কফি হাউসের আড্ডা

লিখেছেন লিখেছেন বৃত্তের বাইরে ২৩ নভেম্বর, ২০১৩, ০১:৩৯:২৬ রাত



পাশ্চাত্যে লোকজন বাঙালির মত এত আড্ডা-প্রবণ নয়। আড্ডা দিতে চায়ও না কারণ তারা কথাবার্তার ব্যাপারে খুবই ফর্মাল এবং কনজার্ভেটিভ। কখনও কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করে না। মানুষের বিয়ে-শাদি, ছেলেমেয়ে, কাপড়-চোপড়, সাজ-গোজ, পেশা – বিশেষ করে বেতন, আর্থিক অবস্থা, গাড়ি-বাড়ি কিনলে তার দাম ইত্যাদি কখনোই জানতে চাইবে না। তারা ধর্ম বিশ্বাস ও তার চর্চা এবং রাজনৈতিক মতামত বা মতাদর্শ ইত্যাদি ইস্যুকেও মানুষের একান্তই ব্যক্তিগত বিষয় মনে করে। জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনে কে কাকে ভোট দিল এটাও আলোচনার বাইরে। কারো সাথে দেখা হলে একটু হেসে হাই বা হ্যালো বলে খেলাধূলা, দিনের আবহাওয়া, ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এতে কথাও হল, আবার কারো সাথে তিক্ততা সৃষ্টিরও কোনো সুযোগ থাকল না। চারদিকে বরফে ঢাকা এমনি হাড় কাঁপানো শীতের সকালে একটু উষ্ণতার ছোঁয়া পেতে সবাই একসাথে মিলিত হয় উত্তর আমেরিকা আর কানাডার একটি অন্যতম বৃহৎ ও জনপ্রিয় কফিশপ “টিম হরটন” এ।

কানাডা আমেরিকার আনাচে কানাচে, পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে এই কফিশপ। এটি একটি চেইন ষ্টোর। অন্যান্য জায়গার মত ট্রেন থেকে নেমে শপিং মলের ভিতর দিয়ে কিছুদূর হাঁটলেই ১৮ তলা ভবনের দোতলায় প্রতিদিন সকালে ৫-১০ মিনিটের কফি ব্রেকের আড্ডায় মিলিত হয় অফিসে কর্মরত সবাই। সেই সাত সকালে অর্থাৎ সকাল ৬:৩০টায় সবার আগে টিম হরটনে এসে হাজির হয় অফিসের ডিরেক্টার ‘ডেভিড। গম্ভীর, সময়ের প্রতি খুব সচেতন। সব সময় ঘড়ির কাঁটা ধরে চলাফেরা করে। অফিসে কাজ শেষে ঠিক ৩:৩০টায় বের হয়ে যায়। একদিন দেখা গেল কম্পিউটার বন্ধ করে সবাইকে বাই বলে লিফট পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে এসে রুমে গিয়ে কম্পিউটার খুলে বসেছে। কারন জিজ্ঞেস করাতে বলল, এখনও ৩:৩০টা বাজতে আরও পাঁচ মিনিট বাকী তাই ভাবলাম ই-মেল টা চেক করে যাই। এই ঘড়ির কাঁটায় চলা লোকটির সাথে সাপ্তাহিক মিটিংয়ে সবাই তাই আগে থেকে সচেতন হয়ে কনফারেন্স রুমে গিয়ে বসে পড়ে যাতে এক চুলও এদিক সেদিক না হয়।

এই অফিসে রয়েছে সাদা, কালো, বাদামী, হলুদ বর্ণের নানা ভাষাভাষী মানুষ। সবচেয়ে বেশী জায়গা দখল করে আছে চাইনিজরা। এরা মিশুক, খেতেও পছন্দ করে। চাইনিজদের সম্পর্কে একটা প্রবাদ চালু আছে এরা টেবিলের উপরে এবং তলায় কোন কিছুই বাদ দেয়না, যা আছে সব খায়। তারপরেও স্লীম। ইদানিং প্রজেক্ট ম্যানেজার ‘ববি’ও ডায়েট করছে এবং আশ্চর্যের বিষয় হল ৩ মাসে শরীরের মেদও অর্ধেক ঝরিয়ে ফেলেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ববির চার ছেলেমেয়ে এবং সে এত মোটা দেখে তার হাজব্যান্ড ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে। কিন্তু স্লীম হওয়ার পর সে দেখতে এত আকর্ষণীয় হয়েছে যে এখন তাকে আবার বিয়ে করার জন্য অন্যদের সাথে তার আগের হাজব্যান্ড ও প্রস্তাব দিচ্ছে। ববি’র স্লীম হওয়া দেখে অফিসে আগে যারা ‘মেদ ভুরি কি করি” এই বিজ্ঞাপন দেখে কাজ হবেনা ভেবে হতাশ হত তারাও স্লীম হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সবাইকে হাসি আনন্দে মেতে থাকতে দেখলে যার সবচেয়ে বেশী কষ্ট হয় সে হল ‘ডায়ানা। তার ক্যান্সার ধরা পড়ায় অফিস থেকে ৬ মাসের ছুটি নিয়েছে। মন খারাপ দূর করার জন্য ডায়ানার জন্য অফিসে একটা সারপ্রাইজ পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। এমনিতে অফিসে কারো জন্মদিন থাকলে তার জন্য সারপ্রাইজ পার্টির আয়োজন করা হয়। যার জন্মদিন তার অনুপস্থিতিতে অন্যরা সবাই বেলুন আর ফুল দিয়ে তার ডেস্ক সাজায়, পরে সবার ম্যাসেজ লেখা একটা কার্ড গিফট করা হয়। বেশীরভাগ সময় এসব আয়োজন করে ‘রবার্ট’ যে কিনা অফিসের মধ্যে সবচেয়ে হাসিখুশি, প্রানবন্ত। হ্যাংলা, রোগা টাইপের কিন্তু সবাই তাকে মজা করে ‘টাইগার’ ডাকে। এই ‘টাইগার’ মাঝে মাঝে মজার সব কাণ্ড করে। একবার মিটিংয়ে নতুন প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, ডিরেক্টার ‘ডেভিড’ গম্ভীর মুখে তার প্রেজেন্টেশন দিচ্ছিলেন। এক ফাঁকে ‘রবার্ট’ এর অমনোযোগীতা লক্ষ্য করে ডেভিড বললেন, ‘প্রেজেন্টেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে আই কন্টাক্ট! রবার্ট তুমি কি জানো কখন আই কন্টাক্ট করতে হয়?’ আরও গম্ভীর মুখ করে রবার্টের নিষ্পাপ উত্তর ‘যখন কেউ প্রেমে পড়ে!’ সেদিন রুমের সবাই গম্ভীর ডেভিডের মুখে প্রথম হাসি দেখেছে তাও উচ্চ স্বরে। অফিসে একটা নিউলি ম্যারেড কাপল আছে যারা সবসময় হাত ধরে হাঁটে। তাদের বিয়েতে সবাই কোন গিফট দিতে চাইলে তারা বললো, ‘প্লিজ কোন গিফট নয়, হ্যাঁ কিছু দিতে চাইলে আমাদের কফি অফার করতে পারো কিন্তু কফি মেশিন না। তাই শেষ পর্যন্ত সবাই তাদেরকে গিফট কার্ড দিয়েছে। বিয়ে সংসার নিয়ে ইদানিং সবচেয়ে টেনশনে আছে নাতাশা। রাশিয়া থেকে তার শ্বাশুড়ি বেড়াতে এসেছে। আর এসেই শুরু হয়ে গেছে ছেলের বউয়ের সাথে খুনসুটি। প্রতিদিন তাদের বউ-শ্বাশুড়ির মান অভিমানের গল্প শুনে ভারতের রিতু হেসে খুন। ‘বল কি! তোমাদের সংসারেও এমন হয়। গায়ের রঙয়ে আমরা ভিন্ন কিন্তু বউ-শ্বাশুড়ির দ্বন্দ্ব দেখি সব জায়গায় এক!

এভাবেই প্রতিদিন মানুষগুলির জ়ীবনের সুখ-দুঃখের নানা রূপ কাহিনী নিয়ে টিম হরটনে মেলা বসে। প্রতিদিন ভোরে ক্রেতাদের ভিড়ে কাউন্টারে লম্বা লাইন, দম ফেলার ফুরসত নেই বিক্রেতাদের। কম বয়সী ছেলেমেয়ে আর কাজমুখো নারী পুরুষের ভীড় জমে। থাকে কফি, ডোনাট আর স্যান্ডুইচ এর রকমারি আয়োজন। বসে খাবার সময় নাই কারোর। কফি হাতে ছুটে সবাই মেট্রো আর বাস পানে। ৯টার পর আসতে থাকে স্কুল বা ডে কেয়ারে বাচ্চাদের পৌঁছিয়ে ঘরমুখো মায়েরা। আসতে থাকে ভোর থেকে এ অবধি কর্মরত নারী পুরুষ। আসে কিছু বুড়ো- বুড়ি। কেউ নিঃসঙ্গ, কেউ বা সঙ্গীর সাথে। কর্নারের নিরিবিলি কোন একটা টেবিল দখল করে ঘণ্টা ধরে চলে তাদের ফেলে আসা জীবনের আনন্দ-বেদনার সাতকাহন। একাকী বসে খবরের কাগজ উল্টায় অনেকেই। অনেক পড়ুয়া পড়া তৈরী করে প্রিয় কোনো ফ্লেভারের কফির কাপ সামনে রেখে, laptop এ একাগ্র চিত্তে কাজ করে কেউ কেউ। সময় গড়িয়ে যায়, ঘড়ির কাঁটা ১২টার কাছাকাছি পৌঁছাতেই লাঞ্চ করতে আসে হাই স্কুল এবং কলেজে পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা। এভাবে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা থেকে রাত অব্ধি ক্রেতা বিক্রেতার কোলাহলে মুখরিত থাকে টিম হরটনের প্রাঙ্গন।

সারাদিন কোথাও মায়ের হাত ধরে আসা ছোট্ট শিশুকে সামলাতে ব্যস্ত মা, কোথাও লাঠি হাতে কোনো বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা, কোথাও কাজ ফেরত ক্লান্ত পথিক, কোথাও নানা রঙয়ের চুল আর উদ্ভট পোশাক পরিহিত ক্লাস ফাঁকি দিয়ে নিচু স্বরে কথা বলা প্রেমিক-প্রেমিকা, কোথাও বা ভার্সিটির প্রজেক্টের কাজে আলোচনায় রত ৪/৫জনের দল, আবার কোথাও কোন নিঃসঙ্গ, দুঃখী হতাশ মুখ। এ যেন সবার মিলনমেলা চিরসাথী টিম হরটন। এভাবে সারাদিন ধুমায়িত কাপ আর উচ্ছসিত আলাপ আলোচনায় নানা বয়সের আর বর্ণের পদচারনায় সময়ের সাথে বয়ে চলে কফি হাউসের আড্ডা।

বিষয়: বিবিধ

২১৫২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File