তুমি রবে নীরবে
লিখেছেন লিখেছেন বৃত্তের বাইরে ২১ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৬:১৮:২৬ সকাল
১
আজ পদ্ম’র ছ’বছর পূর্ণ হল। পদ্ম তোমার একমাত্র নাতনী। মনে পড়ে আমাদের বড় মেয়ে রুনিকে যেদিন বিদায় দিলে ছেলে মানুষের মত ঘরের দরজা বন্ধ করে সে কি কান্না তোমার! ছেলে ভাল চাকরী করে, শিক্ষিত পরিবার, যৌতুকের পক্ষপাতী নয়। বিয়েতে নগদ অর্থের লেনদেন হয়নি কিন্তু মেয়ের নতুন সংসার সাজিয়ে দেয়া, জামাইকে বিদেশে পাঠানোর খরচ দেয়ার মধ্যে এক ধরনের অদৃশ্য যৌতুকের আদান প্রদান ছিল। ভালোই চলছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকলোনা সংসারটা। কত অত্যাচার যে সহ্য করেছে মেয়েটা তারপরও পারেনি সম্পর্কটা টিকাতে। খুব চেষ্টা করে স্বাভাবিক থাকার কিন্তু আমি তো জানি সবটাই অভিনয়। আর কি নিয়ে বাঁচবে বল পদ্মটাও যে অসুস্থ। হাঁটা চলা, কথা বলা কোন কিছুই স্বাভাবিক নয়। ঘরের কোনে রাখা হুইল চেয়ারটাই তার একমাত্র ভরসা। তোমার মেয়ে ওর নাম রেখেছে ‘জলে ভাসা পদ্ম। আমি তো বুঝি একমাত্র সন্তানকে ঘিরে মায়ের এই হাহাকার। আমার পাশে না হয় তুমি ছিলে কিন্তু কি হবে পদ্ম’র, কে দেখবে ওকে!
২
এখনকার ছেলেমেয়েরা যারা বিয়ে করছে তাদের সাথে আমাদের সময়কার বিয়ের বিরাট পার্থক্য। যারা বিয়ে না করে লিভ টুগেদার করছে তারা তো বিয়ের পবিত্র বন্ধনকে অস্বীকার করছে। আর যারা সমসেক্সে বিয়ে করছে তারা বোধহয় বিয়ের সংজ্ঞাটাকেই বদলে ফেলেছে। সমসেক্সে বিয়ের কথা শুনলে মনে হয় আধুনিকতার জোয়ারে ভেসে বাল্যবিবাহ, সতীদাহ, যৌতুক প্রথা থেকে উঠে এসে এ কোথায় আটকে গেলাম আমরা! অবাধ মেলামেশা, পরকীয়ার কারনে সম্পর্কের বন্ধনগুলো কেমন যেন হালকা হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। কত তুচ্ছ কারনে ভেঙ্গে যায় সংসার! এত দেখেশুনে বিয়ে দিয়েও সংসার টিকেনা। অথচ আমাদের সময়ে এত যাচাই-বাছাই করার সুযোগ ছিলোনা। পরস্পরের উপর ভরসা করে কাটিয়ে দিয়েছি সারাটি জীবন। মনে আছে আমাদের সেই প্রথম দেখার কথা! জীবন নিয়ে প্রচণ্ড আশাবাদী একজন তরুন যে দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম ছেড়ে এই ইট কাঠের শহরে এসে কোনরকম মাথা গোঁজার জন্য একটু আশ্রয় খুঁজছিল। উস্ক খুস্ক চুল, ক্লান্ত মলিন চেহারা, গায়ের জামা, পায়ের স্যান্ডেল জোড়া সব কিছুতেই দারিদ্রের ছাপ কিন্তু চোখ দুটো আসাধারন দীপ্তিময়। কি জানি বাবা জ্ঞানী মানুষ ছিলেন বলেই হয়তো ওই চোখের দিকে তাকিয়ে ভিতরের মানুষটিকে চিনতে পেরেছিলেন। তা না হলে জানা নেই শোনা নেই এক দেখাতেই এমন অপরিচিত কাউকে তাঁর একমাত্র মেয়ের জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পারে! পৃথিবীর অন্য সব বাবার মত এই বাবাটিও চেয়েছিলেন অন্তত একটি দিনের জন্য হলেও তার এই অসুস্থ মেয়ের মুখে হাসি দেখতে। বাবাকে অনেক স্বার্থপর মনে হয়েছিল সেদিন। কিন্তু কেন জানি আমারও নতুন করে খুব বাঁচতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। হয়তো নতুন করে বাঁচার স্বপ্নে আমিও ক্ষণিকের জন্য স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর আর কি! শুরু হল নতুন জীবন, একসাথে পথচলা। আমি সোজা হয়ে কখনও দাঁড়াতে পারিনি, সুস্থ মানুষের মত দু’পায়ে ভর করে চলতে পারিনি, হাত দুটোই ছিল একমাত্র ভরসা। কিন্তু তুমি শিখিয়েছিলে কি করে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়। আমায় নিয়ে কেউ উপহাস করলে সাথে সাথে আমার সমর্থনে দ্রুত অগ্রসর হতে তুমি-এর মধ্যে থাকতো তীব্র বিশ্বস্ততা। এক সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত ছিল পরম সুখের। কিন্তু অভাগীদের কপালে সুখ বেশীদিন সয়না। একে একে ঘর আলো ছেলেমেয়েরা এলো। আর তুমি চলে গেলে অসময়ে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে।
৩
তোমার বড় ছেলেটা অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরে আজ অবধি বিয়ে থা করলো না। তুমি নেই, অভাব অনটনের সংসারে স্বচ্ছলভাবে চলতে বিদেশে পাড়ি জমাতে হল। পড়াশুনাটা শেষ করতে পারলে আজ পাশের বাড়ির বাবুর মত অনেক বড় অফিসার হত। শুনেছি বাবু নাকি বিদেশী এক মেয়েকে বিয়ে করেছে। বাবুর মা মাঝে মাঝে দুঃখ করে বলে ‘একটাই ছেলে, ভেবেছিলাম সুন্দর দেখে একটা মেয়েকে ছেলের বউ করে আনবো, নাতি-নাতনি নিয়ে শেষ জীবনটা সুখে কাটাবো কিন্তু সেই সুখ আর কপালে জুটলোনা। মন খুলে দুইটা কথা কি বলবো আজ পর্যন্ত দেখতেও পারলাম না। ছেলের কাছে শুনি ঐ দেশে নাকি বাবা-মা সন্তান জন্ম দেয়ার পর ১৮ বছর পর্যন্ত ভালো মন্দ জানার অধিকার রাখেন। ১৮ পার হলে সব শেষ। রক্তের একটা টান, ভালোবাসার টান মানুষকে কাছে নিয়ে আসে। বিশেষ করে বাবা মা সন্তানের চেহারাটা দেখে স্বর্গসুখ অনুভব করে তা কি ওরা কখনো বুঝতে পারবে! তারপরও ওরা সুখে থাক মা হিসেবে এই কামনা করি। এছাড়া আর কি করবে বলো! আপাকেও তো এ নিয়ে উঠতে বসতে কম কথা শুনতে হয়না! ছেলেমেয়ে মানুষ করতে পারলেনা। তুমি যেমন তোমার ছেলেও হয়েছে ঠিক তেমনি। কথা শুনলে মনে হয় যেন মায়েরা ইচ্ছে করে ছেলেমেয়েকে অন্যায়ের পথে ঠেলে দেয়। এটা আমাদের সমাজের রীতি, সংসারে কিছু হলে প্রথম ঝড় ঝাঁপটা সামলাতে হয় মায়েদের। এসব দেখে ভয় হয় নাবিলার জন্য। সারাক্ষন বিয়ে নিয়ে ভাইয়ের সাথে লেগেই আছে। ওই শোন, এখনো বুঝি লেগেছে দু’জনে ফোনে...
৪
--কিরে! এমন টেনে কথা বলছিস যে! কি যে সব ছাইপাশ মাখিস মুখে! এসব উপটান মেখে যদি ফর্সা হওয়া যেত তাহলে আফ্রিকায় আর একটাও কালো মানুষ থাকতনা ।
--কি করবো বল ভাইয়া! সবাই যে সুন্দরী পাত্রী চায়! দাদী সারাদিন খোঁচায়, দেখ্ হীরার জামাই ...! কী সো-ন্দ-র ধলা মুখ! চশমা লাগাইয়া হীরার লগে ঘোরে কি সোন্দর দেহা যায়! আহা, হীরার কি ভাইগ্য!
-সারাদিন খালি বিয়ে নিয়ে চিন্তা...
-হুম...কারন, মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ গঠনের প্রয়োজনে তার উচিত বিয়ে করা বুঝলি!
-এহ পণ্ডিত! এত বুঝিস তাহলে করিস না কেন বিয়ে
-শোন ভাইয়া। ছেলেরা বিয়ে করে আর মেয়েদের বিয়ে হয়। মেয়ের ব্যাপারে অভিভাবক এবং পাত্রপক্ষ যখন ইচ্ছে করবে তখনই বিয়ে হবে।
-তা তুই কি চিরকুমার সভায় যোগ দিয়েছিস! চুল তো সব উঠে মাথা খালি হয়ে যাচ্ছে। তুই করে ফেললে তো রাস্তাটা ক্লিয়ার হয়। তুই করিস না কেন বিয়ে!
-হুম...কারন, মানুষ সামাজিক জীব। বিয়ে মানেই ঝগড়াঝাটি, অশান্তি তাই সমাজের ভাঙ্গন রোধে মানুষের উচিত বিয়ে না করা। হা হা হা।
৫
দেখলে তো! কেমন পাগল তোমার ছোট মেয়ে! সারাক্ষন বিয়ে নিয়ে লেগেই আছে ভাইয়ের সাথে। মাঝে মাঝে চিন্তা করি ওর বিয়ে হলে আমি কি নিয়ে থাকবো। একা থাকি তাই ভয় হয়। ষাট পেরিয়ে সত্তর ছুঁই ছুঁই। ছেলেমেয়েরা যে যার মত তাদের জীবনকে গুছিয়ে নিয়েছে। জীবনের শেষ বেলায় পৌঁছে কোথায় যেন একটা শূন্যতা বোধ করি এখন । মাঝে মাঝে চোখের কোনে জলের অস্তিত্ব টের পেয়ে আঁতকে উঠি। আজকাল কেন জানি খুব বেশী মনে পড়ে তোমাকে। লিখতে লিখতে খেয়াল করিনি কখন যেন মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতে শুরু করেছে নীল রঙের আকাশ। অন্ধকার কেটে গিয়ে হালকা চাঁদের আলোয় মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে বাড়ির দেওয়াল, গাছের পাতায়। কোথা থেকে যেন অচেনা ফুলের মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে আসছে। হঠাৎ কেন জানি মনে হল ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে ভিজে পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটছি দুজনে। আর তোমার কণ্ঠে তোমার প্রিয় সেই গানটা...
‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমা নিশীথিনী-সম॥
....................................
..........................................
বিষয়: বিবিধ
৩৩২৭ বার পঠিত, ৯২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনুবাদ না করলে কিছুই মনেহয় বুঝতাম না @লুকোচুরি লুবোচুরি গল্প
বেশ ভালো লাগলো। আরও বেশি বেশি লিখার আহ্বান রইলো
অনেক অনেক শুকরিয়া শুভকামনা রইলো সবার জন্য
এত কষ্ট কেন করছি জানেন? আপনি যেন নিয়মিত (যখনই সময় পান) লিখেন। আপনার লেখা অনেক ভালো লাগে।
ভালোই পারবা
এই লাইনটা আমিও রবি ঠাকুরের গান হইতে চুরি করিয়াছি তাই অপরাধ মার্জনীয়
চলেই যাচ্ছে...........................
দারুন ...................................
আলহামদুলিল্লাহ ....................
বেশি বেশি লিখুন....................
এক মুহুর্তে ছেলে পছন্দ করা সহজ যদিও ইলেকট্রনিক্স এর মত ওয়ারেন্টি লাগেনা। (এস্তেখারা)
আমি এরাদা করলাম আমার বিয়েতে ইনশাআল্লাহ একটি ফুটা পয়সাও আগে এবং পড়ে নিবনা। এবং মনেও কোনো আকাংক্ষা নেই আলহামদুলিল্লাহ । শ্বশুরবাড়ি থেকে কারো কিছু নেয়াকে আমি সবসময়ই তাদের ব্যাক্তিত্বের নিচুতা হিসেবেই মনে করি।
বাহ্ বেশ চমৎকার লিখনী শুকরিয়া বৃত্তাপুজ্বী।
এই নিন ফুলকপি আর ধনে পাতা সবজি পাক করুন সাথে একটু জামাল গোটা দিয়ে দিয়েন ঐ ভীলেনটাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব আমার।
১, আমার প্রিয় একটি লেখা আপনার প্রিয়তে।
২, প্রথম মন্তব্যের জবাব
ভালোই পারবা
ধন্যবাদ। আপনার কফি হাউস তো অসাধারণ হয়েছে।
আমার অফিসের কলিগদের কর্মকান্ড নিয়ে লিখেছিলাম। কফি হাউস কে ঘিরে প্রাণচঞ্চল মানুষগুলোকে দেখতে ভাল লাগে তাই লেখা। আপনার ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগলো। শুভেচ্ছা জানবেন
আওন রাহ'বার তাত্তু তুমি তো সুদু ফুল কেতে পাব্বা না, তাই তোমাকে কেকওয়ালা ফুল দিলাম এতা কাও। আল সবাইকে দিও, ওঁলাও কাবে।
তাক আমি তুব তুসি । আমাল এত্তা তাত্তু পেয়ে।
তবাই বাক কলে তাই আতুন।
আলো বেতি মদা
একনও আম্মুল মাইল কাই।
গুমুতে দাই।
সালাম।
লজ্জা পাইছি। আসলে নাম দেখে বোঝার উপায় থাকেনা ভাই নাকি বোন
আসলে পাশে থাকাই সাথে থাকা নয়। অনেকে আজীবন পাশাপাশি থেকেও সাথে থাকেনা, আর অনেকে কয়েক মূহূর্ত পাশে থেকেও যেন সারাজীবনে ছেয়ে যায়
আপনাকে ফেবুতে কিভাবে পাই বলুন তো, কথা বলা দরকার
ফেসবুকে আমি নেই। ইমেইল এড্রেস দিলে যোগাযোগ করতে পারি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন