অতঃপর অরিন্দম কহিল বিষাদে...

লিখেছেন লিখেছেন বৃত্তের বাইরে ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০১:৫৪:০৯ রাত

জ্ঞান অর্জন ভালো লাগে। বরং ঘরের কাজ করার আলসেমীর কারনে মাঝে মাঝে মনে হয় অন্য কাজে ফাঁকি দিয়ে সারাদিন বই নিয়ে বসে থাকতে পারলে মন্দ হতোনা! কিন্তু জ্ঞানার্জনের নামে পরীক্ষা, অ্যাসাইনম্যান্ট, প্রেজেন্টেশন এর ধকল আর ভাল লাগেনা। কখনও পরীক্ষার বাড়তি চাপে মন হালকা করার জন্য বলে ফেলি, ‘হে আল্লাহ! রহম করেন আমার প্রতি, আমি আর পড়তে চাইনা। পরীক্ষার টেনশনে গত কয়েকদিন টিভি, ইন্টারনেট, বিনোদনজগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকায় মনে হচ্ছিল মাথা থেকে পরিক্ষা নামক বোঝাটা নামিয়ে ফেলতে পারলে জীবনটা আরও অনেক হাসি আনন্দে পার করা যেত। একদিকে দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কখন দেশ থেকে কি খারাপ খবর আসে এই আতঙ্কে দিন কাটে অন্যদিকে বছরের শেষে অফিসে কাজের চাপ, পড়াশুনা, তার উপর প্রকৃতির বৈরি আচরন। সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে একবার বাড়ির সামনে বরফ পরিষ্কার করে ঘর থেকে বের হতে হয়, আবার রাতে বাসায় ফিরে হাঁটু সমান বরফ পরিষ্কারের উদ্দেশে যখন বের হতে হয় তখন ছেলেবেলায় কোন কাজকর্ম দায়দায়িত্ব ছাড়া বাবার হোটেলে ফ্রি খাওয়ার কথা মনে হয়। মনে পড়ে সেই সময় কোন কাজ করতে না চাইলে বান্ধবীরা দুষ্টামি করে বলতো বাবার সংসারে ফ্রি খাও তাই গায়ে লাগেনা নিজের ঘাড়ে পড়লে বুঝবে কেমন লাগে! আসলে তাই, নিজের ঘাড়ে না পড়লে দায়িত্ব কি জিনিস বুঝা যায়না। নিত্যদিনের কাজের মধ্যে যে কাজটা নিতান্ত অনিচ্ছার সাথে একান্ত বাধ্য হয়ে করতে হয় তার একটা হল ড্রাইভিং। ড্রাইভিং এ অনীহার একমাত্র কারন হল সবসময় ইন্দ্রিয়কে সজাগ রেখে, মস্তিষ্ক ঠাণ্ডা রেখে সতর্কতা অবলম্বন করে চলা যা কিনা আমার মতো অস্থির চিত্তের অধিকারীনির পক্ষে মাঝে মাঝে কঠিন হয়ে পড়ে।

দৃশ্য-১

নিয়মমাফিক সেদিনও অফিসের পর ভার্সিটিতে ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। বের হয়ে দেখি বাইরে অঝোর ধারায় স্নো ঝরছে। সকাল থেকেই রেডিওতে বারবার বলছিল খুব প্রয়োজন না পড়লে বের না হতে। উপায় নেই পরিক্ষা ছিল। সাথে ছিল আমার এক বান্ধবী। রাতে ফেরার সময় দেখলাম চারদিকে বরফের সমুদ্র। পারকিং লটে, রাস্তায় অনেকের গাড়ি আটকা পড়ে আছে। সারাদিনে রেকর্ড সংখ্যক এক্সিডেন্টও হয়েছে। যাই হোক, পরীক্ষার পর দোয়া পড়তে পড়তে কোন রকম রওয়ানা দিলাম। চশমা ছাড়া এমনিতেই দূরে কম দেখি, তার উপর জিরো ভিজিবিলিটিতে সামনে কিছু দেখার উপায় নেই। গাড়ি চালাতে হচ্ছে অনেকটা অনুমানের উপর ভিত্তি করে। এদেশে কোন কারন ছাড়া কাউকে পিছন থেকে হর্ন দেয়ার নিয়ম নেই, কাউকে হর্ন দেয়া মানে অপমান করা। কিন্তু এদিন সবাইকে বাধ্য হয়ে এই নিয়ম ভঙ্গ করতে হল। মনে মনে ভাবলাম, পিছন থেকে কেউ হর্ন দিলে দিক দরকার হয় পাশ কাটিয়ে চলে যাবে কিন্তু আমার গাড়ি যেন রাস্তায় না আটকে যায়। দোয়ার ফল বেশীক্ষন কার্যকর হলনা। রাইট টার্ন নিতে যেয়ে গাড়ির সামনের চাকা স্লিপ করে খাম্বার সামনে বরফের মধ্যে আটকে গেল। ভাগ্যিস আমাদের দেশীয় খাম্বা ছিলনা তাই গাড়ির উপর ভেঙ্গে পড়েনি। কিন্তু গাড়ির চাকা এমনভাবে বরফের মধ্যে আটকে গেল যে কারো সাহায্য ছাড়া বের করা সম্ভব ছিলনা।

দৃশ্য-২

অনেক এলাকায় ভারী তুষারপাতের কারনে পাবলিক বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। প্রথমে ফোন করলাম বাসায়, রিসিভ করলেন আমার ভগ্নীপতি। ভগ্নিপতি মানুষ হিসেবে খুবই ভাল, অমায়িক। আমি উনাকে ডাকি বাংলা সিনেমার নায়ক। বাংলা সিনেমার নায়কদের মত উনি সবসময় সব পরীক্ষায় প্রথম হন। পড়াশুনা, জ্ঞানার্জন ছাড়া জাগতিক কোন বিষয় তাকে তেমন স্পর্শ করতে পারেনা। যে কোন পরিস্থিতিতে তিনি কিভাবে যেন বরফ শীতল থাকতে পারেন। টিভির খবর, পেপার এত গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং পড়েন দেখলে মনে হবে এটাও ওনার পিএইচডির একটা পার্ট। আমার গাড়ি রাস্তায় আটকে আছে, ঠাণ্ডায় জমে বরফ হয়ে যাচ্ছি এই খবর শুনে বললেন, ‘ও আচ্ছা!’ উত্তরটা শুনে বুঝতে পারলাম, উনি এ মুহূর্তে দেশের বা বহির্বিশ্বের কোন গুরুত্বপূর্ণ খবর গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছেন তাই কেয়ামত হলেও টের পাবেননা।

ফোন দিলাম পাশের বাড়ির আপাকে। আপা প্রবাসে আমাদের অভিভাবকবিহীন সংসারে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে আমাদের দুই বোনকে মায়ার বন্ধনে আগলে রেখেছেন। কথা বেশী বলেন কিন্তু মনটা ভাল। রাত দেড়টায় ফোন করলেও ওনাকে পাওয়া যায়। আপা যেমন ভাল তেমনি তার পরিবারের সদস্য বিশেষ করে তার ছেলে পুরা ভিলেন। প্রথমদিন থেকেই তার সাথে আমার শত্রুতার কারনে আমি তাকে দেখতে পারিনা। পাঠক আবার ভাববেননা চশমা ছাড়া চোখে কম দেখি বলে জলজ্যান্ত মানুষও চোখে দেখিনা। তাকে দেখতে না পারার একমাত্র কারন হল তার ব্যবহার। যাই হোক, সবসময় ফোন করলে আপা রিসিভ করেন সেদিন দিনটা খারাপ ছিল বলে ফোন রিসিভ করলো তার ছেলে। বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না তাও বললাম আমার গাড়ি আটকে আছে কারো সাহায্য দরকার। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে উত্তর এল ‘বাড়ির মেয়েরা রাত পর্যন্ত বাইরে থাকলে সংসার করবে কখন? বলেই রিসিভার রাখার শব্দটা এত জোরে কানে এসে লাগলো মনে হচ্ছিল খুন করা পাপ না হলে আমি ঐ মুহূর্তে একটা খুন করে হাসিমুখে জেলে যেতাম। আশেপাশে টিমটিমে আলো আর চারদিকে সব সাদা বরফে ঢেকে যাওয়ায় জনমানবহীন এলাকাকে মনে হচ্ছিল ভুতুড়ে এলাকা। এমনিতে এদেশে গাড়ী ছাড়া রাস্তায় মানুষ চলাচল খুব একটা চোখে পড়েনা, তার উপর শীতের রাত তাই সাহায্যের আশায় কাউকে দেখব প্রশ্নই আসেনা। আর কাউকে ফোন করবোনা এই জেদ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখলাম আমার বোন পাশের বাড়ির আপাকে নিয়ে চলে এসেছেন। তিনজনে মিলে গাড়ি সরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে গাড়ি ওই অবস্থায় রেখে রওয়ানা দিলাম।

দৃশ্য-৩

ড্রাইভিং সিটে বসা ছিল আপা। প্রথমে আমার বান্ধবীকে নামানোর পালা। কোন রকম ড্রাইভ করে বান্ধবীর এলাকার কাছাকাছি যাওয়ার পর হঠাত করে ঝোপের আড়াল থেকে আওয়াজ দিয়ে লাইট জ্বালিয়ে পুলিশ মামা সামনে এসে দাঁড়ালেন। পুলিশ অফিসার ক্যামেরা নিয়ে ঝোপের আড়ালে বসা ছিল। ক্যামেরায় ধরা পড়েছে গাড়ি ৫ কিমি বেশী চলছিলো। মানে ঐ এলাকায় ৫০ কিলোমিটারের জায়গায় ৫৫ কিমি থাকাতে আপা একটা টিকিট খেলেন। অন্যদিন হলে হয়তো এমন হতোনা সেদিন আবহাওয়ার কারনে ড্রাইভারদের অতিরিক্ত সাবধান হওয়ার জন্য মামাদের এই সতর্কতা। আপা রাগে গজগজ করতে করতে সামনে এগোলেন। ওনার কাণ্ড দেখে আমাদেরও হাসি পাচ্ছিলো। আমাদের হাসি দেখে আপা আরও রেগে গিয়ে অতিশুদ্ধ বাংলায় বললেন, ‘ দেখেছো! বেশী হেসেছো তাই বিপদে পড়েছো’। হাসির সাথে বিপদে পড়ার কি সম্পর্ক বুঝতে পারলামনা তবে মনে পড়লো স্কুলে পড়ার সময় এক শালিক দেখলে বান্ধবীরা বলতো আজ কপালে দুঃখ আছে, দুই শালিক দেখলে সুখ। তাই আমরাও দুই শালিক খোঁজার জন্য ব্যস্ত হয়ে যেতাম। এদেশে তো সামারেও পাখি দেখা যায়না, শীতে দেখব এটাও দুরাশা। সকালে কার মুখ দেখে বের হয়েছিলাম জানিনা তবে পুরো একটা খারাপ দিনে প্রশান্তি এতটুকুই এ বছরের জন্য পরীক্ষা শেষ হয়েছে, বাকি দিনগুলো পরীক্ষার ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়া গেল এটা ভেবে অনেকটা হালকা লাগছিল।

কিছুদূর যাওয়ার পর আপার মনে হল টিকেট খাওয়ার ঘটনাটা এই মুহূর্তে বাসায় না জানালে ওনার পেটের ভাত হজম হবেনা। উনি সেলফোনে কথা বলতে বলতে ড্রাইভ করছেন। আমি আমার বোনকে বললাম,‘ তোর এই আপার কপালে আজ শনি ভর করেছে। ড্রাইভ করার সময় সেলফোনে কথা বলার জন্য আরেকটা টিকেট খাবে। যা ভাবলাম হলোও তাই। বাড়ির সামনে এসে নামার পর আরেক অফিসার লাইট জ্বালিয়ে সামনে এসে হাতে টিকেট ধরিয়ে দিলেন। আপার করুন অবস্থা দেখে আমাদেরই খারাপ লাগছিল। আমাদের নিতে এসে একের পর এক টিকেট খাচ্ছেন। একই দিনে দুই টিকেট খেয়ে আপা মনের দুঃখে অফিসার কে বললেন, ‘ড্রাইভ করার সময় সেলফোনের পরিবর্তে ব্লু টুথ ব্যবহারে কি কোন আইন আছে? অফিসার চলে যাওয়ার সময় বলে গেল, ‘সরি, ড্রাইভ সেফলি’।

বিষয়: বিবিধ

৩২২২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File