যক্ষের ধন
লিখেছেন লিখেছেন বৃত্তের বাইরে ২৭ জুলাই, ২০১৩, ০৯:১৯:৫৫ রাত
রহমান সাহেব গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার। ছয় ছেলেমেয়ে,বউ সহ অভাবের সংসার। ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ, টিউশন ফী, আর দু বেলা অন্নের যোগান দিতে দিন আনে দিন খায় অবস্থা। পাশাপাশি তার বড় ভাই একই গ্রামের চেয়ারম্যান, অনেকের কাছেই গণ্যমান্য ব্যাক্তি। ইলেকশনে নমিনেশন পাওয়ার আশায় লোক দেখানো অনেক ধরনের জনহিতকর কাজ করে। প্রতি বছর রমজান এলে এলাকার গরীব-দুস্থ দের মাঝে শাড়ী-লুঙ্গি বিতরন করে জন প্রচার চালায়। এভাবে যাকাতের সামান্য একটা কাপড় নিতে এসে ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলিতে ২/৪ জন মারা গেলেও তাদের খোঁজ কেউ রাখেনা। রহমান সাহেবের সব সময়ই মনে হয় তার এলাকায় অভাবের মধ্যে থাকা মুখ চেনা এই লোকগুলো প্রতি বছর একটা কাপড় পাওয়ার আশায় বসে থাকে এতে তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হচ্ছেনা। এভাবে লোক দেখানোর জন্য একটা কাপড় না দিয়ে বরং পুরো টাকাটা একজনের হাতে দিলে বা তার আয় রোজগারের একটা পথ খুলে দিলে বছরে অন্তত একটা পরিবারকে স্বাবলম্বী করা যায়। যাকাতের উদ্দেশ্য তো আসলে তাই যে ব্যক্তিকে এ বছর যাকাত দেয়া হবে তাকে যেন পরবর্তী বছর আর হাত পাততে না হয়। কিন্তু এ কথা তার বড় ভাইকে কে বুঝাবে! রহমান সাহেবের সাথে তার বড় ভাইয়ের সামাজিক ব্যবধান অনেক। অবৈধ উপায়ে টাকা কামাই করে রাতারাতি অনেক উপরে উঠে গেছে। আর সামনে ইলেকশন তাই লোক লজ্জার ভয়ে এখন রহমান সাহেবকে সমাজে তার ভাই বলেও পরিচয় দেয়না। রহমান সাহেবের নিজের আর্থিক এই অসচ্ছলতার কথা মনে হলে তার ভাগ্যকে গাল-মন্দ করেন, সব ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে। শুধুমাত্র ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সংসারের মায়ায় ভাগ্যের এই নির্মম পরিহাস মুখ বুঝে সয়ে যান। তার ছেলেমেয়েরাও তাদের চাচাতো ভাইবোনদের বিত্তবৈভব দেখে হীনমন্যতায় ভোগে।
১০ বছর পর......
অভাবের মধ্যেই রহমান সাহেবের দিন যায়, ছেলেমেয়েরাও কোন রকম খেয়েপড়ে বড় হয়। একবার শখ করে এক বন্ধুর পরামর্শে আমেরিকার ডিবি ভিসার জন্য এ্যাপ্লাই করেছিল। তার ভাগ্য ভালোনা, কিছু হবেনা জানে তারপরও তার স্কুলের এক সহকর্মীর পাল্লায় পড়ে শখ করে এ্যাপ্লাই করা। কিন্তু আজ এত বছর পর তাকে অবাক করে দিয়ে ভাগ্য বিধাতা তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে। সে ডিবি ভিসা পেয়েছে। বউ ছেলেমেয়েরা তো মহাখুশি, উপরওয়ালার কাছে তার ভাগ্যের জন্য শুকরিয়া আদায় করে। সে গ্রামে তার ভিটেমাটি বিক্রি করে বড় ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে সপরিবারে আমেরিকায় চলে আসে। রহমান সাহেব পরিশ্রমী মানুষ আমেরিকায় এসে আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বউ, ছেলেমেয়েকে নিয়ে ছোটখাটো একটা ব্যবসা চালু করে। কয়েক বছরের মধ্যে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। রহমান সাহেবের এখন বউ ছেলে মেয়েদের নিয়ে বিলাস বহুল জীবন। বিশাল বাড়ি, নতুন মডেলের গাড়ী, ব্যাংক ব্যালেন্স সবই আছে। কিন্তু তারপরও কোথায় যেন একটা শুন্যতা বিরাজ করে। সব থেকেও কি যেন নেই! আগের সেই পারিবারিক বন্ধন গুলো কেমন যেন ঢিলে হয়ে গেছে। পরস্পরের প্রতি আবেগ, ভালবাসা কমে গিয়ে সবাই কেমন যেন যান্ত্রিক হয়ে গেছে। সারাদিন তার বউ ছেলেমেয়ে কারো সাথে কারো দেখা হয়না, একজন ঘরে এলে আরেকজন বের হয়ে যায়। দিনরাত শুধু টাকার পিছনে ছুটে চলা, সবাইকে মনে হয় টাকা বানানোর মেশিন। আজ তার কোন কিছুর অভাব নেই তারপরও কিসের অভাব যেন সবাইকে তাড়া করে ফিরে। আজ রহমান সাহেব নিজে যাকাত দেয়ার যোগ্যতা রাখেন কিন্তু যাকাতের পরিমান হিসাব করতে যেয়ে তার বুক কেঁপে উঠে। বউয়ের গোল্ড,ক্যাশ টাকা সব মিলে ব্যাংকে তার গচ্ছিত সম্পদ প্রায় এক কোটি টাকা। আগে ১০০০ টাকার ২.৫% এ ২৫ টাকা দেয়াটা যতটা সহজ ছিল এখন এক কোটি টাকার ২.৫% এর বিপরীতে ২,৫০০০০ লাখ টাকা দেয়াটা ততটাই কঠিন। রহমান সাহেব জানেন অভাব কি জিনিস। কঠোর পরিশ্রম করে তিল তিল করে যে সম্পদ তিনি গড়েছেন,এতদিন যেগুলো যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছেন আজ তা এত সহজে দিয়ে দিতে তার কষ্ট হচ্ছে। রহমান সাহেব মনে মনে হাসেন, হায়রে টাকার নেশা! এর ক্ষুধা এমনই যার যতই থাক এই ক্ষুধা কমেনা বরং দিন দিন বাড়ে।
[q]জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফ এ ও) এর তথ্য মতে অর্থ নৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর ভারতে প্রতিদিন ২৩ কোটি মানুষ অভুক্ত থাকে, ২১ শতাংশ মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে। পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রায় ৪৪ শতাংশ কম ওজন সম্পন্ন। আর এই শিশুদের মধ্যে ৭ শতাংশ পাঁচ বছর বয়সে পৌঁছার আগেই মারা যায়।আই এফ পি আর আই জানায়, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুধা পীড়িত দেশ গুলোর মধ্যে ভারত অন্যতম। দেশটির পরিস্থিতি কঙ্গো, চাঁদ, ইথিওপিয়া্র চেয়ে ভাল হলেও পাকিস্তান, নেপাল, উত্তর কোরিয়া ও সুদানের চেয়ে খারাপ। আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অক্স ফ্যাম বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে বিত্তশালী ১০০ ব্যাক্তি গত বছর অর্থাৎ ২০১২ সালে যে পরিমান অর্থ আয় করেছেন তা দিয়ে বিশ্বের হত দরিদ্র লোকদের চরম দারিদ্র চার চারবার দূর করা সম্ভব হতো ! সংস্থাটি বলছে, গত বছর এই ১০০ ধনী ব্যক্তির মোট রোজগার ছিল ২৪ হাজার কোটি ডলার যেখানে চরম দারিদ্রের মধ্যে থাকা লোকজনের দৈনিক মাথাপিছু আয় ছিল প্রতিদিন মাত্র ১ ডলার ২৫ সেন্টস।[q]
ধনী দরিদ্রের বৈষম্য পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই ছিল, আছে এবং থাকবে। কিন্তু তাই বলে বৈষম্য খুব বেশী হবে এটা মানা যায়না। আমাদের দেশের মুষ্টিমেয় কিছু লোক অবৈধ উপায়ে যে হারে সম্পদের পাহাড় গড়ছে তাতে দারিদ্র মোকাবেলা করা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। ধনী দরিদ্রের এই বৈষম্য ঘোচাতে আমাদের দেশের বিত্তশালীরা যদি তাদের সম্পদকে যক্ষের ধনের মতো আগলে না রেখে ঠিক মতো ট্যাক্স দিত এবং যাকাত আদায় করতো তাহলে বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র চিরতরে দূর করা সম্ভব হত।
বিষয়: বিবিধ
২১৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন