক। দেশের বাইরে বড় হওয়া বাচ্চাগুলো একটু বোকা টাইপের তার চেয়ে দেশের বাচ্চারা বেশী ইচড়ে পাকা। সময় পাইনা,প্রফেশনের সাথেও মিল নেই তাও বাচ্চাদের সাথে কাজ করতে ভালই লাগে
--আচ্ছা ঠিক আছে,এইতো আর একটা লাইন পড়লেই শেষ হয়ে যাবে। টিচার তো মুখস্ত করতে বলেনি
আপনার লেখাটিতে আমাদের সমস্যা তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ
না হলে ওই পিতা মাতাই একসময় অন্য সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠা তাদের সন্তানগুলোর কাছে অপরিচিত হয়ে উঠবে।
ধন্যবাদ আপনাকে, সচেতন মূলক পোস্ট টির জন্য।
প্রবাসে প্রতিটি পিতা মাতা বাংলা নিয়ে সমস্যায় আছে। আলহামদু লিল্লাহ আমিও প্রবাসী থাকি, তবে শুরু থেকে সচেতন ছিলাম বলে ছেলেকে বাংলায় চালু রাখতে পেরেছি। সে বাংলা ইংরেজী দুটোতেই ভাল কথা বলতে পারে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন