বৈচিত্র্যময় ঈদ

লিখেছেন লিখেছেন বৃত্তের বাইরে ০৭ আগস্ট, ২০১৩, ১১:৩২:০৭ রাত



চারদিকে ঈদের সাজ সাজ রব,উৎসবের আমেজ। দেশে রোজার শুরুতেই হাল ফ্যাশানের জামা-জুতো কেনার ধুম পড়লেও প্রবাসের ঈদ সেই তুলনায় পানসে। ফ্যাশানের দিক দিয়ে দেশের তুলনায় প্রবাসীরা ব্যাকডেটেড বলা যায়। আর এটা বুঝা যায় অনেকদিন পর দেশে বেড়াতে গেলে। বান্ধবীরা পোশাক-আশাক দেখে বলা শুরু করে আরে তুই এখনও এই ড্রেস পড়ছিস! এই ফ্যাশান তো সেই কবে চলে গেছে! তখন বুঝতে পারি দেশ কত এগিয়ে গেছে! আর আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের সাথে একদমই বেমানান। ছোটবেলায় দেশে বাবা-মা, ভাইবোনকে নিয়ে কাটানো ঈদের যে আনন্দ তা তুলনাহীন। দেশে ঈদ মানেই টানা কয়েকটা দিন ছুটি,দাদার বাড়ি বা নানা বাড়ি বেড়াতে যাওয়া, হৈ–হুল্লোড়,বন্ধুদের সাথে আড্ডা, নতুন কাপড় পড়ে বাইরে বেড়াতে যাওয়া, মজার মজার খাওয়া আরও অনেক কিছু। প্রবাসের ঈদ মানে ছুটি নিয়ে অনিশ্চয়তা। স্কুল,পরীক্ষা,অফিস থেকে ছুটি পাওয়া যাবে কিনা নানা ভাবনা। আবার শর্তের ভিত্তিতে কোনরকম ছুটি ম্যানেজ করা গেলেও সবার ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়না। মোটামুটি বছরের শুরু থেকেই পরিকল্পনা করে রাখতে হয় এবারের ছুটি কদিন নিব, কিভাবে নিব ,কোথায় কাটাবো...ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই আলাদা করে ঈদের ছুটি নিয়ে কারো উৎসাহ তেমন একটা চোখে পড়েনা। প্রবাসে সবাই একসাথে হওয়ার একটা বিশেষ সুযোগ হচ্ছে ঈদের পরের উইকেন্ডে। ঈদের পর উইকেন্ডে সবাই একটা করে ডিশ তৈরি করে নিয়ে যে কোন একজনের বাড়িতে একসাথে হয়। মজার মজার খাওয়া, আড্ডা সবই চলে। প্রবাসের এই আনন্দের মধ্যেই সবাই দেশকে অনুভব করার চেষ্টা করে।

আমার দেশে ঈদ করা হয়না অনেক বছর। ২০০৯ এ আগের বছরের ছুটি মিলিয়ে জোড়াতালি দিয়ে কোনোরকম তিন সপ্তাহের ছুটি ম্যানেজ করে ঠিক করলাম রোজায় কয়েকটা দিন মায়ের সাথে কাটিয়ে একবারে ঈদ করে ফিরব। ঐ সময় দেশে যাওয়ার আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল, আমার এক বোন তার পাঁচ বছরের মেয়েকে নিয়ে একা আমেরিকা থাকে। তার সেকেন্ড বেবি হওয়ার ডেট ছিল ঈদের পর। সেই উপলক্ষে মা ভিজিট ভিসায় আসার কথা ছিল। মা এতটা পথ একা আসতে পারবেননা এই ভেবে আমি ছুটি নিয়ে দেশে গেলাম যাতে আসার সময় মাকে সাথে করে নিয়ে আসতে পারি। অনেক বছর পর বাবা-মায়ের সাথে ঈদ করবো এই খুশিতে দেশে গিয়ে সবার জন্য কেনাকাটা করলাম। দাদার বাড়ীতে আমরা সব চাচাতো-ফুপাতো ভাইবোন সবাই একসাথে কি কি করব সব পরিকল্পনা আগে থেকেই সবাইকে জানিয়ে ঠিক করে রাখলাম। সব কিছু ঠিক এর মধ্যে ঈদের দুই দিন আগে আমেরিকা থেকে বোনের ফোন এল তার শরীরের অবস্থা ভাল না ডাক্তার ঈদের আগেই হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেছে। আমার ভগ্নীপতি অন্য শহরে থাকে সব কিছু ম্যানেজ করে আসতে দেরী হবে। আমার যেহেতু রিটার্ন টিকেট কাটা আছে তাই আমি যত তাড়াতাড়ি পারি যেন রওনা হই। এদিকে মা ফোন পেয়ে অস্থির হয়ে গেলেন। মায়ের কাগজপত্র রেডি হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে দেখে আমিও নিরুপায় হয়ে একাই ঈদের দুদিন আগে রওনা দিলাম। সাথে আমাদের পাশের বাড়ির খালাম্মার মেয়ে সেও প্রথম বাচ্চা হওয়ার জন্য আমেরিকা যাচ্ছে সে আমার সঙ্গী হল।

খালাম্মা তার মেয়ে প্রথম দেশের বাইরে যাচ্ছে দেখে মেয়ের নতুন সংসারের যাবতীয় জিনিস কিনে দিলেন। আমাকেও আমার নিজের জিনিস রেখে তার কিছু জিনিস বাধ্য হয়ে বহন করতে হল। আমাদের ট্রানজিট ছিল বাংলাদেশ থেকে কাতার হয়ে হিউস্টোন। কাতার থেকে হিউস্টোন পর্যন্ত টানা ১৭ ঘণ্টার যাত্রা আর শেষ হয়না। শেষ পর্যন্ত আমেরিকার এয়ারপোর্টে পৌঁছে লাগেজের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। ভিতরে ঢুকে দেখি বিরাট লাইন, অনেকেই যারা দেশ থেকে শখ করে খাবার এনেছিল তা ফেলে দেয়া হচ্ছে। ইমিগ্রেশন অফিসার বিরক্ত মুখে খাবার গারবেজে ফেলছেন আর সবার ব্যাগ আরও কড়াকড়ি চেক করছেন। আমার ব্যাগে কিছু নেই তাই তাড়াতাড়ি মুক্তি পাবো এই ভেবে নিশ্চিন্ত থাকলাম। যখন আমার পালা এল তখন এক কাণ্ড ঘটলো। আমার ব্যাগে খালাম্মা যে প্যাকেট দিয়েছিলেন তাতে এক্সরে প্লেট দিয়ে মুড়ানো কিছু ছিল যা কম্পিউটার স্ক্রিনে আসছেনা। তারা আমাকে এর ভিতরে কি আছে জানতে চাইলে আমি এর কোন সদুত্তর দিতে পারলাম না। আসলে ঘটনার আকস্মিকতায় আমি এতোটাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম যে কিছু বুঝে উঠতে পারছিলামনা। এতে তাদের সন্দেহ বেড়ে যাওয়ায় তারা আমার সামনে লাগেজ খুললো । পরে এক্সরে প্লেটের ভিতরে ছোট্ট একটা বটি আবিষ্কৃত হল যা খালাম্মা তার মেয়ের রান্নার কাটাকুটির কাজ সহজ করার জন্য দিয়েছেন। অফিসারের কাছে এই জিনিস নতুন,আর তাদের কাছে ছবির যেসব স্যাম্পল আছে তার কোনটার সাথে মিলছেনা বলে আমাকে নানারকম প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। আমি অফিসারকে যথা সাধ্য বুঝাতে চেষ্টা করলাম এটা এক ধরনের বড় ছুরি যা দিয়ে আমাদের দেশে মাছ-সবজি কাটা হয়। কে শোনে কার কথা! ইতিমধ্যে আমাদের দুজনের অন্য সব লাগেজ খুলে দেখা শুরু হয়ে গেছে। এদিকে আমার সহযাত্রী এমনিতেই অসুস্থ তার উপর এত কাণ্ড দেখে নার্ভাস হয়ে তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল। এতক্ষণে অফিসারের টনক নড়ল। সে তাড়াতাড়ি এ্যাম্বুলেন্স ডেকে আমাদের হাসপাতালে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করল। তবে আমাদের লাগেজসহ পাসপোর্ট রেখে দেয়া হল এই বলে যে চেকিং শেষ হলে পরে তা বাসার ঠিকানায় পৌঁছে দেয়া হবে। আমিও লাগেজের চিন্তা ছেড়ে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেয়েছি দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

এদিকে হাসপাতালে পৌঁছে জানতে পারলাম আমার বোনকে দুই/তিন ঘণ্টা আগে লেবার রুমে নেয়া হয়েছে। আমার নাম আগে থেকেই রিসেপশনে বলা ছিল যাতে আমি গেলে ঢুকতে দেয়া হয়। যথাসময়ে নার্স এসে তাদের অ্যাপ্রন পড়িয়ে ভিতরে নিয়ে গেল। ভিতরে ঢুকে দেখি ডাক্তার-নার্স তাকে ঘিরে রেখেছে। তারা প্রানপন চেষ্টা করছে যাতে নরমাল ডেলিভারি হয়। সে প্রেশার দিতে গিয়ে বারবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। এই দৃশ্য তাকিয়ে দেখা যায়না। ডাক্তার আমাকে ইশারায় কাছে আসতে বললেন। আমাকে দেখে আমার বোনের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, তার মুখে অক্সিজেন মাস্ক থাকায় আমাদের কোন কথা হয়নি তাই তার এই অশ্রু আনন্দের না কষ্টের বুঝতে পারলাম না। সে শুধু আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে যাতে ছুটে না যায়। আমিও দমবন্ধ করে তার হাত ধরে বসে আছি গভীর উৎকণ্ঠায়। কতক্ষন এভাবে ছিলাম, কিভাবে সেই সময়টা পার করেছি জানিনা যখন নতুন বাবুটাকে তোয়ালে দিয়ে প্যাঁ চিয়ে নার্স তার মায়ের কোলে দিল তখন মনে হল এটা স্বপ্ন নয়, আমি এই মুহূর্তে জগতের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখছি। মা-সস্তানের মাঝে যে বন্ধন তা দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা বন্ধন। এত কষ্টের পর প্রিয় সন্তানের মুখ দেখে মুহূর্তেই তা ভুলে গিয়ে সন্তানকে কাছে টেনে নেয়া তা একজন মায়ের পক্ষেই সম্ভব।

আমি মা আর সন্তানকে বিশ্রামে রেখে বাইরে বের হয়ে এলাম। রুম থেকে বের হওয়ার পর টের পেলাম সারাদিনের ধকল, টেনশনে আমার নিজের শরীর ও অনেক ক্লান্ত। মাথা ঘুরছে, ঠিকমত দাঁড়াতে পারছিনা। পরদিন সকালে আমার বোনের পিচ্চিটার ডাকে ঘুম ভাঙল। আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে হাতে স্যালাইন ঝুলছে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ভগ্নীপতি বলছেন, কি শ্যালিকা! বোনের সেবা করতে এসে তুমি নিজেই দেখি শয্যাশায়ী, ভাগ্যিস হাসপাতালে মাথা ঘুরে পড়েছিলে তা না হলে আমাকে এত রাতে ট্যাক্সি ভাড়া করে নিয়ে আসতে হত। যাক, আমার ট্যাক্সির খরচ বেঁচে গেল হা হা হা! এদিকে আমার একমাত্র ভাগ্নী কাছে এসে জড়িয়ে ধরে তার হাতে লুকিয়ে রাখা ফুল আমাকে দিয়ে বলল,‘অ্যান্টি, ঈদ মুবারক। আরে তাইতো! এত কিছুর পর আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আজ এখানে ঈদ! দেশে মা-বাবার সাথে সবার ফোনে কথা হল, স্কাইপে নাতির ছবি দেখানো হল। এত ঝড় - ঝাঁপটার পর সবার মুখে হাসি দেখে মনে হচ্ছিল জীবন আসলেই বৈচিত্র্যময়।

** উপরের ছবি অনুযায়ী দেশে এবং দেশের বাইরে যে যেখানে অবস্থান করছেন সেখানকার সময় এবং চাঁদ দেখার উপর নির্ভর সকল ব্লগার এবং শুভাকাংখীদের ‘বৃত্তের বাইরে’র পক্ষ থেকে ঈদের অনেক অনেক শুভেচ্ছা Rose Rose Rose Rose

বিষয়: বিবিধ

২৫৩৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File