স্বপ্নের শহরে
লিখেছেন লিখেছেন বৃত্তের বাইরে ২৮ জুন, ২০১৩, ১১:০৬:১৫ রাত
ঘড়িতে এখনও ৯ টা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকী। জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ। অফিসের মেইন গেট থেকে লিফট দিয়ে রিসেপশন পর্যন্ত পৌঁছাতে প্রতিটা মুহূর্তেই মনে হয়েছে এই জায়গা আমার জন্য নয়, আমি ভুল জায়গায় এসে পড়েছি। ব্যাগ থেকে ই-মেইলের কপিটা আবার বের করে দেখলাম ঠিকানাটা ঠিক আছে কিনা। ভয়ে ভয়ে রিসেপশন পর্যন্ত পৌঁছে অপেক্ষা করতে থাকলাম। ভিতরে যার ইন্টারভিউ চলছে সে বেড়িয়ে আসলে আমার ডাক পড়বে এটা ভাবতেই টেনশনে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। প্রায় এক ঘণ্টা পর ভিতর থেকে মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক বের হয়ে এলেন মাথায় কাঁচা পাকা চুল। ভদ্রলোককে দেখার পর আমার কনফিডেনস লেভেল আরও একধাপ নীচে নেমে এল। বয়স দেখেই বুঝা যাচ্ছে উনি অনেক অভিজ্ঞ সেই হিসেবে আমার তো চাকরির কোন অভিজ্ঞতাই নেই। ভদ্রলোকের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল বাংলাদেশী কিন্তু পরিচয় নেই বলে এগিয়ে গিয়ে ইন্টারভিউ কেমন হয়েছে জিজ্ঞাসাও করতে পারছিলামনা। নিজের দেশে হলে না হয় এই বয়সের কাউকে সালাম দিয়ে ‘আঙ্কেল কেমন আছেন’- এই দিয়ে কথা শুরু করা যায় তাতে কেউ কিছু মনে করেনা। এ দেশে তো আর সেটা সম্ভব না। হুট করে অপরিচিত কাউকে তো আর আঙ্কেল বলে সম্বোধন করা যায়না। আর কেন জানি ভদ্রলোকের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিলো উনি বেশ হতাশ বা কোন কারনে দুশ্চিন্তায় আছেন। আর সেটা টের পেলাম কিছুক্ষন পরেই। তার হাতের কফির মগ নিয়ে রিসিপশনিস্টকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে যেয়ে পুরো কফির মগ উল্টে ডেস্কের উপর পড়ে যায়। ডেস্কের উপর ছড়িয়ে থাকা সমস্ত ফাইল, কাগজপত্র মুহূর্তেই ভিজে একাকার। ভদ্রলোক আকস্মিক এই ঘটনায় বার বার ‘সরি’ ‘সরি’ বলে যতটা সম্ভব টিস্যু পেপার দিয়ে মোছার চেষ্টা করলেন। দেশে থাকলে হয়তো এতক্ষনে রিসিপশনিস্টের সাথে একচোট হয়ে যেত। এ দেশে এরা অতিভদ্র বলে কারও ভুলের জন্য তাকে সরাসরি দোষারোপ করতে যেয়ে বিকৃত মানসিকতার পরিচয় না দিয়ে বরং মনে মনে ইচ্ছামত গালমন্দ করাটাকেই সমীচীন মনে করে। যাই হোক এর পরের দৃশ্য দেখার আগেই ভিতর থেকে আমার ডাক চলে এল।
ভিতরে ঢোকার পর ইন্টারভিউ বোর্ডের কর্মকর্তাদের পারস্পরিক আলাপচারিতায় এতটুকু বুঝা গেল, তারা এই পর্যন্ত এমন হতাশ চাকরীপ্রার্থী একটাও পাননি যে কিনা resume এর শেষ অংশটুকু টাইপ না করে নিজের হাতে লিখে এনেছে। রিসিপশনের ঘটনা, বোর্ডের কর্মকর্তাদের আলাপচারিতা সবকিছু দেখে মনে মনে ভাবছিলাম, আজ দিনটাই খারাপ। কোন কারনে ইন্টারভিউটা বাতিল হলে বেঁচে যেতাম। আরেকদিন না হয় ভালভাবে প্রস্তুতি নিয়ে আসা যেত। যাই হোক, সব কিছু ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে যতটুকু পারা যায় পজিটিভ থাকার চেষ্টা করলাম। এটাই তো আর শেষ নয় মাত্র তো ক্যারিয়ার শুরু হল, সামনে হয়ত আরও কত ইন্টারভিউ দিতে হবে। দেখাই যাক না কি হয়, চাকরি না হলে না হবে কি ধরনের প্রশ্ন করে সেই অভিজ্ঞতা তো হবে- এটা ভাবার পর কিছুক্ষনের জন্য হলেও নিজেকে খানিকটা আশাবাদী মনে হল। শেষ পর্যন্ত প্রশ্নকর্তাদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে দেড় ঘণ্টা পর রুম থেকে বের হওয়ার পর মনে হল এ যাত্রায় যমদূতের হাত থেকে রেহাই পেয়েছি। শুনেছি যমদূত একবার এক শহরে এসে ঘোরাফেরা করছিল। এক লোক তাকে চিনে ফেললো । জিজ্ঞেস করলো, এখানে কি কর? সে বললো, আগামী পরশু এই শহরে দশ হাজার লোক মেরে ফেলবো, তাই শহরটা একটু দেখে যাচ্ছি । সেই লোক পরের দুদিন ওই শহরের পরিচিত-অপরিচিত যত জনকে পেল খবরটা দিয়ে দিল। তিন দিন পর যমদূত আবারও এল ঐ শহরে এবং সেই লোকের সাথে দেখা। যমদূতকে পেয়ে সেই লোকটি রেগেমেগে জিজ্ঞাসা করলো ‘তুমি না বলেছিলে দশ হাজার লোক মারা যাবে কিন্তু মারা তো গেছে চল্লিশ হাজার’! যমদূত বললো, আমি দশ হাজারকেই মেরেছি। বাকি ত্রিশ হাজার টেনশনে মারা গেছে। আমার অবস্থাও হয়েছিল যমদূতের নাম শুনেই অক্কা পাওয়ার মত।
যাই হোক এই যাত্রায় যমদূতের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে চাকরিটা হবে এই আশায় বুক বেঁধে বাইরে পার্কিং লটে এসে দেখি রিসেপশনের সেই ভদ্রলোক এখনও বাইরে দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে নিজেই এগিয়ে এলেন। আলাপ পরিচয়ে জানতে পারলাম উনি কিছুদিন হল সপরিবারে প্রবাসে এসেছেন। দেশে বড় পোষ্টে চাকরি করতেন। শুধুমাত্র ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সব ফেলে এই দেশে আসা। আসার পর থেকেই বিভিন্ন জায়গায় শুধু ইন্টারভিউ দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু কোথাও কিছু হচ্ছেনা। সংসারের খরচ চালানোর জন্য বাধ্য হয়ে সিকিউরিটির একটা চাকরি কোন রকম জোগাড় করেছেন। কিন্তু এই বয়সে নাইট শিফটের ধকল শরীরে কুলাচ্ছেনা। আর দেশে এত বড় পজিশনে চাকরি করে এখানে এসে এই ছোট খাট কাজ করে বন্ধু মহলে মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি। কেউ তো reference দিয়ে চাকরীর ব্যবস্থা করে দেয়না শুধু সমলোচনা আর মুখে বড় বড় কথা! আক্ষেপের সুরে বলা কথাগুলোর এক পর্যায়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার চাকরীটা এত প্রয়োজন তাহলে resume হাতে লিখে এনেছেন কেন? উত্তরে বললেন, হতাশ হয়ে। কারন, আমি জানি আমাদের দেশের যত বড় ডিগ্রীই থাকনা কেন চাকরী পেতে হলে এ দেশের ডিগ্রী এবং অভিজ্ঞতা দুটোই লাগবে। এ দেশে তো মাত্র এলাম, চাকরি না করে অভিজ্ঞতা পাবো কোথায় –এরা তো আর এটা বুঝবেনা। আর শরীরের যা অবস্থা দেশে থাকলে আর হয়ত বড়জোর ৩/৪ বছর চাকরি করে অবসরে যেতাম তাই এখানে এসে আবার এই বয়সে নতুন করে পড়ালেখায় ঢুকা অসম্ভব। আমার ছেলের বয়সী হলে না হয় আরেকটা ঝুঁকি নিয়ে দেখা যেত। বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে এসে পড়াশুনার জন্য ঝুঁকি নিতে যেয়ে দুশ্চিন্তায় নিজের জীবনই না আবার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। তাই ওই পথে আর আগাতে সাহস পাচ্ছিনা। দেখা যাক, এদেশের ডিগ্রী আর অভিজ্ঞতা ছাড়া ভাগ্য বিধাতা যদি কখনো মুখ তুলে তাকান!
ডিগ্রী তো আর কম নেইনি। দেশে থাকতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে এমবিএ করলাম, পড়ে ঢুকলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায়। এখানে এসে আগের অভিজ্ঞতা নেই বলে ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। এমবিএ করা আছে বলে শেষ চেষ্টা হিসেবে ইনসুরেন্স কোম্পানিতে চেষ্টা করে দেখতে চেয়েছিলাম কিছু হয় কিনা। কিন্তু সব জায়গায় ইন্টারভিউতে একই প্রশ্ন করে তুমি তোমার লাইনে চেষ্টা না করে অন্য লাইনে কেন আসতে চাইছো? আসলে আমাদের দেশে তো যে যেই বিষয়ে পড়ে সেই অনুযায়ী চাকরি পায়না বা করেনা। দেখা যায় ইতিহাস বা ভূগোলের ছাত্ররা ব্যাঙ্কে চাকরি করছে। তাই দেশের বাইরে এলে ডিগ্রির সাথে চাকরির অভিজ্ঞতা মিলে না বলে চাকরি পায়না। তাই এদেশকে আমি দোষ দিবনা কারন এরা তো জানেনা যে আমাদের দেশে সবই সম্ভব। যে কোন বিষয়ে পড়ে যে কোন জায়গায় চাকরি করা যায়। বয়স কম হলে না হয় আবার পড়াশুনায় ঢুকতাম। এখন এই বয়সে আবার নতুন করে পড়াশুনা করার মত আর সাহস বা শক্তি কোনটাই নেই। বুঝতে পারছি এসে ভুল করেছি। দেশের এত ভাল চাকরি ছেড়ে এখানে এসে না পারছি ওই পজিশনে নিজেকে নিয়ে আবার দাঁড় করাতে আর না পারছি বয়সের জন্য কোনরকম যেনতেন একটা অড জব করে সংসার চালাতে। হতাশ হই যখন দেখি আমাদের দেশ থেকে এত যাচাই বাছাই করে শিক্ষিত ইমিগ্র্যান্টদের এনে চাকরি দিতে না পেরে আমাদের কষ্টে অর্জিত সার্টিফিকেটগুলো যখন তাদের কাছে অর্থহীন হয়ে যায়। সব কিছু থাকার পরও সব ছেড়ে এসে নিজেকে মাঝে মাঝে শিকড় ছিড়ে আসা এক উদ্বাস্তু মনে হয়। আমাদের ষড়ঋতুর সংস্কৃতির সাথে পাশ্চাত্যের এই চোখ ঝলসানো জীবনের অনেক ব্যবধান জানি, তারপরও আমাদের সন্তান, আমাদের নতুন প্রজন্মকে আরেকটু ভাল রাখার চেষ্টায়ই এই বয়সে এসে অচল হয়ে যাওয়া জীবনের চাকাকে সচল করতে স্বপ্নের শহরে প্রবাসী হওয়া ।
বিষয়: বিবিধ
১৪৩১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন