বিপন্ন মানবতা
লিখেছেন লিখেছেন বৃত্তের বাইরে ১৮ আগস্ট, ২০১৩, ০৮:১২:৩৪ রাত
কিছুদিন আগে দেশের জাতীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় দেখলাম কোন এক গ্রামে নাম পরিচয়হীন এক যুবকের লাশ কয়েক টুকরা করে অপরাধীরা বিভিন্ন জায়গায় ফেলে রেখে যায়। উক্ত যুবকের বাড়ীতে সম্ভবত কোন পোষা কুকুর ছিল সে তার মনিবের লাশের হদিস পেয়ে তা উদ্ধার করতে সক্ষম হয় এবং গ্রামবাসীরা সেই হিরো কুকুরটিকে এক নজর দেখার জন্য দলে দলে ওই যুবকের বাড়িতে ভিড় করে। খবরটা কতটুকু সত্য ছিল জানিনা কিন্তু পড়ার পর মনে হয়েছিল মানুষের কাছে সেই যুবকটির মৃত্যুর চেয়ে তার লাশ সনাক্তকারী কুকুরটির বীরত্ব বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে! হয়তো তাই! প্রতিদিন যত অপরাধ আমাদের চারদিকে দেখছি তাতে বিবেকের সাথে সাথে আমাদের অবাক হওয়ার ক্ষমতাও দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর সেই সাথে আমাদের দেশের মিডিয়া আমাদের আবেগের শেষ অংশটুকুও কেড়ে নিচ্ছে। পত্রিকার পাতায়, টিভির স্ক্রিনে, ফেসবুকে, ব্লগে লাশের বীভৎস ছবি দেখতে দেখতে মানুষের হিংস্রতার সাথে আমরা দিন দিন অভ্যস্থ হয়ে যাচ্ছি।
মানুষকে যেহেতু সেরা হিসাবে সৃষ্টি করা হয়েছে তাই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ নেই। মানুষ পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠরূপে আসে ঠিকই কিন্তু এই শ্রেষ্ঠত্ব টিকে থাকে তার কৃতকর্মের উপর। অনেকের ধারনা শিক্ষিত হলে অন্যায় থেকে দূরে থাকা যায়। এটা আংশিক সত্য। যদি জ্ঞান ও শিক্ষাতেই সব হত তাহলে সমাজে দুর্নীতি, মিথ্যাচার, খুন, ব্যভিচার, গরীবের সম্পদ হরণ, এমন শত শত পাপাচার ও অপকর্ম থাকতনা। এসব অন্যায় একশ্রেনীর শিক্ষিত সার্টিফিকেটধারী মানুষই করছে। বর্তমান পৃথিবীতে মুসলমানদের মধ্যেও এক বিরাট জনসমষ্টির উদ্ভব ঘটেছে যারা শুধুমাত্র নামেই মুসলমান। যারা জন্মসূত্রে মুসলমান হওয়ার সার্টিফিকেট পেয়েছে ঠিকই কিন্তু তার কৃতিত্ব বজায় রাখতে পারেনি। তাই আজ পার্থিব ও ধর্মীয় জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও মুসলমান নামধারীরা এসব অন্যায় কাজকর্ম করে যাচ্ছে সাথে সাথে নামাজ পড়ছে, রোজা রাখছে, হজ্জও করছে। এমন কেন হচ্ছে?কারন, আমরা যা মুখে বলি অন্তর দিয়ে সেটা বিশ্বাস করিনা, আবার কেউ কেউ কখনো অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করলেও কর্মে তা সত্যায়িত ও প্রতিফলিত করিনা। আমরা প্রত্যেকেই চাই সংশোধনটা অপরের দিক থেকে শুরু হোক। আমাদের মধ্যে এ ধরনের ধারনা রয়েছে যে আমি ছাড়া দুনিয়ার সবাই খারাপ। তাই আমার চেয়ে অপরের সংশোধন হওয়া আগে প্রয়োজন-এই ধারনা মাথায় নিয়ে অন্যকে উপদেশ দিতে বেশী পছন্দ করি। আমরা খুব কমই ভাবি যে, আমাদের নিজেদের মধ্যেও কিছু দোষ আছে এবং সর্বপ্রথম আমার আত্মশুদ্ধি প্রয়োজন। ব্যক্তির সমষ্টির নামই তো সমাজ। প্রত্যেকে যদি সর্বপ্রথম নিজেকে, নিজের পরিবারের সদস্যদের সংশোধন করার চেষ্টা করতো তাহলে সমাজে কমপক্ষে একজন ব্যাক্তি পরিশীলিত হত। এভাবে একজন ব্যক্তি থেকে একটি পরিবার, পরিবার থেকে ধীরে ধীরে পুরো সমাজ পরিশুদ্ধ হত।
আজকাল অপরের দোষচর্চা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরের দোষচর্চা না করলে মনে হয় আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের কি যেন প্রয়োজনীয় কাজটি বাদ পড়ে গেছে। আমাদের সমস্যা হল আমরা রাজনৈতিকভাবে বিশ্বাস করি অন্য কারো মতামত থাকবেনা। তাই কেউ ভিন্ন মত দেয়ার চেষ্টা করলে তার জন্য বরাদ্ধ থাকে লাঞ্ছনা, অপমান, তা না হলে বন্দুকের নল। যে জাতির মধ্যে নীচুতা, হৃদয়হীনতা থাকবে তার ধবংস অনিবার্য। দিন দিন আমরা ধংসের পথেই যাচ্ছি। আমাদের সামনেই একজন আরেকজনকে পিটিয়ে, গুলি করে মেরে ফেলে আমরা কিছু করতে পারিনা। নীরব দর্শকের মত শুধু তাকিয়ে দেখি। ছেলেবেলায় এমনি এক বীভৎস দৃশ্য দেখেছিলাম যখন ঢাকায় মগবাজারে ভাড়া থাকতাম। এক সকালে লোকজনের হৈচৈ শুনে ছাদে উঠে দেখেছিলাম বাড়ীর পাশের ডাস্টবিনে কে বা কারা যেন এক যুবকের শরীর থেকে তার মাথাটা আলাদা করে ময়লার সাথে রেখে গেছে। সেই অপরিচিত, দু’চোখ বন্ধ যুবকের মুখটা এখনও চোখে ভাসে। তার কি অপরাধ ছিল জানিনা। তার চুলের মুঠি ধরে শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া মাথাটা যখন কৌতূহলী দর্শনার্থীদের দেখানো হচ্ছিল তখন মনে হয়েছিল এও কি সম্ভব! মানুষ কি এতোটাই নির্দয় আর নিষ্ঠুর হতে পারে! কিন্তু পারছে তো। আজকাল পত্রিকার পাতা খুললে এসব দৃশ্যই তো অহরহ দেখি, আমাদের দেশের শিশুরাও এসব দেখছে। আর এসব করছে মানুষ নামের এক প্রজাতি যাকে কিনা আদিম যুগের সেই অসভ্যতার খোলস থেকে বেড়িয়ে শিক্ষা এবং চারিত্রিক উৎকর্ষতার মাধ্যমে সভ্য যুগে প্রবেশ করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সৃষ্টির কি নির্মম পরিহাস, কি নিদারুণ অবমূল্যায়ন! বাহ্যিক পরিচর্যার মাধ্যমে আমরা খোলস থেকে বের হয়েছি ঠিকই কিন্তু মনের দিক দিয়ে আজও উন্নত হতে পারিনি। আজও রয়ে গেছি সেই আদিম, অন্ধকার, বন্য যুগে। চারদিকে এত মানুষ! কিন্তু এত মানুষের ভীড়ে প্রকৃত মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কি জানি অদূর ভবিষ্যতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে শিখানোর জন্য মিউজিয়ামে ডায়নোসারের পাশে প্রকৃত মানুষ দেখতে কেমন হবে, একজন আদর্শ মানুষের চরিত্র, আচার-আচরন কেমন হবে তার নিদর্শনও হয়ত সাথে রেখে দেয়া হবে। এভাবেই একদিন হয়তো মনুষত্বের অভাবে মানুষ নামের প্রাণীটি এই গ্রহে হয়ে উঠবে এক বিরল প্রজাতি!
বিষয়: বিবিধ
১৬৮৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন